মুসলিম সমাজে প্রচলিত হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন (৫ম কিস্তি)

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 903 বার পঠিত

(৪৪) সতী সাধ্বী/সাবিত্রী : সতী সাধ্বী বা সাবিত্রী শব্দ দু’টি বহুল প্রচলিত এবং বাংলা সাহিত্যে প্রভূত প্রয়োগকৃত উপমা। শাব্দিক অর্থে সতী বলতে সচ্চরিত্র কুমারী নারীকে বোঝায়। আবার বহু প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় কুসংস্কার অনুযায়ী যে নারী স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর জলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দেয় তাকেও সতী বলা হ’ত। হিন্দু পুরাণ মতে, সতী ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের কন্যা এবং দেবতা শীবের স্ত্রী ছিল। প্রচলিত অর্থে সতী-সাধ্বী অর্থ অত্যন্ত সচ্চরিত্রা কন্যা। যে বিবাহের পূর্বে সতীত্ব রক্ষা করেছে এবং বিবাহের পরে নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সংস্পর্শে আসে নি। আমরা সতী সাধ্বী শব্দটি কোন নারীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যরূপে যেমন ব্যবহার করি তেমন ব্যাঙ্গার্থেও প্রয়োগ করে থাকি। অপরদিকে সতী সাবিত্রী বলতে সাবিত্রীর ন্যায় সতী স্ত্রী বোঝানো হয়। হিন্দু পুরাণে সাবিত্রী নামে একজন সাধারণ নারী ও একজন দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যিনি ধর্মগ্রন্থ বেদ প্রসব (?) করেন তিনি দেবী সাবিত্রী নামে পরিচিতি। ইনিই ত্রিদেবের অন্যতম ব্রহ্মার স্ত্রীরূপে সরস্বতী, গায়ত্রী, ব্রাহ্মণী ইত্যাদি নামে অভিহিত হন। পুরাণ উপাখ্যান অনুযায়ী মদ্র দেশে অশ্বপতি নামে ধার্মিক এক রাজা ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় সন্তান কামনায় ১৮ বছর দেবী সাবিত্রীর পূজা করেন। অশ্বপতির পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী সাবিত্রী তাকে কন্যা সন্তান হওয়ার বর দিলেন। রাজার স্ত্রী যথাসময়ে সুদর্শনা এক কন্যার জন্ম দিলেন। দেবীর নামানুসারে এই কন্যার নাম সাবিত্রী রাখা হ’ল।

এই কন্যা ধর্ম-কর্ম, শিক্ষা-দীক্ষায় এতটাই উচ্চাসীন ছিলেন যে, কোন রাজকুমার বিবাহের জন্য নিজেদেরকে তার যোগ্য মনে করত না। ফলে সাবিত্রীর বিবাহ হচ্ছিল না। একদিন অশ্বপতি সাবিত্রীকে বললেন, তুমি তোমার বিবাহের জন্য নিজেই বর অনুসন্ধানের জন্য ভ্রমণ করো। সাবিত্রী রাজ্য সচিবদের সাথে ভ্রমণে চলে যায়। অনেক দিন পরে ফিরে এসে পিতাকে জানায়, সত্যবান নামক কোন এক যুবককে সে বিবাহ করবে। সত্যবান শাল্ব দেশের রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র ছিল। বাল্য অবস্থাতেই তার পিতা অন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে শত্রু রাষ্ট্রের আক্রমণে রাজা দ্যুমৎসেন রাজ্য হারিয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ বনে জীবন কাটাচ্ছিলেন। সাবিত্রী যখন তার বিবাহের বিষয়টি স্বীয় পিতার কাছে উপস্থাপন করছিলেন সেই সময় দেবতাদের ঋষি নারদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, সত্যবান অত্যন্ত যোগ্য কিন্তু সে এক বছর পরে মারা যাবে। এ কথা শুনে রাজা অশ্বপতি তার কন্যাকে অন্য আরেকটি বর পসন্দ করতে বললেন। কিন্তু সাবিত্রী সত্যবানকেই বিবাহ করতে অনঢ় ছিল। ফলে অশ্বপতি বাধ্য হয়ে রাজ্যহারা বনবাসী রাজকুমার সত্যবানের সাথেই সতীর বিবাহ দিলেন। বিবাহের পর সাবিত্রী স্বামীর মৃত্যুক্ষণ গুনতে থাকে। এক বছর হ’তে তিনদিন অবশিষ্ট থাকতে সাবিত্রী উপবাস থেকে স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। মৃত্যুর দিন সাবিত্রী স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেবও তার সাথে বনে কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। এক পর্যায়ে সত্যবান তীব্র মাথা যন্ত্রণা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অতঃপর মৃত্যু দেবতা যম এসে তার আত্মা নিয়ে যায়। সাবিত্রী যমের পিছন পিছন যেতে থাকে। যাত্রাপথে যম বারংবার তাকে অনুসরণ করতে নিষেধ করে। কিন্তু সাবিত্রী যমকে অনুসরণ করতেই থাকে। এতে যম ও সাবিত্রীর মধ্যে কথোপকথন হ’তে থাকে। যম সাবিত্রীর চমকপ্রদ কথায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীর জীবন ছাড়া যেকোন বর চয়ণের সুযোগ দেয়। সাবিত্রী চালাকি করে পরপর চারটি বর প্রার্থনা করে। বরগুলো ছিল শ্বশুরের দৃষ্টি শক্তি ও হারানো রাজ্য, সাবিত্রীর পিতার শতপুত্র এবং সত্যবানের ঔরসজাত সাবিত্রীর গর্ভে শতপুত্র। যম সাবিত্রীর কথায় প্রভাবিত হয়ে উক্ত চারটি বর প্রদান করেন এবং পঞ্চম বর প্রার্থনার সুযোগ দেন। এই সুযোগে সাবিত্রী মৃত স্বামীর প্রাণ ফেরত চায়। সে যুক্তি দিয়ে বলে, আপনি আমাকে সত্যবানের ঔরসজাত শত সন্তানের বর দিয়েছেন যা তার জীবন ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। যেহেতু বর ফেরত নেওয়া যায় না সেহেতু যমকে বাধ্য হয়ে সত্যবানের প্রাণ ফেরত দিতে হয়। এভাবেই সাবিত্রী নিজের বিচক্ষণতায় শ্বশুরের রোগমুক্তি ও হারানো রাজ্য উদ্ধার করে এবং নিজের পিতার জন্য শত পুত্র লাভ করে। পরিশেষে স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও সতীত্বের বলে যমের হাত থেকে স্বামীর প্রাণ রক্ষা করে![1] এ সমস্ত ঘটনার আলোকেই সতী সাধ্বী বা সাবিত্রী দ্বারা সচ্চরিত্র পুণ্যবান নারী বোঝানো হয়ে থাকে। যা সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে উদাহরণ হিসাবে প্রচলিত’।[2]

(৪৫) দশচক্রে ভগবান ভূত : এটি একটি সংস্কৃত প্রবাদ। এর শাব্দিক অর্থ দশজন ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে ভগবান নামক একজন ব্যক্তিকে জীবিত ভূত হ’তে হয়েছিল। প্রবাদটির মধ্যে কোন আক্বীদাগত বিভ্রান্তি নেই। এ প্রবাদের পিছনের গল্প হ’ল, কোন এক দেশে ভগবান নামে একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী হওয়ায় সর্বদা রাজার আনুকুল্য পেতেন। এতে অন্যান্য সভাসদগণ ভগবানকে হিংসা করত। একদিন সকলে চক্রান্ত করে রাজদরবারের দ্বাররক্ষীকে বলে রাজার আদেশ রয়েছে যে, ভগবানকে কোনক্রমে দরবারে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। দ্বাররক্ষী আদেশ পেয়ে ভগবানকে দরবারে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। রাজা ভগবানের অনুপস্থিতি জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন ভগবানের মৃত্যু হয়েছে। এতে রাজা ব্যথিত হ’লেন। কিছুদিন পর রাজা নগর ভ্রমণে বের হ’লেন। এ খবর পেয়ে ভগবান রাজার সাক্ষাতের জন্য গেল কিন্তু রাজার অনুচর ও জনতার ঢল অতিক্রম করতে পারছিল না। তখন সে এক গাছে উঠে চিৎকার করে বলতে থাকে, হে মহারাজ! আমি সেই ভগবান পন্ডিত। রাজা ভগবানের চিৎকার শুনে সেদিকে তাকানো মাত্র রাজার মন্ত্রীরা বলে, ভগবান মারা গিয়ে ভূত হয়ে এসেছে। অতএব আপনি দ্রুত এই রাস্তা ত্যাগ করুন। রাজা মন্ত্রীদের কথা শুনে সেখান থেকে চলে গেলেন। সেদিন ভগবান দুঃখ করে বলেছিলেন, কেবল রাজ সেবা করলেই ফল পাওয়া যায় না বরং রাজ চক্রের সেবাও করতে হয়। আহ! আজ দশচক্রে পড়ে ভগবানকে ভূত হ’তে হ’ল।[3] মূলত এ ঘটনার ভিত্তিতেই প্রবাদটির উৎপত্তি ঘটে। এ প্রবাদের অর্ন্তর্নিহিত অর্থ হ’ল, দশজন কারো বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে সে ব্যক্তি যেমনই হৌক না কেন তাকে নানারূপ নির্যাতন ভোগ করতে হয়।[4] প্রবাদটির মধ্যে কোন আক্বীদাগত সমস্যা বা ধর্মীয় অসঙ্গতি না থাকলেও এটি যেন বর্তমান সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

(৪৬) মান্ধাতার আমল : আমরা অতি প্রাচীনকালের কথা বোঝাতে মান্ধাতার আমল প্রবাদটি প্রায়শই ব্যবহার করে থাকি। মান্ধাতা অতি প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীর একজন চরিত্র। তার জন্ম বিবরণ নিয়ে অদ্ভূত কাহিনী রয়েছে। সেটা হ’ল, সূর্য বংশীয় প্রাচীন রাজা যুবনাশ্বের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঋষিদের গৃহে বসবাস করছিলেন। পরবর্তীতে একদিন ঋষিদের সহায়তায় যুবনাশ্ব পুত্র প্রাপ্তির জন্য যজ্ঞ আরম্ভ করেন। অতঃপর সেদিন গভীর রাত্রে পিপাসার্ত হয়ে যুবনাশ্ব যজ্ঞ বেদীতে রাখা মন্ত্রপূত পানি পান করে নিজেই গর্ভবতী হয়ে যান (?)। যুবনাশ্বের গর্ভে মান্ধাতার জন্ম হয়! মান্ধাতার বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। বলা হয়ে থাকে সূর্যের উদয়-অস্তব্যাপী বিস্তৃত ছিল মান্ধাতার রাজ্য’।[5] রামায়ণে বর্ণিত আছে যে, রাজ্য বিস্তারের জের ধরে মান্ধাতার সাথে রাক্ষস রাবণের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেউ পরাস্ত না হওয়ায় ঋষি পুলস্ত ও গালব দু’জনের মধ্যে সখ্যতা স্থাপন করে দেন’।[6] এ সমস্ত পৌরাণিক বর্ণনার উপর ভিত্তি করে পুরনো কোন ঘটনা বা বিষয়ের অবতারণা প্রসঙ্গে মান্ধাতার আমল কথাটি উল্লেখ করা হয়।

(৪৭) অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট : চৈত্র মাসের শেষ দিন শিবের পূঁজা উৎসবকে গাজন বলা হয়। গাজনের সময় ভক্ত-সন্ন্যাসীরা তিন থেকে পনেরো দিন পর্যন্ত উপবাস করে থাকে। গাজন উৎসব অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। উৎসবগুলোর মধ্যে সার্কাস জাতীয় বিভিন্ন খেলা যেমন- আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা, জিহবায় শলা ফোঁড়া, পিঠের শিরদাঁড়ায় বড়শি বিঁধানো অন্যতম। এ অনুষ্ঠানে সাধু-সন্ন্যাসীদের সংখ্যা যত বাড়ে দ্বন্দ্ব-কলহের সাথে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা ততই বৃদ্ধি পায়। এতে গাজনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তদ্রূপ একটি কাজে একাধিক লোক হাত লাগালে নিজেদের মধ্যে অন্তকলহে কাজটি পন্ড হয়ে যায়। সেজন্য অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও একটি সাধারণ কাজ যখন সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয় না তখন সে পরিস্থিতিকে সজ্ঞায়িত করতে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি অনুসারে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়’।[7]

(৪৮) ঠুঁটো জগন্নাথ : বাংলা অভিধানে ঠুঁটো জগন্নাথ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে শক্তি থাকা সত্ত্বেও কোন কাজ করতে অক্ষম এমন’।[8] ঠুঁটো শব্দের অর্থ হাতবিহীন। আর জগন্নাথ বলতে জগতের পালনকর্তা তথা দেবতা নারায়ণ বা বিষ্ণুকে বোঝানো হয়। তবে জগন্নাথ নামে এক দেবতার পূঁজা বাংলাদেশ-ভারতে ধুমধামের সাথে পালন করা হয়। ভারতের উড়িষ্যার পুরীতে দেবতা জগন্নাথের মন্দির রয়েছে। জগন্নাথ নামে একজন দেবতা ও বাংলায় তাঁর নামে প্রবাদ চালু হওয়ার পিছনে লম্বা কাহিনী প্রচলিত আছে। মহাভারতের মহা বিধ্বংসী যুদ্ধের পর বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণের সমৃদ্ধ যাদব বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। কৃষ্ণ তখন তাঁর নগরী দ্বারকা ছেড়ে বনে গাছের নীচে শুয়ে থাকে। এ সময় জরা নামে এক শিকারী হরিণ ভেবে কৃষ্ণকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। সেই তীরের আঘাতে কৃষ্ণের মৃত্যু ঘটে। কৃষ্ণের মৃত দেহ সেখানেই পড়ে থাকে। পরে কোন একজন সেই দেহাস্থি সংগ্রহ করে রাখে। পরবর্তীতে সেই দেহাস্থি মালব দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের হস্তগত হয়। তিনি সেই অস্থির সমন্বয়ে মূর্তি স্থাপনের জন্য দেবতাদের শিল্পী বিশ্বকর্মাকে আমন্ত্রণ জানান। বিশ্বকর্মা মূর্তি বানাতে সম্মত হন। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেন যে, মূর্তি বানানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত কক্ষের দরজা বন্ধ থাকবে। কেউ যদি কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগে সেটা দেখতে যায় তাহ’লে তিনি কাজ ছেড়ে চলে যাবেন। বিশ্বকর্মা দরজা বন্ধ করে মূর্তি বানানো শুরু করলেন। উল্লেখ্য যে, মূর্তি কাঠ খোদাই করে বানানো হচ্ছিল। পনের দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। আবার ঘর থেকে খোদাই করারও কোন শব্দ আসছিল না। ফলে রাজা কৌতুহলী হয়ে দরজা খুলে ফেলেন। ফলে বিশ্বকর্মা মূর্তি খোদাই অসম্পূর্ণ রেখে চলে যান। দেখা গেল তখনও মূর্তির হাত পা নির্মাণ হয়নি। অগত্যা মূর্তি সে অবস্থাতেই থাকল। পরবর্তীতে ব্রহ্মার আদেশে হাত-পা বিহীন মূর্তির নামকরণ করা হয় জগন্নাথ এবং এই ঠুঁটো মূর্তির পূঁজা শুরু করা হয়’।[9]

এই ঘটনার আলোকেই শক্তিমান বলে বিবেচিত অলস, অকর্মন্য, প্রচেষ্টাহীন ব্যক্তিকে বিশেষায়িত করতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।

(৪৯) রথ দেখা ও কলা বেচা : এই প্রবাদটির সাথে ইসলামী আক্বীদার সংঘর্ষ না থাকলেও এর উৎসস্থল হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি। দেবতা জগন্নাথ, কৃষ্ণের সৎভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রার সাথে পূজিত হন। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে জগন্নাথের রথযাত্রা উৎসব আয়োজন করা হয়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি একটি রথযানে স্থাপন করে দঁড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয় রথের দঁড়ি টানা পুণ্যের কাজ। এ সময় জগন্নাথ ভক্তরা কলা, পান, চিনি ইত্যাদি বস্ত্ত ভাগবানকে নিবেদন করতে থাকে। সেজন্য রথ যাত্রায় রাস্তার দু’পাশে কলা, পান ও চিনি বিক্রির মেলা বসে। এই মেলায় আগত দোকানীদের রথযাত্রা দেখাও হয় আবার কলার ব্যবসাও রমরমা হয়। এ কারণে যদি কেউ একই সঙ্গে দু’দিক থেকে লাভবান হয় তখন রথ দেখা ও কলা বেচা অথবা মেলা দেখা ও কলাবেচা প্রবাদ ব্যবহার করা হয়’।[10]

(৫০) মধ্যযুগীয় বর্বরতা : দীর্ঘদিন থেকে ব্যবহৃত মধ্যযুগীয় বর্বরতা শব্দটি একটি প্রবচন। শাব্দিক অর্থে মধ্যযুগে কৃত পৈশাচিক আচরণকে বোঝানো হয়। কারো উপরে মাত্রাতিরিক্ত অন্যায়-অবিচার কিংবা নির্যাতন করা হ’লে উক্ত প্রবচনের প্রয়োগ করা হয়। ঐতিহাসিক ও অভিধান বিদগণের মধ্যে এ যুগের সময়কাল নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ইউরোপীয় ইতিহাসে রোম সাম্রাজ্যের পতন থেকে কনস্টান্টিনোপল সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত (৫০০-১৪৫৩ খ্রি.) সময়কালকে মধ্যযুগ বোঝানো হয়’।[11] কেউ চতুর্থ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী আবার কেউ পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীকে মধ্যযুগ বলেছেন। ভারতীয় ইতিহাসে ১১শ’ থেকে ১৭শ’ শতাব্দীকে মধ্যযুগ বলা হয়েছে। তাদের মতে এই যুগের ধারাবাহিক ইতিহাস থাকলেও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারাদি না হওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি।[12] ভারতভূমির ইতিহাসে এই যুগে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবহীনতার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা আদৌ ঠিক কি-না সেটা খতিয়ে দেখার বিষয়। কিন্তু সে সময় শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা ইতিহাস থেকে ভুরি ভুরি প্রমাণ উপস্থাপন সম্ভব। এক্ষণে মধ্যযুগের সময়কাল থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই সময়ে স্বয়ং বিশ্বমানবতার নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব ও তিরোধান ঘটে। সুতরাং এখান থেকে বোঝা যায়, মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলতে ইসলামের উৎকর্ষতাকে টার্গেট করা হয়েছে। কেননা এই সময়ে রোমানদের পতন ঘটে। সেজন্য রোমান সাম্রাজ্যের বর্বরতার গ্লানি ইসলামের উৎকর্ষতার উপয় চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এই প্রবচন ব্যবহার করা হয়। যে যুগে স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) জীবিত ছিলেন সে যুগকে অন্ধকার যুগ বা বর্বর যুগ আখ্যায়িত করা কূপমন্ডুকের কাজ ছাড়া কিছুই নয়। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইসলাম আসার পূর্বে আরব জাতি বর্বর ছিল। কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমস্ত বর্বরতাকে জীবন্ত দাফন করার মাধ্যমে। এরপরে ইসলামে আর কোন বর্বর যুগ ছিল না। কেননা ইউরোপে ৮ম শতাব্দীতে ইসলাম প্রবেশ করে। তার পূর্বেও ইসলাম ছিল কিন্তু ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে ৮ম শতকে এবং পতন হয় পঞ্চদশ শতকে।

ভারতে ১১ শতকে ইসলাম আগমন করে বলে ইতিহাসে লেখা হ’লেও রাসূল (ছাঃ)-এর সময় থেকেই ভারতবর্ষে ইসলামের অস্তিত্ব ছিল। অন্ধকার যুগের যে সময়কাল নির্দেশ করা হয়েছে সেই সময়ে সমগ্র বিশ্বে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলামেরই জয়জয়কার ছিল। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নববীর শিক্ষার আলো সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বায়তুল হিকমাহ বিশ্ববিদ্যালয়, স্পেনের কর্ডোভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮ম শতকে, মিশরের বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল-আযহার প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে, বাগদাদের নিজামীয়া মাদ্রাসা ১০৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠত হয়। যা মূলত বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এছাড়াও আল-বিরুনী, আল-কিন্দি, জাবের ইবনে হাইয়ান, ইবনে সীনা, ওমর খৈয়ামের মত বিজ্ঞানী, জ্যোর্তিবিদ, গণিতবিদ, রসায়নবিদ ও জীববিজ্ঞানীদের জীবনী ও ঐতিহাসিক কর্ম মওজুদ থাকতে মধ্যযুগ কীভাবে বর্বর হ’তে পারে? যে সময় ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল সে সময় ইসলামী বিশ্ব অহি-র আলোয় উদ্ভাসিত ছিল। সেজন্য ইউরোপীয়রা তাদের ছাপাখানা আবিষ্কার তথা শিল্প বিপ্লবের পূর্বের সময়কে অন্ধকার যুগ এবং এর প্রভাবে ইসলামের উৎকর্ষতার পতনকে আধুনিক যুগ নামকরণ করে। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, ইউরোপীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়েও আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ ইসলামকে আক্রমণ করে কথা বলার জন্য ইসলামের উৎকর্ষের সময়কেই মধ্যযুগীর বর্বরতা বলে কটূক্তি করে থাকেন। আর আমরা অনুকরণ প্রিয় জাতি জেনে না জেনে হরহামেশা বাক্যটি ব্যবহার করে যাচ্ছি।

(৫১) অগ্নিপরীক্ষা : অগ্নিপরীক্ষা শব্দটি দ্বারা কঠিন পরীক্ষা বোঝানো হয়। শব্দটির প্রেক্ষাপট নিশ্চিতরূপে জানা না গেলেও উৎসস্থল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বাংলা অভিধান অনুযায়ী অগ্নি এবং পরীক্ষা শব্দ দু’টি সংস্কৃত শব্দ হ’তে বাংলায় আগত। অগ্নি বলতে আমারা শুধুমাত্র আগুনকেই বুঝে থাকি। কিন্তু হিন্দু ধর্মালম্বীরা অগ্নি বলতে আগুনের দেবতাকেও বোঝায়। মহাভারত ও ঋগ্বেদে অগ্নির জন্মের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। প্রসিদ্ধ মতানুসারে ঋষি কশ্যপের ঔরশে দেবতাদের মাতা অদিতির গর্ভে অগ্নির জন্ম হয়। ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি দক্ষের কন্যা স্বাহা অগ্নির স্ত্রী। অগ্নি দেবতাকে পূর্ব ও দক্ষিণের মধ্যবর্তী কোণের অধিষ্ঠাতা বলা হয়’।[13] মহাভারতে ব্রহ্মা অগ্নিকে পবিত্র বলেছেন। সেজন্য কোন কিছুর শুদ্ধাশুদ্ধ নির্ণয়ের জন্য আগুনে পরীক্ষা করা হয়। পুরাণ মতে, দক্ষ পুত্রী শিবের স্ত্রী সতী এবং মহাভারতে উল্লেখিত কাশি রাজার কন্যা অম্বা স্বেচ্ছায় আগুনে আত্মাহুতি দেয়। রামায়ণে রামের স্ত্রী সীতাকে আগুনে ঝাপ দেওয়ার মাধ্যমে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়। ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণের মত নির্দয় প্রথার বলী হ’তে হ’ত। সুতরাং ধারণা করা যায়, হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী আগুনকে পবিত্র মানার কারণে এবং রামায়ণের সীতার অগ্নি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই মূলত উক্ত শব্দ ও ভাবার্থের উদ্ভব ঘটে।

(৫২) অগ্নি কন্যা : অগ্নি বা আগুনের ন্যায় তেজস্বী কন্যাকে অগ্নিকন্যা শব্দ দ্বারা আখ্যায়িত করা হয়। এই শব্দটি সংস্কৃত হ’লেও এর সাথে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের কোন সংযোগ পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায় এটি মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র দ্রৌপদীর জন্ম কথন থেকে এসেছে। পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। এক যুদ্ধে হস্তিনা পুরের রাজগুরু দ্রোনাচার্যের কাছে দ্রুপদ হেরে যায়। ফলে প্রতিশোধ নিতে দ্রোনাচার্যকে হত্যা করতে পারবে এমন তেজস্বী পুত্র কামনায় যজ্ঞের আয়োজন করে। সেই যজ্ঞের আগুন থেকে দ্রুপদ পুত্র ধৃষ্টদ্যুন্ম এবং কন্যা দ্রৌপদীর জন্ম হয়।[14] পরবর্তীতে মহাভারত যুদ্ধে দ্রুপদ পুত্র দ্রোনাচার্যকে হত্যা করে। আর ১৮ দিন ব্যাপী মহাভারত যুদ্ধ শুরুই হয় মূলত হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকে কেন্দ্র করে। হ’তে পারে এ সমস্ত ঘটনার আলোকে বীরপুরুষ কিংবা নারীর উপমা দেওয়ার জন্য অগ্নিপুরুষ ও অগ্নিকন্যা শব্দের প্রচলন ঘটেছে।

(৫৩) আত্মাহুতি : এটি কোন প্রবাদ নয় বরং একটি সংস্কৃত শব্দ। আত্মাহুতি শব্দের অর্থ মহৎ কাজের উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ। এ শব্দের আরো একটি অর্থ পূঁজার উপকরণ।[15] আহুতি ও অর্ঘ্য শব্দ দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূঁজার উপকরণ বোঝানো হয়। বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যজ্ঞের আগুনে যে পূজার সামগ্রী দেওয়া হয় তাই অর্ঘ্য বা আত্মাহুতি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে অভীষ্ট ইচ্ছা পূরণে বিভিন্ন বস্ত্তর সাথে সাথে শরীরের অঙ্গ পর্যন্ত যজ্ঞের আগুনে আত্মাহুতি দেওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। সুতরাং অর্ঘ্য ও আত্মাহুতি শব্দদ্বয় হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির অংশ বিশেষ। এ সমস্ত শব্দ আমাদের ত্যাগ করা উচিত।

(৫৪) শনির দশা : রাহুর দশা ও শনির দশা প্রবাদটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে শনি অন্যতম। হিন্দ ধর্ম বিশ্বাস মতে শনি গ্রহের একজন দেবতা আছে যাকে শনি দেবতা বলা হয়। শনিকে কর্মফল দাতা বলা হয়। মানুষের ভাল-মন্দ কর্মের ফল শনি দেবতা দিয়ে থাকেন। এজন্য শনির দৃষ্টি যার উপর পড়ে তার জীবন সুখময় অথবা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। শনির বক্র দৃষ্টির প্রভাবে অনেক মানুষের অমঙ্গল হয়েছে এমন ঘটনা পুরাণ এবং পুথি কাব্যে পাওয়া যায়। শনি গ্রহের এমন প্রভাবের পিছনে দীর্ঘ ঘটনা বিভিন্ন পুরাণে রয়েছে। শনি দেবতা সূর্যের পুত্র। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ মতে, একদা শনি কৃষ্ণ ধ্যানে মত্ত ছিল। এমন সময় তাঁর স্ত্রী সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে শনির সঙ্গম প্রার্থনা করে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু শনি তাঁর স্ত্রীর দিকে কোনক্রমেই দৃষ্টিপাত করে না। এতে স্ত্রী ক্ষুদ্ধ হয়ে তাকে অভিশাপ দেয় যে, শনি যার দিকে দৃষ্টি দিবে তারই ধ্বংস হবে’।[16] সেদিনের পর থেকে শনি কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। যেহেতু শনিকে দন্ডদাতা বা কর্মফল দাতা হিসাবে মান্য করা হয়, সেজন্য শনির দৃষ্টিপাতকে হিন্দুরা সবাই ভয় করে। এ কারণে কারো দুঃসময় আসলে ধারণা করা হয়, শনি গ্রহ তার উপর দৃষ্টিপাত করেছেন। এটাকে শনির বক্র দৃষ্টির প্রভাব বলা হয়। আর এই প্রভাবই উপমহাদেশে শনির দশা নামে প্রচলিত। যা সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত ও ইসলামী আক্বীদা বিরোধী বিষয় ভিন্ন কিছু নয়। 

(৫৫) রাহুর দশা : অত্যন্ত দুঃসময় কিংবা খারাপ অবস্থা বোঝাতে রাহুর দশা বাক্য প্রয়োগ করা হয়। এই প্রবাদটি বিধর্মীয় একটি ঘটনা অবলম্বনে সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহাভারতের বর্ণনামতে অমৃত প্রাপ্তির আশায় দেবতা ও অসুররা একত্রে কোন এক ক্ষীর সমুদ্র মন্থন করে’।[17] অমৃত পাওয়ার পর দেবতা ও অসুরদের মধ্যে অমৃতের বণ্টন নিয়ে বিরোধ হয়। এ সময় দেবতা বিষ্ণু অবতারিত হয়ে মোহিনী নামে নারীরূপ ধারণ করে দেবতা ও অসুরদের স্বীয় সৌন্দর্যের মোহে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে। মোহিনীর মোহে অমৃত বণ্টনের ভার তারা মোহিনীর উপর অর্পণ করে। মোহিনী প্রথমে দেবতাদের অমৃত পান করাতে থাকে। এ সময় রাহু নামে এক অসুর মোহিনীকে সন্দেহ করে দেবতারূপ নিয়ে চন্দ্র ও সূর্য দেবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে ফেলে। চন্দ্র ও সূর্য দেবতা রাহুকে চিনতে পেরে মোহিনীরূপী বিষ্ণুর কাছে রাহুর পরিচয় বলে দেয়। মোহিনী তখন স্বীয় বিষ্ণুরূপে ফিরে এসে তাঁর সুদর্শন চক্র অস্ত্রের সাহায্যে রাহুকে দ্বিখন্ডিত করে। যেহেতু রাহু অমৃতের কিছু অংশ পান করে সেজন্য তার মাথা অমর হয়ে যায়। সেই থেকে রাহুর মাথাকে রাহু এবং ধড়কে কেতু নামকরণ করা হয়েছে। অমরত্ব পাওয়ার কারণে রাহু-কেতুকে সৌরজগতের গ্রহের মর্যাদা দেওয়া হয় বলে হিন্দু ধর্ম ও তাদের জ্যোতিষশাস্ত্রে বর্ণনা পাওয়া যায়’।[18] চন্দ্র ও সূর্য রাহুর প্রকৃতরূপ ফাঁস করার কারণে রাহু চন্দ্র ও সূর্যের কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এমনকি রাহু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করে বিধায় চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে’।[19] এজন্য অনেকেই চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণকে রাহুগ্রাস নামে আখ্যায়িত করেন। ধারণা করা হয় অন্যান্য গ্রহের তুলনায় মানুষের জীবনে রাহুর প্রভাব অত্যন্ত ভয়ানক। রাহুর প্রভাবে মানুষ নানাবিধ কষ্ট ভোগ করে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে (?)। এজন্য মানুষ ভয়ানক কষ্টে পড়লে সেটাকে রাহুর দশা বলা হয়’।[20]

(৫৬) রুদ্র রূপ : রুদ্র একটি সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ ভীষণ, ভয়ংকর। বাংলা অভিধান অনুযায়ী রুদ্র শব্দের অর্থ শিবের সংহার মূর্তি’।[21] অর্থাৎ শিবের ভয়ংকর রূপকে রুদ্র রূপ বলা হয়। রুদ্র শব্দের আরেকটি অর্থ হ’ল গর্জনকারী অথবা যারা শিকড় থেকে সমস্যা দূর করেন’।[22] রুদ্র থেকে রুদ্রমূর্তি শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। রুদ্রমূর্তি শব্দের অর্থ ভীষণ আকৃতিবিশিষ্ট। প্রতিটি অর্থের সারমর্ম হিন্দু দেবতা শিবের বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। যিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার জন্য ভীষণ ভয়ংকর আকৃতি ধারণ করে সমস্যার মূলোৎপাটন করে থাকেন। শিবের এই রূপই রুদ্ররূপ কিংবা রুদ্রমূর্তি। ঋগ্বেদ ও বিষ্ণু পুরাণে রুদ্রের আলোচনা এসেছে। শিবের এগারোটি অবতারের কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এর বেশীও পাওয়া যায়। এ সমস্ত অবতারের মধ্যে প্রসিদ্ধ রুদ্র অবতার কাল ভৈরব, বীর ভদ্র এবং হনুমান উল্লেখযোগ্য। দক্ষ যজ্ঞ ব্যাপার প্রবাদে আমরা আলোচনা করেছি যে, দক্ষ কন্যা সতী নিজ পিতার মুখে স্বামী শিবের অপমান সহ্য করতে না পেরে আগুনে আত্মাহুতি দেয়। এতে শিব দক্ষের অহংকার চূর্ণ করার জন্য বীর ভদ্র নামক রুদ্ররূপ ধারণ করে। এছাড়াও কথিত আছে যে, ব্রহ্মার কপাল থেকে বালকরূপে রুদ্রের জন্ম হয়। জন্ম মাত্রই সে ভীষণ গর্জন করতে থাকে এবং সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করে। ব্রহ্মা তাঁর গর্জন থামায়। সূর্যলোকে তাকে অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয়। ইনি একাদশ মূর্তিতে একাদশ রুদ্র নামে খ্যাত’।[23] সুতরাং এ আলোচনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হ’ল, আমরা ভয়ংকর কিছু বোঝানোর জন্য রুদ্ররূপ, রুদ্রমূর্তি যে শব্দদ্বয় ব্যবহার করি মূলত হিন্দু শাস্ত্রের ভয়ংকর দেবতাকে বোঝায়। অতএব এ সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করা হ’তে আমাদের বিরত থাকা ঈমানী দায়িত্ব।

(৫৭) নাড়ী নক্ষত্র : নাড়ী নক্ষত্র প্রবাদ দ্বারা আগাগোড়া সমস্ত খবর, জন্মাবধি সমস্ত বৃত্তান্ত, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় বোঝানো হয়’।[24] এই প্রবাদটি মূলত ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রীয় জ্যোতিবির্দ্যা থেকে এসেছে। পুরাণে বিশিষ্ট ঋষির পুত্র পরাশরকে জ্যোর্তিবিদ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই পরাশর ঋষি ও হস্তিনাপুরের রাজমাতা সত্যবতীর বিবাহ বর্হিভূত সন্তানই মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বা বেদব্যাস ছিলেন। যাহোক ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে ২৭ প্রকার নক্ষত্রের ও ৯টি গ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। নক্ষত্রগুলো হ’ল অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিয়া, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফাল্গুণী, উত্তর ফাল্গুণী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মুলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তর আষাঢ়, শ্রবণা, ধনিষ্টা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ ও রেবতী।[25] অপরদিকে গ্রহগুলো যথাক্রমে সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু। এই নয়টি গ্রহ ও সাতাশটি নক্ষত্রের নিজস্ব শক্তি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নক্ষত্রের মিলিত শক্তি যোগ তৈরি করে মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। গ্রহ-নক্ষত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ১২টি রাশি চক্রে বিভক্ত করা হয়েছে। ১২টি রাশির ১২টি প্রতীক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার রাশিফল অংশে দেখা যায়। মানুষের জন্ম সময়ের উপর নির্ভর করে নক্ষত্র যোগ বের করা হয়। অতঃপর যে নক্ষত্রের যোগ পাওয়া যায় সে নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হয়। এটিই মূলত রাশিফল। এরই মাধ্যমে মানুষের জীবনের আদ্যোপান্ত জানা যায় বলে নাড়ী নক্ষত্র প্রবাদ দ্বারা ‘আগাগোড়া সমস্ত খবর’ অর্থ প্রকাশ করে। জ্যোতির্বিদদের এ সমস্ত কপোল কল্পিত ব্যাখ্যা সরাসরি ইসলামী আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ গ্রহ-নক্ষত্র মহান আল্লাহর সৃষ্টি। এসমস্ত সৃষ্ট বস্ত্ত আল্লাহর হুকুম ছাড়া মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মানুষকে যে জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সেটা ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষ ভাল-মন্দ পথ বেছে নেয়। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন। নক্ষত্র স্রেফ আকাশের সৌন্দর্য মাত্র।

(৫৮) অরুণ : বাংলা অভিধান অনুযায়ী অরুণ শব্দের অর্থ নবোদিত সূর্য, সন্ধ্যাকালীন সূর্যের আভা’।[26] অর্থাৎ সকালের সূর্য প্রকাশ হওয়ার পূর্বে এবং সন্ধ্যা আকাশে যে সূর্য কিরণ দেখা যায়, তাকেই অরুণ বলা হয়। তবে পুরাণে অরুণের ব্যতিক্রম পরিচয় পাওয়া যায়। অরুণ ঋষি কশ্যপ ও বিনতার সন্তান। অরুণ বিনতার গর্ভে নয় বরং ডিমের মধ্যে ছিল! জন্ম নিতে দেরী হওয়ায় ডিম ফোঁটার পূর্বেই বিনতা ডিম ভেঙ্গে ফেলে। তাতে অরুণ জানুহীন অপূর্ণাঙ্গভাবে জন্মগ্রহণ করে।[27] পরবর্তীতে সূর্য দেবতা তাকে রথের সারথি হিসাবে গ্রহণ করেন। যেহেতু ধারণা করা হয় সূর্য প্রতিদিন রথে আরোহন করে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, সেজন্য রথ সারথি হিসাবে সকালে সূর্যের পূর্বে অরুণকে দেখা যায়। এমনকি সূর্য ডোবার সময়ও অরুণ আভা ফুঁটে উঠে। সম্ভবপর এখান থেকেই সূর্য সারথি প্রবাদটির উৎপত্তি ঘটেছে। সূর্যের সারথি অরুণ যেমন প্রথম কিরণের মাধ্যমে পৃথিবীকে আলোকিত করে। তদ্রূপ কোন ব্যক্তি সমাজ সংস্কারে অবদান রাখলে তাকে উপমায়িত করতে সূর্য সারথি শব্দ ব্যবহার করা হয়। যা ইসলামের সাথে পরিপূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক এবং হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

(৫৯) গৌরচন্দ্রিকা : বৈষ্ণব দর্শনের নবীনতম প্রবক্তা শ্রীচৈতন্য দেব। তাঁর অপর নাম গৌরাঙ্গ বা গৌরচন্দ্র। তিনি ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৪৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪ই জুন ১৫০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে কৃষ্ণের অবতার মনে করা হ’ত’।[28] তিনি মূলত সকল জাত ভেদাভেদ ভুলে কৃষ্ণের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের

মানুষকে আহবান করতেন। বৈষ্ণবদের অনুষ্ঠানের শুরুতেই শ্রীচৈতন্যের বন্দনা করা হ’ত। সেই থেকে গৌরচন্দ্রিকার অর্থ ভূমিকা নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, চমকপ্রদ শব্দের আড়ালে কিভাবে বাংলার মুসলিম সমাজে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির বিষবাষ্প ঢুকে গেছে। [ক্রমশঃ]

- মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

[লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ এবং এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।]


[1]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, (কলকাতা এম. সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮ সন), বনপর্ব, পৃ. ২৫২-২৫৮।

[2]. ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অনুবাদ : শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, (কলকাতা দেব সাহিত্য কুটীর, পুনর্মুদ্রণ ১৩৬০ বঙ্গাব্দ) প্রকৃতি খন্ড, ১৩তম অধ্যায়, পৃ. ১৪৫-১৫৪।

[3]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ. ১৫০৭।

[4]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫৬।

[5]. বিষ্ণু পুরাণ, অনুবাদ : শ্রীরামসেবক বিদ্যারত্ন, ষষ্ঠ খন্ড, চতুর্থ অংশ, পৃ. ৪১০-৪২১।

[6]. রামায়ণ, রাজশেখর বসু, ১৩তম মুদ্রণ : বাংলা ১৪১৮ সন, উত্তরকান্ড, পৃ. ৪১১।

[7].প্রবাদের উৎস সন্ধান, সমর পাল, ৩য় প্রকাশ-২০১৬, পৃ. ২৮-২৯।

[8]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ৫৬১।

[9]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, পৃ. ৫৬৬।

[10]. প্রবাদের উৎস সন্ধান, সমর পাল, ৩য় প্রকাশ-২০১৬, পৃ. ১৩৪।

[11]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ১০৭৪ ।

[12]. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, সংকলক : শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, প্রকাশক : শ্রীমহেন্দ্রনাথ দত্ত, পুনর্মুদ্রণ : মে ১৯৭৩, পৃ. ৬৭৯।

[13]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, পৃ. ১৫

[14]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, পৃ. ৭১-৭২

[15]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ৯৫ ও ১৭৭।

[16]. ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, অনুবাদ : শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, (দেব সাহিত্য কুটীর, ২২৫ বি, ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা) পুনর্মুদ্রণ ১৩৬০ বঙ্গাব্দ, অষ্টম অধ্যায়, গণেশ খন্ড, পৃ. ২১৮

[17]. বিস্তারিত : অত্র প্রবন্ধ, ৩য় কিস্তিত, মার্চ-এপ্রিল ২০২২

[18]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, পৃ. ১৫; শ্রীমদ্ভাগবত, বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা : শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ ভট্টাচর্য, (পি.এম. বাকিচ এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড) কলিকাতা, গোহাটী, ৯ম সংস্করণ, বাংলা ১৩৮৩ সন, পৃ. ৪৮৯-৯০।

[19]. Madan Gopal, India Through The Ages, Publication Division, Ministry of Information and Broadcasting, Govt. of India, March 1990, page-125

[20]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, পৃ. ১৬১০।

[21]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ১১৮৪।

[22]. https://bn.wikipedia.org › wiki › রুদ্র

[23]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, পৃ. ১১৭৬।

[24]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫৬।

[25]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩৭।

[26]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৯৪

[27]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, পৃ. ১৩৯

[28]. https://bn.wikipedia.org › wiki › গৌরচন্দ্রিকা



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও