মুহিববুল্লাহ : এক খোদা ইনসান বান গিয়া

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1143 বার পঠিত

[বার্মায় জন্মগ্রহণকারী এই সাবেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর স্বলিখিত ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি তামিল ভাষা থেকে উর্দূতে অনুবাদ করেন মাওলানা রিয়ায মূসা। সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন মাওলানা আব্দুল্লাহ সালাফী ও মাওলানা মিছবাহুদ্দীন। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বইটি তখনই আমাদের হস্তগত হয়। বইটির উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে পাঠকের খেদমতে পত্রস্থ করা হল- নির্বাহী সম্পাদক] 

বার্মায় এক বৌদ্ধ পরিবারে আমার জন্ম। থাইল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণ। পিতামাতার কামনা ছিল, আমি যেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হতে পারি। ফলে তারা আমাকে থাইল্যান্ডের এক বৌদ্ধধর্ম শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করেন। বয়স ছিল তখন আমার পাঁচ বছর। বৌদ্ধনুসারীদের ধারণা হল- ছেলেকে সন্ন্যাসী বানাতে পারলে পিতামাতার পাপ মোচন হয়ে যাবে। আমাকে যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হল সেখানকার নিয়মনীতি এতই কঠোর যে, সেশনের শুরুতে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও শেষাবধি তাদের দু-পাঁচজনই অবশিষ্ট থাকে। আমার সহপাঠীদের মধ্যে আমরা মাত্র দুজন কোর্স সমাপ্ত করি। ছাত্রাবস্থায় একনাগাড়ে ১৫ বছর যাবৎ ২৪ ঘণ্টায় ২৫০ গ্রাম খাদ্যদ্রব্য ও শুধুমাত্র এক গ্লাস পানি দেওয়া হত। অবশেষে আমি উত্তীর্ণ হলাম ও বিশেষ এক পর্যায়ে গিয়ে বৌদ্ধগুরুদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে আমাকে বৌদ্ধস্বামী বা ধর্মগুরু হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে আমি বিশ্বে স্বামী আনন্দ নামে পরিচিত হই। স্বামী হিসেবে মনোনীত হবার পর জাপান সরকারের পক্ষ হতে আমাকে একটি গ্রীনকার্ড দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে আমি সৌদি আরব ব্যতীত সারা বিশ্ব বিনা খরচে ভ্রমণ করতে পারতাম। আমার সম্ভাব্য যাত্রার জন্য জাপানী ফ্লাইটগুলোতে একটি সীট সবসময় রিজার্ভ রাখা হত। আমার যাত্রা নিশ্চিত হওয়ার সংবাদ বিমানবন্দরে পেঁŠছে গেলে ২০ মিনিট অবধি বিমান দেরীতে ছাড়ত। সৌদি সরকার ভিসা না দেওয়ায় সে দেশ ছাড়া গোটা বিশ্ব আমি তিনবার ভ্রমণ করেছি। বার্মাতে শিক্ষা গ্রহণের সময় আশ্রমে যে সমস্ত বিষয়াদি গুরুত্ব পেয়েছিল, তার অন্যতম হল-সমস্ত ধর্ম নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা। বিশেষভাবে ইসলাম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকত। বলা হত যে, গৌতম বুদ্ধ শতবার জন্মগ্রহণ করেন এবং শেষবার তিনি গাভীপৃষ্ঠে আরোহণ করে আসেন। এই সেই গাভী যা মুসলমানদের জন্য প্রতিনিয়ত জবাই করা হচ্ছে, অথচ সেটা আমাদের কাছে পূজনীয়। সেজন্য মুসলমান হতে সাবধান থাকতে হবে। কেননা তারা আমাদের প্রধানতম শত্রু। একথাও শিক্ষা দেওয়া হত যে, মুসলমানদের নবী (ছাঃ) এমন যাদু জানতেন যে, সেটা পড়ে যার উপরে ফুঁক দিতেন সে তার বশীভূত হয়ে যেত। তাই ওদের থেকে খুব সর্তক থাকতে হবে। অতঃপর আমি ৪৫ বছরে কোন মুসলমান দেখিনি। ২০ বৎসর বয়সে যখন আমি সার্টিফিকেট পাই তখন আমার ওযন মাত্র ৪৫ কেজি। প্রশংসাপত্র নিয়ে আমি আমাদের প্রধান ধর্মগুরুর আর্শীবাদ গ্রহণ করার জন্য অস্ট্রেলিয়া যাত্রা করি। তিনি তখন আশ্রমের পঁয়ষট্টিতম তলায় অবস্থান করছিলেন। অনেক বাধা অতিক্রম করে সেখানে পেঁŠছে দেখি গুরুর সম্মুখে রকমারী খাদ্যসম্ভার, মাছ, মাংস, ডিম, ফল-মূল ছাড়াও বহুমূল্যবান মদের বোতল সাজানো আছে। আনুমানিক ১২০ কেজি ওযন ধর্মগুরুর পার্শ্বে কয়েকজন যুবতী তার সেবায় নিবেদিত রয়েছে। আমি এসব প্রত্যক্ষ করার পর ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতেই তিনি বসতে বললেন। পরে এক গ্লাস মদ দিয়ে তিনি তা পান করার নির্দেশ দিলেন। যেহেতু আমি কোনদিন মদ খাইনি সেহেতু ভয় পেয়ে অসম্মতি জানালাম। তিনি বললেন, ‘না খেলে তুমি স্বামী হতে পারবে না।’ তিনি জোরপূর্বক আমাকে পান করালেন। ফলে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি। কখন আমার জ্ঞান ফিরেছিল তা আমার মনে নেই। এভাবে আমার নবজীবনের সূত্রপাত হল। ২৯ কেজি ওযন হতে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি ৯০ কেজিতে রূপান্তরিত হই। ভগবান গৌতম বুদ্ধের অবতার সেজে এভাবে আমার জীবনের ৪৫ বছর কেটে যায়। মানুষ আমার পায়ে কুর্ণিশ করতে লাগল ও আমাকে ভগবান বলে বিশ্বাস করতে লাগল। আমিও নিজেকে মনে মনে ভগবান বুদ্ধের অবতার হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করলাম। আমার ধারণা ছিল যে আমি যা বলি তা ভগবানেরই কথা। জাফরানী রঙ এর পোষাক ও রেশমবস্ত্র পরিহিত প্রতিটি বৌদ্ধ ভিক্ষুর ধারণা এটাই, শুধুমাত্র আমার একার নয়। বিশ্বের ধর্মগুলির অন্যতম হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্মের বার্তাবাহক হয়ে আমি মাঠে নেমে পড়ি। সারা বিশ্বে আমার অজস্র শিষ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার পদধূলি ও আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য লোকেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আশীর্বাদের প্রণামী ছিল এক লক্ষ এক টাকা মাত্র। তারা আমার পদদ্বয় ধৌত করে পানি পান করত ও শুয়ে গেলে তাদের মাথায় এক মিনিট পা রেখে দিতাম। এভাবেই আশীর্বাদ পর্ব শেষ হত।

এমনিভাবেই একদিন সিঙ্গাপুরের এক ধনকুবের তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাছে হাজির হল। বিবাহের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাদের কোন সন্তান জন্মেনি। তাই আমার আশীর্বাদ প্রয়োজন। বিনিময় তারা আমার দ্বারা নির্মীয়মাণ ইমারত যেটা আমেরিকার লস এঞ্জেলসে নির্মিত হচ্ছিল সেই আশ্রমের দুটি তলা বানিয়ে দেবার প্রস্তাব দিল। আমি বললাম দু’তলা নয় পাঁচটি তলার খরচ দিতে হবে। তারা তাতেই সম্মত হয়ে গেল। তাদের বললাম, আজকে সন্ধ্যার পর একটি মাদুলি দিব। কথামত একটা মিথ্যা মাদুলী তাদের হাতে ধরিয়ে দিলাম এবং বললাম রাতে বালিশের নীচে মাদুলীটিকে রেখে ঘুমাবে। যদি গৌতম বুদ্ধ তোমাদের সঙ্গে কথা বলেন তাহলে আমার কাছে আসবে। তারা খুব সকালে এসে বলল, হ্যাঁ আজ রাতে ভগবান বুদ্ধ আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি মনে মনে বললাম সারাজীবন তপস্যা করেও ভগবান বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেলাম না, আর তারা নাকি একদিনেই সাক্ষাৎ পেয়ে গেল। আমি প্রস্তাব দিলাম মহিলাটিকে নিরীক্ষণের জন্য চারমাস আমার কাছে রাখতে হবে, তাহলে ওর সন্তান হতে পারে। তারা সাগ্রহে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে মহিলাটিকে আমার কাছে রেখে যায়। এর ফলে আমার মাধ্যমে মেয়েটি পরপর দুটি সন্তান জন্ম দেয়। ব্যাস। সারা বিশ্বে প্রচার হয়ে গেল স্বামী আনন্দ সন্তান দিতে পারেন। অবশ্য আপনারা এ প্রশ্ন করবেন না যে- ঐ সন্তানগুলি কার ঔরসের?

যে কোন আশীর্বাদ যদি ঘটনাক্রমে প্রতিফলিত হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে প্রচার করা হত যে, স্বামী আনন্দের আশীর্বাদে অমুক কাজটা হয়েছে। আর কোন আশীর্বাদ প্রতিফলিত না হলে ব্যাখ্যা দেওয়া হত যে, ভগবান গৌতম বুদ্ধ তাদের প্রতি এখনও সন্তুষ্ট নন, সেজন্য আশীর্বাদ কার্যকরী হয়নি।

দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত বহু লোক আরোগ্য লাভের আশায় আমার  মূত্রপান করত। আমার মূত্রপানে অসুবিধা কি? আমি তো তখন সাক্ষাৎ ভগবানই হয়েছিলাম। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আমার কাছে তিনবার আশীর্বাদ নিতে এসে মোট পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। জার্মানীতে একদিন সভা চলছিল। এমন সময় এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করল, গুরুজী আমার সন্তান কটি? আমি বললাম ‘তিনটি’। তখন সে আমার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, গুরুদেব আমার সন্তান তো ছয়টি। আমি বিচলিত হয়ে উর্ধ্বমুখী বসে কিছুক্ষণ ধ্যানের ভান করে পরে বললাম, তুমি ঠিক বলেছ, তবে ছয়টি সন্তান এই জন্মে নয়। তোমার তিনটি সন্তান প্রথম জন্মের ও অপর তিনটি পরের জন্মের। সে লোকটি মহানন্দে বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে প্রশ্ন করল এই বলে যে, তার কোন সন্তানগুলি প্রথম জন্মের আর কোনগুলি পরের জন্মের? এই ঘটনার পর আমার চিন্তা হল যে, এভাবে যদি আমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হতে থাকে তাহলে তো লোকদের আস্থা কমে যাবে। তখন হতে বৌদ্ধ সোসাইটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, স্বামŠ আনন্দ সরাসরি জনগণের সাথে কথা বলবেন না। ঘোষণা দেওয়া হল যে, স্বামী আনন্দ এখন গৌতম বুদ্ধের সাথে সংলাপ করছেন। সুতরাং তিনি কোন পাবলিকের সাথে কথা বলবেন না।

জীবনের মোড় পরিবর্তন :

এক সময় আমি দু’বার কুরআনুল কারীম পড়ার সুযোগ পেলাম। এতে আমার মনের বদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। আমার মনে হতে লাগে বিগত পঁয়ত্রিশ বছর আমি সোজাপথ হারিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছি। এই উপলব্ধি আসার পরও এই বিলাসবহুল জীবনের মোহ ত্যাগ করে আসা ছিল আমার জন্য তখন অকল্পনীয় ব্যাপার। এমতবস্থায় নিম্নবর্গের এক ধনী নেতা তার ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থী হল এবং তাতে সে সফলকাম হলে সে আমাকে প্রচুর অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। আমি তাকে ১২০ বছর বেঁচে থাকার ও প্রচুর লাভবান হওয়ার আশীর্বাদ দিলাম। ঘটনাক্রমে সে মাত্র নববই দিনের মাথাতে মৃত্যুবরণ করে। তার অনুগামীরা একদিন সকালে এসে সংবাদ দিল যে, ‘আপনি যাকে ১২০ বৎসর বাঁচার আশীর্বাদ করেছিলেন সে মারা গেছে। এখন ওকে পুড়িয়ে সৎকার করব না কবর দিব?’ আমি বললাম, ‘এর উত্তর নিতে হলে কুড়ি হাজার টাকা প্রণামী দিতে হবে।’ তারা তাই করল। আমি তাদেরকে বললাম ‘ওকে পুড়িয়ে সৎকার কর’। কেননা আমার শংকা ছিল যে, পোস্টমর্টেম হলে আমিও জড়িয়ে যেতে পারি।

১৯৯১ সালে কাঁচির শংকরাচার্য্যের নিকট প্রয়াত রাজীব গান্ধী আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য যান। শংকরাচার্য্যজী প্রধানমন্ত্রীর মাথায় পা রেখে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘তুমি একশত এক বৎসর বাঁচবে ও আমৃত্যু তুমিই প্রধানমন্ত্রী থাকবে।’ এই আশীর্বাদের মাত্র সাতাশ দিনের মাথায় এল.টি.টি.ইর গুলিতে রাজীব গান্ধী মারা যান। এই দুই ঘটনা আমার মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আমি যাকে ১২০ বছর বাঁচার আশীর্বাদ করলাম সে মারা গেল নববই দিনের মাথায়, আর স্বামী শংকরাচার্য্য যাকে ১০১ বছর বাঁচার আশীর্বাদ করলেন সে মারা গেল মাত্র সাতাশ দিনের মাথায়। তাহলে আমরা দু’জনেই মিথ্যুক। এর চেয়ে অপমানের আর কি আছে? আমাদের কথার কোন মূল্য নেই। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষ কোন ক্ষমতার অধিকারী নয়। বিশ্বে শুধু একজন স্রষ্টারই আদেশ ও ইচ্ছা কার্যকরী হয়। এই বোধোদয় আমার বিশ্বাসের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে ও বিবেক বলতে থাকে যে, আমার মত তুচ্ছ ব্যক্তির আশীর্বাদ দেওয়ার নৈতিক কোন অধিকার নেই। এই ভাবাবেগ হৃদয়ে জাগ্রত হতেই অজ্ঞাতসারে আমার শরীর হতে ধর্মগুরুর পোষাক খসে পড়তে থাকে এবং মনের মধ্যে শক্তভাবে এই বিশ্বাস গুঞ্জরিত হতে থাকে যে, এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া উপাসনার যোগ্য কেউ নেই।

সিঙ্গাপুর হতে একদিন জার্মানী যাচ্ছি। এমতাবস্থায় দেখি আমার পেছনে দু’জন মুসলমান বসে আছে। তাদের কাছে ছিল ১০ লিটার করে পানির জার। আমার রাগ হল ও মনে মনে বললাম, এরা বোকা জাত নইলে সিঙ্গাপুর হতে ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদির পরিবর্তে পানির ক্যান নিয়ে যাচ্ছে। ওদের দেশে কি পানি নেই? বিমানে বসে দেখলাম ওরা একটা ছোট গ্রন্থ বের করে পড়ছে। ব্যাস! ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ে গেল যে, ওদের নবী মুহাম্মদ (ছাঃ)। যে ব্যক্তি মন্ত্র পাঠে লোকদের বশীভূত করত। মনে হয় এরাও আমাকে বশীভূত করার জন্য সেই গ্রন্থ পড়ছে। এই ভয়ে আমি আমার সঙ্গীর সীটে সরে গেলাম। জার্মান বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের সঙ্গে কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা পানি বহন করছেন কেন? কত ভাল ভাল দ্রব্যাদি ছেড়ে পানি বহন করছেন, আপনাদের দেশে কি পানি নেই?’ তাঁরা বললেন, ‘সংক্ষিপ্ত সময়ে এই পানির বৃত্তান্ত বলা সম্ভব নয়। এটা সাধারণ কোন পানি নয়। যমযম কূপের পানি। আপনি নিজের বাসার ঠিকানা দিন অথবা আমাদের ঠিকানায় আসুন। আমরা এর বিস্তারিত বিবরণ আপনাকে জানাব। আমি আমার কৌতূহল চাপতে পারলাম না। তাই একদিন তাদের বাসায় গিয়ে সকাল ন’টা হতে রাত্রি নটা পর্যন্ত যমযম কূপের উৎপত্তি ও তার মাহাত্ম্যের কথা বিস্তারিতভাবে শুনলাম। তারা বললেন, ‘অতিরিক্ত কিছু শোনার ইচ্ছা থাকলে অপেক্ষা করুন, আগামীকাল পাকিস্তান হতে দু’জন বিশেষজ্ঞ আলিম আসছেন, তারা আরও তথ্য দেবেন।’ তাঁরা যেসব তথ্য আমাকে দিয়েছিলেন তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এই যে, খৃষ্টান বৈজ্ঞানিকরা চিন্তা করল যে, যমযমের প্রতি মুসলমানদের যে বিশ্বাস অর্থাৎ তা পবিত্র ও তাতে অনেক উপকার আছে-এটাকে নস্যাৎ করতে হবে। যদি ঐ পানির উৎসকে শেষ করে দেওয়া যায় তাহলে এটা সহজেই হবে। কিন্তু কাজটা তো সহজ নয়, সেজন্য তারা সৌদি সরকারকে বোঝালো যে, কূপটি আদিকালের। এর সংস্কারের প্রয়োজন আছে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা আবর্জনা দূরীভূত হলে পানি আরও পরিষ্কার হবে। এতে সরকার রাজী হয়। সেই মোতাবেক আমেরিকা হতে চারটি শক্তিশালী পাম্প মেশিন এনে ৩/৪ ইঞ্চি পাইপ দ্বারা পানি উত্তোলন শুরু করল। সপ্তাহকাল ধরে পানি উত্তোলনের ফলে মক্কায় প্লাবনের সৃষ্টি হল। কিন্তু পানির বেগ এক ইঞ্চিও কমল না । অবশেষে তারা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।

আমি স্বামী থাকা অবস্থায় একজন মুসলিম ভাই ও আমার এক বৌদ্ধ ছাত্র ডাঃ চিরাপ্পান (মাদ্রাজ)-এর দ্বারা আমার ইসলামের সাথে পরিচয় ঘটেছিল। তাঁরা আমাকে ইসলামের উপর লিখিত বই-পুস্তক দেন। আমি কিন্তু সেগুলি মনযোগ দিয়ে পড়িনি। কিন্তু এসকল ঘটনা আমাকে কুরআন ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী পুণরায় পড়তে উৎসাহিত করল। আমি যতই পড়তে লাগলাম ততই আমার মনে অতীতের কৃত অন্যায়ের অনুভূতি জাগ্রত হতে লাগল। পরিণামে ভগবানের  স্থলাভিষিক্ত  এই  আমি  ধীরে  ধীরে  সাধারণ মানুষে রূপান্তরিত হতে থাকি। ব্রক্ষ্মচারী (যেটা মূলত ধোঁকা ) হতে নিজেকে পিতা ও স্বামীর আসনে এনে উপস্থিত করি। যে আমি অন্যকে তথাকথিত পথপ্রদর্শনকারী ছিলাম আজ নিজেই আমি সত্যপথের জন্য হন্যে হয়ে বেড়াতে থাকি। অবশেষে আমি এক আল্লাহর সম্মুখে আত্মসমর্পণ করি। সংক্ষিপ্তসার এই যে, আমি এর আগে ভগবান ছিলাম এখন মানুষ হয়ে গেছি।

আমার অর্থহীন জীবনের কিছু নিদর্শন : 

‘বুদ্ধম শরনম গচ্ছামি, ধরনাম শরনম গচ্ছামি, সংগম শরনম গচ্ছামি’

অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করাই আমার ধর্ম, সেই ধর্ম স্মরণ করাটাই আমার কর্ম ও সেই ধর্মে মিলিত হওয়াটাই আমার জীবনের মূল লক্ষ্য। এই নিয়মের উপরেই আমার জীবন যাত্রা। উপরে বর্ণিত মন্ত্র জপ করা ও বোধি গাছের নিচে বসে শিক্ষাগ্রহণ ও তার প্রচার করাটাই চিল আমার বৌদ্ধ জীবনের মূল লক্ষ্য।

গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে আমার ধারণা :

আমাকে শিখানো হয়েছিল যে, মানুষকে মানুষের দাসত্ব হতে মুক্ত করতে, অসভ্যতা ও বর্বরতাকে নির্মূল করতে এবং আর্য্য সম্প্রদায়ের অত্যাচার বন্ধ করে মানুষকে নিরাপত্তা বিধান ও শান্তি দিতে যিনি এসেছিলেন, তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধ। কিন্তু কে তিনি? মানুষ? মানুষ কি স্বয়ং জন্মেছে? না তার সৃষ্টিকর্তা কেউ আছে? মৃত্যু কেন আসে ও মৃত্যুর পর মানুষের কি হয়? এ ধরনের বহু প্রশ্ন আমার বিবেককে জর্জরিত করতে থাকে। হারিয়ে যাওয়া বস্ত্ত খোঁজার ন্যায় আমি এগুলির উত্তর খুঁজতে থাকি। পরিণামে দুনিয়ার প্রতি আমার মোহ কাটতে থাকে। আমি সত্যের খোঁজ করতে থাকি। মনে দয়া, ভালবাসা ও নম্রতা যা অর্থ দ্বারা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, তা আমার মনে স্থান করে নিতে থাকে। আমার নিজের চলার পথ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও বিভিন্ন ধর্মকে নিয়েও আমি পর্যালোচনা করতে থাকি।

আমার পূর্বপুরুষদের বসতভিটা তামিলনাডু জেলার রামনাথপুরম পারামকুন্ডির নিকট আলকানকুলাম গ্রামে ছিল। পরে সিদ্ধার কুট্রাই বন্দর দিয়ে নৌকা দ্বারা বার্মা পৌঁছে আমার দাদা বসবাস আরম্ভ করেন। আমি এক বৌদ্ধগৃহে জন্মলাভ করি। আমি স্বামী আনন্দজী হলেও আমার আত্মীয়-স্বজনরা গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জীবিকার খোঁজেই তারা বার্মা এসেছিলেন। আমাদের মাতৃভাষা ছিল তামিল। আমার পিতামাতা আশৈশব বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। সেহেতু তারা আমাকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী করে তোলেন। আমাকে বৌদ্ধভিক্ষু করার মানসে বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়। রেংগুন, তিববত, চিন, গোরবা, কম্বোডিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের বৌদ্ধগুরুদের নিকট আমি শিক্ষাগ্রহণ করি। আমার এই শিক্ষা সমাপ্ত হয় ১৯ বছর বয়সে। বার্মার দ্বিতীয় রাজধানী মান্ডেলায় বৌদ্ধগুরু ‘চানীশর’ এশিয়ার পাঁচ বৌদ্ধগুরুদের একজন রূপে আমাকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। অতঃপর আমাকে জাফরানী পোষাক পরিধান করানো হয় ও বৌদ্ধগুরু বোদীদাসওয়াদাস নাগাসাকীতে আমাকে রেখে সারাবিশ্বে এই ধর্ম প্রচারের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। অতঃপর ১০১ জন ধর্মগুরু আমাকে নেতা নির্বাচন করেন। আমি তারপর ধর্মপ্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করি। এশিয়া মহাদেশের ১৭টি দেশে যেখানে বৌদ্ধধর্ম আছে সেখানে ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে আমি বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে থাকি। এতে আমি প্রভূত সম্মানের অধিকারী হই। আমার আপন ভাই স্বামী নন্দনজী আচার্য্য আমেরিকার লস এঞ্জেলসে ৬৭ তলা আশ্রমের মঠপতি হয়ে বসে আছেন। সেখানে আমিও সাড়ে তিন বছর আধিপত্য চালিয়েছি। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ইসলাম আমাকে ঘিরে ফেলল। মুসলমানদের সাথে আমার সর্ম্পক নিগূঢ় হতে থাকল। ছোট ছোট পুস্তিকা পাঠ ও নবী (ছাঃ)-এর জীবনীপাঠ ও সর্বোপরী কুরআন পাঠে ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকল। ফলে এই বিশ্বাস আমার বদ্ধমূল হল যে, সৃষ্টিকর্তা একজনই ও তাঁরই নির্দেশে সূর্য উদিত হচ্ছে ও অস্ত যাচ্ছে। এই উপলব্ধির পরে তার বিশাল জগৎ সর্ম্পকে ভাবতে ভাবতে আমি বিস্ময়াভূত হয়ে পড়ি ও ইসলামের নিকটবর্তী হয়ে পড়ি। অতঃপর কুরআনের পুনর্পঠন আমার বৃদ্ধি পেতে থাকে ও মন্দিরের দৈনন্দিন কাজে আমার অনীহা বাড়তে থাকে। ফলে সকাল-সন্ধ্যা মোমবাতী জ্বালানো, পানিতে ফুল দেওয়া ও মন্ত্রপাঠ বন্ধ হয়ে যায়।

মানুষ কি খোদা ?

আমি কি খোদা? একথা চিন্তা করতে ইসলাম আমাকে বাধ্য করেছিল। মানুষ তার জৈবিক চাহিদা অনুযায়ী জীবন-যাপন করবে এটাই তার দায়িত্ব। একজন পুরুষ সামর্থ্য অনুযায়ী চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে-এ অনুমতি ইসলামে আছে। কিন্তু বৈবাহিক জীবন বর্জন করে মানুষ শত শত নারীর সঙ্গে দৈহিক মিলন ঘটিয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে নারীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে এটা বিরাট অন্যায়। এ পাপ হতে ইসলাম আমাকে রক্ষা করেছে। আমি আমার খোদায়ী ছুঁড়ে ফেলে আজ মানুষ হয়ে গেছি।

গুরু ও তার অভিশাপ

আমার ইসলাম গ্রহণের সংবাদটা আগুন লাগার মত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। তিববতের স্বামীজীর নিকটেও সংবাদ পৌঁছল। তিনি সর্বদা আমার প্রশংসা করতেন। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি শুধুমাত্র স্বামী নন তিনি একজন দক্ষ যাদুকরও ছিলেন। আমি তার ডাকে উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থা বর্ণনা করলাম। তিনি বললেন, ‘আপনার ইসলাম গ্রহণে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষতি সাধন হয়নি। বরং অসংখ্য জনগণ যারা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের জন্য ইচ্ছা করেছিলেন তাদের জন্যও আপনি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সুতরাং আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন।’ আমি বললাম, ‘আর কোন অবকাশ নেই।’ এত বলিষ্ঠ জবাব আমি দিতে পারব, এটা আমার চিন্তাতেই ছিলনা। ইতিপূর্বে তার কথার প্রতি আমার এমন অবিচল বিশ্বাস ছিল যে, তিনি যদি বলতেন, ‘খরগোশের তিনখানা পা হয়, তাহলে আমি বলে দিতাম গুরু যা বলছেন তাই ঠিক। গুরুজী আমার ওপর রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন যে, তার কথা অমান্য করার অপরাধে ১৫০ দিনের মধ্যে আমার এক পা ও একহাত পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার অভিশাপের কথা মনে করতেই মন শিউরে উঠত। অথচ তার ওই বদদো‘আ আমাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না। এ ধরনের বাজে কথার ইসলামে কোনই ভিত্তি নেই। শয়তান মনে দুর্বলতা আনার চেষ্টা করলেও আমি আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখে তথা হতে প্রস্থান করি। অতঃপর আমি খুব সতর্কতার সাথে এই জন্য চলাফেরা করতাম যে, কোন অঘটন ঘটে গেলে যেন লোকদের বলার সুযোগ চলে না আসে যে এটা অভিশাপের পরিণতি। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে সুস্থভাবে ১৫০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আমি তখন মক্কাতে আছি। সমস্ত প্রশংসার যোগ্য হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। বহু মানুষ এ ধরনের অভিশাপে পড়ে নিজেদের জীবন নষ্ট করে ফেলে। আল্লাহ আমাকে বিপদের অবস্থাতে রক্ষা করেছেন। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী অন্য কারও জন্য প্রতারক হতে পারেন না। বৌদ্ধভিক্ষু থাকাবস্থায় শত সহস্র লোককে প্রতারণা করেছি। আমি ও আমাদের গুরুদের হাতে প্রতারণার শিকার হয়েছি। ইসলাম গ্রহণের পর সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। জাফরানী পোষাক আমার মনে যে অহমিকার সৃষ্টি করত ইসলাম তা নিঃশেষিত করে দিয়েছে। আমার মন কোমল হয়ে গেছে। ১৯৯৩ সনের ১৩ই অক্টোবর চেন্নাই (মাদ্রাজের) মসজিদে মা‘মূরে কালিমায়ে তাওহীদের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করি ও স্বামী আনন্দ হতে মুহিবুল্লাহ (আল্লাহ প্রেমিক) হয়ে যাই। আশা করি আল্লাহ আমার পূর্বের পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন। ইসলাম গ্রহণ করলে গ্রহণকারীর পূর্বের পাপ মাফ হয়ে যায়। আল্লাহর নিকট সমস্ত মানুষই সমান। এই সমঅধিকারের প্রকৃত স্বাদ আমি অনুভব করছি। আজ হতে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মসজিদে প্রবেশ করার অধিকার আমি অর্জন করেছি ও যে কোন মসজিদে যে কোন মুসলমানের সাথে ছালাত আদায় করতে আমাকে পৃথিবীর কোন শক্তি বাধা দিতে পারবে না। ইসলাম গ্রহণের দিন হতেই আমার মানসপটে এ বাসনা জাগ্রত হয় যে, আমি মানুষে মানুষে ভালবাসা ও প্রেম-প্রীতির পাঠ দিয়ে বেড়াব। এতদুদ্দেশ্যে অধিক জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে চিদাম্বরম জেলা কায়েল-পাটনামের দিকে যাত্রা করলাম। সেখানে অবস্থানকালীন গভীরভাবে জ্ঞানার্জনে মনোনিবেশ করলাম ও সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমার জীবনের লক্ষ্য হল নিজের ঈমানকে সুদৃঢ় করা এবং ইসলামকে  অন্যের  কাছে  পৌঁছে  দেওয়া  ও  সাম্যবাদের  সঠিক চিন্তাধারা মানুষের কাছে তুলে ধরা। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইসলাম সম্পর্কে বহু ভুল ধারণা ছিল। আমার মত ভুলের শিকার হয়ে অজস্র মানুষ ইসলামের নেয়ামত হতে বঞ্চিত আছে। আমাদের উচিত মানুষের মধ্য হতে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো, ইসলামের সাম্যবাদকে তুলে ধরা ও তাদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়া। আমাদের সংগঠিত হতে হবে ও ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, শত শত গ্রাম ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে নিয়েছে।

নবী মুহাম্মদ (ছাঃ) সম্পর্কে আমার উপলব্ধি :

মানবেতিহাসের অমর ব্যক্তিত্ব ও অসাধারণ চরিত্রের যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ (ছাঃ)। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই কম করে হলেও দশখানা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার জীবনে। বিপ্লব এনেছে এই জীবনচরিত পাঠ। যে কেউ তাঁর জীবনকথা গভীরভাবে অধ্যয়ন করবে সে তার জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলি অনুভব করতে পারবে। তিনি যেভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন সেভাবে চলার মত লোক দ্বিতীয়জন পাওয়া যায়নি ও  যাবেনা। এছাড়া তিনি অসাধারণ গুণাবলীর সমন্বয়কেন্দ্র ছিলেন। স্বীয় ঈমানে পর্বততুল্য অবিচলতা, দ্বিধাহীন ও আপোষহীন তাওহীদে বিশ্বাসী। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভেদাভেদহীন সাম্যবাদী। অতিথিপরায়ণতা, দয়াপরবশ হওয়া ও সহানুভূতিপ্রবণ ব্যক্তিত্বের তিনি মহাধিনায়ক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও তিনি শত্রু-মিত্র সকলের নিকট সমান প্রশংসিত। মানবজীবনের জন্য এত সহজ ও সরল নীতি তাঁর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে যা অন্যের দ্বারা আর কখনও সম্ভব বলে মনে হয় না। বিশ্বে এ যাবৎ যত মনীষী খ্যাতি লাভ করেছেন তাদের জীবনেতিহাস ও নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনকে তুলনামূলক স্টাডি করুন তাহলে আপনার নিকট স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মুহাম্মদ (ছাঃ) অতুলনীয়। মহাপ্রলয়ের দিন পর্যন্ত তিনিই উত্তম মডেল বা আদর্শ হয়ে থাকবেন ইনশাআল্লাহ। এই মহান ব্যক্তি কিভাবে স্বীয় জীবন যাপন করেছেন ও অন্যের সাথে তাঁর আচার-ব্যবহার ও তাঁর ব্যবহারিক জীবন কেমন ছিল- এসবকিছু প্রমাণসহ অধ্যয়ন করেছি। নবীরূপে বরিত হওয়ার পূর্বে ৪০ বৎসরের জীবন কলুষমুক্ত ও অনুকরণীয় ছিল। প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিছিন্নভাবে কিছু ভাল গুণ থাকে। কিন্তু সর্বগুণের সমন্বয় সাধিত হয়েছিল নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর ব্যক্তিত্বে।

খৃষ্টজগৎ তথা ইসলামবিদ্বেষীদের মিথ্যাচার হল যে, ইসলাম তরবারী দ্বারা প্রচারিত হয়েছে। এর উত্তরে সরোজিনী নাইডু লন্ডনে নিজের এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘ইসলাম অন্য ধর্মের অনুগামীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় না’। মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর অনুসারী ছাহাবীগণ ও তাঁদের অনুগামীরা সিসিলি পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন, আটশত বৎসর খৃষ্টানদের দেশ স্পেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, কিন্তু তারা কখনও সাধারণ লোকের পূজা-পাঠ ও উপাসনাতে হস্তক্ষেপ করেননি। বরং খৃষ্টজগৎ তাদের মর্যাদা পেয়েছে। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা হয়েছে ও সম্মানের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এটা তাদের কুরআন শিক্ষার ফসল তা স্বীকার করতেই হবে। সালাহুদ্দীন আইয়ূবী সম্পর্কে ফ্রান্সের বাদশাহ বলেছিলেন, ‘‘আমি সালাহুদ্দীনকে নিয়ে আশ্চর্য হই যে, তিনি কিভাবে এত ভাল মানুষ হলেন। তাঁর উপর তো কোন চাপ ছিল না। আমার বিবেক কিন্তু মুসলমান হওয়ার জন্য কথা বলছে।’’ থাক্স্ আরনল্ড বলেছিলেন, ‘‘বিশ্বের যত ধর্ম আছে তার মধ্যে ইসলামই এমন একটা ধর্ম যার মধ্যে সমস্ত উন্নত গুণাবলী বিদ্যমান। সাধারণ লোকের দাওয়াত ও তাবলীগে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। অর্থলোভ দেখিয়ে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এমন কোন ইতিহাস নেই। কুরআনের আলোকে মূল উৎস হিসাবে বরণ করে অসংখ্য মুসলিম বণিক সেই আলো দ্বারা বিশ্বকে আলোকিত করেছেন। পন্ডিত সুন্দর লালা বলেছেন, ‘মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে ব্যবহার তার শত্রুদের প্রতি দেখিযেছেন, তা ইতিহাস কোনদিন ভুলতে পারবে না। যারা সারা জীবন অন্যায়-অত্যাচার, অপমান- অপরাধ করেছিল তাদের সেদিন নিঃশর্ত ক্ষমা করে বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে তিনি চির অস্লান হয়ে থাকবেন।’ ভারতের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লালা ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেছেন, মুসলিমগণ মুক্তচিন্তা-চেতনার ধারক ছিলেন।  যদি তারা অত্যাচারী হতেন তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ভূখন্ডে তারা শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারতেন না। তারা ভারতসহ সমগ্রদেশের জনসাধারণের হিতাকাঙ্খী ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন ধর্মের উপর তারা কোন সময় হস্তক্ষেপ করেননি। তাঁদের মতাদর্শ গ্রহণ করতে কাউকে বাধ্য করেননি। অমুসলিম নাগরিকদের সাথে তাঁদের ব্যবহার, দয়া, অনুগ্রহ ও সহানুভূতির ব্যবহার ছিল।’ আমি নিয়মিত কুরআন পাঠকালে আমার অন্তরাত্মা জাগ্রত হয়। আমি স্বস্তি পেতে থাকি। আল-কুরআন এমন এক ধর্মগ্রন্থ যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। যার যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞান আমাকে আমার আলো দেখাচ্ছিল। আমি একজন পুরোহিত হওয়ার সুবাদে আমার নিজস্ব ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।

গৌতম বুদ্ধ ও তার বৌদ্ধধর্ম :

যিশুর জন্মের পাঁচশ তিয়াত্তর বৎসর পূর্বে ভারতে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খৃষ্টাব্দে। খৃষ্টপূর্ব ৬৩২ অব্দে গৌতম বুদ্ধ ২৯ বৎসর বয়সে বৌদ্ধজ্ঞান প্রাপ্ত হন। কাশী নদী হতে উত্তরে ২ কিমি দূরে অবস্থিত সারনাথে আর্যদের তৈরী ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথার বিরুদ্ধে নিজস্ব ভাষণ প্রদান করেন। ৪৫ বৎসর বয়সে দক্ষিণ ভারতে মূর্তিপূজার নামে, ভগবানের নামে নির্দয়ভাবে পশুবলির বিরুদ্ধে সরব হন।

বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি :

(১) মিথ্যা বলবে না। (২) ব্যভিচার করবে না। (৩) নেশাদ্রব্য ব্যবহার করবে না। (৪) অহিংসার নীতিতে  বিশ্বাসী হবে। (৫) পাপ হতে দূবে থাকবে। (৬) মূর্তিপূজার বিরোধী হবে।

এসবের জন্য গৌতম বুদ্ধ জীবনের সিংহভাগ ব্যয় করেন ও অযোধ্যা হতে ২৫০ কিমি দূরে অবস্থিত খুশীনগরে ৮২ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার ভাষা ছিল ‘পালী’। পরবর্তীকালে ‘বুদ্ধ’ নামে একখানা বই লেখা হয়েছে।

বুদ্ধ মানুষের মতই জন্মগ্রহণ করেন। পরে বিবাহিত হন ও শেষে সন্ন্যাসী হয়ে যান।  ন্যায়ের জন্য স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করেন ও মৃত্যুবরণ করেন। অথচ তার মৃত্যুর পরে তাকেই তাঁর ভক্তবৃন্দ ভগবান বলে মেনে নিতে থাকেন। তিনি একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি আর্য নীতি ও শাস্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ধর্মে আর্যদের আদর্শ অনুসারীরা অনুপ্রবেশ করে। যার প্রভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীগণ দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ১) মহাযান। ২) হিনযান। আর্যদের ধূর্তামি ও চাতুর্যের কারণে তাদেরকে ভারত হতে বিতাড়িত হতে হয়। সে সময় নাগাপট্টনামে আর্য ব্রাহ্মণরা হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। বর্তমানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহে ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি নিয়ে বৌদ্ধগণ নিজ ধর্ম পালন করে চলেছেন। মহাযানরা তিববতে, হিনযানরা বার্মা, শিলং ও থাইল্যান্ডে, জাম্বুতরা জাপানে এবং কোরিন বুতরা উত্তর বার্মাতে বসবাস করছে।

ভারতে থেকে বহিষ্কৃত হয়ে বৌদ্ধগণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। ভারতে বৌদ্ধগণ বর্ণাশ্রমের শিকার হয়ে আছেন। শিলং-এ বৌদ্ধগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তারা জাত-পাতের দ্বন্দ্বে বন্দী ছোট জাতের জন্য পৃথক বৌদ্ধ বিহার ও উঁচু জাতের জন্য পৃথক বিহার নির্ধারণ করেছে। শুক্রবার ‘খারীতা আম্মান’ মন্দিরে জনগণকে পেট ভর্তি খাবার খাওয়ানো হয় অতঃপর বৌদ্ধমতে আমাদের শ্লোগান দেওয়া হয়। এভাবে কি মানুষ স্বাধীন মর্যাদা পাবে?

স্বাধীনতার পথ :

যে সমস্ত মানুষ স্বাধীনতার খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে তাদের বলব, অস্পৃশ্যতা, দালিত্যের বেড়াজাল হতে মুক্তির একটাই পথ সেটা হচ্ছে ‘ইসলাম’। সেজন্য আমি আপনাদের বলি, ইসলাম গ্রহণ করুন। হে দলিত বন্ধুগণ! আপনারা না পারাইয়া বৌদ্ধ না পাল্লা বেŠদ্ধ হয়ে জন্মেছেন। আপনারা জন্মেছেন কেবলই মানুষরূপে। মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদা একমাত্র ইসলামেই পাওয়া যাবে। কমিউনিষ্ট নেতা চোডিকাল চালাপ্পা তাঁর বই ‘চল তোমরা ইসলামের দিকে’-তে লিখেছেন, আচ্ছুত গান্ধীর পূর্বেও ছিল, পরেও ছিল, এখনও আছে এবং আগামীতেও থাকবে। হে দ্রাবীড় জাতি, তোমরা চল ইসলামের দিকে। তোমাদের স্বাধীনতা একমাত্র ইসলামেই আছে।’ সর্বভারতীয় ওয়ার্কশপ পার্মীর জেনারেল সেক্রেটারী ডাঃ চিয়াপ্পন M.B.B.S  ইয়াগমুরা শ্রীলংকার বৌদ্ধবিহারে সবসময় পূজার জন্য যাতায়াত করতেন। সেখানে একবার তিনি আম্বেদকর জয়ন্তী করবার অনুমতি চেয়েছিলেন। তার উত্তরে তথাকার বৌদ্ধশাস্ত্রী নন্দীশাস্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘আপনারা পারিযা বৌদ্ধদল শুধুমাত্র জাতপাত ভোলার জন্য ‘বুদ্ধম মরনম’ করেন।’’ তিনি জাত তুলে উত্তর দেওয়ার ফলে ক্ষুদ্ধ ডাঃ চিয়াপ্পন বৌদ্ধবিহার হতে বেরিয়ে এসে আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন যে, আমার মত নেতার সাথে যখন এমন আচরণ তাহলে আমার জাতির সাধারণ মানুষের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। এ ঘটনার পরে তিনি বই লিখলেন, ‘পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একমাত্র পথ ইসলাম।’ ইসলামের স্বাধীনতা, সাম্যবাদ ও ভ্রাতৃত্ব আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। এ ব্যাপারে আমার হজ্জ সফরের কিছু অনুভূতি উপস্থাপন করছি। হজ্জ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আমি আনন্দিত ও পুলকিত বোধ করছি। বিভিন্ন দেশ হতে আগত প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ কা‘বাঘর তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করতে এসেছিলেন ও তারা সকলেই সমস্বরে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে রেখেছিলেন। আমার জন্য এটা একটা নতুন অনুভূতি ছিল যে, একই সময়ে এত লোক একই স্থানে বিভেদহীনভাবে সমবেত হয়েছেন। ছিল না এদের মধ্যে জাতপাতের কোন অহমিকা, ভেদভারের কোন দুর্গন্ধ। কেননা জাতপাতের নিরস পরিবেশে আমার জীবনের বৃহৎ একটা অংশ অতিবাহিত হয়েছে। সাদা-কালো রঙের মানুষ বিভিন্ন প্রান্ত হতে আগত হয়ে সব একাকার হয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে একটি সূতো দ্বারা সমগ্র মানুষকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কা‘বাপ্রাঙ্গণে কাতারবন্দী হয়ে ছালাত পড়ার দৃশ্য আমাকে মন্ত্র-মুগ্ধ করেছে, যা মানব ইতিহাসের পুরনো যুগের নয় বরং আধুনিক বিশ্বের এক অসাধারণ সম্মেলন। ইসলামী শিক্ষার মৌলিক আদর্শগুলির অন্যতম হল পারস্পরিক ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যবাদ। যার পূর্ণ প্রতিফলন এই হজ্জের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। হজ্জে উপস্থিত হয়ে এসবের আনন্দ আমার মন-মস্তিষ্ক, শিরা-উপশিরা সবকিছুকে হিল্লোলিত করেছে।

মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার পয়গাম :

হে মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনারা যদি নবীর হাদীছ ‘যারা উপস্থিত আছে তারা যেন অনুপস্থিতদের পেঁŠছে দেয়’-এর প্রতি আমল করেন তাহলে সমগ্রবিশ্বে ইসলাম জয়ী হবেই ইনশাআল্লাহ। ‘মানুষকে দেখবে যে তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে (সূরা নাছর)।’ শর্ত একটাই, আপনারা ইসলামের নমুনা বা মডেল হয়ে যান। নিজের কর্ম দ্বারা প্রমাণ করুন যে, ইসলামই হচ্ছে একমাত্র পরিত্রাণের পথ। হে আল্লাহ, আমার প্রভু! তুমি মুসলিম উম্মাতকে এই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দাও, এদেরকে পরকালে মুক্তি দান করো। আমি যেন জীবনের অন্তীম মুহূর্ত পর্যন্ত এই গুরু দায়িত্ব পালন করে আল্লাহর বিধান অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারি এবং এপথেই নিজেকে উৎসর্গ করে মৃত্যুবরণ কবতে পারি সেই দো‘আ করছি। আমীন!

আমার ইসলাম গ্রহণের পরিণতি :

আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর মাদ্রাজসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আমাকে মেরে ফেলা ও কষ্ট দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতে থাকে। একদা মাদ্রাজ বৌদ্ধিক সোসাইটিতে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় এবং ইসলাম পরিত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। আমি অস্বীকার করলে আমার এক শিষ্য স্বজোরে আমার ডান চোখে আঘাত করে যাতে সেটি বেরিয়ে পড়ে ও পরে পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এখন সৌন্দর্য রক্ষার্থে চোখটিতে পাথর বসানো আছে। অতঃপর ফুটন্ত পানি আমার উপরে ঢেলে দেওয়া হয়, যাতে শরীরের সম্পূর্ণ চামড়া খসে পড়ে। এ সংবাদ পুরো মাদ্রাজে (চেন্নাই) আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে। তথাকার এক ধনী ব্যক্তি আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রায় ষাট হাজার টাকা ব্যয়ে আমাকে সুস্থ করে তোলেন।

পারিবারিক জীবন :

ইসলাম পূর্ববর্তী জীবনে স্বামী আনন্দ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বহু নারীসম্ভোগের ঘটনা আমার দ্বারা ঘটেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। যারা আমার কাছে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন হাজত পূরণ করার জন্য আসত। কিন্তু আমার ইসলাম পরবর্তী জীবন তা হতে পূর্ণভাবে পবিত্র। ইসলাম গ্রহণের পর সউদী সরকার আমাকে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমি তাতে সম্মত হই। যেহেতু ইসলামী নাম (মুহিবুল্লাহ) আমরা পাসপোর্ট ছিল না, সেজন্য আমি আমার পুরনো নামের পাসপোর্ট দ্বারা সউদীআরব যাই ও হজ্জ করি। পরে সেখানে সরকারী লোকজন স্থায়ীভাবে বাস করার অনুবোধ করেন। আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। আমি বলেছিলাম যে, আমি অতীত জীবনে সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেছি এবং আয়েশী জীবন কাটিয়েছি। সুতরাং তার প্রায়শ্চিত্যস্বরূপ অবশিষ্ট জীবন নবী মুহাম্মদ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবাদের ন্যায় অতিবাহিত করব। অতঃপর আমি দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে বিবাহের কথা আলোচিত হলে অনেক ধনী মানুষ তাদের মেয়েকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। শেষে এক কদাকার, কুৎসিত, বিধবা ও পিতৃহারা মেয়েকে বিবাহ করি। বিবাহের কথা আলোচনা করার সময় তাদের চা দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিলনা। আর আমিও এখন নিঃসম্বল হয়ে পড়েছিলাম যে, আমার হবু স্ত্রীকে এক জোড়া চপ্পলও দিতে পারিনি। এমতাবস্থায় আমাদের বিবাহপর্ব সম্পন্ন হয়। আমাদের পরিবারে এক মেয়ের জন্ম হয় ও মারা যায়। অতঃপর আল্লাহ এক পুত্র দান করেছেন যাকে- শিক্ষার জন্য মাদ্রাজে ভর্তি করেছি। আল্লাহ যেন আমাকে, আমার স্ত্রীকে ও সন্তানকে ঈমানের উপর কায়েম রাখেন। আমীন!

অনুবাদ : মাওলানা মিছবাহুদ্দীন



আরও