মানব জীবনে ইসলামী আক্বীদার প্রভাব

সানাউল্লাহ নজির আহমদ 9041 বার পঠিত

ইসলামী আক্বীদার রয়েছে এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস, যা অন্য কোনো ইজম বা বিশ্বাসের নেই। এ আক্বীদা ক্ষণিকের মধ্যেই ঘুরিয়ে দিয়েছে মানুষের গতিপথ, পাল্টে দিয়েছে তাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি। মুহূর্তে উন্নীত করেছে পৌত্তলিকতা থেকে একত্ববাদে, কুফর থেকে ইসলামে। মুক্ত করেছে মানুষের আনুগত্য আর দাসত্ব থেকে।

ইসলামী আক্বীদার মৌলিক দিকগুলো হচ্ছে : আল্লাহ, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, রাসূল, পরকাল ও তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা মানব জীবনে এ আক্বীদার প্রভাব ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

মুসলিম জাতির ওপর আল্লাহর অশেষ করুণা যে, তিনি তাদের মনোনীত ধর্মের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস দান করেছেন। যে কারণে এ ধর্ম ও তার আক্বীদা কিছু প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতা আর ধারণাপ্রসূত বিধি-বিধানে আবদ্ধ নয়; বরং ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ভর দীপ্যমান এক মহা জীবনাদর্শ।

এ কথা কারো কাছে অস্পষ্ট নেই যে, মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, আবার মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম যে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। এ উত্তম কাজটি সম্পাদন করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি নিজ নিজ জ্ঞান, ধর্ম, মত ও পরিসরের মধ্যে থেকে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যা কখনো সফলতা বয়ে এনেছে, কখনও বা হিতে বিপরীত হয়েছে। এদিক থেকে ইসলামের কোনো জুড়ি নেই। কারণ ইসলাম মানব কল্যাণের জন্য পরিকল্পিত, নিখুঁত ও সুন্দর একটি বিধান দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের (কল্যাণের) জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (আলে ইমরান ১১০)

ইসলাম একমাত্র ধর্ম যার আদ্যপান্ত কল্যাণ আর কল্যাণ। কী ইহকালীন কী পরকালীন, কী শারীরিক, কী আত্মিক সব বিষয়ে ও সর্বক্ষেত্রে তার রয়েছে মানব কল্যাণের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদা, নিশ্চিত সিদ্ধান্ত ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। যার মূল হচ্ছে কুরআন ও হাদীছ। এরই উপর পরিচালিত হয়েছেন মুসলিম মিল্লাতের প্রথম কাফেলা ছাহাবায়ে কেরাম। এঁরাই হলেন মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা নিজ জীবনে কুরআন ও সুন্নাহ বাস্তবায়ন করেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন তাতে বর্ণিত আক্বীদা ও বিশ্বাসে। তাই মানবীয় জীবনে ইসলামী আক্বীদার প্রভাব প্রত্যক্ষ করার জন্য উম্মতের প্রথম সারির মানুষদের জীবনাচার ও কর্মধারা পর্যালোচনা করাই যথেষ্ট হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

তাওহীদ : এটি ইসলামী আক্বীদার মূল ভিত্তি। ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, মানব জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব সৃষ্টিকারী হচ্ছে এ তাওহীদ। এ আক্বীদা গ্রহণকারী একজন মানুষ যে পরিমাণ ত্যাগ ও কঠিন কর্ম সম্পাদন করতে পারে, তা এ আক্বীদাশূন্য অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তাওহীদের প্রভাব সে ব্যক্তির মধ্যেই বিকশিত হবে, যে একে আলিঙ্গন করবে এবং এর রঙে রঙিন হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি ব্যাটারী বিদ্যুৎ থেকে যে পরিমাণ চার্জ সংগ্রহ ও ধারণ করতে পারবে, সে সে পরিমাণ-ই দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এটাই খাঁটি তাওহীদে বিশ্বাসী একজন পূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তির উদাহরণ। যে ব্যক্তি ইসলামী আক্বীদা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এবং প্রাণবন্তভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে, সেই হচ্ছে শাশ্বত দীক্ষায় দীক্ষিত প্রকৃত মুসলমান।

ইসলাম তার প্রথম যুগের অনুসারীদের দ্বারা যে দৃষ্টান্ত পেশ করেছে, তা সমগ্র মানব ইতিহাসে বিরল ও দুর্লভ। যা শুধু আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী কিংবা এদের মত উজ্জ্বল কতক নক্ষত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, যদিও তারা গৌরবময় মানব ইতিহাসের মধ্যমণি। তদুপরি তারা ছাড়াও হাযার ব্যক্তি ও উদাহরণ বিদ্যমান রয়েছে। ইতিহাস যাদের উপাখ্যান লিপিবদ্ধ করতে অক্ষম-অপরাগ। বোধ করি এ কারণেই ঐতিহাসিকগণ এ জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাস আদ্যপান্ত লিপিবদ্ধ করার পরিবর্তে শুধু ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে এক পর্বে থেকে অন্য পর্বের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে এ আকীদার উর্বর ভূমি থেকে এ ধরনের অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত বিকশিত হওয়া স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছিল। যেমন দেখা যায়- একজন মুজাহিদকে যিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য নিজ হাতে বিদ্যমান কয়েকটি খেজুর এ বলে ফেলে দিয়েছিলেন, ‘এগুলো খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার জন্য দীর্ঘ জীবনের আশা করা বৈকি’। অতঃপর তা নিক্ষেপ করে শাহাদাতের অদম্য স্পৃহায় যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে শাহাদাতের স্বর্গীয় সুধা পান করে পার্থিব জীবনের ইতি টানেন।

যানবাজ আরেক লড়াকু মুজাহিদ যিনি পারস্যের মোকাবিলায় জিহাদের জন্য বর্ম পরিধান করেন, অন্য সাথীরা বর্মে ছিদ্র দেখে সাবধান করে তা পাল্টাতে বললেন। উত্তরে তিনি হেসে বলে বললেন, এ ছিদ্রজনিত আঘাতে মারা গেলে অবশ্যই আমি আল্লাহর কাছে আদৃত হব। এরপর বিলম্ব না করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সে ছিদ্র দিয়ে হঠাৎ আঘাত হানে একটি তীর, ফলে সহাস্যবদনে সেখানেই তিনি শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেন। শাহাদাতের স্বতঃস্ফূর্ত আলিঙ্গনে এভাবেই তিনি আল্লাহর পানে ছুটে চলেন।

মানব কল্যাণ, পরার্থপরতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিবিধ ক্ষেত্রে এরূপ অনেক নযীর রয়েছে, যা অন্য আক্বীদায় বিশ্বাসী কোন মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না। ইতিহাস এমন নযীর গড়তে ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

এ পর্যায়ে আমরা মুসলিম উম্মাহর জীবন থেকে নেয়া কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে এ আক্বীদার প্রভাব ও কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করব। প্রসঙ্গত: যারা একে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাও যে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও কিছু উল্লেখ করার চেষ্টা হল।

১. ইসলামী আক্বীদার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে, আল্লাহভীতি ও ক্বিয়ামত দিবসের বিশ্বাস। এর ফলে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয়, সর্বক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নিজ দায়িত্ববোধ সদা জাগ্রত থাকে। উদাহরণস্বরূপ ওমর (রাঃ)-এর কথা উল্লেখ করা যায়, তিনি ছিলেন খলীফাতুল মুসলিমীন। তিনি আল্লাহভীতি ও নিজ দায়িত্ববোধ থেকে বলেছিলেন, ‘ইয়ামানের সানআ‘তেও যদি কোন গাধার পা পিছলে যায়, তাহলে সে ব্যাপারে আমিই দায়ী, কেন তার রাস্তা সমতল করে দেইনি।’

২. এ আক্বীদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা নিজ জান ও মালের মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের যে নমুনা পেশ করেছেন, তার দৃষ্টান্তও বিরল। এর ওপর নির্ভর করেই জগৎ সংসারে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সামান্য অস্ত্র ও সীমিত জনবল দিয়েই বিপুল অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত, দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশী শত্রু বাহিনীর মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য বিজয় অর্জন করেছেন।

৩. এ আক্বীদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছেন, তারই সুবাদে এক সময় এ বসুন্ধরার সর্বত্র নিরাপত্তাময় পরিবেশ বিরাজমান ছিল।

৪. সামাজিক নিরাপত্তামূলক তহবিল গঠন। এ আক্বীদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা সামাজিক নিরাপত্তামূলক তহবিল গঠন করেছেন। যার ফলে পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। ঐক্য ও সম্মিলিত শক্তি বিনষ্টকারী মানবিক ব্যাধি হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব হয়েছে। পরার্থপরতা ও সহমর্মিতার সুবাতাস বয়ে বেড়িয়েছে পুরো ইসলামী সমাজে। যা আমরা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করি বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াকফকৃত দান-অনুদানের ভেতরে।

৫. পারস্পরিক চুক্তির যথাযথ সংরক্ষণ। মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে যতটুকু এগিয়ে পূর্ণ মানব ইতিহাসে তার কোন দৃষ্টান্ত নেই ।

৬. ধরাপৃষ্ঠে ইনছাফের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। যা কোন জাতির ইতিহাসে বিদ্যমান নেই। তারা স্বজনপ্রীতি ও সর্বপ্রকার স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে গরীব-ধনী, ছোট-বড়, মুসলিম-অমুসলিমদের মাঝে যে ন্যায়বিচার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করেছে, তার কোন দৃষ্টান্ত ইতিহাস আজও পর্যন্ত পেশ করতে পারেনি।

৭. ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার হেফাযত। তারা অমুসলিমদের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক যে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন, তার নজির খোদ অমুসলিম রাষ্ট্রেও অনুপস্থিত।

৮. ইসলামী সমাজের আদর্শ ও ভাবমূর্তির যথাযথ সংরক্ষণ। ইসলামী সমাজে মাদকদ্রব্য, অনৈতিক কার্যকলাপের কোন প্রশ্রয় নেই। যে কারণে ইতিহাস সাক্ষ্য দিতে বাধ্য, মুসলিম সমাজে অন্য যে কোন সমাজের তুলনায় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার উপস্থিতি ছিল একেবারেই গৌণ। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত বর্তমান পাশ্চাত্য বিশ্ব যেসব মরণব্যাধি, যেমন এইডস, গণরিয়া, সিফিলিস ইত্যাদিতে আক্রান্ত, তার সিকি ভাগও মুসলিম সমাজে বিদ্যমান নেই। যদি কোথাও তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তাও তাদের অনুসরণে অভ্যস্ত, তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার ও সমাজে সীমাবদ্ধ।

৯. ইসলামী আক্বীদায় বিশ্বাসী মুসলিম জাতির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মচাঞ্চল্যতার বৃদ্ধি ঘটে। যার প্রমাণ ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় স্বল্পতম সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রসার। সঙ্গে সঙ্গে আরবী ভাষারও    বিস্তার।

১০. ইসলামী আক্বীদায় বিশ্বাসী জাতির মধ্যে জ্ঞান আহরণ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যার প্রমাণ মুসলিম জাতির কুরআন ও হাদীছের ব্যাপক চর্চা। আরো প্রমাণ, তাদের বিজ্ঞানকে থিওরিগত বিদ্যা থেকে বের করে বাস্তব ও অভিজ্ঞতাপূর্ণ বিদ্যায় রূপান্তরকরণ। তাদের আবিষ্কার ছিল বাস্তবভিত্তিক, বস্ত্তনিষ্ঠ ও প্রমাণিত। ব্যক্তি ও দার্শনিকদের নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

১১. এ আক্বীদার ফলে বিশ্বব্যাপী ইসলামী সভ্যতার আন্দোলন ঘটে। যে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শারীরিক ও আত্মিক সাধনার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। ইহকাল ও পরকালের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করা।

১২. বিশ্বময় দেশ ও জাতির মধ্যে ঐক্যের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করা। যার মূলভিত্তি ছিল এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস। তার মধ্যে ছিল না কোন ভাষা, বংশ ও জাতির ভেদাভেদ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা এক  দেশ থেকে অন্য দেশে বিচরণ করেছে, তাতে ছিল না কোন বাধা, ভিসা কিংবা নিরাপত্তার নামে অন্য কোন হয়রানি। তাদের মধ্যে ছিল না কোন পরদেশির ভাবনা। অথচ তাদের সরকার ভিন্ন, দেশ ভিন্ন। আবার কোন কোন দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও এক আক্বীদার ফলে পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অটুট ছিল।

এ হ’ল ইসলামী আক্বীদায় গঠিত ও এর রঙে রঙ্গিন মুসলিম জাতির বর্ণিল ইতিহাস। ইসলামী সমাজের সামান্য নমুনা। সংক্ষেপে বলতে পারি, এ আক্বীদার দ্বারা এমন একটি জাতি তৈরি হয়, যারা হয় বিশ্বস্ত-আমানতদার, সৎ-নীতিবান, আল্লাহভীরু ও মানবতার কল্যাণকামী। আরো একটু ব্যাপক করে বলা যায়, তারা আল্লাহর খাঁটি আবেদ-আনুগত্যশীল, তারা নিজ কর্ম, চিন্তা-চেতনা, বোধ ও অনুভূতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণকারী। পূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে উচ্চারণ করে,إِنَّ صَلَاتِىْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ. لَا شَرِيْكَ لَهُ ‘নিশ্চয় আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্ল­াহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব, তাঁর কোনো শরীক নেই’ (আন‘আম ১৬২-৬৩)

যে ব্যক্তি জাগতিক চাহিদার ওপর আপন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম; প্রতিমা ও দেবদেবীর পূজা-অর্চনা ত্যাগ করে এক আল্লাহর এবাদত-আনুগত্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম; স্বীয় চাল-চলন, চিন্তা-গবেষণা ও পার্থিব জগতের উন্নয়নে বোধ-বুদ্ধির ভারসাম্য রক্ষায় যত্নশীল, একমাত্র সে-ই পারে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে পাথেয় বানাতে।

অমুসলিমদের ওপর ইসলামী আক্বীদার প্রভাব :

যারা ইসলামী আক্বীদা গ্রহণ করেনি; বরং বিরোধিতা করেছে সর্বতোভাবে, ক্রুসেডসহ অন্যান্য যুদ্ধে ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর বারবার পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেই পশ্চিমা গোষ্ঠীর ইসলাম ও মুসলমান থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।

মধ্যযুগের পতনোম্মুখ ইউরোপ আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মানুষের অন্তরাত্মায় ক্ষমতাসীন রাজত্বের প্রভাব ও মহিমা ধরে রাখতে সরকার ও পুরোহিতগণ গলদঘর্ম হচ্ছিল। রাজ্যগুলো ছিল প্রদেশ কেন্দ্রিক, খন্ড-খন্ড। নিজেদের মাঝে ছিল না কোন মিলন সূত্র। অথচ সম্পূর্ণটাই ছিল খৃষ্টরাজ্য। কারণ প্রাদেশিক সরকার নিজ রাজত্বে স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্রীয় ও বিচার-বিভাগীয় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল।

এরই মধ্যে তাদের সুযোগ হয় ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের ও আদান-প্রদানের। কখনো সন্ধির ফলে, যেমন মুসলিম স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি দ্বীপ ও অন্যান্য দেশের সাথে। আবার কখনো যুদ্ধের ফলে, যেমন ক্রুসেড। এ ধরনের শান্তিচুক্তি ও যুদ্ধের ফলে ইউরোপ ইসলামের সংস্পর্শে আশার সুযোগ লাভ করে। তাদের আরো সুযোগ হয় ইসলাম সম্পর্কে জানার ও পর্যালোচনা করার। তারা কিভাবে ইসলাম সম্পর্কে জেনেছে ও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, নিম্নে তার কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল :

১. ইসলামের সংস্পর্শে এসে ইউরোপ ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করে। তারা স্বয়ং সাইন্টিফিক গবেষণায় ইসলামের প্রায়োগিক পদ্ধতি উদ্ভাবন ও অবলম্বন করে। তার উপর ভিত্তি করেই তাদের বর্তমান বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা।

২. তারা ইউরোপকে এক ও ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য ইসলামী খেলাফত পদ্ধতি অবলম্বন করে। কারণ তারা লক্ষ্য করেছে ইসলামের খেলাফত পদ্ধতির দ্বারাই পুরো মুসলিম বিশ্ব এক ও অভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তবে সেটি সঠিক বিশ্বাস ও নির্ভুল আক্বীদার উপর নির্ভরশীল নয় বলে তারা সফলতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। কারণ তাদের আক্বীদা ভ্রান্ত এবং তাদের পুরোহিতরাও ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে তারা পুরো ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য জাতীয়তাবাদকে প্রধান্য দেয় এবং ঐক্যের ভিত্তি হিসাবে একেই বেছে নেয়। আজ পর্যন্ত সে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। মূলত: তারা এ নীতিও ইসলাম থেকে শিখেছে।

৩. কালফন, মার্টিন লুথার ও অন্যান্য ব্যক্তিরা ইসলামের স্পর্শে এসে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান আক্বীদাগত ও গীর্জার ভ্রান্তিগুলো দূর করতে সচেষ্ট হয়। এজন্য বিভিন্ন আন্দোলনেরও সূচনা করে। তবে তাদের মধ্যে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা ও অশ্লীলতার কারণে সফলতা খুব বেশি একটা দেখা যায়নি। কারণ সংস্কার ও সংশোধনের সঠিক পথ ইসলামকে তারা গ্রহণ করেনি।

৪. ইসলামের স্পর্শে এসে তারা ইসলামী বিদ্যাপীঠগুলোর নিয়ম-পদ্ধতি ও সিলেবাস রপ্ত করে এবং সে অনুসারে নিজেদের শিক্ষাঙ্গনে সংস্কার এনে সেখানে ইসলামী পদ্ধতির বাস্তবায়ন করেন।

৫. তারা মুসলমানদের বিচক্ষণতা, দুঃসাহসিকতা ও সাহসী অভিযান প্রত্যক্ষ করে নিজেদেরকে সেভাবে গড়তে শুরু করে। সাথে সাথে মুসলমানদের ন্যায় অশ্বারোহণ বিদ্যা শিক্ষা করে নিজেদের মাঝে তার বাস্তবায়নও ঘটায়।

৬. ‘কুরআনুল কারীম’ মুসলমানদের সংবিধান। এটা আল্লাহর বাণী এবং তার অনুমোদিত একমাত্র বিধান। এতে কোন ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি; বরং এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সবার স্বার্থ ও কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তারা এ কুরআনের পদ্ধতি থেকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সংবিধান রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যা আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বিদ্যমান। তারা মালেকী ফিক্বহ থেকে নগর উন্নয়নের অনেক নীতি-ই গ্রহণ করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য- ফ্রান্স। ফ্রান্সের নগর উন্নয়নের অধিকাংশ নীতি ও নিয়ম গ্রহণ করা হয়েছে মালেকী ফিক্বহ থেকে।

৭. তারা ইসলামী নির্মাণ কৌশল ও স্থাপত্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয় ব্যাপকভাবে। তাইতো ধর্মীয় ও সাধারণ প্রাসাদসমূহে ইসলামের নির্মাণ কৌশল অনুপুঙ্খ অনুসরণ করে। তারা ইসলামের নিখুঁত পদ্ধতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন : ঘরের সঙ্গে বাথরুম নির্মাণ ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য গোসল করা। মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার পূর্বে ইউরোপে এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না।

৮. ভৌগলিক রূপরেখা প্রণয়নেও তারা ইসলাম থেকে উপকৃত হয়েছে। ইসলামী মানচিত্র দেখে সে অনুপাতে নিজেরা নিজেদের মানচিত্র প্রণয়ন করে এবং তার মধ্যে ব্যাপক উন্নতি সাধনে ভূমিকা রাখে।

মোটকথা ইউরোপ তার বর্তমান প্রগতি ও উন্নতির মূল রসদ গ্রহণ করেছে ইসলাম থেকে। যদিও বর্তমান যুগে স্বার্থান্ধতায় ইসলামকে তারা দূরে নিক্ষেপ করেছে।

প্রশ্ন হল : বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে কিংবা তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে এর কোন প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। তাহলে কী ইসলামী আক্বীদা স্বীয় ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলল?

কস্মিনকালেও নয়। ইসলাম কোন অংশেই তার কর্মক্ষমতা ও কার্যকারিতা হারায়নি। কারণ ইসলাম সর্বযুগের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত চিরন্তন জীবনবিধান। একমাত্র এর মাধ্যমেই মানবজাতি সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে এবং রাখতে পারে প্রতি পদে সাফল্যের শাশ্বত স্বাক্ষর।

তবে মূল ব্যাপার হল : এটি তখনই কাজ করবে মানুষ যখন নিষ্ঠাবানচিত্তে এ আক্বীদার বাস্তবায়ন করবে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হচ্ছে: إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوْا مَا بِأَنْفُسِهِمْ  আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (রা‘দ ১১)।

এ হল আল্লাহর বিধান, যার কোন পরিবর্তন নেই। প্রচেষ্টা ব্যতীত এবং উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা ছাড়া কখনো মানুষের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। মানুষের জীবন অধ্যায় পরিচালনার জন্য ইসলামী আকীদার ন্যায় সফল অন্যকোন চালিকাশক্তি নেই। কিন্তু সে তাকে-ই পরিচালনা করবে যে ইসলামকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ  করবে, তার প্রতি মনোনিবেশন করবে এবং বাস্তব জীবনে তার    বাস্তবায়ন কল্পে জীবন-মরণ পণ করবে। যেমন বিদ্যুৎ উপাদন কেন্দ্র। সর্বদাই সে সক্রিয় কিন্তু যদি কোন সংযোগ দানকারী না থাকে, তবে কি উপকারে আসবে? অথবা মনে করুন সে সক্রিয়। কিন্তু কেউ যদি তা থেকে শক্তি সঞ্চয় না করে তবে কি লাভ হবে? আমরা কি বলব- বিদ্যুৎ প্রভাব শূন্য হয়ে গেছে? না-কি বলব- মানুষ তার ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে?

এ হল ইসলামী আক্বীদার উদাহরণ। আর সেসব মুসলমানদের উদাহরণ যারা নামে মাত্র ইসলামের অনুসরণ করে। যে ইসলাম দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের পরিবাহক তারা সে ইসলামকে প্রয়োগ করে না, তার প্রতি ধাবিত হয় না। ফলে তাদের জীবন পতনোন্মুখ। আবার কখনো এর থেকে উত্তরণের চিন্তা করলেও সত্যিকারার্থে ত্রাণকর্তার দিকে দৃষ্টি দেয় না। বরং যে পথ পতন ত্বরান্বিত ও গভীর করবে, তার প্রতি-ই ধাবিত হয়।

মুসলমানের সময় এসেছে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের এবং তার মনোনীত ইসলামের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের। তাদের সময় এসেছে বাস্তব ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করার। শয়তানের আছরকৃত ব্যক্তির ন্যায় এদিক-সেদিক ঘুরা ফিরা ছেড়ে, ইসলাম থেকেই জীবনের সঠিক রূপরেখা গ্রহণ করা। যার উপর নির্ভর করে এগুবে অভীষ্ট লক্ষ্যপানে।

তবে মুসলিম যুবকদের ভেতর ইসলামী পুনর্জাগরণের যে ধারা দুনিয়াজুড়ে বিরাজ করছে, অদূর ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি শুভ সংবাদ। যদিও এ ভবিষ্যত প্রচুর ত্যাগ-তিতীক্ষা আর কুরবানীর দাবীদার।

তবে যারা দ্বীন পরিত্যাগ করেছে কিংবা দ্বীন থেকে নিজেকে চিরতরে মুক্ত করে নিয়েছে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদা প্রযোজ্য নয়। বরং তাদের উপর প্রযোজ্য হবে আল্লাহর এ বাণী-وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوْا أَمْثَالَكُمْ - যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতির সৃষ্টি করবেন যারা তোমাদের মত হবে না’ (মুহাম্মাদ  ৩৮)

পক্ষান্তরে যারা এ দ্বীন আঁকড়ে আছে, এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তারা অতি সত্বর আল্লাহর ওয়াদা প্রত্যক্ষ করবে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎ কর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীর শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না (নূর  ৫৫)।’



আরও