স্টিফেন লেকার ইসলাম গ্রহণ ও দাওয়াতী জীবন

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 393 বার পঠিত

[ড. মুহাম্মাদ স্টিফেন লেকা রোমানিয়ার একটি কট্টর খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক এবং রোমানিয়ার বাকু (ভ্যাসিলে আলেকজান্ডারী) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক। তুরস্কে ভ্রমণকালে এক পরিবারের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ১৯৯৩ সালে ইসলাম তাকে গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তার পরিবার থেকে নির্বাসিত হন। তথাপি তিনি ধৈর্য্যধারণ করে একে একে পরিবারের সকলকেই ইসলামে দীক্ষিত করেন। পরবর্তীতে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত নিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শুরু করেন। নিম্নে তার ইসলাম গ্রহণের চমৎকার ঘটনা ও সংগ্রামী দাওয়াতী জীবন সংক্ষেপে পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হ’ল]

মুহাম্মাদ স্টিফেন লেকা তার ইসলাম গ্রহণের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী তুরস্ক সফরে গিয়েছিলাম। একদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সফরে রাত হয়ে যায়। আমরা হোটেলে যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলি। আমি এক বৃদ্ধ লোককে রাস্তায় থামাই। তিনি এসে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সালাম নিবেদন করেন। এর আগেও অসংখ্যবার মুসলমানদের সালাম পেয়েছি। কিন্তু এই বৃদ্ধের সালামের ভেতর ভিন্ন কিছু ছিল। চেহারা থেকে নূর ঝরছিল। তার কাছে আমরা রাত কাটানোর জন্য হোটেলের সন্ধান করলাম। তিনি জানালেন, ‘এখানে বহুদূর পর্যন্ত কোন হোটেল পাবেন না। আপনারা মেহমান মানুষ। আমার বাড়িতে রাত কাটিয়ে সকালে চলে যাবেন। আমি খুশি হব’। তিনি বারবার আবেদন করতে লাগলেন। কিন্তু আমার অন্তর সায় দিচ্ছিল না। বিদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের একজন অচেনা মানুষের ওপর কিভাবে ভরসা করা যায়! কিন্তু বৃদ্ধের উজ্জ্বল চেহারার প্রভাবে আমরা মেহমান হয়ে গেলাম! তিনি খুব খুশি হ’লেন। তার বাড়িটি পুরনো ও কাঁচা। চারদিকে দারিদ্রু্যতার ছাপ। অন্ধকার ঘর, অগোছালো পরিবেশ। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কেবল তার পাঁচটি শিশু এবং দুই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই লোকটি আমাদেরকে খুব সাধারণ রাতের খাবার পরিবেশন করলেন। তিনি আমাদের সাথে যেভাবে আচরণ করেছিলেন তাতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। তারপর তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানে ঘুমান, আমাদের অন্য জায়গা আছে’। আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম বিধায় দ্রুত ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে জাগ্রত হয়ে বাড়িতে কাউকে পেলাম না। আমরা ঘাবড়ে গেলাম। দ্রুত বাইরে বের হয়ে এক দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। দেখি, বৃদ্ধ লোকটি তার মা ও স্ত্রী-সন্তানসহ উঠানে একটি গাছের নিচে শুয়ে আছেন! হিম শীতল শীতের রাত তারা গাছের নিচে কাটিয়ে দিল! আমি রীতিমত কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি কি পাগল? এটা কেন করলেন’? তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমাদের একটিই ঘর। আপনারা আমার মেহমান আর ইসলাম আমোদেরকে মেহমানকে কষ্ট দিতে শেখায়নি’। তিনি যখন এ কথা বলছিলেন তখন তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, আপনি ইসলাম সম্পর্কে কতটুকু জানেন? তিনি বললেন, ‘ইসলাম সম্পর্কে আমার খুব বেশী জ্ঞান নেই, তবে আপনি কুরআন এবং হাদীছের বই পড়লে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারবেন’। সাথে সাথে লাইব্রেরীতে গিয়ে একটা কুরআন ও কয়েকটি হাদীছের বই কিনে পড়া শুরু করলাম। প্রায় দু’মাস একটানা পড়লাম। কুরআন ও বাইবেলের মধ্যে মিল খুঁজে পেলাম। একজন সত্যিকারের খ্রিষ্টান জানেন যে, বাইবেলে শুকরের গোশত খাওয়া এবং ওয়াইন (মদ) পান করা হারাম। বাইবেলে ঈসা (আঃ) বলেছেন, কেউ আমার পরে নবী হয়ে আসবে, মারিয়াম (আঃ) মুসলমানদের মত পোষাক পরতেন ইত্যাদি অনেক বিষয় আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, ইসলামই একমাত্র সঠিক ধর্ম। দু’মাস পর, আমার হৃদয় খুলে গেল এবং ১৭ জানুয়ারী ১৯৯৩ সালে মুসলমান হয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ!

দাওয়াতী জীবন : মুহাম্মাদ লেকা তার মুসলিম জীবনের শুরু থেকেই দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন। ইসলাম গ্রহণ করার ‘অপরাধে’ পিতা বাড়ি থেকে বের করে দেন। মা কথা বলা বন্ধ করে দেন। কিন্তু তিনি ধৈর্য্য ও সাহস হারাননি। ধারাবাহিকভাবে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। তার অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রথমে মা, এরপর ভাই, একে একে পরিবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর এলাকার লোকদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ দেশ, পরবর্তী সময়ে বিশ্বে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে পদব্রজে সফর করেছেন। তিনি ১৫৬ টির অধিক দেশে ঘুরে ঘুরে ইসলাম প্রচার করেছেন। ৪০টি দেশে হেঁটে ২৯ হাযার কিলোমিটার সফর করেছেন। বার্ধক্যের কারণে এখন হেঁটে বেশী সফর করতে পারেন না। এ জন্য বিশেষ পদ্ধতির শক্তিশালী গাড়ি বানিয়েছেন। গাড়িটি সমতল, জঙ্গল ও পাহাড়ি সব ধরনের রাস্তায় চলতে সক্ষম।

‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ এই শ্লোগান নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি দাওয়াতের কাজ করছেন। আল্লাহর অনুগ্রহে বিপুল সংখ্যক মানুষ তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছে। দাওয়াতের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি আরব দেশেও গিয়েছেন। সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, কাতার এবং আরব আমিরাত সফর করেছেন। দাওয়াতের পথে তিনি নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন। ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তিন মাস শিক্ষকতা করার চুক্তি করেছেন। এই তিন মাসের বেতন নিয়ে পরবর্তী তিন মাস সফর করবেন! এভাবেই রুটিন করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, খ্রিষ্টানদের দাওয়াত দেওয়ার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। সূরা মারিয়ামই যথেষ্ট। অধিকাংশ খ্রিষ্টান জানেই না যে, পবিত্র কুরআনে সূরা মারিয়াম নামে কোন সূরা আছে! এই সূরায় তাদের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা আছে। ইউরোপের গ্রাম-গঞ্জে খ্রিষ্টানদের সামনে সূরা মারিয়ামের অনুবাদ শোনালে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। খ্রিষ্টানদের বোঝাতে হবে তিনি একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যিনি কখনো একটিও মন্দির ধ্বংস করেননি এবং কখনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেননি।

আমার দাওয়াত দেখে সারা বিশ্বের অনেক মানুষ অবাক হয়ে গেছে। কখনো কখনো লোকেরা আমার গাড়ি থেকে আমার ইমেইল ঠিকানা পায় এবং আমাকে আমার মিশন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আমি যখন কোন দেশে যাই, তখন সেখানকার মানুষ, তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে অধ্যয়ন করতে আমার ১০ দিন সময় লাগে। তবেই আমি তাদের সাথে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলি। আমি নিজেকে কোন আলেম কিংবা শায়খ বলছি না। তবে আমি কিছু মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের দেখেছি তারা ইসলামকে একঘেয়ে ও ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করে। নিঃসন্দেহে তাদের উদ্দেশ্য ভাল কিন্তু পদ্ধতি ভাল নয়। মুসলমান কোন ধর্মপ্রচারক কোন খ্রিষ্টানের সাথে ভ্রু কুচকে রাগের স্বরে কথা বলা কিংবা ‘আমার ধর্ম তোমার চেয়ে ভাল’ এ কথা বলা উচিত নয়।

ইসলাম মানে অপরের সাথে তুলনা করা, সামান্য ভুল করলেই মুসলিম থেকে বাদ পড়ে যাওয়া নয়। ইসলাম ভালবাসা ও শান্তির ধর্ম। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দান করেছেন। মুসলমান হওয়ার তাওফীক দিয়েছেন। এখন আমার ওপর আবশ্যক, ইসলাম বঞ্চিতদের নিকট ইসলামের মহা নে‘মত পৌঁছে দেওয়া। রোমানিয়ায় এক হাযার মানুষকে কালেমা পাঠ করানোর সময় বলেছিলাম, মেহনতের কিছু কিছু ফল হাতে আসা শুরু করেছে। আলহামদুলিল্লাহ, নিজ শহরেই এখন মুসলমানদের সংখ্যা ৮০ হাযার ছাড়িয়ে গেছে! সমগ্র দেশে এর পরিমাণ অর্ধ মিলিয়ন! আল্লাহ আমাদের ইসলাম উপহার দিয়েছেন। এই উপহারটি সমস্ত মানবতার কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।

[সূত্র : ইন্টারনেট]



আরও