মুসলিম সমাজে প্রচলিত হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন (৬ষ্ঠ কিস্তি)

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 1190 বার পঠিত

(৬০) গোবর গণেশ : বাংলা একাডেমী আধুনিক বাংলা অভিধান মতে, বাংলা শব্দ গোবর ও সংস্কৃত শব্দ গণেশ মিলে উদ্ভূত গোবর গণেশ। যার অর্থ গোবরের তৈরি গণেশ মূর্তির মত অকর্মণ্য, ব্যক্তিত্বহীন ও নির্বোধ’।[1]

হিন্দু শাস্ত্রে যেমন গরুকে দেবতা হিসাবে মান্য করা হয় তদ্রূপ গরুর গোবরকেও পবিত্র ও ঔষধী গুণসম্পন্ন (?) উপাদান হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়াও প্রচলিত আছে যে, গাভীর পেছন অংশে সুখ-সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর বসবাস। সেকারণে গাভীর গোবর অত্যন্ত পবিত্র। তাই সংসার সমৃদ্ধির আশায় গ্রাম বাংলার হিন্দু বাড়িগুলোর উঠোন প্রতিদিন সকালে গোবর দিয়ে লেপা হয়। এক্ষণে গণেশ হ’ল হিন্দু শাস্ত্রের একজন বিখ্যাত বৈদিক দেবতা। তার মস্তক হাতীর মত আর ধড় মানুষের মত। প্রত্যেক কাজের পূর্বে তাকে পূজাঁ করা হয় যেন কাজে কোন বাধা-বিঘ্ন না ঘটে। তাকে জ্ঞান বা বুদ্ধির দেবতা বলা হয়। ধারণা করা হয়, গোবরের তৈরি গণেশ অত্যন্ত পবিত্র, জাগ্রত এবং শুভ ফল প্রদানকারী। এ বিশ্বাস থেকেই গোবরের তৈরি গণেশ মূর্তি পূ্ঁজার উদ্ভব ঘটেছে। ভারতের কিছু প্রদেশে গোবরের তৈরি গণেশ মূর্তির মন্দির রয়েছে। ২০২০ সালে পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য ভারতের কয়েকটি প্রদেশে কিছু সংস্থা গোবরের গণেশ মূর্তি তৈরি করে’।[2] যাতে পূঁজা শেষে সেগুলো দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়।

সুতরাং প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী গোবর গণেশ প্রবাদ দ্বারা অকর্মণ্য ও নির্বোধ ব্যক্তিকে কটাক্ষ করা হয়। কিন্তু প্রবাদটির উৎপত্তি বিধর্মী আক্বীদা থেকে, যে আক্বীদা বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে বাংলার মুসলিম সমাজে ইসলামী আক্বীদা বিধ্বংসী অস্ত্র হিসাবে নীরবে কাজ করে চলেছে। মহান আল্লাহ মানুষের খেদমতে পশু-পাখি সৃষ্টি করেছেন। কোন পশুর কতটুকু অংশ উপকারী তা মহান আল্লাহ হালাল হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে পশুর মল-মূত্রকে মানুষের খাদ্য তৈরির সহায়ক হিসাবে আবিষ্কার করেছে। এ পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান গরুর গোবরে কোন ঔষধী গুণ খুঁজে পেয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। পৃথিবীতে শুধুমাত্র মৌমাছির মল তথা মধুকে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যার ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তা স্বীকৃত। এ বিষয়ে পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষ একমত। খোদ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও সেটা মানেন। এক্ষেত্রে যৌক্তিকতা বিবেচনায় প্রশ্ন আসে যে, মধুর এত গুণ থাকা সত্বেও হিন্দুরা কেন মৌমাছির পূঁজা করে না? সুস্থ বিবেকবান মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীব কিংবা জীবের মল কী করে পূঁজনীয় হ’তে পারে? তাহ’লে সৃষ্টিকর্তা আর সৃষ্ট জীবের মধ্যে কী পার্থক্য থাকল? বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, স্বয়ং পশুরাও তাদের মলকে পবিত্র জ্ঞান করে না। সেকারণে আমরা কোন পশুকে অন্য পশুর মল ভক্ষণ করতে দেখি না। অথচ সৃষ্টির সেরা জীব কতক মানুষ নামের কলংক হাস্যকরভাবে গরু ও গরুর মলের বন্দেগী করে!

(৬১) দেবতার বেলায় লীলাখেলা, পাপ লিখেছে মানুষের বেলা : লীলা একটি সংস্কৃত শব্দ। বাংলা অভিধানে লীলা শব্দের অর্থ যথাক্রমে ভাবভঙ্গি, খেলা, শৃঙ্গার রসজনিত অভিব্যক্তি, প্রমোদ, ইহলোকে নির্দিষ্টকালব্যাপী মানুষের কার্যকলাপ[3], দেবতাদের কর্ম বা আচরণ ইত্যাদি’।[4]

লীলা শব্দটি বিভিন্ন শব্দের পূর্বে বসে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রদান করে। আলোচ্য প্রবচনটির ক্ষেত্রে লীলাখেলা বলতে দেবতাদের রহস্যজনক কাজ বোঝানো হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রের অনেক দেবতা বিভিন্নরূপ ধারণ করে অনৈতিক কাজ করেছেন। বিভিন্ন পুরাণে দেবতাদের অনৈতিক কাজের বহু দৃষ্টান্ত বিদ্যমান রয়েছে। তাদের মধ্যে বিখ্যাত হ’লেন শ্রীকৃষ্ণ। এ পর্যন্ত কৃষ্ণের স্ত্রীর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। কারো কারো মতে, তার স্ত্রীর সংখ্যা ১৬ হাযার। তবে প্রচলিত মতানুসারে কৃষ্ণের স্ত্রী ৭ কিংবা ৮ জন। কৃষ্ণকে মূলত প্রেমের দেবতা বলা হয়। তার কুকীর্তির মধ্যে অন্যতম হ’ল নিজের মামীর সাথে অবৈধ প্রণয়। কৃষ্ণের মত দেবতাদের অসংখ্য অনৈতিক কাজের প্রমাণ থাকার পরেও ধর্মগ্রন্থগুলোতে সেগুলোর দূরতম ব্যাখ্যা দিয়ে বৈধ করা হয়েছে। সেগুলোকে দেবতার লীলা তথা রহস্যজনক কাজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যে কাজ মানুষের জন্য শোভনীয় নয় সে কাজ দেবতার জন্য শোভনীয় হবে না এটাই সাধারণ বিশ্বাস। কারণ দেবতাগণ সর্বোচচ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন, যার কোন তুলনা থাকবে না। অথচ সাধারণ মানুষের কৃত অপরাধের ন্যায় দেবতা যখন অপরাধ করছে, তখন লীলা শব্দের আড়ালে দেবতার অপরাধকে বাহ্বা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সে অপরাধ ঠিকই পাপ হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে। সেজন্য বিদ্রূপ করে বলা হয়েছে, দেবতা করলে লীলাখেলা আর মানুষ করলে সেটা পাপ। অর্থাৎ ক্ষমতাধর ব্যক্তি অন্যায় কাজ করলেও সেটা বৈধ। কিন্তু সাধারণ কোন মানুষ সামান্য অপরাধ করলেই সমাজের চোখে সেটা বিরাট বড় পাপ।

স্মর্তব্য যে, আমরা চলতি ভাষায় আল্লাহর ক্ষেত্রেও লীলাখেলা শব্দটি ব্যবহার করে থাকি, যা অবশ্য পরিত্যাজ্য।

(৬২) বিন্দেদূতী : কেউ মধ্যস্থতা করে দু’জনের কথা পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান করলে তাকে বিন্দেদূতী আখ্যা দেয়া হয়। পুরাণের বর্ণনানুযায়ী এক সময় কৃষ্ণ ও রাধিকার মধ্যে দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ ঘটে। তখন তাদের মিলনকল্পে বৃন্দা নামক বন সাহায্য করেছিল’।[5]

এক পর্যায়ে কৃষ্ণ মথুরায় গমন করলে বৃন্দা সেখানে গিয়ে রাধিকার অনুযোগ উপস্থাপন করে। এজন্য কেউ কারো কথা আদান-প্রদান করলে তাকে ‘বৃন্দেদূতী’ তথা বৃন্দাবনের ন্যায় দূত বলা হয়’।[6]

(৬৩) শক্তের ভক্ত নরমের যম : বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে অর্থ হয়, ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তি ভুল করলেও তার বিরুদ্ধাচারণ না করে বরং তার অনুগত হয়ে থাকা। আর দুর্বল কোন ব্যক্তি সামান্য ভুল করলেই মৃত্যুর দেবতা যমের মত জীবন নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগা। অর্থাৎ ক্ষমতাবান ব্যক্তির অনুগত থাকা এবং দুর্বলের উপর অত্যাচার করা অর্থে প্রবচনটি ব্যবহৃত হয়। বাক্যটি ইসলামী আক্বীদা পরিপন্থী। কারণ এ বাক্যের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত অনিচ্ছা সত্ত্বেবও হিন্দুদের মৃত্যুর দেবতা যমের অস্তিত্ব স্বীকার করছি। সুতরাং এ ধরনের বাক্য আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত।

(৬৪) কলির সন্ধ্যা : কলির সন্ধ্যা অর্থ দুঃখের সূচনা, ঘোর বিপদ, দুঃখ শুরু হওয়া, দুর্দিন ইত্যাদি। হিন্দু শাস্ত্রে ৪টি যুগ রয়েছে। সেগুলো হ’ল সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। বলা হয়ে থাকে শ্রী কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের শেষ অবতার। বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী শ্রী কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গারোহণের সময় থেকে পৃথিবীতে কলি যুগের সূত্রপাত ঘটেছে। বর্তমান যুগটি কলি যুগেরই একটি অংশ। এ যুগের বৈশিষ্ট্য হ’ল, পৃথিবীতে ধর্ম সংকুচিত হয়ে অধর্ম বৃদ্ধি পাবে। পূণ্য এক ভাগ হ’লে পাপ হবে তিন ভাগ। মানুষ স্বল্পায়ু হবে, সত্য থেকে দূরে থাকবে, শাসক ধনলোভী হবে, ব্রাহ্মণ হবে জ্ঞানহীন, সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি’।[7]

যেহেতু এ যুগে সর্বত্র অশান্তি ও দুঃখ-কষ্ট বিরাজ করবে বলে বিশ্বাস করা হয়, সেহেতু কলির সন্ধ্যা বাক্য দ্বারা অবর্ণনীয় দুর্দিনের সূচনা বুঝানো হয়েছে। মূলত কলি যুগের ধারণা থেকেই হিন্দু সংস্কৃতিতে প্রচলিত কলির সন্ধ্যা বাক্যটি মুসলিম সমাজে চালু হয়েছে।

(৬৫) নাগপাশ : নাগ ও পাশ শব্দ সহযোগে গঠিত নাগপাশ বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। নাগ অর্থ সাপ ও পাশ অর্থ বন্ধন। অভিধানিক অর্থে নাগপাশ হ’ল, বন্ধন করার জন্য স্বর্পরূপ পাশ, বরুণের অস্ত্র’।[8] আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী পৌরাণিক মতে যে অস্ত্র নিক্ষেপ করলে সাপ শত্রুকে আড়াই প্যাঁচে বেষ্টন করে ফেলে’।[9] নাগপাশ যেকোন শব্দের পূর্বে বসলে তার ভাবার্থ হয় অত্যন্ত শক্ত বাঁধন, যে বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। ঋষি কশ্যপের পুত্র বরুণ হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রাচীন দেবতা। পুরাণে জলের অধিপতি দেবতারূপে বরুণের নাম উল্লেখ রয়েছে। নাগপাশ বরুণেরই অস্ত্র। বরুণ দেবতার কল্পিত অস্ত্রের ধারণা থেকেই নাগপাশ শব্দের উৎপত্তি।

(৬৬) শ্যাম রাখি না কূল রাখি : এই প্রবচনটির মাধ্যমে উভয় সংকটে পড়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার অবস্থা বোঝানো হয়’।[10] এখানে শ্যাম বলতে কৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে। কার্যত রাধা-কৃষ্ণের অবৈধ প্রেমের দহন থেকে এই প্রবচনের উৎপত্তি ঘটেছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, কৃষ্ণের মামা আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধার সাথে কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরপুরুষ শ্যামের প্রতি রাধার গভীর আসক্তি তাকে মানসিক দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। একদিকে কৃষ্ণকে পাবার জন্য ব্যাকুল হৃদয়। অপরদিকে স্বামী, সংসার ও বংশ মর্যাদা হারানোর ভয়। এহেন পরিস্থিতিতে রাধা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে দোটানায় পড়ে যায়। এরকম উভয় সংকট সৃষ্টি হ’লে উক্ত প্রবচন প্রয়োগ করা হয়। 

(৬৭) ঠাকুর ঘরে কে? আমি কলা খাইনি : প্রবচনটি গ্রাম-বাংলায় ব্যাপক প্রচলিত। অর্থ হ’ল, যে প্রকৃত দোষী সে দোষ ঢাকতে গিয়ে এমন কথা বলে যে তাতে নিজের দোষ প্রকাশ হয়ে যায়’।[11] অর্থাৎ অতি সতর্ক অপরাধী কর্তৃক নিজেই নিজের অপরাধ ফাঁস করে দেওয়া। বাক্যটিতে ঠাকুর ঘর বলতে হিন্দু বাড়ীতে স্থাপিত পারিবারিক মন্দির বোঝানো হয়েছে। যেখানে দেবতাকে উৎসর্গ করা বিভিন্ন ফল-ফলাদীসহ ভোগের সামগ্রী মওজূদ থাকে। এই প্রবচনটি ইসলামী আক্বীদা বিরোধী নয়। তবে আমরা এর মাধ্যমে আমাদের অগোচরে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছি।

(৬৮) জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে : ধারণা করা হয় জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি ঘটনা দেবতা কর্তৃক নির্দিষ্ট। জন্ম ও মৃত্যুর মত বিয়েও কবে, কোথায়, কার সঙ্গে হবে তা আগে থেকে ঠিক করা থাকে বলে মনে করা হয়। সেজন্য বাংলা অভিধানে এই প্রবচনের অর্থ লেখা হয়েছে জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের ব্যাপারে মানুষের বিন্দুমাত্র কোন হাত নেই’।[12] এটি হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হ’তে পারে। কারণ তাদের যেমন দেবতার অন্ত নেই তেমন ব্যক্তি নিজের তাক্বদীর নিজেই ঠিক করে নিতে পারে। শুধু তাক্বদীরই নয় বরং মানুষ সৃষ্টি জগৎ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে এরকম অনেক উদাহরণ হিন্দু পুরাণে রয়েছে। ইসলামী আক্বীদা অনুযায়ী শুধুমাত্র উপরোক্ত তিনটি বিষয় নয়, উপরন্তু মানুষের সমস্ত কার্যাবলী তাক্বদীরের অন্তর্ভুক্ত। সেকারণে এই প্রবচনটি ঈমান বিধ্বংসী। কেউ যদি বিশ্বাস করে জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে মানুষের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা থাকে তাহ’লে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং আমাদেরকে এ ধরনের কুফরী বাক্য প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৬৯) পরশুরামের কুঠার : পরশুরামের প্রকৃত নাম রাম। পরশুরাম সংস্কৃত শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ কুঠার হাতে রাম। তার পিতা ঋষি জমদগ্নি এবং মাতা রেণুকা। পরশুরামকে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার বলা হয়। রামায়ণ ও মহাভারতে পরশুরামের আলোচনা এসেছে। ঋষিদের মধ্যে তিনিই শাস্ত্র ও অস্ত্র জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্র বিদ্যা অর্জন করেন। পরশুরাম কঠোর তপস্যা করে শীবের নিকট থেকে দৈব কুঠার লাভ করেন। কথিত আছে, পরশুরামের মাতা চিত্ররথ নামক এক রাজাকে তার স্ত্রীদের সাথে পানিতে খেলতে দেখে কামুক হয়ে পড়েন। এতে ঋষি জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে পরশুরামকে নিজের মাতার শিরচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়। স্বীয় পিতার নির্দেশে পরশুরাম কুঠার দিয়ে নিজেরই মায়ের শিরচ্ছেদ করে। অবশ্য পরবর্তীতে পরশুরামের অনুরোধে জমদগ্নি স্ত্রীর প্রাণ ফেরত দেন (?) কার্তবীর্য নামক এক রাজা জমদগ্নির যজ্ঞকৃত গাভীর বাছুর হরণ করেছিলেন বলে পরশুরাম তাঁকে কুঠার দিয়ে হত্যা করেছিলেন। কার্তবীর্যের পুত্ররা প্রতিশোধ নিতে তপস্যারত জমদগ্নিকে হত্যা করে। এতে বিক্ষুব্ধ পরশুরাম একাই কার্তবীর্যের সকল পুত্রকে সেই কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। অতঃপর তিনি নাকি পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে একই কুঠারের সাহায্যে একুশবার পৃথিবীর সমস্ত ক্ষত্রিয় হিন্দুদের হত্যা করে পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন’।[13] পরশুরাম এ সমস্ত সংহারক কাজ শীব প্রদত্ত অস্ত্রের শক্তিতে করেছিল। সেজন্য পরশুরামের কুঠার প্রবাদের মাধ্যমে সর্বসংহারক অস্ত্র কিংবা ভয়ংকর নৃশংস অস্ত্র বোঝানো হয়’।[14]

(৭০) চিত্রগুপ্তের খাতা : চিত্রগুপ্ত একজন পৌরাণিক দেবতা। ত্রিদেবের অন্যতম দেবতা ব্রহ্মার অঙ্গ থেকে চিত্রগুপ্তের জন্ম। পৃথিবী সৃষ্টির পর ব্রহ্মার ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তার অঙ্গ থেকে নানা বর্ণে বিচিত্র এক পুরুষ দোয়াত ও কলম হাতে বেরিয়ে আসেন। জন্মের পর ব্রহ্মাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তাকে কী কাজ করতে হবে। ব্রহ্মা বললেন, তুমি মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে যাও এবং সেখানে বসে মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখ। মানুষের পাপ-পুণ্যের চিত্রবিচিত্র হিসাব গুপ্ত রাখেন বলে তার নাম চিত্রগুপ্ত’।[15] সেকারণে চিত্রগুপ্তের খাতা অর্থ করা হয়েছে, যে খাতায় জীবনের কৃত-কর্মের সকল হিসাব-নিকাশ পাওয়া যায়।

(৭১) শীব রাত্রির সলতে : শীব রাত্রিতে হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবতা শীবের পূঁজা করা। দিনে উপবাস থেকে রাতে ঘি-এর সলতে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাত্রি জাগরণ করে পালিত হয় শীব লিঙ্গের পূঁজা। সাধারণত ইংরেজী ফেব্রুয়ারী বা মার্চ মাসে এ পূঁজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে’।[16] এ রাত্রিতে সলতে প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে নিভু নিভু পর্যায়ে চলে যায়। বিধায় এখান থেকে শীব রাত্রির সলতে উপমা প্রয়োগ করে বংশের একমাত্র সন্তান কিংবা একমাত্র সঞ্চয় বোঝানো হয়েছে।

(৭২) দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ : প্রবাদটি গোবরে পদ্মফুল-এর সমার্থক অর্থে ব্যবহৃত হয়। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ প্রবাদের সারকথা হচ্ছে, মন্দ বংশে ভাল লোক কিংবা যার চরিত্র ও কর্ম তার বংশকুলের বিপরীত। পৌরাণিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মূলত এ প্রবাদের আবির্ভাব। প্রহ্লাদ হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর একটি চরিত্র। তার পিতা দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু এবং মাতা কয়াধুর। হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরণ্যাক্ষকে দেবতা বিষ্ণু শূকর অবতার ধারণ করে হত্যা করে। এতে হিরণ্যকশিপু প্রবল বিষ্ণু বিদ্বেষী হয়ে উঠে। অথচ তারই সন্তান প্রহ্লাদ যে বিষ্ণুর পরম ভক্ত এ বিষয়ে দৈত্য রাজা কিছুই জানত না। পরবর্তীতে সন্তানের গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে হিরণ্যকশিপু বিষয়টি জানতে পারে। অতঃপর ছেলেকে বিষ্ণু পূঁজা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে খড়গ দ্বারা হত্যা করার চেষ্টা করেন। এমনকি হাতির পায়ের নিচে, অগ্নিকুন্ডে ও সাগরে নিক্ষেপ করেও হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই বিষ্ণু তাকে রক্ষা করে। অবশেষে এক সন্ধ্যায় সে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করে তোমার বিষ্ণু কোথায় থাকে? উত্তরে প্রহ্লাদ বলে, বিষ্ণু সর্বত্র থাকেন। হিরণ্যকশিপু প্রাসাদের একটি স্ফটিক স্তম্ভ দেখিয়ে বলেন যে, বিষ্ণু কি এর ভিতরেও আছে? উত্তরে প্রহ্লাদ হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। এরপর হিরণ্যকশিপু পদাঘাতে স্তম্ভ ভেঙে ফেলে। স্ফটিকস্তম্ভ থেকে বিষ্ণু অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহরূপ অবতার ধারণ করে হিরণ্যকশিপুকে পেট বিদীর্ণ করে হত্যা করেন’।[17] দৈত্যপুত্র হয়েও বংশের বিপরীত আচরণ হওয়ার এ ঘটনা থেকে উক্ত প্রবাদের উৎপত্তি ঘটেছে। (ক্রমশঃ)

- মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

[লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]


[1]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ৪১৭।

[2]. https://www.anandabazar.com/india/viral-a-ngo-from-punjab-makes-eco-friendly-idols-and-lamps-out-of-cow-dung-dgtl-1.

[3]. আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ১২০৬।

[4]. সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র, অষ্টম সংস্করণ : জুলাই ১৯৮৪, পৃ. ১১৯১।

[5].বৃন্দাবন ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মথুরা যেলার অন্তর্গত একটি শহর। বর্তমান বৃন্দাবন শহরের আবিষ্কারক বৈষ্ণব দর্শনের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্য দেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ)। ১৫১৫ সালে কৃষ্ণের বাল্যকালীন স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে চৈতন্য দেব মথুরায় এসেছিলেন। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, চৈতন্য তার দৈবিক শক্তির মাধ্যমে বৃন্দাবন ও তার চারপাশে যে সকল স্থানে কৃষ্ণ বাল্যকাল অতিবাহিত করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেগুলো আবিষ্কার করেন।https://bn.wikipedia.org/s/1yqx

[6]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গালা অভিধান, পৃ. ১৫৮৩।

[7].https://bn.wikipedia.org/s/jw0

[8]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গালা অভিধান, পৃ. ৭৫৩।

[9]. আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৭২২।

[10]. আশুতোষ দেব, নূতন বাঙ্গালা অভিধান, প্রবচন-সংগ্রহ, পৃ. ১৫৮২।

[11]. নূতন বাঙ্গালা অভিধান, প্রবচন-সংগ্রহ, পৃ. ১৫৫৭।

[12]. নূতন বাঙ্গালা অভিধান, আশুতোষ দেব, প্রবচন-সংগ্রহ, পৃ. ১৫৫৬।

[13]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, (কলকাতা : এম. সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, ১৩তম মুদ্রণ, বাংলা ১৪১৮ সন), বনপর্ব, পৃ. ১৯০-১৯২।।

[14]. নূতন বাঙ্গালা অভিধান, প্রবচন-সংগ্রহ, পৃ. ১৫৬৭।

[15]. মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, যার যা ধর্ম : বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান, পৃ. ১৫১।

[16].https://bn.wikipedia.org/s/7acm

[17]. শ্রীমদ্ভাগবত, বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা : শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ ভট্টাচার্য, (কলিকাতা : পি.এম.বাকিচ এ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, ৯ম সংস্করণ, বাংলা ১৩৮৩ সন), সপ্তম স্কন্ধ, পৃ. ৪২৯-৩৪।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও