উত্তম দাওয়াত

নাজমুন নাঈম 182 বার পঠিত

আমস্টার্ডাম শহরের উপকণ্ঠের মসজিদে একজন মধ্যবয়সী ইমাম ছিলেন। তিনি প্রতি শুক্রবার জুম‘আর ছালাতের পর তঁার এগার বছর বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে শহরে বের হ’তেন। সেখানে তারা লোকদের মাঝে ‘জান্নাতের পথ’ নামক একটি ছোট বই ও অন্যান্য ইসলামী বই বিতরণ করতেন।

এক জুম‘আর দিন বাইরে তীব্র শীতের পাশাপাশি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন যখন তাদের রওয়ানার সময় হ’ল, তখন ছেলেটি সাধ্যমত গরম কাপড় পরে নিল; যাতে ঠান্ডা তাকে আক্রান্ত করতে না পারে। অতঃপর তার পিতাকে বলল, আমি প্রস্ত্তত! তার পিতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কীসের জন্য এত প্রস্ত্ততি নিয়েছ? ছেলেটি বলল, আমাদের বই বিতরণে বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে। তার পিতা বললেন, বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ছেলেটি তার পিতাকে অবাক করে উত্তর দিল, এই প্রচন্ড বৃষ্টি সত্ত্বেও সেখানে অনেক মানুষ অনবরত জাহান্নামের আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পিতা বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ; তবু এই বিরূপ আবহাওয়ায় আমি বের হব না। ছেলেটি বলল, তাহলে দয়া করে আমাকে একা যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি বইগুলো বিতরণ করতে চাই। ছেলের কথায় ইমাম ছাহেব কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতঃপর তাকে কিছু বই দিয়ে বললেন, তুমি যেতে পার। ছেলেটি অনুমতি পেয়ে তার পিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল।

মাত্র এগার বছর বয়সী একটি ছেলে বৃষ্টিস্নাত প্রতিকূল আবহাওয়ায় শহরের রাস্তায় একাকী হেঁটে চলল; যাতে কোন মানুষের সাক্ষাৎ পেলে তাকে একটি বই দিতে পারে। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় কোন মানুষের দেখা না পেয়ে সে আশেপাশের বাড়িতে গিয়ে বই বিতরণ শুরু করল। এভাবে বৃষ্টির মধ্যে দুই ঘণ্টা যাবত বাড়ি বাড়ি হেঁটে বই বিতরণ শেষে তার হাতে মাত্র একটি বই অবশিষ্ট থাকল। সে পুনরায় রাস্তায় ফিরে বাড়ির দিকে রওনা হ’ল এবং হাতে থাকা বইটি দেওয়ার জন্য একজন মানুষ খুঁজতে থাকল। কিন্তু তখনো রাস্তাটি ছিল সম্পূর্ণ ফঁাকা। তাই সে বইটি দেওয়ার জন্য শহরের প্রান্তে একটি বাড়িতে কলিং বেল বাজাল। কিন্তু কোন সাড়া পেল না। সে দরজায় হাত দিয়ে কয়েকবার করাঘাত করল। তবুও কারো সাড়া না পেয়ে সে চলে যাওয়ার মনস্থ করল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে সে আবার থমকে দঁাড়াল। কী যেন ভেবে সে ফিরে যেতে পারল না।

ছেলেটি গভীর দৃষ্টিতে দরজার দিকে আরেকবার তাকাল। অতঃপর হাত দিয়ে সজোরে দরজায় আঘাত করতে থাকল। সে জানত না তার সাথে তখন কী ঘটতে যাচ্ছে। সে শুধু বারবার দরজায় করাঘাত করতে থাকল। অবশেষে দরজাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল। সে দরজায় একজন বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতে পেল। মহিলাটির চেহারায় কঠিন দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মহিলাটি তাকে বলল, কী চাও বাবা? ছেলেটি বৃদ্ধার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর ঠেঁাটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল, দাদী! আমি যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহ’লে দুঃখিত। আমি শুধু আপনাকে বলতে চাই যে, আল্লাহ আপনাকে খুব ভালবাসেন। তিনিই আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছেন। আমি আমার হাতের এই বইটি আপনাকে দিতে এসেছি; যাতে আপনি জানতে পারেন, সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। এই বই থেকে আপনি আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তঁার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়সমূহ জানতে পারবেন। কথাগুলো বলে ছেলেটি হাতের শেষ বইটি বৃদ্ধার হাতে ধরিয়ে দিল। অতঃপর চলে যাওয়ার মনস্থ করল। বৃদ্ধা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, স্রষ্টা তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন।

পরবর্তী শুক্রবারে মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ শেষে ইমাম ছাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কারো কোন প্রশ্ন আছে? কেউ কিছু বলতে চান? পিছনের মহিলাদের সারি থেকে একটি দুর্বল কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তিনি বললেন, ‘এই মজলিসের কেউ আমাকে চিনে না। আমি এখানে আগে কখনো আসিনি। গত শুক্রবারেও আমি মুসলিম ছিলাম না। এমনকি ইসলাম গ্রহণের কোন চিন্তাও তখন আমার ছিল না’।

তিনি বলতে থাকলেন, ‘মাত্র কয়েক মাস আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। তারপর থেকে আমি এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছি। গত শুক্রবার আবহাওয়া খুব ঠান্ডা ছিল। আর বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টিও হচ্ছিল। তখন আমি আত্মহত্যার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। কেননা বেঁচে থাকার কোন আশাই আমার ছিল না। আমি একটা চেয়ার ও দড়ি জোগাড় করলাম। অতঃপর আমি বাড়ির উপর তলায় উঠে ছাদের একটি আংটায় দড়িটা শক্ত করে ঝুলিয়ে দিলাম। এরপর চেয়ারের উপর দঁাড়িয়ে দড়ির অন্য প্রান্ত আমার গলায় বঁাধলাম। কয়েক মাস সম্পূর্ণ একা থাকার ফলে মৃত্যুচিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তখন আকস্মিক একটা শব্দে আমার চেতনা ফিরল। আমি অঁাতকে উঠলাম। নিচ তলার দরজায় করাঘাতের আওয়াজ আমার কানে আসল। আমি ভাবলাম, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি, হয়তো আগন্তুক এমনিতেই চলে যাবে’।

‘আমি করাঘাতের শব্দ বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু দরজার কলিং বেল মুহুর্মুহু বেজেই চলল। করাঘাতের আওয়াজও তীব্র হ’তে থাকল। আমি চিন্তা করতে থাকলাম, কে হ’তে পারে? অনেক দিন কেউ আমার দরজার কলিং বেল বাজায় না। আমাকে দেখতে আসারও তেমন কেউ নেই। অনেক ভেবে গলা থেকে দড়ির ফাস খুলে ফেললাম। মনে মনে বললাম, কে এতক্ষণ ধরে আমার দরজার বেল বাজাচ্ছে? আমি দেখব। অতঃপর নিচে গিয়ে দরজা খুলে আমি যা দেখলাম, তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেখানে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বালক ছিল। তার মত প্রফুল্ল চেহারা, প্রখর চোখের চাহনি আর মায়াবী মুচকি হাসি আমি আগে দেখিনি। বাস্তবে তার রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সে বলল, দাদী, আল্লাহ আপনাকে খুব ভালবাসেন। তিনিই আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটির প্রতিটি কথা আমার হৃদয়ে এমনভাবে স্পর্শ করছিল যে, আমার মৃত অন্তর আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল। অতঃপর সে আমাকে আমার হাতের এই বইটি ধরিয়ে দিল ‘জান্নাতের পথ’। এরপর সেই ছোট্ট ফেরেশতা শীত আর বর্ষার ঝাপসা চঁাদরের আড়ালে হারিয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দঁাড়িয়ে রইলাম। অতঃপর দরজা বন্ধ করে প্রবল আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করলাম। আমি বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি শব্দ, বাক্য হৃদয়ে গভীরভাবে অনুভব করলাম। এর অনেক কিছুই আমাকে আন্দোলিত করল। আমি জীবনের নতুন আলো খুঁজে পেলাম। তৎক্ষণাৎ আমি উপর তলায় গিয়ে দড়ি ছিড়ে ফেললাম এবং চেয়ার সেখান থেকে সরিয়ে নিলাম। কারণ এগুলোর আমার আর কোন প্রয়োজন নেই।

বৃদ্ধা আরো বললেন, আপনারা দেখছেন আজ আমি কত খুশি! এর কারণ আমি আমার প্রকৃত এক ইলাহের সন্ধান পেয়েছি। আমি বইটির প্রচ্ছদ থেকে এই মারকাযের ঠিকানা পেয়েছি। তাই আমি নিজে এখানে এসেছি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে। আলহামদুলিল্লাহ ফেরেশতার মত ফুটফুটে ছেলেটি একেবারে উপযুক্ত সময়ে আমার নিকট এসেছিল। তার মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। তখন মসজিদে এমন কোন মুছল্লী ছিল না, যার চোখ মহিলার ঘটনা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়নি। মুহুর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে তখন মসজিদ প্রকম্পিত হচ্ছিল। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার...।

মহিলার ঘটনা শুনে ইমাম ছাহেব আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি মিম্বার থেকে নেমে তার সামনের কাতারে আসলেন, যেখানে তঁার ছেলে বসেছিল। তিনি তাকে দু’হাতে কোলে তুলে নিয়ে বলতে থাকলেন, এই সেই ছোট্ট ফেরেশতা, এই সেই ছোট্ট ফেরেশতা...। তিনি মুছল্লীদের সামনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কঁাদলেন। ঐ মজলিসে তঁার মত পুত্রকে নিয়ে এত গর্বিত আর কোন পিতা ছিল না।

এই ছোট্ট ছেলের উদ্যমের তুলনায় আমরা কোথায়! আমরা কতজন এই বালকের মত সকল পরিস্থিতিতে দাওয়াতের আকাঙ্খা করি!

শিক্ষা : গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়টি সুস্পষ্ট। আমরা অনেক সময় দাওয়াতী কাজে অনাগ্রহবশত অযুহাত পেশ করি। কখনো কখনো আশানুরূপ ফলাফল দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু সর্বাবস্থায় সংস্কারের চেতনা নিয়ে দাওয়াত পেঁŠছে দেওয়াই প্রকৃত দাঈ ইলাল্লাহর বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ যখন ইচ্ছা দাওয়াত কবুল করে তঁার বান্দাকে হেদায়াত দান করবেন। তখন তা আমাদের জন্য মূল্যবান লাল উট তথা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ অপেক্ষা উত্তম বলে গণ্য হবে। আমাদের দায়িত্ব শুধু নিয়মিত দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখা এবং আল্লাহর নিকট খালেছ অন্তরে দো‘আ করা। আল্লাহ আমাদের প্রকৃত দাঈ ইলাল্লাহ হওয়ার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[গল্পটি আরবী ভাষা থেকে অনূদিত।]




আরও