দুর্বলতাই যখন শক্তি

নাজমুন নাঈম 95 বার পঠিত

[গল্পটি পাঠের পূর্বে জুডো খেলা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। জুডো একটি আধুনিক মার্শাল আর্ট। একে প্রাচীন মল্লযুদ্ধ ও কুস্তির আধুনিক সংস্করণ বলা যেতে পারে। ১৮৮২ সালে (মতান্তরে ১৮৮০ সালে) জাপানী শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ড. জিগারো কানোর হাত ধরে এই খেলার উৎপত্তি হয়। ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকে এটি অলিম্পিক গেমসের অন্তর্ভুক্ত হয়। জুডো খেলায় খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে দেওয়া এবং অাঁকড়ে ধরে অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা। এই খেলায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণের চেয়ে আত্মরক্ষার প্রতি বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেকারণ মুখমন্ডলসহ শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশে আঘাত করা খেলার নিয়ম বহির্ভূত। জুডো খেলোয়াড়দের জুডোকা ও কোচ বা প্রশিক্ষকদের সেনসি বলা হয়।- অনুবাদক]

দশ বছর বয়সী একটি ছেলে জুডো খেলার জন্য মনস্থ করল। কিন্তু সমস্যা হল এক বছর আগে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সে তার বাম হাতটি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে জুডোর সব কৌশল পুরোপুরি আয়ত্ত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য সে একজন জাপানী সেনসির নিকট জুডো প্রশিক্ষণ শুরু করল।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে জুডোর প্রাথমিক নিয়মাবলী ও প্রতিরক্ষা কসরত ভালোভাবে রপ্ত করে নিল। এরপর তিন মাস যাবৎ সেনসি তাকে কেবল একটি উচ্চ আক্রমণ কৌশল প্রশিক্ষণ দিল। সে বুঝতে পারছিল না কেন সেনসি বারবার তাকে কেবল একটি চালই শেখাচ্ছিল। একদিন সে প্রশ্ন করে বসল, সেনসি! আমি কি আর কোন চাল শিখব না? উত্তরে সেনসি তাকে বললেন, এই একটি চালই ভালোভাবে রপ্ত কর। এটির কারণেই তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করবে। এটিই একমাত্র কৌশল যা তোমার সব সময় প্রয়োজন হবে। ছেলেটি সেনসির কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু সে তার কথায় বিশ্বাস রেখে প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেল। অবশ্য এ ছাড়া তার অন্য কোন উপায়ও ছিল না। কারণ হাতকাটা ছেলেকে জুডো শেখানোর মত পন্ডশ্রম কে করতে চায়!

কয়েক মাস টানা প্রশিক্ষণের পর সে একটি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করল। দেখা গেল, মাত্র একটি কৌশল জেনেও ছেলেটি প্রথম দুই পর্বে সহজে জয় লাভ করল। এমন অভাবনীয় সাফল্যে ছেলেটি নিজেই অবাক হয়ে গেল। তবে তৃতীয় পর্বে ছেলেটি কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখী হল। কিছুক্ষণ তুমুল লড়াইয়ের পর তার প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় ধৈর্য হারিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। তখনই ছেলেটি তার একমাত্র চাল প্রয়োগ করে জয়লাভ করল এবং চুড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হ’ল। টুর্নামেন্টের বিজয়ের মালা তার থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরত্বে। এমন উত্তরোত্তর সাফল্যে ছেলেটির বিস্ময়ের সীমা রইল না।

আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর হয়ে ছেলেটি ফাইনাল খেলা শুরু করল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারল, সে এবার অধিকতর শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করছে। এক পর্যায়ে মনে হ’ল, ছেলেটি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তার পক্ষে আর বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব না। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ তার ক্ষতির আশংকা করছিল। তথাপি সে হাল ছাড়ল না। এমনকি খেলার মধ্য বিরতির সময় রেফারী তাকে পরাজয় মেনে নিয়ে খেলা শেষ করার প্রস্তাব দিল। তখন তার সেনসি বললেন, তাকে খেলা চালিয়ে যেতে দিন। বিরতির পর খেলা আবার শুরু হ’ল। ছেলেটি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে শুধু প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করে যাচ্ছিল। সেনসি অধীর আগ্রহে কেবল একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় একটি ভুল করে বসল। সাথে সাথে ছেলেটি নিখুঁতভাবে তার একমাত্র চালটি প্রয়োগ করে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। এক হাত না থাকা সত্বেও ছেলেটি একটি পুরো টুর্নামেন্ট জিতে গেল।

ফেরার পথে ছেলেটি বিস্ময়ের সাথে তার সেনসির সাথে প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে কথা বলছিল। এক পর্যায়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, সেনসি! কেবল একটিমাত্র চাল শিখে আমি পুরো টুর্নামেন্ট কীভাবে জিতে গেলাম? এটা কীভাবে সম্ভব হ’ল? সেনসি বললেন, তুমি দু’টি কারণে জয় লাভ করেছ। এক. তুমি জুডোর সবচেয়ে কঠিন চালগুলোর মধ্যে একটি রপ্ত করেছ এবং তুমি তা খুব ভালোভাবে প্রয়োগ করতে পার, যা অনেক বড় খেলোয়াড়রাও নিখুঁতভাবে পারে না। ফলে তোমার অধিকাংশ প্রতিপক্ষ বিশেষ করে প্রথম দুই পর্বের খেলোয়াড়রা এটা ধারণাও করতে পারেনি। দুই. তোমার শেখা এই চালটি প্রতিহত করার সবচেয়ে সহজ ও প্রচলিত পদ্ধতি হ’ল আক্রমণকারীর বাম হাত ধরে তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু তোমার বাম হাত কাটা সেহেতু প্রতিপক্ষ তোমার এই চাল প্রতিহত করতে সক্ষম হয়নি। ছেলেটি বুঝতে পারল, তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাই এখন তার সবচেয়ে বড় শক্তি। সে মহৎ পরিকল্পনাকারী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।

শিক্ষা : কখনো কখনো আমরা নিজেদের দুর্বলতা দেখে বিচলিত হয়ে নিজ তাক্বদীরকে দোষারোপ করি। কখনো আবার প্রতিকূল পরিস্থিতে সামান্য সীমাবদ্ধতার কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হই। কিন্তু আমরা জানিনা, এ দুর্বলতাই কোন একদিন আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি রূপে আবির্ভূত হ’তে পারে। এটি আল্লাহর মহৎ পরিকল্পনারই অংশ। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক মানুষ স্বতন্ত্র এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাই নিজেকে কখনও অক্ষম ভাবা উচিত নয়। বরং নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করাই কর্তব্য। এর মাধ্যমেই একদিন চুড়ান্ত সফলতা আসবে ইনশাআল্লাহ!

[গল্পটি আরবী থেকে অনূদিত]


-মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম




আরও