আমার শ্রেষ্ঠ মা

আব্দুল কাদের 95 বার পঠিত

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মা অনেকটা সামরিক কায়দায় আমাদের শাসন করতেন। তখন মনে হ’ত এ কেমন স্বৈরশাসন! কিন্তু তার ঐ শাসনের সুফল আজ প্রতিটি মুহূর্তে টের পাই। যখনই নিজের কোন সফলতার সংবাদ পাই তখনই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মায়ের দৃঢ়চিত্ত প্রচেষ্টার কারণেই আমাদের আজ এই অবস্থান। হৃদয়ের গভীর থেকে আমার শ্রেষ্ঠ মাকে অনুভব করি। দৌড়ে গিয়ে তাকে সফলতার সুসংবাদ দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার জন্য নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়েই ক্ষান্ত হয়ে যাই, ‘রবিবর হামহুমা কামা রববাইয়ানী ছগীরা’।

একবার কোন এক কারণে মায়ের প্রতি আমি খুবই রাগান্বিত হয়ে তার কথার প্রত্যুত্তর করি। কোথায় যাই! মা তো রেগে আগুন। বুঝতে পারলাম কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলাম। যাওয়ার পথে তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, ‘আজ রাতে বাড়িতে আসতে পারবি না’। বুঝলাম আমার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে। এ তো আর কোন দেশের আইন না, যে কারো ওকালতি বা সুফারিশ চলবে। এ আইন মায়ের মোবাইল কোর্টের আইন। সন্ধ্যা হ’ল। কিন্তু ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে দাদী পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কোন সমস্যা না হওয়ার অভয় দিলেন। কিন্তু কোনভাবেই নিজেকে মানাতে পারছিলাম না। কারণ, মা যতই রাগী হোন না কেন, রাতে তিনিই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন।

যাইহোক ভাবছি মা যদি আর কোনদিন না ডাকেন। যদি বাড়িতে না উঠতে দেন! নানা ভাবনা-চিন্তার মধ্যে শুয়ে শুয়ে শুধু এপিঠ-ওপিঠ করছি। এক পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করলাম। আর নির্লজ্জের মত মা মা করে ডাকতে শুরু করলাম। আমার কান্নার আওয়াজে যেন তিনি তার দেহে প্রাণ খুঁজে পেলেন। তার বুঝতে বাকী নেই তার ভালোবাসা কঠোরতার ঊর্ধ্বে। তারপরও তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। যেন আমি দ্বিতীয় বার এধরনের ভুল না করি। এজন্য তিনি বললেন, ঘরে উঠতে হ’লে ওয়াদা করতে হবে, দ্বিতীয়বার আর কখনো যেন এমন ভুল না হয়। আমি সাথে সাথে রাযী হয়ে গেলাম।

মনে পড়ছে, মা নবীদের কাহিনী থেকে ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে তার ভাইদের নির্মমতার ঘটনা, ইসমাঈল (আঃ)-কে তার বাবা ইব্রাহীম (আঃ)-এর কুরবানী করতে যাওয়ার ঘটনা ইত্যাদি গল্প শুনাতেন। তিনি পড়তেন আর আমি গভীর আগ্রহে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। প্রতিটি রাত ছিল একটা নতুন কিছুর সাথে পরিচয়, একটা নতুন এপিসোড।

আমাদের থালা-বাসন পরিষ্কার থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনিই দিতেন। আমরা দুই ভাই যখন ছোট, তখন মা আমাদের ছালাত শিক্ষার বিষয়ে খুবই তৎপর ছিলেন। সাধারণত দিনের বেলায় মসজিদে গিয়ে ছালাত পড়তে সমস্যা হ’ত না। আবার ফজরের ছালাতে আববাই সাথে নিয়ে যেতেন। কিন্তু সমস্যা ছিল এশার ছালাতে। তাই মা তখন একটি হারিকেন নিয়ে আমাদেরকে মসজিদের দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য গেট পর্যন্ত আসতেন। আমরা দু’জন মসজিদে গিয়ে চিৎকার দিতাম যে, আমরা পেঁŠছে গেছি। তখন দেখতাম ঐ আলোটা আস্তে করে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে। আমরা বুঝতাম মা ভিতরে চলে গেছেন। এরপর ছালাত শেষ হলে আবার আমরা মা বলে ডাক দিতাম। দেখতাম একটা আলো বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। বুঝতাম মা চলে এসেছেন। আসলে তিনি আমাদেরকে পাঠিয়ে অপেক্ষা করতেন। এরপর ঐ আলোকে লক্ষ্য করে আমরা দু’জনে দৌড় দিতাম।

ফজরের ছালাতের পর আববা-মা দু’জনই কুরআন ও হাদীছ পড়তে বসতেন। আমাদেরও পাশে বসাতেন। আমরা কুরআন পৃথক পৃথক পড়ার চেষ্টা করলেও হাদীছ একজনই পড়তেন আর বাকিরা শুনতাম। আর হাদীছ পড়তেন মা। কারণ মায়ের পড়া ছিল স্পষ্ট আর আববার পড়া ছিল অস্পষ্ট। ফলে আববা পড়লে মা প্রায়ই ভুল ধরতেন। যে কারণে আববা মায়ের সামনে পড়ার ঝুঁকি নিতেন না। তবে ব্যাখ্যা করতেন আববা। এদিক দিয়ে আববা মায়ের থেকে উপরে ছিলেন। আর এটা মাও মেনে নিতেন। আবার কুরআন পড়ার ক্ষেত্রে আববা ছিলেন মায়ের উস্তাদ।

যাইহোক মক্তবে পাঠানোর পাশাপাশি মা নিজেও আমাদের কুরআন ও ছালাত শিক্ষা দিতেন। আর এভাবেই তিনি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা দেন। যেহেতু তখন আমাদের কোন বোন ছিল না। আবার আববাও সকালে বাজারে যেতেন। আর রাতে ফিরতেন। তাই মাকেই বাড়ির সকল কাজ করতে হ’ত। আর এ কারণেই তিনি সকালে আমাদের বিছানা, টেবিল, আলনার কাপড় ইত্যাদি গুছিয়ে দিয়ে বলতেন, রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যেন এমনই থাকে। আর আমরাও যথাসম্ভব তা পালন করার চেষ্টা করতাম, পাছে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি হয়ে যায়!

ছোট বেলায় নিয়মিত আর একটু বয়স হ’লে বিশেষ দিনে তিনি আমাদের গোসল করাতেন। আর ঐদিন আমাদের পাতিলের মত অবস্থা হ’ত। না কান্না করা পর্যন্ত ঘষাঘষি চলত। কান্না ছিল তার মানদন্ড। অর্থাৎ কাঁদলে তিনি বুঝতেন কাজ হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল, মাদ্রাসা, আত্মীয়বাড়ি ইত্যাদি জায়গায় যাওয়ার সময় তার নির্ধারিত ড্রেস বা ফ্যাশনই ছিল একমাত্র ফ্যাশন। এমনকি চিরুনি পর্যন্ত তিনি নিজে করে দিতেন। তিনি আমাদের ছোট-বড় সকল কাজ শেখাতেন।

খাওয়ার আদব থেকে শুরু করে বড়দের সাথে ব্যবহার। হাতের নখ কাটা থেকে রোদে কাপড় শুকানোতে যে একটা সৌন্দর্য আছে তাও তিনি শেখাতেন। এ বিষয়ে তিনি আববাকে প্রায়ই কথা শুনাতেন। ঘরের আসবাবপত্র প্রতি ৩/৪ মাস পরপর স্থানান্তর করতেন। তাতে যেন এক নতুনত্ব প্রকাশ পেত। অর্থাৎ তিনি একজন রুচিশীল বা সৌন্দর্যপ্রেমী ছিলেন। নিজেরা নিজেদের জিনিস ঠিকমতো গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি তাকেও তার কাজে আমরা সাহায্য করতাম।

সন্ধায় একটা নৈমিত্তিক কাজ ছিল হারিকেন মোছা ও ঘর-বারান্দা ঝাড়ু দেওয়া। আমি একটা করলে ভাই করত অন্যটা। রান্নার আগে ও পরে তাকে সাহায্য করতাম। একটু বড় হলে নিজেদের কাপড় নিজেরাই পরিষ্কার করতাম। এভাবে তিনি আমাদেরকে যেমন পরিষ্কার থাকার শিক্ষা দিতেন, তেমন স্বনির্ভরতার শিক্ষাও দিতেন। যার ফল এখন পদে পদে উপলব্ধি করি।

তিনি ছিলেন একজন বুনন শিল্পী। হয়তো এটি তিনি পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে অর্থাৎ আমার নানীর কাছ থেকে। কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে প্রায় সব সেলাই তিনি পারেন। আমরাও তার থেকে এর কিছু শিখতে ভুল করিনি। এক্ষেত্রে তিনি আমাদের উস্তাদ। তিনি একজন ডাক্তার বা হাকীম। যে কোন ধরনের রোগে আক্রান্ত হ’লে তিনি মানসিক সান্তনা থেকে শুরু করে ঔষধি খাবার, ঔষধ ও ডাক্তারের খোঁজ করার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। আমার এখনো মনে পড়ে জ্বর হলে মা কলসের তলায় ছিদ্র করে তাতে পাটকাঠি দিয়ে লাইন করে দিতেন, যার ফলে কলসে ভরা পানি আস্তে আস্তে মাথায় এসে পড়ত। এ যেন এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আবার ঠান্ডা লাগলে রাতে তেল দিয়ে পা মালিশ করে দিতেন।

তিনি ছিলেন সকল কাজের কাযী। বাড়ির আসবাবপত্র থেকে শুরু করে মাঠে, বাজারে জমি ক্রয় পর্যন্ত উদ্যোগ তিনি নিতেন বা আববার প্রস্তাবে তিনিই সবচেয়ে বেশী সাহস যোগাতেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তিনিই ছিলেন অগ্রবর্তী। মা যদি বলতেন এ কাজটা তিনি করবেন তাহ’লে ধরে নিতে হবে কাজটি হয়ে গেছে। কারণ যত রাতই হোক তিনি ঐ কাজটা না করে ঘুমাতে যেতেন না।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে মা ছিলেন আমার দেখা শ্রেষ্ঠ আপোষহীন মহিলা। অন্যায় করে ফেললে আববা পর্যন্ত ভয়ে থাকতেন। এ বিষয়ে নানা বাড়িতেও তার নাম ডাক আছে। কিন্তু আববার প্রতি তার ছিল অগাধ ভক্তি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভয়। আমি খেয়াল করে দেখতাম, বাসায় যখন ভালো কিছু রান্না হ’ত, মা তখন আববার জন্য আগেই কিছু রেখে দিতেন। মা বলতেন, তিনি সারাদিন বাইরে থাকেন, অনেক কষ্ট করেন, আবার সবার শেষে খান। তাই তার জন্য ভালোটা না রাখলে তিনি মনে কষ্ট পাবেন। আবার আববার ময়লা কাপড় যদি পরিষ্কার করতে ভুলে যেতেন আমাদের সামনে বলে বসতেন ‘তোর আববা আমাকে যে কী বলবে’!

মায়ের স্বপ্ন : মা স্বল্পশিক্ষিতা হওয়ার কারণে তার স্বপ্ন সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে তুলবেন। তার এই স্বপ্ন পূরণের জন্য বড় ভাইকে উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে পাঠালেন। তিনি অত্যন্ত কঠোর হলেও যে দিন বড় ভাই পড়ালেখার জন্য বাইরে গেলেন, সেদিন থেকে তিনি আমার প্রতি দুর্বল হ’তে শুরু করলেন। আর তখন থেকে তিনি আমার প্রতি কিছুতা সহনশীল হ’তে থাকেন। হয়তো তিনি আমাকেও ছেড়ে দেওয়ার জন্য দিন গুণতেন।

যাইহোক আমিও যখন বাড়ি ছাড়লাম, তখন মা মানসিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন। যখন আমি বাড়িতে যাওয়ার দিন বলতাম, তখন থেকে মা দিন গুণতে থাকতেন। তার সমস্ত দুঃখ যেন শেষ হয়ে যেত। আর যেদিন আমি ফিরে আসার দিনটি বলতাম, সেদিন থেকে তার মুখটা মলিন হয়ে যেত, আবার অসুস্থতা, দুঃখ-চিন্তা তাকে ঘিরে ধরত।

বাড়ি থেকে শহরের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, দাদী, ফুফু অনেকেই বিদায় দিতে আসতেন। আসার সময় দেখতাম তার পাশ থেকে একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখের দিকে তাকালেই দেখতাম তার চোখ অশ্রুসিক্ত। কিন্তু বুঝতে দিতে চাইতেন না। চোখে যেন কিছু পড়েছে এমনটি বুঝানোর চেষ্টা করতেন।

মাকে শেষবার দেখার পর আমিও আমার চাপা কান্না ঠেকাতে পারতাম না। মনের অজান্তেই চোখ লাল হয়ে যেত, বেয়ে পড়ত অশ্রু। আবার তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতাম। কারণ তিনি আমাকে কাঁদতে পাঠাননি, জয় করতে পাঠিয়েছিলেন! চলে আসার পর আমার ফেলে আসা জিনিসগুলো, পড়ার চেয়ার, টেবিল, কখনো বা আমার সাথীদের দেখে তাদের কাছে ছুটে চলে যেতেন। কিন্তু পিছন থেকে কেউ যেন বলত তোমার ছেলে ঐখানে নেই। তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে ফিরে আসতেন না পাওয়ার বেদনা নিয়ে।

মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কোন এক অজানা বিষন্নতা কাজ করে। আমার সমস্ত ব্যস্ততা শেষে করে বাড়ী গেলেও তার সাথে সাক্ষাত হয় না। আমার জন্য কেউ অপেক্ষাও করে না, দিনও গুণে না। মোবাইলে কল দিয়ে বাবা বলে কেউ ডাকও দেয় না। বাড়ী থেকে বিদায়কালে আমার হাতে-কপালে কেউ চুমুও খায়না। মসজিদের মিনারে আযানের সূর ভেসে আসলেই মনে হয়, মা আমাকে এসে বলবেন, বাবা তাড়াতাড়ি টুপি-পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যাও। কিন্তু এমনটি হয়না। তবে মায়ের শেখানো অভ্যাসের কারণেই অবচেতন মনে মসজিদ পানে ছুটে চলি। এশার ছালাত শেষে যখন ফিরে আসি, তখন মনে হয় বাড়ী থেকে একটি আলো বের হয়ে আসবে। কিন্তু এমনটি আর হয় না।

এখন প্রতি ছালাতে তাঁর জন্য প্রাণ খুলে দো‘আ করি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন। আদর্শ সন্তান হিসাবে তার কবরে আমল পৌঁছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। সাথে সাথে মৃত্যু অবধি দ্বীনের সঠিক পথে চলতে পারি সেই কামনা করি। আল্লাহ সকলকেই যেন তাওফীক দান করেন।- আমীন!

[লেখক : ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]



আরও