হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ (রহ.)-এর কুরআনী খেদমত (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মুখতারুল ইসলাম 884 বার পঠিত

তাফসীর নিয়ে কিছু কথা :

পবিত্র কুরআনের তাফসীর আক্বীদা, তাওহীদ এবং রিসালাতের উপর ভিত্তি করে রচিত হতে হবে। কিন্তু বর্তমান তাফসীরের বর্ণনাগুলি অনুমান নির্ভর এবং ইখতিলাফে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে কুরআনে বর্ণিত বিগত যুগের জাতি ও গোষ্ঠীর কাহিনীগুলিতে যে ধরণের বাড়াবাড়ি এবং খেয়ানত করা হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক!

পাক-ভারত উপমহাদেশে রচিত তাফসীরগুলিতে উপমহাদেশের মানুষের রুচিবোধ এবং ধর্মীয় পরিবেশ পরিস্থিতির অনেক অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। মুফাসসিরগণের ধর্মীয় পরিবেশ পরিস্থিতি উপলব্ধিতে থাকা সত্ত্বেও তারা পবিত্র কুরআন, ছহীহ সুন্নাহ ও তাওহীদ ভিত্তিক মতবাদের ঘোর সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছেন। এর বিপরীতে হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ পবিত্র কুরআন ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক তাফসীর রচনায় এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তিনি বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের নবী তাদের বললেন, তার শাসক হবার নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সেই সিন্দুকটি সমাগত হবে, যাতে থাকবে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে প্রশান্তি এবং মূসা ও হারূণ পরিবারের পরিত্যক্ত বস্ত্তসমূহ। ফেরেশতাগণ ওটি বহন করে আনবে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৮)

আয়াতে বর্ণিত সিন্দুকটি ছিল ইহূদীদের নিকট বরকতের প্রতীক। ইবনু আববাস, রবী বিন আনাস প্রমুখ বলেন, এর মধ্যে হারূণ ও মূসার লাঠি, তাদের কাপড়-চোপড়, তওরাতের ফলক সমূহ ইত্যাদি সংরক্ষিত ছিল। আমালেক্বারা যখন ইহূদীদের তাড়িয়ে দিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করে, তখন সিন্দুকটি তারা রেখে দেয়। অতঃপর তালূতের শাসক নিযুক্তির নিদর্শন হিসাবে ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে উক্ত সিন্দুক উঠিয়ে নিয়ে চলে আসে এবং তালূতের সামনে এনে রেখে দেয়। যা সকলে প্রত্যক্ষ করে। তখন সবাই তাকে শাসক হিসাবে মেনে নেয় (ইবনু কাছীর)

কিন্তু পরবর্তীতে সিন্দুকটিতে বরকতের নামে কত যে কপোলকল্পিত কাহিনী রচিত হয়েছে, তার হিসাব কে রাখে। বনী ইস্রাইল যুগের সিন্দুকটি নিয়ে অনেক তাফসীরকারক নবী করীম (ছাঃ) ও উম্মতে মুহাম্মাদীর স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ব্যাখ্যা করে থাকেন। শুধু তাই নয় বুযুর্গ ও ছালেহীন খ্যাত ভন্ড পীরেরা পীর-মুরীদী খেলায় মেতে উঠে এবং তারা বিপদে পতিত ও কষ্টক্লিষ্ট মানুষদেরকে বরকত দেওয়ার নাম করে অনেক গল্প-কাহিনী বর্ণনা করেন। আর মানুষরা তার ফায়েয হাসিল করার জন্য পাগলপারা হয়ে অনেক দূর থেকে এসে তাদের পায়ের তলায় সিজদায় পড়ে যায়। অথচ এসব কাহিনীর ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই।

নবী পাগল কোন কোন মানুষ রাসূল (ছাঃ)-এর জুতা মুবারককে বরকতের হাসিলের উপলক্ষ মনে করে, প্রতীকী জুতা বানিয়ে বরকত হাসিলের হাস্যকর খেলায় মেতে উঠে। তারা প্রতীকী জুতাকে নানা ধরণের নতুন নতুন মিথ্যা কাহিনীর আবরণে ঢেকে রাসূলী জুতার আবেগী আবহ সৃষ্টি করে। জুতা বাড়ির এক কোণে লটকিয়ে রেখে বৈষয়িক যাবতীয় চাওয়া পাওয়া ও মুশকিলে আসান বা সকল সমস্যার সমাধাকারী অসীলা হিসাবে গণ্য করে। আর তা ব্যবহারের বিভিন্ন তরীকা ও মতলববাজী তো রয়েছেই। পাশাপাশি তারা পীর-বুযুর্গদের কবরে নযর-নেওয়ায দেওয়ার মাধ্যমে বরকত হাসিলের প্রাণান্তকর চেষ্টা করে থাকে। পীরের কবর ধুয়েমুছে ছাফ করা, কবর ধোয়ার পানিকে বরকতের পানি মনে করা, পীর সাহেবের কবর ধোয়াকে বায়তুল্লাহ কা‘বাকে ধৌত করার সমান গণ্য করা ইত্যাদি। তারা কিভাবে এ ধরণের দুর্গন্ধময় নর্দমার পানিকে বরকতী পানি মনে করতে পারে? তারা বেমালূম ভুলে যান যে, গায়রুল্লাহ নামে এসমস্ত গর্হিত কর্মকান্ড স্পষ্ট শিরক এবং ইসলামী শরী‘আত পরিপন্থী।

কুরআনে নাসেখ এবং মানসূখের আলোচনা :

কুরআনের তাফসীরে বড় একটা জায়গাজুড়ে নাসেখ এবং মানসূখের আলোচনা বিধৃত হয়েছে। আর আলোচনাটিও কুরআনে বৈচিত্র্যময় আলোচনার একটি। এ বিষয়ে ইসলামী পন্ডিতগণ পৃথক বড় বড় বই লিখেছেন। অনেক মুফাসসির এ বিষয়ে পদস্খলিত হয়েছেন। কেউ কেউ দয়া ও পারস্পরিক সহানুভূতির আয়াতগুলো দিয়ে পবিত্র জিহাদের আয়াতসমূহকে মানসূখ প্রমাণ করেছেন। আবার কেউ কেউ কুরআনে বর্ণিত আয়াত নাসেখ এবং মানসূখের আলোচনাই প্রবেশই করেননি।

কিন্তু ছালাহুদ্দীন ইউসুফ নাসেখ মানসূখ বিদ্যাকে কুরআনের অমূল্য রত্ন জ্ঞানভান্ডার মনে করেন। তিনি নাসেখ মানসূখ মাসআলাটি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি আলোচনা শুরু করেছেন সূরা বাক্বারাহ কয়েকটি আয়াত দিয়ে। মহান আল্লাহ বলেন, مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ ‘আমরা কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা তা ভুলিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী? তুমি কি জানো না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই? আর তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১০৬-১০৭)

তিনি উক্ত আয়াতের আলোকে শারঈ দৃষ্টিকোণ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এ বিষয়ে জাতির সামনে বহুবিধ শিক্ষাগুলো উপস্থাপন করেছেন।

نسخ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো মানসূখ বা রহিত করা। কিন্তু শারঈ ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে এটি এমন একটি বিষয় যে, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা শারঈ একটি হুকুম পরিবর্তন করে নতুন আরো সুন্দর বিধান চালু করেন। কুরআন থেকে কোন আয়াত গায়েব করার বিষয় এটি নয়। আর নাসেখ মানসূখ বিষয়টি একান্ত আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। অন্য কারো তরফ থেকে পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের বিষয় এটি নয়। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হযরত আদম (আঃ)-এর যুগে আপন ভাই বোনের সাথে বিবাহ জায়েয ছিল। পরবর্তীতে সেটি মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা হারাম ঘোষণা করেন। অনুরূপভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা বিভিন্ন আয়াত ও আহকামকে মানসূখ করেছেন এবং তদস্থলে নতুন বিধানাবলীর আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। এটি তাঁরই শান।

তবে নাসেখ মানসূখ আয়াত সংখ্যা নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে। শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভীর লিখিত গ্রন্থ الفوز الكبير-এ শুধুমাত্র পাঁচটি বলেছেন। উক্ত নাসেখ আয়াতসমূহ আবার তিনভাগে বিভক্ত।

১. সাধারণ নাসেখ মানসূখ আয়াত : একটি আহকাম পরিবর্তন করে, অন্যটি একটি আহকাম চালু করা।

২. তিলাওয়াতে নাসেখ মানসূখ : প্রথম বিধানের শব্দগুলো কুরআন মাজীদে থেকে গেছে এবং পরবর্তীতে বিধানটিও কুরআন মাজীদে থেকে গেছে। মূলত নাসেখ এবং মানসূখ উভয় বিধানটিই কুরআন মাজীদে মওজূদ রয়ে গেছে।

৩. মানসূখকৃত আয়াত : পবিত্র কুরআনে আয়াতটি মওজূদ নাই। কিন্তু বিধানকে রাসূল (ছাঃ) রেখে দিয়েছেন। যেমন : সাঈদ ইবন মুসায়়্যব (রহঃ) বর্ণনা করেন, উমর (রাঃ) যখন মিনা হতে প্রত্যাবর্তন (২৩ হিজরী) করলেন তখন তিনি (মক্কার অনতিদূরে) ‘আবতাহ’ নাম স্থানে তাঁর উট বসালেন। আর এদিকে কতকগুলি পাথর একত্র করলেন। তার উপর একখানা চাদর রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। অতঃপর আকাশের দিকে স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমার অনেক বয়স হয়েছে। শক্তি রহিত হয়ে গেছে। প্রজাবৃন্দ অনেক। এ সময় আপনি আমাকে আপনার নিকট ডেকে নিন, যাতে আমার দ্বারা আপনার কোন আদেশ অমান্য না হয়ে যায় এবং আপনার ইবাদতে অনিচ্ছা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি মদীনা চলে গেলেন, মদীনার লোকদের সম্মুখে খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, হে উপস্থিত ভ্রাতৃবৃন্দ! তোমাদের সম্মুখে সমস্ত পথই প্রকাশ হয়ে পড়েছে; যত রকম ফরয কাজ ছিল সমস্তই নির্ধারিত হয়ে গেছে। তোমরা পরিষ্কার সোজা পথে চালিত হয়েছ। এখন তোমরা পথ ভুলিয়া যেন এদিক-ওদিক বিপথগামী না হয়ে যাও। তিনি তার এক হাত অন্য হাতের উপর রেখে বললেন, দেখ, তোমরা প্রস্তরাঘাতের আয়াতটি ভুলে যেও না। কেউ যেন না বলে, আমরা আল্লাহর কিতাবে প্রস্তরাঘাতের আয়াত দেখছি না। দেখ, আল্লাহর রাসূল প্রস্তরাঘাত করেছেন। ঐ আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মানুষ এ কথা না বলত যে, উমর আল্লাহর কিতাবে অতিরিক্ত করেছেন তা হল আমি (الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ) (অর্থাৎ যখন বিবাহিত পুরুষ অথবা নারী ব্যভিচার করে তবে তাদেরকে প্রস্তরাঘাত কর) আয়াতটি কুরআনে লিখে দিতাম।

আমরা এই আয়াত পাঠ করেছি। অতঃপর তার তিলাওয়াত রহিত হয়ে গেছে (কিন্তু তার হুকুম কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে)। সাঈদ বলেন, অতঃপর যিলহজ্জ মাস শেষ না হতেই উমর (রাঃ) নিহত হলেন।[1]

উল্লেখিত দলীলে প্রথম দু প্রকারের নাসেখের বর্ণনা রয়েছে।

এখানে উদিষ্ট উদ্দেশ্য হলো হুকুম এবং তেলাওয়াত দু’টিই রহিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছেন এবং নতুন বিধান চালু করে দিয়েছেন অথবা রাসূল (ছাঃ)-এর অন্তর থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তার স্মৃতি থেকে বিস্মৃত করে দিয়েছেন। ইহুদীদের তাওরাত থেকে কোন কোন বিধান রহিত করে দেওয়া হয়েছে এবং পবিত্র কুরআনে কিছু বিধানের ক্ষেত্রে মানসূখ অবস্থায় রয়ে গেছে বা তার বিপরীত কিছু বিধান আনায়ন করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখিত বিধানাবলী রদ করে দিয়েছেন। কেননা যমীন আসমানের বাদশাহী একমাত্র তাঁরই হাতের কব্জায়। তিনি স্থান, কাল, পাত্রভেদে যে কোন বিধান যে কোন সময় পরিবর্তন করে দিয়েছেন। সংশোধনী তাঁরই মানায়। কেননা তিনি সকল যুগের এবং সময়ের খবরদার। তাই যখন যেটা চান, তখন সেটি তিনি করেন। সবকিছু তাঁরই ইচ্ছাধীন। এগুলো সবই তার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।

আবু মুসলিম আছফাহানী মুতাযেলীর মত কিছু গোমরাহ, নামধারী শিক্ষিত চরমপন্থীরা ইহুদীদের মত কুরআনের নাসেখ মানসূখের মত গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রর্দশন করে।

সালাফে ছালেহীনদের আক্বীদামতে নাসেখ মানসূখ বিধান পবিত্র কুরআনের এক অনন্য বিধান যা আছে এবং থাকবে। এতে কোন প্রকার বাড়াবাড়ির স্থান নেই।

মুহকাম এবং মুতাশাবিহ দ্বন্দ্ব নিরসন :

পবিত্র কুরআনের আয়াত দুই প্রকার ১.মুহকাম ২. মুতাশাবিহ

মুহকাম এবং মুতাশাবিহ আয়াতের পার্থক্য কি এবং এর মমার্থই বা কি এবং কুরআনে মুহকাম এবং মুতাশাবিহ স্বরূপ কি- এ বিষয়ে ছালাহুদ্দীন ইউসুফ খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট অর্থবোধক। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল অংশ। আর কিছু রয়েছে অস্পষ্ট। অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা অস্পষ্ট আয়াত গুলির পিছে পড়ে ফিৎনা সৃষ্টির জন্য এবং তাদের মনমত ব্যাখ্যা দেবার জন্য। অথচ এগুলির সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর গভীর জ্ঞানী ব্যক্তিগণ বলে, আমরা এগুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। সবকিছুই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে এসেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না’ (আলে-ইমরান ৩/৭)

ইসলামে বর্ণিত সমস্ত কেচ্ছাকাহিনী, মাসআলা-মাসায়েল, হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ এবং মানবতার সহজ পাঠগুলো মুহকাম আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে, যা বুঝতে মানুষকে বেশী একটা বেগ পেতে হয় না।

অপরপক্ষে মুতাশাবিহ আয়াতসমূহে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, বিচার ফায়ছালা ও তাক্বদীর সংক্রান্ত মাসলা মাসায়েল, জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতাসহ যাবতীয় ইসলামী আক্বীদার জটিল পাঠগুলো সংযোজিত হয়েছে। বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষেই এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবী রাখে, যা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের হাত ধরে সম্পন্ন হওয়া উচিৎ। কিন্তু যখনই এর ব্যত্যয় ঘটে, তখনই শয়তান সুযোগ বুঝে তার চেলাচামুন্ডাদের আম জনসাধারনের মাঝে ছড়িয়ে দেয় এবং বিভ্রান্ত করে, যেমনভাবে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে বিভ্রান্ত করে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল।

শয়তান অজ্ঞদেরকে ভাল করে কুরআন বুঝার নামে ভুলভাল বুঝিয়ে মুতাশাবিহ আয়াতের অতি গবেষণায় লিপ্ত করে এবং ভয়ানক ফেৎনায় ফেলে দেয়। ফলে ব্যক্তিটি ফেৎনার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় এবং ইসলামের বিভিন্ন বুনিয়াদী বিষয়ে নতুন বির্তকের জন্ম দেয়। ফলে সে নিজে বিভ্রান্ত হয় এবং অপরকে বিভ্রান্ত করে।

যেমন ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা পবিত্র কুরআনে আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা এবং নবী হিসাবে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু মুতাশাবিহপন্থীগণ এটা নিয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি করে যে, তারা খিস্টানদের মত ঈসা (আঃ)-কে রুহুলুল্লাহ এবং কালিমাতুল্লাহ বলে আল্লাহর বেটা বানানোর প্রান্তকর চেষ্টায় লিপ্ত হয় যা স্পষ্টই গোমরাহী।

মুহকাম ও মুতাশাবিহ আয়াতগুলি নিয়ে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা খোলাখুলিভাবে বিবৃত করেছেন যা কোন বিবেকবান মানুষের সন্দেহ পতিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

কিন্তু মানুষের প্রকাশ্য শত্রু শয়তান মুহকাম ও মুতাশাবিহ বির্তক পুঁজি করে বনু আদমকে বিভ্রান্ত করতে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে এবং সর্বত্র সন্দেহের জাল বিছিয়ে মানুষদেরকে চরমভাবে জাহান্নামের অতল গহবরে ঠেলে দিচ্ছে।

ফলে যুগে যুগে বিভিন্ন বাতিল ফিরকাগুলি মুতাশাবিহ আয়াতের অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়ে নিজেদের পালে হাওয়া দিতে গিয়ে কালজয়ী ইসলামকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অতত্রব হক্ব পিয়াসী মুমিনের কর্তব্য হবে, ছহীহ আক্বীদা ও আমল পরিচালিত হবে মুহাকাম আয়াত সমূহের উপর ভিত্তি করে এবং সাথে সাথে ইসলামী শারঈ মুহাকাম বিধানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে কুরআনী মুতাশাবিহ আয়াত সমূহ।

চার রাকাআত ছালাতে দুই বৈঠকেই দরুদ শরীফ পড়া :

সাধারণত ছালাতের শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতুর পরে দরূদ শরীফসহ অন্যান্য দোআ-এ মাছূরাহ পড়তে হয়। চার রাকা‘আত ছালাতের প্রথম বৈঠকেই আত্তাহিয়্যাতুর সাথে দরূদ শরীফও পড়া যেতে পারে যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।

কিন্তু এ বিষয়ে অনেক ফক্বীহ বিদ্বানের বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। তারা বলতে চায় যে, চার রাকা‘আত ছালাতের প্রথম বৈঠকে আত্তাহিয়াতু ব্যতীত অন্য কিছু পড়ার কোন বিধান ইসলাম সমর্থন করে না। এতদ্ব্যতীত তারা আরো বলে যে, চার রাকা‘আত বিশিষ্ট ছালাতে যদি কেউ প্রথম বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতুর পরে দরূদ পড়ে, তাহলে তাকে সহু সিজদা দেওয়া ওয়াজিব। নইলে তার ছালাতই হবে না।

হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ তাদের অসার মন্তব্যের দলীল ভিত্তিক যথাযথ জবাব দিয়েছেন। তিনি আলোচনার শুরুতেই কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে এসেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন। (অতএব) হে মুমিনগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর’ (আহযাব ৩৩/৫৬)

তিনি বলেন, অত্র আয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চাঙ্গের শানমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফেরেশতাদের মাঝে মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় নবীর প্রশংসা ও তারীফ করে থাকেন এবং তার উপর রহমান বর্ষণ করেন। সর্বশেষ তাকে মাকামে মাহমূদাহ বা উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন। ফেরেশতারাও রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদায় প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ দো‘আ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহ যমীনবাসীর জন্যও তার উপর দরূদ ও শান্তি বর্ষণের তাকীদ আরোপ করেছেন। যাতে করে আকাশে ও যমীনে সর্বত্র তার প্রশংসার জয়ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে।

হাদীছে এসেছে, عَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ رضى الله عنه قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَمَّا السَّلاَمُ عَلَيْكَ فَقَدْ عَرَفْنَاهُ فَكَيْفَ الصَّلاَةُ قَالَ قُولُوا اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ. কাব ইবনে উজরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর সালাম সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি; কিন্তু ছালাত কিভাবে? তোমরা বলবে হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ এবং মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের উপর রহমত নাযিল কর, যেমনিভাবে ইব্রাহিম-এর পরিবার বর্গের উপর তুমি রহমত নাযিল করেছ। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত, মর্যাদাবান। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ-এ উপর এবং মুহাম্মাদ-এর পরিবারবর্গের প্রতি বরকত নাযিল কর। যেমনিভাবে বরকত নাযিল করেছ ইব্রাহিমের পরিবারবর্গের প্রতি। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত, মর্যাদাবান। [2]

হাদীছে দরূদ পড়ার অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর উপর পূর্ণাঙ্গ দরূদ পড়তে হলে দরূদে ইবরাহীম পড়তে হবে যা ছালাতে আত্তাহিয়্যাতুর পর পড়তে হয়। তবে সংক্ষিপ্তভাবে ‘ছাল্লাল্লাহু আলা রসূলিল্লাহ ওয়া সাল্লাম’ বা ‘ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ পড়া ছহীহ হাদীছ সম্মত। রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে ‘আছ্ছলাতু ওয়াস সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ’ পড়া যাবেনা। খারাপ আক্বীদা পোষণকারী ব্যক্তিরা ইসলামের নামে এই ধরণের অপচর্চার করে থাকে যা স্পষ্ট বিদ‘আত। আর প্রত্যেকটা বিদ‘আতই গোমরাহী এবং গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম। আর সবচেয়ে বড় কথা হল দরূদ হিসাবে এমন কোন বর্ণনা রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হয়নি। বিধায় তা পরিত্যজ্য।

উল্লেখ্য যে, ছালাতে আত্তাহিয়্যাতুর মধ্যে আস-সালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীয়ু বলায় কোন দোষ নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) থেকে এমন অনেক বর্ণনা রয়েছে।

ছালাতে দরূদ শরীফ পড়া কি ওয়াজীব না সুন্নাত? এ বিষয়ে আলেম-ওলামাদের মাঝে ইখতিলাফ পরিলক্ষিত হয়। জমহুর আলেম-ওলামা ছালাতে দরূদ শরীফ পড়া সুন্নাত মনে করে। ইমাম শাফেঈ (রহঃ)সহ আরো অনেক ইমামগণ এটি ছালাতে পড়া ওয়াজিব মনে করেন। শুধু তাই নয় চার রাকাআত ছালাতে উভয় বৈঠকেই আত্তাহিয়্যতুর পরে দরূদ শরীফ পড়া ওয়াজিব।

মুসনাদে আহমাদের একটি বর্ণনায় দেখা যায় যে, একজন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করে যে, আমরা তো ছালাতের বাইরে আপনার প্রতি সালাম প্রদানের পদ্ধতি জানি। কিন্তু আমরা ছালাতে থাকলে কিভাবে আপনার প্রতি দরূদ পাঠাবো? তখন তিনি সাফ সাফ বলেন যে, তোমরা ছালাতে থাকলে দরূদে ইবরাহীম পড়বে (ফাৎহুল রাববানী ৪/২০-২১ পৃ.)

ছহীহ ইবনু হিববান, সুনানে কুবরা, বায়হাক্বী, মুসতাদরাকে হাকেম, ইবনে খুযায়মা এবং মুসনাদে আহমাদসহ আরো অন্যান্য হাদীছের গ্রন্থে এ বিষয়ে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ছালাতে সালাম তথা তাশাহহুদ এবং ছালাত তথা দরূদে ইবরাহীম পাঠ করা দো‘আ কবুলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বর্ণনাগুলিতে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে উভয় বৈঠকেই পড়ার ব্যাপারে তাকীদ পরিলক্ষিত হয়। সূরা আহযাবের আয়াতে ছালাত ও সালাম প্রেরণের যে ব্যাখ্যা এসেছে তা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম দিককার ব্যাখ্যা হিসাবে শুধু সালাম প্রেরণের ব্যাপারে বলা হয়েছিল। কিন্তু ৫ম হিজরীর পরবর্তী সময়ে রাসূল (ছাঃ) সালামের সাথে ছালাতের অর্থাৎ তাশাহহুদ এবং দরূদ শরীফ উভয় বৈঠকে পড়ার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেন, হৌক সেটা প্রথম বৈঠক বা দ্বিতীয় বৈঠক। এ ব্যাপারে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) একবার নয় রাক‘আত বিশিষ্ট এক রাতের ছালাতে অষ্টম রাকা‘আতের বৈঠকে তাশাহহুদ, দরূদ এবং দো‘আ করলেন এবং সালাম না ফিরিয়ে উঠে গেলেন। অতঃপর নবম রাকা‘আতে শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ, দরূদ এবং পরিপূর্ণ দো‘আ পড়ে সালাম ফিরিয়েছিলেন।[3]

হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ বলেন, এতে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) রাতে তাহাজ্জুদের নফল ছালাতে উভয় বৈঠকে তাশাহহুদ এবং দরূদ উভয়টিই পড়েছেন। এটি নফল ছালাতের ঘটনা হলে কি হলো। এটি দ্বারা সর্বত্রই পালনের তাকীদ এসেছে। সুতরাং এটিকে শুধু নফল ছালাতে সীমাবদ্ধ বিধান ভাবাটা ঠিক হবে না।

গণতন্ত্র এবং রাজতন্ত্র :

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এবং রাজতন্ত্র একই গণ্য করেন। কিন্তু কুরআনী ব্যাখ্যায় এর ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মুত্তাকী, পরহেযগার ব্যক্তি মাত্রই প্রচলিত গণতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্রকে অধিক কল্যাণকর মনে করেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَاقَوْمِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيكُمْ أَنْبِيَاءَ وَجَعَلَكُمْ مُلُوكًا وَآتَاكُمْ مَا لَمْ يُؤْتِ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ ‘(স্মরণ কর) যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর যখন তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন একের পর এক নবী এবং তোমাদেরকে (ফেরাঊনী দাসত্বের পর) করেছেন স্বাধীন। আর তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত (যেমন মান্না ও সালওয়া) দান করেছেন, যা জগদ্বাসীর কাউকে দান করেননি’ (মায়েদাহ ৫/২০)

অনেকে অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় রাজতন্ত্রকে ইসলাম সম্মত বলতে চান। আবার অনেকে প্রচলিত গণতন্ত্রকেই জায়েয করতে চান। এখানে উভয় পক্ষই শাব্দিক অর্থের বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছেন। মূলতঃ এর অর্থ হবে إِذْ جَعَلَكُمْ مُلُوْكًا ‘যখন তিনি তোমাদেরকে ফেরাঊনের সাগর ডুবির পরে নিজ নিজ কর্মে স্বাধীন করে দেন’। বাস্তব কথা এই যে, রাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র কোনটির এখানে ব্যাখ্যার দাবী রাখে না।

তবু্ও প্রসঙ্গতঃ বলতে হয় যে, রাজতন্ত্র যদি খারাপ কিছু হত তাহলে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কোন নবীকে বাদশাহ বানাতেন না। আর তার নিয়ামতরাজীর গুণকীর্তনেই সবাইকে ব্যস্ত রাখতেন।

বর্তমান সময়ে খুবই আফসোস হয় যে, অনেকে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পেছনে পড়ে গিয়ে আবোল-তাবোলভাবে এটাকেই ইসলামী শাসনতন্ত্র বলছে, যা ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত।

তবে বাস্তব কথা এই যে, রাজতন্ত্র মূলতঃ ব্যক্তিতন্ত্র। কেননা ব্যক্তির উপর এ শাসন ব্যবস্থার ভাল মন্দ নির্ভর করে। সেখানে শাসক ভাল বা খারাপ দুই আসতে পারে। তবে যদি শাসক ভাল হয় তাহলে জনগণ এর সুফল পুরো মাত্রাই ভোগ করতে পারে। কিন্তু প্রচলিত গণতন্ত্রের মূলকথা জনগনই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। ফলে ভাল বা মন্দ কোনটাই শাসক ভাল বা খারাপ হ্ওয়ার উপর নির্ভর করে না। বরং ভাল কোন ব্যক্তি ক্ষমতায় আসলে তাকে পুরোদমে জনপ্রীতি অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। বস্ত্ততঃ তা কাজে নয়; বরং ভূঁইফোড় কথাবার্তার ফানুস ফাটিয়ে মিথ্যা ছলনার মোহে ফেলে জনগণকে ঠকানোর সব ধরনের রাস্তা আবিস্কার করা হয়। বর্তমান বিশ্বে মিথ্যুক শাসকদের জনগণ দেখছে। যা সবটুকুই প্রচলিত গণতন্ত্রের ফসল।

অনেক মুফাসসির আবার নিমোক্ত আয়াতের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে অগ্রহনীয় মতবাদ এবং প্রচলিত গণতন্ত্রকে একমাত্র জীবন বিধান হিসাবে বলতে চান। তাদের দলীল, মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ ‘আর যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, ছালাত কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে এবং তাদেরকে আমরা যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে’ (শূরা ৪২/৩৮)

হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ তার প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ আহসানুল বায়ানে এ বিষয়ে সবিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ছালাহুদ্দীন ইউসুফ বলেন, شُورَى শব্দটি ذكري بشري শব্দের মত। যা باب مفاعلة এর মাছদার থেকে এসেছে। অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তি বর্গ মাত্রই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি পরস্পর পরস্পরে আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে করে থাকে। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে মুসলমানদের সাথে শলাপরামর্শ করে কাজ করার আদেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে-ইমরান ৩/১৫৯)

বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভায় বসে যেতেন। বদর, ওহুদ, খন্দকের মত বড় বড় যুদ্ধগুলো আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ মওজূদ রয়েছে।

হযরত ওমর (রাঃ) যখন বেদ্বীন কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং বেঁচে থাকার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েন। তখন তিনি রাষ্ট্রীয় খিলাফতের সংকটময় মুহূর্তে ছয় ব্যক্তির পরামর্শ সভায় বসার তাকিদ দিলেন। উছমান, আলী, তালহা, যুবাইর, সাদ এবং আব্দুর রহমান ইবনু আ্ওফের তিনি নাম ঘোষণা করলেন। অনেক মানুষ পরামর্শ সভা বলতে রাজতন্ত্রের মূলোৎপাটন করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। যে কোন কাজ করতে গেলে পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে। হতে পারে সেটি শাসনকার্যে বা রাজতন্ত্রে বা অন্য কিছুতে। রাজা বাদশাহরা্ও অনেক সময় বিভিন্ন কাজে শলাপরামর্শে বসে যান। তাই বলে সবকিছুকেই গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দিতে হবে?

অতএব যদি কেউ উক্ত আয়াত থেকে রাজতন্ত্রকে মূলোৎপাটন করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চান; অথবা গণতন্ত্রকে মূলোৎপাটন করে রাজতন্ত্রকে। তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

মূলত আলোচনা পর্যালোচনার মানে হলো জনগন যেন বুঝে যে, বিষয়টির অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কেননা বিল্ডিং, জাহাজ ইত্যাদি আমরা যাই বানাই না কেন, আমরা সবকিছুতে কাজের গুরুত্ব বুঝে আলোচনা পর্যালোচনা করে থাকি।

অনেক সময় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ বিভিন্ন জটিল রোগের সমাধান একাকী করতে পারে না। বিধায় তারা পরামর্শ সভায় বসে যান। সবকিছুতেই যদি শুধু গণতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর থাকেন। তাহলে জন্ডিসের রোগীর মত সবকিছুকে হলুদ মনে হবে।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো ইদানিংকালে খুব জোরেশোরে ইসলামী গণতন্ত্র বলে চিৎকার দেওয়া হচ্ছে। ভাবখানা এই যে, ইসলাম ও গণতন্ত্র একই জিনিস। আফসোস কিভাবে একজন মুসলমান ইসলামী খিলাফতকে কবর দিয়ে কুফুরী গণতন্ত্রকে ইসলামী গণতন্ত্র বলে লেবেল সেঁটে দিতে পারে? এভাবে হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ বাতিল তাফসীর প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

শেষকথা : তাফসীরে আহসানুল বায়ান এমন একটি যুগপোযোগী তাফসীর, যা মুমিন হৃদয়ের পিপাসা মিটাবে। তাফসীরের নামে মিথ্যাচার যেখানেই হয়েছে, সেখানেই তাফসীরে আহসানুল বায়ানের সুদৃঢ় পদচারণা রয়েছে। মুসলিম জীবনে পবিত্র কুরআনের বাইরে যে শিক্ষাই চর্চিত হচ্ছে বা হয়েছে; সে বিষয়ে তাফসীরটির বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর উচ্চারিত হয়েছে। দ্বীনী এবং দুনিয়াবী প্রতিটি বিষয়ই ধরে ধরে আদ্যোপান্ত আলোচিত হয়েছে। মহান আল্লাহ সম্মানিত মুফাস্সিরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং আমাদেরকে পবিত্র কুরআন সঠিকভাবে বুঝার তাওফীক দিন-আমীন!

[লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]

 

[1]. মু্ওয়াত্বা মালেক হা/৩০৪৪।

[2]. বুখারী হা/৪৭৯৭।

[3]. সুনানে কুবরা লিল বায়হাক্বী ২/৭০৪ পৃ.; সুনানে নাসাঈ ১/২০২ পৃ. নতুন সংস্করণ, কিয়ামুল লাইল অধ্যায়; শায়খ আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন্নাবী, ১৪৫ পৃ. আলোচনা দ্রষ্টব্য।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও