পরহেযগারিতা (৩য় কিস্তি)

মুহাম্মাদ হাফীযুর রহমান 518 বার পঠিত

পরহেযগারিতা অবলম্বনে যে যে সফলতা অর্জিত হয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى’ ‘অবশ্যই সফলতা অর্জন করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে’ (আ‘লা ৮৭/১৪)। আল্লামা ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘عَمِلَ وَرِعًا’ ‘মুত্তাক্বী হিসাবে আমল করবে’।[1] 

মুসা ইবনে হাম্মাদ (রহঃ) বলেন, رَأَيْتُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيْ فِي الْمَنَامِ فِي الْجَنَّةِ يَطِيْرُ مِنْ نَخْلَةٍ إِلٰى نَخْلَةٍ وَمِنْ شَجَرَةٍ إِلٰى شَجَرَةٍ فَقُلْتُ يَا أَبَا عَبْدَ اللهِ بِمَ نَلَتْ هَذَا قَالَ بِالْوَرْعِ بِالْوَرْعِ ‘আমি সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ)-কে স্বপ্নে দেখি সে জান্নাতে এ গাছের ডাল থেকে অপর গাছের ডালে এবং এ গাছ থেকে আরেক গাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থা দেখে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আবু আব্দুল্লাহ! তুমি এ ধরনের মান-মর্যাদা বা সম্মান কিভাবে অর্জন করলে? উত্তরে সে বলল, পরহেযগারিতার মাধ্যমে, দ্বীনদারীর মাধ্যমে’।[2]

ক্বিয়ামতের দিন সহজ হিসাব গ্রহণ :

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, عَلَيْكَ بِالزُّهْدِ يَبْصُرُكَ اللهُ عَوْرَاتِ الدُّنْيَا وَعَلَيْكَ بِالْوَرْعِ يُخَفَّفُ اللهُ عَنْكَ حِسَابَكَ ‘তুমি দুনিয়া বিমুখ হও, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে দুনিয়ার সব দুর্বলতা প্রদর্শন করবে। আর তুমি পরহেযগারিতা অবলম্বন কর, আল্লাহ তা‘আলা তোমার থেকে হিসাব নেয়া সহজ করে দিবে। অর্থাৎ যারা যারা পরহেযগারিতা অবলম্বন করেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের দুনিয়াতেও সুখী জীবন দান করেন এবং আখেরাতেও তাদের হিসাবকে সহজ করে দিবে’।[3]

অধিক বরকত ও ছওয়াব অর্জন :

ইউসুফ ইবনে আসবাত্ব (রহঃ) বলেন, يِجْزِىْ قَلِيْلُ الْوَرْعِ عَنْ كَثِيْرِ الْعَمَلِ وَيَجْزِيْ قَلِيْلُ التَّوَاضُعِ عَنْ كَثِيْرِ الْاِجْتِهَادِ ‘অধিক আমল করা হতে সামন্য তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা অর্জন করা যথেষ্ট’।[4]

একজন ব্যক্তি আবু আব্দুর রহমান আল-‘আমরীকে বলল, عَظَّنِيْ فَأَخَذَ حَصَاةً مِنَ الْأَرْضِ فَقَالَ مِثْلَ هَذَا وَرْعُ يَدْخُلُ فِيْ قَلْبِكَ خَيْرٌ لَكَ مِنْ صَلَاةِ أَهْلِ الْأَرْضِ ‘তুমি আমাকে ওয়ায কর! এ কথা শুনে যমীন থেকে একটি পাথর নিল এবং বলল, এ পাথরের টুকরা পরিমাণ পরহেযগারিতা বা তাক্বওয়া তোমার অন্তরে প্রবেশ করা সমস্ত যমীনবাসীর ছালাত হতে উত্তম’।[5]

পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হওয়া :

আত্মার সংশোধন একটি যরূরী বিষয়। আত্মার সংশোধন ছাড়া একজন মানুষ কখনই পরহেযগার হতে পারে না। অর্থাৎ যখন মানুষ পরহেযগার হবে না তখন তাকে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। তবে মানুষ যখন পরহেযগার হয়, তখন সে অন্যের সংশোধনের পূর্বে নিজের সংশোধন নিয়েই অধিক ব্যস্ত হয়।

ইবরাহীম বিন দাউদ বলেন,

وَالمَرْءُ إِنْ كَانَ عَاقِلاً وَرِعًا + أَخْرَسَهُ عَنْ عُيُوبِهِمْ وَرَعُهْ

كَمَا السَّقِيْمُ المَرِيْضُ يُشْغِلُهُ + عَنْ وَجَعِ النَّاسِ كُلِّهِمْ وَجَعُهْ

‘যদি কোন মানুষ জ্ঞানী ও মুত্তাক্বী হয়, তার তাক্বওয়া তাকে মানুষের দোষত্রুটি নিয়ে মন্তব্য বা সমালোচনা করা হতে বোবা বানিয়ে দেয়। যেমন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তার ব্যথা-বেদনা অন্যান্য মানুষের ব্যথা-বেদনা নিয়ে চিন্তা করা হতে বিরত রাখে’।[6] বিলাল ইবনে সা‘ঈদ (রহঃ) বলেন, وَرْعُ مُؤْمِنُ لَمْ يَدَعْهُ حَتَّى يَنْظُرَ مَاذَا نَوَىٰ فَإِذَا صَلُحَتْ النِّيَةُ فَبِالْحَرِي أَنْ يَّصْلُحَ مَا دُوْنَهُ ‘তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ছাড়বে না যতক্ষণ না সে কি নিয়ত করে তা দেখে নিবে। যখন কোন বান্দার নিয়ত সঠিক হবে, তখন তার পরবর্তী সব আমল সঠিক হবে। আর যদি নিয়ত সঠিক না থাকে, তখন তার আমলও সঠিক থাকবে না’।[7]

সন্দেহমুক্ত জীবন লাভ :

আবু আব্দুল্লাহ আল-ইনত্বাকী (রহঃ) বলেন, مَنْ خَافَ صَبَرَ وَمَنْ صَبَرَ وَرَعَ وَمَنْ وَرَعَ أَمْسَكَ نَ الشُّبْهَاتَ ‘যে ভয় করে সে ধৈর্য ধারণ করে, আর যে ধৈর্য ধারণ করে সে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে, আর যে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে সে সন্দেহ থেকে বিরত থাকে’।[8]

দো‘আ কবুলের কারণ :

মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসে‘ (রহঃ) বলেন, قَالَ مُحَمَّدُ بْنِ وَاسِعٍ يَكْفِيْ مِنَ الدُّعَاءِ مَعَ الْوَرْعِ الْيَسِيْرُ كَمَا يَكْفِيَ القَدْرُ مِنَ الْمِلْحِ ‘পরহেযগারিতার সাথে সামান্য দু‘আই যথেষ্ট যেমন খাওয়ার সাথে সামান্য লবনই যথেষ্ট’।[9]

উপকারী ইলমের অধিকারী হওয়া :

আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) বলেন, لَا يُتِمَّ طَلَبَ الْعِلْمِ إِلَّا بِأَرْبَعَةٍ أَشْيَاءٍ بِالْفَرَاغِ وَ الْمَالِ وَ الْحِفْظِ وَ الْوَرْعِ ‘চারটি বিষয় ব্যতীত পরিপূর্ণ ইলম অর্জন করা যায় না। চারটি বিষয় হল, (১) ইলম অর্জনের জন্য নিজেকে ফারেগ বা পৃথক করা। (২) টাকা-পয়সা। (৩) স্মরণশক্তি। (৪) তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা’।[10]

আল্লামা কানূজী (রহঃ) বলেন, لَا بُدَّ لِلْعَالِمِ مِنَ الْوَرْعِ لِيَكُوْنَ عِلْمٰهُ أَنْفَعُ وَفَوَائِدِهِ أَكْثَرُ ‘একজন আলেমের জন্য যরূরী হল, তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা। যখন একজন আলেমের মধ্যে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা থাকবে তখন তার ইলমের উপকারীতা বেশি হবে।[11]

সত্য প্রকাশে সহায়ক :

সুফিয়ান ছাওরী বলেন, مَا خَالَفَتْ رَجُلًا فِي هَوَاهُ إِلَّا وَجَدَتْهُ يَغْلَى عَلٰى ذَهْبِ أَهْلِ الْعِلْمِ وَالْوَرْعِ ‘আমি যখনই কোন মানুষের নফসের চাহিদার বিরোধিতা করি, তখনই তাকে দেখতে পাই সে আমার উপর বিরক্ত হয়। আসলে বর্তমানে আলেম ও পরহেযগার লোকের খুব অভাব দেখা দিয়েছে’।[12]

আদর্শবান হওয়া :

আব্দুল করীম জাযায়েরী (রহঃ) বলেন, ‘مَا خَاصَمَ وَرْعٌ قَطٌ’ ‘একজন পরহেযগার মানুষ কখনোই ঝগড়া-বিবাদ করে না’।[13]

ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্যের ছোঁয়া :

ফুযায়েল ইবনু আয়ায (রহঃ) বলেন, خَمْسَةٌ مِنَ السَّعَادَةِ الْيَقِيْنُ فِي الْقَلْبُ وَالْوَرْعُ فِي الدِّيْنِ وَالزُّهْدُ فِي الدُّنْيَا وَالْحَيَاءُ وَالْعِلْمُ ‘পাঁচটি জিনিষ সৌভাগ্য লাভের কারণ- (১) অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস, (২) দ্বীনের বিষয়ে পরহেযগারিতা অর্জন করা, (৩) দুনিয়া হতে বিমুখ হওয়া, (৪) লজ্জা করা, (৫) ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা’।[14]

কিভাবে আমরা পরহেযগার হতে পারি?

নিশ্চয়ই পরহেযগারিতা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অনেক বড় নে‘মত। তিনি তার বান্দাদের থেকে যাকে চান তাকেই পরহেযগারিতা দান করেন। পরহেযগারিতা লাভের কতিপয় কারণ রয়েছে যেগুলো একজন বান্দাকে পরহেযগারিতার মর্যাদা পর্যন্ত পৌঁছতে সহযোগিতা করে। তন্মধ্যে কতিপয় সবাব বা কারণ উল্লেখ করা হয়-

ক. নিষিদ্ধ বস্ত্ত থেকে বিরত থাকা :

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, قَالَ عَبْدُ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ اِجْتَنِبْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكَ تَكُنْ مَنْ أَوْرَعَ النَّاسِ ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তা হতে বিরত থাক, তাহলে তুমি বড় পরহেযগার হতে পারবে’।[15]

খ. লেনদেনে পরিচ্ছন্ন হওয়া :

ওমর ইবনুল খাত্তবাব (রাঃ)-এর নিকট একজন লোক এসে কোন একটি বিষয়ে সাক্ষী দিলে তিনি বললেন, আমি তোমাকে চিনি না। আর আমার না চেনায় তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তুমি একজন লোক নিয়ে আসো যে তোমাকে চেনে। এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের একজন বলল, আমি তাকে চিনি। ওমর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে কি হিসাবে চেন? সে বলল, ন্যায়পরায়ণ ও মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসাবে। ওমর (রাঃ) বললেন, সে কি তোমার নিকট প্রতিবেশী? তুমি কি তার রাত-দিন, গোপন-প্রকাশ্য সকল বিষয়ে অবগত? সে বলল, না। তুমি কি তার সাথে টাকা-পয়সার লেনদেন করেছ, যা মানুষের পরহেযগারিতার প্রমাণ? লোকটি বলল, না। ওমর (রাঃ) বললেন, তুমি কি তার সাথে কখনোও সফরে সঙ্গী হয়েছিলে, যার মাধ্যমে চারিত্রিক মাধুর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়? লোকটি বলল, না। তখন তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে জান না। সুতরাং তুমি এমন একজন লোক নিয়ে আস, যে তোমার সম্পর্কে জানে’।[16] সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ)-কে পরহেযগারিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন,

إِنِّي وَجَدْتُ فَلاَ تَظُنُّوا غَيْرَهُ + هَذَا التَّوَرُّعَ عِنْدَ هَذَا الدِّرْهَمِ

فَإِذَا قَدِرْتِ عَلَيْهِ ثُمَّ تَرَكْتَهُ + فَاعْلَمْ بِأَنَّ هُنَاكَ تَقْوَى الْمُسْلِمِ

‘মনে রেখো, আমি দিরহামের নিকট পরহেযগারিতাকে খুঁজে পেয়েছি। এর বাইরে তুমি অন্য কিছুকে ধারণা কর না’। ‘যখন তুমি দিরহাম অর্জনে সক্ষম হলে অতঃপর তা পরিত্যাগ করলে। জেনে রেখো! এখানেই একজন মুসলমানের তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা (লুকিয়ে) রয়েছে’।[17]

অন্য একজন কবি কবিতা আবৃতি করে বলেন,

لَا يَغُرَّنْكَ مِنَ الْمَرْءِ قَمِيْصُ رَقَعَهْ

أَوْ إِزَارًا فَوْقَ كَعْبِ السَّاقِ مِنْهُ رَفَعَهْ

أَوْ جَبِيْنٌ لَاح فِيْهِ أَثَرٌ قَدْ قَلَعَهْ

وَلَدَى الدِّرْهَمِ فَانْظُرْ غَيَّهُ أَوْ وَرَعَهْ

‘যখন কোন মানুষকে তুমি ছেড়া কাপড় পরিধান করতে দেখবে, তাকে তুমি পরহেযগার মনে করে ধোঁকায় যেন না পড়। অনুরূপভাবে যখন তুমি কোন মানুষকে দেখবে সে (পায়ের) গোড়ালির উপর কাপড় পরিধান করে, তখন তাকে তুমি পরগেযগার ধারণা করে, অথবা তার চেহারার মধ্যে এমন কোন আঘাত রয়েছে যা তার পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী বুঝায়, তা দেখে তুমি যেন ধোঁকায় না পড়। তোমাকে একজন মানুষের পরহেযগারিতা পরীক্ষা করতে হলে, তখন সে তাকে কিভাবে গ্রহণ করে। তখন তার পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী প্রাধান্য পায় নাকি তার গোমরাহি প্রাধান্য পায়’।[18]

গ. সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকা :

আবুল আবখাস বিন আত্বা (রহঃ) বলেন, تُوْلَدُ وَرْعَ الْمُتَوَرَّعِيْنَ مِنْ ذِكْرِ الَّذَّرَةِ وَ الْخَرْدَلَةِ وَ أِنَّ رَبَّنَا الذِّيْ يُحَاسِبُ عَلَى الْلَحْظَةِ وَ الْهَمْزَةِ وَ اللِمْزَةَ لَمُسْتَقِصُّ فِي الْمُحَاسِبَةِ وَ أَشَدُّ مِنْهُ أَنْ يُحَاسِبَهُ عَلَى مَقَادِيْرُ الَّذَّرَةِ وَ أَوْزَانُ الْخَرْدَلَةِ وَ مَنْ يَكُنْ هَكَذَا حِسَابَهُ لَحَرَّي أَنْ يَّتَقٰى ‘পরহেযগার ব্যক্তির পরহেযগারিতা সৃষ্টি বা তৈরি হয়, শস্য দানা বা অনুকণাকে স্মরণ করার মাধ্যমে। তাকে জানতে হবে, আমাদের রব যিনি আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ভালো ও মন্দ কর্ম বিষয়ে হিসাব নিবেন। তিনি আমাদের হিসাবের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ছাড় দিবেন না এবং আমাদের হিসাবে কঠোরতা করবেন। তার চেয়ে আরো কঠিন ব্যাপার হ’ল, তিনি তাঁর বান্দাদের থেকে অনুকণা পরিমাণ বা শস্য দানার ওজনের সমপরিমাণ বিষয়েও হিসাব নিবেন। সুতরাং যে বান্দার হিসাবের এ অবস্থা হবে তাকে অবশ্যই হিসাব দেয়ার জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হবে এবং তাকে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আমাদের যাবতীয় কর্মের হিসাব নিবেন সেদিনের জন্য প্রস্ত্তত হ’তে হ’লে আমাদের অবশ্যই দুনিয়াতে পরহেযগার হ’তে হবে। হালাল হারাম বেঁচে চলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার আদেশ নিষেধের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে’।[19]

আবু আব্দুল্লাহ আল-ইনত্বাকী (রহঃ) বলেন, ‘اَلْخَوْفُ يَكْسِبُ الْوَرْعَ’ ‘আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার মাধ্যমে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা অর্জিত হয়।[20] ইয়াহইয়া ইবনে মা‘আয (রহঃ) বলেন, اَلْوَرْعُ مِنْ ثَلَاثِ خِصَالٍ مِنْ عِزِّ النَّفْسِ وَصِحَّةِ الْيَقِيْنِ وَتَوَقَّعُ الْمَوْتِ ‘তিনটি অভ্যাসের চর্চা দ্বারা পরহেযগারিতা অর্জিত হয়। (১) আত্মমর্যাদা, (২) সঠিক বিশ্বাস ও (৩) মৃত্য সংঘটিত হওয়ার অনুভূতি’।[21]

ঘ. সুন্নাতের অনুসরণ এবং বিদ‘আত বর্জন

আল্লামা আওযা‘ঈ (রহঃ) বলেন,لَقَدْ كُنَّا نَتَحَدَّثُ أَنَّهُ مَا اِبْتَدَعَ رَجُلٌ بِدْعَةً إِلَّا سُلِبَ وَرْعُهُ ‘আমরা আমাদের যুগে এ আলোচনা করতাম যে, যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আতে লিপ্ত হয়, তখন তার তাক্বওয়া-পরহেযগারিতাকে ছিনিয়ে নেয়া হয়’।[22]

আবু মুযাফফার আস-সাম‘আনী (রহঃ) আহলে কালামীদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, وَهَلْ رَأىٰ أَحَدٌ مُتَكَلِّمًا أَدَاهُ نَظْرَهُ وَكَلَامُهُ إِلَى تَقْوَى فِي الدِّيْنِ أَوْ وَرْعٌ فِي الْمُعَامَلَاتِ أَوْ سِدَادُ فِي الطَّرِيْقَةِ أَوْ زُهْدٌ فِي الدُّنْيَا أَوْ إِمْسَاكَ عَنْ حَرَامٍ أَوْ شُبْهَةٍ أَوْ خُشَوْعٍ فِي عِبَادَةٍ أَوْ اِزْدَيَادُ فِي طَاعَةٍ أَوْ تَوَرَّعُ مِنْ مَعْصِيَةِ إِلَّا الشَّاذَ النَّادِرَ ‘কোন কালামীকে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি, তার কালাম (কথা) ও চিন্তা-চেতনা তাকে দ্বীনের ব্যাপারে পরহেযগারিতার দিকে নিয়ে গেছে অথবা তারা পারস্পারিক আদান-প্রদানে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করছে। অথবা চলার পথে তারা ভুল পথ ছেড়ে দিয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করছে এবং দুনিয়ার মায়া ছেড়ে দিয়ে পরকালমুখী হয়েছে; বা কোন হারাম ও সন্দেহযুক্ত বস্ত্ত হ’তে বিরত থাকছে। তারা তাদের ইবাদত বন্দেগীতে ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা অবলম্বন করার কোন দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। আর তাদের কালাম বা কথা আল্লাহ তা‘আলা প্রতি আনুগত্যটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে অথবা তার কালাম তাকে কোন নাফরমানী বা অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখছে এরকম কোন নযীর তারা প্রমাণ করতে পারেনি’।[23]

ঙ. ইলম অনুযায়ী আমল করা :

সাহল ইবনে আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন,إِذَا عَمِلَ الْمُؤْمِنٌ دَلَّهُ عَلَى الْوَرْعِ فَإِذَا تَوَرَّعَ صَارَ قَلْبُهُ مَعَ اللهِ ‘যখন কোন মুমিন ব্যক্তি তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, তখন তার ইলম তাকে পরহেযগারিতার পথ দেখাবে। আর যখন সে পরহেযগারিতা অবলম্বন করবে, তখন তার অন্তর আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পৃক্ত হবে’।[24]

চ. দুনিয়া বিমুখ হওয়া :

আবু জা‘ফর আস-ছাফফার (রহঃ) বলেন, مِنَ الْبَصْرَةِ حَرَامٌ عَلٰى قَلْبِ يَدْخُلُهُ حُبُّ الدُّنْيَا أَنْ يَدْخُلُهُ الْوَرْعُ الْخَفِيُّ ‘যার অন্তরে দুনিয়ার ভালবাসা প্রবেশ করেছে, তার অন্তরে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা প্রবেশ করা হারাম’।[25] আবু জাফর আল-মিখওয়ালী (রহঃ) বলেন,حَرَامٌ عَلٰى قَلْبِ صَحِبَ الدُّنْيَا أَنْ يَّسْكُنَهُ اَلْوَرْعُ الْخَفِيُّ ‘যে অন্তর দুনিয়াকে তার সাথী বানিয়েছে সে অন্তরে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা বসবাস করা হারাম’।[26]

অধিকাংশ মুত্ত্বাকী বা পরহেযগার ব্যক্তিকে দেখা যায়, তারা অভাবী বা ফকীর-মিসকীন। যারা পরহেযগারিতা অবলম্বন করে না তারা সুদখোর, তারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করে এবং হালাল-হারাম বেঁছে চলে না। এ ধরনের লোকদের মধ্যে কাউকে তাক্বওয়া অর্জন করতে দেখা যায় না। তারা সাধারণত দুনিয়াদারী নিয়েই ব্যস্ত থাকে।

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, مَا رَأَيْتُ وَرْعًا قَطُّ إِلَّا مُحْتَاجاً ‘আমি যত পরহেযগার লোককে দেখেছি, তাদের সবাইকে অভাবী দেখেছি’।[27] যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না, সে পরহেযগারিতা বা দ্বীনদারী অবলম্বন করতে পারবে না।

ছ. রাগ থেকে দূরে থাকা :

আবু আব্দুল্লাহ আস-সাজী (রহঃ) বলেন, إِذَا دَخَلَ الْغَضَبُ عَلَى الْعَقْلِ اِرْتَحَلَ اَلْوَرْعُ ‘যখন কোন অন্তরে রাগ প্রবেশ করে, তখন তার অন্তর থেকে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা দূর হয়ে যায়। অর্থাৎ রাগী মানুষ যখন রাগ করে তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলে। ফলে তার মধ্যে তাক্বওয়া অবশিষ্ট থাকে না’।[28]

জ. কম খাওয়া এবং প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা :

ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন, مِفْتَاحُ الزُّهْدِ وَالْعَفَةِ وَالْوَرْعِ قِلَّةُ الْأَكْلِ وَقَمْعِ الشَهْوَةِ ‘দ্বীনদারী ও তাক্বওয়ার চাবিকাঠি হ’ল, কম খাওয়া এবং প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা’।[29]

ঝ. আশা-আকাংখাকে সীমিত রাখা :

ইবরাহীম বিন আদহাম (রহঃ) বলেন, قِلَّةُ الْحَرْصِ وَالطَّمْعِ تُوْرِثُ الصِّدْقَ وَالْوَرْعَ ‘স্বল্প লোভ ও আশা-আকাংখা মানুষের মধ্যে সততা এবং দ্বীনদারী সৃষ্টি করে’।[30]

ঞ. কম কথা বলা

আব্দুল্লাহ ইবনু আবী যাকারীয়াহ (রহঃ) বলেন,مَنْ كَثُرَ كَلَامُهُ كَثُرَ سَقْطُهُ وَمَنْ كَثُرَ سَقْطُهُ قَلَّ وَرْعَهُ وَمَنْ قَلَّ وَرْعَهُ أَمَاتَ اللهَ قَلْبَهُ ‘যার কথা বেশী হবে, তার ভুল-ভ্রান্তি বেশী হবে, তার তাক্বওয়া কমে যাবে। আর যার তাক্বওয়া কমে যাবে, আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরকে নিষ্প্রাণ বানিয়ে দিবেন’।[31]

ত. ঝগড়া পরিহার করা

আওযা‘ঈ (রহঃ) হাকাম ইবনু গায়লান আল-কাইসীর নিকট লিখিত চিঠিতে বলেন,دَعْ مِنَ الْجِدَالٍ مَايُفْتِنُ الْقَلْبُ وَيَنْبِتُ الْضَغِيْنَةَ وَيَجْفٰي الْقَلْبُ وَيْرِقُ الْوَرْعَ فِي الْمَنْطِقِ وَالْفِعْلِ ‘তুমি ঝগড়া-বিবাদ ছেড়ে দাও, যা তোমার অন্তরকে কলুষিত করে, দুর্বলতা তৈরী করে, হৃদয়জগতকে শুকিয়ে দেয় এবং কথা ও কাজের মধ্যে তাক্বওয়া অবশিষ্ট রাখে না’।[32] 

থ. অন্যের চর্চা ছেড়ে দিয়ে নিজের দোষ-ত্রুটির মনোযোগী হওয়া :

ইবরাহীম বিন আদহাম (রহঃ)-কে কিভাবে তাক্বওয়া পূর্ণতা লাভ করবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তুমি তোমার গুনাহের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে চিন্তা কর এবং তোমার প্রভুর নিকট তওবা কর, তাতে তোমার অন্তরে তাক্বওয়া বা দ্বীনদারী প্রতিষ্ঠিত হবে’।[33]

দ. অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করা হতে বিরত থাকা :

সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, مَنْ شَغَلَ جَوَارِحِهِ بِغَيْرِ مَا أَمَرَهُ اللهُ بِهِ حَرَّمَ اَلْوَرْعُ ‘যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়, সে পরহেযগারিতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়’।[34] তিনি আরো বলেন,  مَنِ اشْتَغَلَ بِالْفُضُوْلِ حُرِمَ الْوَرْعَ‘যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে লিপ্ত হয়, সে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা হতে বঞ্চিত হয়’।[35]

ধ. লজ্জাশীল হওয়া :

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, مَنْ قَلَّ حَيَاؤُهُ قَلَّ وَرْعَهُ وَمَنْ قَلَّ وَرْعَهُ مَاتَ قَلْبَهُ ‘যার লজ্জা কম হয়, তার তাক্বওয়া কম হয়। আর যার তাক্বওয়া কম হয়, তার অন্তর মারা যায়’।[36]

(ক্রমশ)

[লেখক : শিক্ষক, ইক্বরা ইসলামিয়া মডেল মাদরাসা, বি-বাড়িয়া ]

[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ১২/৫৪৬।

[2]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-মানামাত ২৭৫; ১/১২৭-১২৮।

[3]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/২০; ইবনু আরাবী, আয-যুহুদ ওয়া ছিফাতুয যাহিদীন ৩৬; ১/৪৩ পৃঃ।

[4]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/২৪৩।

[5]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/২৮৬; ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ ২৩ পৃঃ।

[6]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘উ হা/২১৮, ২২৩ পৃঃ

[7]. হিলয়াতুর আউলিয়া ৫/২৩০, কিঞ্চিত পরিবর্তিত।

[8]. হিলয়াতুর আউলিয়া ৯/২৯০ পৃঃ।

[9]. শু‘আবুল ঈমান হা/১১৪৯।

[10]. শু‘আবুল ঈমান হা/১৭৩২।

[11]. আবজাদুল ঊলুম ১/২৪৮ পৃঃ।

[12]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/১৯ পৃঃ।

[13]. শু‘আবুল ঈমান হা/৮৪৮৯।

[14]. হিলইয়াতুল আউলিয়া ১০/১১৬ পৃঃ

[15]. শু‘আবুল ঈমান হা/২০১, ইবনে জাওযী (রহঃ) একে ছহীহ বলেছেন।

[16]. বায়হাক্বী, সুনানে কুবরা হা/২০১৮৭, [মা.শা হা/২০৯০১], আলবানী (রহঃ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[17]. কাযবীনী, মুখতাছার শু‘আবুল ঈমান ১/৮৬ পৃঃ।

[18]. ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন ২/৮২ পৃঃ।

[19]. শু‘আবুল ঈমান হা/২৭০[২৮৭] ।

[20]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৯০ পৃঃ।

[21]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/৬৮ পৃঃ।

[22]. আব্দুর রহমান ‘আজলী, আহাদীছ ফী যাম্মিল কালাম ৫/১২৭ পৃঃ।

[23]. আল-ইন্তিছার লি-আছহাবিল হাদীছ ১/৬৫ পৃঃ।

[24]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫)। উল্লেখ্য যে, হিলয়াতুল আউলিয়া (১০/২০৫) গ্রন্থে আমি ‘আল-মুমিন’ শব্দটি পাইনি সেখানে রয়েছে ‘বিল-ইলম’ যার অর্থ হবে, ‘যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করবে’- অনুবাদক।

[25]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ হা/২৯।

[26]. তারীখে বাগদাদ ১৪/৪১০ পৃঃ, হা/৭৭৪৩।

[27]. তাহযীবুল কামাল ২৮/৩৪০ পৃঃ; হা/৬১১৬।

[28]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/৩১৭ পৃঃ।

[29]. মা‘আরিজুল কুদস ৮১ পৃঃ।

[30]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/৩৫ পৃঃ।

[31]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৫/১৪৯ পৃঃ।

[32]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৬/১৪১ পৃঃ।

[33]. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/১৬ পৃঃ), কিঞ্চিত পরিবর্তিত

[34]. শু‘আবুল ঈমান হা/৫০৫৬

[35]. হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/১৯৬ পৃঃ

[36]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব ২/৩৭০, হা/২২৫৯



বিষয়সমূহ: আমল
আরও