মেঘ-ঝর্ণার বিস্তীর্ণ প্যানারামায় দু’দিন

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 617 বার পঠিত

ঘন অরণ্য, সাদা মেঘ আর সগর্জন ঝর্ণা- প্রকৃতির সবকিছুই অপরূপ সুন্দর এবং রহস্যময়। যার সংস্পর্শ আপনাকে করবে উদ্দীপ্ত এবং প্রশান্ত। আর এর সাথে যদি যুক্ত হয় দ্বীনী ভাইদের সাথে পাওয়ার আকুলতা, তবে তা যেন পরিণত হয় আল্লাহর জন্য ভালোবাসাময় এক অফুরন্ত জান্নাতী নহর। প্রতি বছর তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় মুখিয়ে থাকি কখন আসবে প্রিয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর বার্ষিক শিক্ষা সফর। মাঝেমধ্যে মনে হয় অপেক্ষার পালা যেন শেষই হয় না। অবশেষে এল সেই ক্ষণ। নির্ধারিত স্থান প্রাকৃতিক

সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান। বান্দরবান নাম শুনেই মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথের পংক্তি সমূহ;

‘বর্ষায় প্রপাতের সৌন্দর্য দেখার বড় স্বাদ

জুম ঘরে বসে বৃষ্টি দেখার আহ্লাদ,

পিচ্ছিল পাথুরে পথে দুঃসাহসিক অভিযান

দুর্গম বন পেরোবো হাতে নিয়ে প্রাণ’।

নির্ভেজাল তাওহীদী জাগরণ সৃষ্টিকারী যুব কাফেলা ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কর্মীদের প্রাণোচ্ছলতায় মুখরিত হবে খ্রিস্টান মিশনারী প্রভাবিত বান্দরবান। একথা ভাবতেই মনের গহীনে পল্লবিত হল আশার জাগরণ।

২৮শে অক্টোবর ভোরের প্রথম প্রহর। পাখিরা তখনো ঘুম থেকে জেগে উঠেনি। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কর্মী ও সুধীরা বান্দরবান শহরে গ্র্যান্ড ভ্যালি রিসোর্টে চলে এসেছে। গ্র্যান্ড ভ্যালির গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফজরের জামা‘আত শুরু হল। ইমাম ছাহেবের সুললিত কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াতের সুর লহরী যেন একটি সুন্দর দিনের আগমনীবার্তা ছড়িয়ে দিল। ইতিমধ্যে বান্দরবানের দ্বীনী ভাইরা আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। সকাল ৭টায় কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ভাই বান্দরবান পৌঁছালেন। পৌঁছে গেলেন যুবসংঘ-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলবৃন্দ। শুরু হল শিক্ষাসফর আরম্ভের চূড়ান্ত তোড়জোড়। ‘যুবসংঘে’র নাম এবং লোগো সম্বলিত টি-শার্ট সবার হাতে হাতে পেঁŠছে দিয়ে সর্বশেষ আমার ভাগে ডাবল এক্সেল টি-শার্ট জুটলো। কি আর করা। টি-শার্টকে পাঞ্জাবী ভেবে সাথে রেখে দিলাম। সকাল ৮টায় বান্দরবান শহর থেকে থানচির উদ্দেশ্যে ছয়টি চাঁদের গাড়ি ৭৫ জনের কাফেলা রওনা হল।

শহর পেরিয়ে উঁচুনিচু পাহাড়ী পথের প্রারম্ভিকায় সংক্ষিপ্ত নাশতা বিরতি দেওয়া হল। নাশতা শেষে কেন্দ্রীয় সভাপতি মহোদয় ভ্রমণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন। বিশেষ করে শিক্ষাসফরের আনন্দঘন মুহূর্তগুলোকেও কিভাবে ইবাদতে পরিণত করা যায় এ বিষয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার নছীহত প্রদান করলেন। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ না করতে যোর তাকীদ প্রদান করেন। বাস্তবিকার্থে আমরা বাঙালিরা ৫৬ হাযার বর্গের এই স্বদেশকে ছোটখাটো একটি ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আমেরিকা মহাদেশের পর্বতশৃঙ্গেও বাংলাদেশের শপিংব্যাগ পাওয়া যায়। শৃঙ্খলা-আনুগত্য, ধৈর্য এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দীপ্ত শপথ নিয়ে পুনরায় সবাই গাড়িতে উঠলাম। বান্দরবান-থানচি সড়কের প্রায় ৮৩ কি. মি. এই পথ মনে হল মেঘের রাজ্যের মধ্য দিয়েই চলছি। শরতাকাশের মেঘের ভেলায় চড়ে এমন রোমাঞ্চকর ভ্রমণ সবাইকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে তুলল। এ যেন শিলিগুড়ি টু দার্জিলিং ‘হিলকার্ট’ রোড।

যতোই আমরা সামনে চলছি ততোই ভারী মেঘদলের দেখা মিলছে। দ্বীনী ভাইদের সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত হল পাহাড়ি পথ, জঙ্গল। পথেই দেখা মিলল মিলনছড়ি শৈলপ্রপাত আর চিম্বুক, নীলগিরির অপরূপ সৌন্দর্য ঘেরা পাহাড় মেলা। পথে পথে উপজাতি গ্রাম। মোড়ে মোড়ে অস্থায়ী বাজারে পেপে, আনারস, কলার আধিপত্য। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মেঘদলেরা ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায়। মাঝেমধ্যে শিশুদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সারি সারি পাহাড় শ্রেণী মাড়িয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ আমরা থানচি বাজারে এসে পৌছলাম। পথে পথে চেকপোস্টের ভোগান্তি আমাদের খুঁনসুটিতে বাধা হল না একটুকুও। তপ্ত দুপুরে থানচী ব্রীজে দাঁড়িয়ে সাংগু নদীর সৌন্দর্য সবাই অবলোকন করছি আর ভাবছি এ যেন বাংলার পাঁজরে এক টুকরো সোয়াত উপত্যকা। ক্লান্ত দেহ, ক্লান্ত শরীরে যোহরের ছালাত শেষে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হল। তৃপ্তিকর খাবার শেষে শুরু হল বিরক্তিকর প্রশাসনিক ঝামেলা। বহু ভোগান্তি শেষে রেমাক্রীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর অনুমতি মিলল।  নিরাপত্তার মোড়কে পদে পদে হয়রানির এ বৃত্ত থেকে আমরা ঠিক কবে বের হব তা জানিনা।

সাংগু নদীর স্রোতের সাথে সুর মিলিয়ে ১৬টি ইঞ্জিন চালিত বিশেষ নৌকাযোগে আমাদের এবারের গন্তব্য তিন্দু, বড় পাথর হয়ে রেমাক্রি। থানচি থেকে রেমাক্রি যাওয়ার এ পথটি যেন আজীবন ধরে রাখার মতো সুখস্মৃতি। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে খরস্রোতা সাংগু। নদীর সাথে পাথরের এক অদ্ভুত মিতালী ঘেরা এই পথ। নদীর মাঝে বড় বড় পাথর। সেই পাথর মাড়িয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে চলা। কবেকার কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা নিতান্তই আল্লাহর ইচ্ছায় নদীর বুকে মনলোভা এই দৃশ্য। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ি বৃষ্টি এসে আমাদের ভিজিয়ে দিল। সারাদিনের সকল ক্লান্তি ধুয়ে মুছে নদীর সাথে মিশে গেলো। সে এক অদ্ভূত উপভোগ্য অনুভূতি। পথেই দেখা মিললো ছবির মতো সুন্দর তিন্দু গ্রাম, রাজাপাথর, কলস পাথরের দৃশ্য। নদীপথটি এমন যে, কিছুদূর পরপর হঠাৎ বেশ ভয়ংকরভাবে ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে, আবার হঠাৎ উঁচূ হয়ে উঠে গেছে। এ যেন উঁচুনিচু পাহাড়ী সড়কপথেরই নদীরূপ। দু’পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। সবুজে মোড়ানো প্রতিটি পাহাড় যেন মেঘের কোলে শুয়ে আছে অবলীলায়। পাহাড়ের চূড়ায় হঠাৎই দেখা মিলে দু’একটি উপজাতি বসতি। সুবোধ বালকেরা কেউ মাছ ধরছে, আবার কেউ গোসল করছে। নদীকে ঘিরেই তাদের জীবন। এসব দেখতে দেখতে আড়াই ঘন্টার নৌ অভিযাত্রা কখন যে শেষ হল তা টেরই পেলাম না। এক বর্ণনাতীত অভিজ্ঞতা।

সাঙগু বেয়ে নাফাখুম যাওয়ার পথে সর্বশেষ জনপদ রেমাক্রি। পাহাড়ী জলপ্রপাত ঘেরা জনপদ রেমাক্রির কথা যে কোন ভ্রমণপিপাসুর মনে থাকবে সারাজীবন। সূর্য ডোবার মুহূর্তে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ রেমাক্রির মৃদু আছড়ে পড়া পানিতে আমরা ক’জন গোসল করলাম মনের সুখে। বড় চাতালের মতো উঠান ঘিরে পাহাড়ীদের ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। তার গা ঘেঁষে সরু রাস্তা আর শুধুই নির্জনতা।

নৌকা বদলিয়ে এবারের নতুন গন্তব্য নাফাখুম। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। নৌকার বেশ সংকট। অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে কয়েকটা নৌকা এল। ধীরে ধীরে নৌকা চলতে লাগলো। প্রকৃতিতে ততক্ষণে ঘন তমসা নেমে এসেছে। পিনপতন নীরবতা ছেদ করে পক্ষীকূলের হরেক রকম শব্দ ভেসে আসে। গা ছমছম করে ওঠে। অপরদিকে নৌকা সংকটে অনেকে পিছনে আটকে আছে। নদীর মাঝে বড় বড় পাথরখন্ড বারবার নৌকার পথ রুদ্ধ করে যাচ্ছে, কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদেরকে ঝিরিপথে নামিয়ে মাঝিরা বাকীদেরকে আনতে গেল। সাথে থাকা গাইডরাও কোথায় যেনো হারিয়ে গেল। বলে রাখা ভালো, থানচির পরে এই অঞ্চলে কোথাও কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোন রাজ্য যেন। রাতের অন্ধকারে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ি। একেক দলে আমরা প্রায় ৮/১০ জন করে ছিলাম। এক্ষেত্রে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। ঝিরি পথে পানির বয়ে চলা প্রমাণ করে এ ঝিরির উৎপত্তি নাফাখুম থেকে। তাই এই ঝিরিকে অনুসরণ করে, জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে সংকীর্ণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। রাতের অন্ধকারে বিপদের ঘনঘটা থেকে বাঁচতে এই মুহূর্তে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের বিকল্প নেই। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া প্রত্যেকটা টিম যেন সংগঠনের একেকটা শাখা স্বরূপ। প্রত্যেক টিমেই রয়েছে এক জন করে লিডার। গাড় অন্ধকার আর জোক-বিচ্ছুর ভয়কে জয় করে ঝিরির পাড় ধরে আমরা রাত্রি সাড়ে সাতটায় নাফাখুম পাড়ায় পৌছলাম। অনেকদূর থেকেই নাফাখুম ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ পেলাম। পানি প্রপাতের এই শব্দশৈলী আমাদের মনে এনে দিল আশার সঞ্চারণ। সর্বোপরি অলী হাসান ভাইয়ের সাহসের তারিফ করতেই হয়।

রাত ৯টার মধ্যে একে একে সবাই চলে আসলো। ঝর্ণার পার্শ্ববর্তী নাফাখুম পাড়ায় তিনটি উপজাতি টং ঘরে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা হল। খাবার তৈরী হতে হতে দীর্ঘ সাংগঠনিক আলোচনা শুরু হয়। মৌলভীবাজারের নওমুসলিম আব্দুল্লাহ ও বান্দরবানের ইফতিদার মাশফি ভাই তাদের জীবন কাহিনী শুনালো। সর্বোপরি রংপুরের মোস্তফা সালাফী ছাহেবের কমিউনিস্ট থেকে আহলেহাদীছ হওয়ার ইতিবৃত্ত  সবাইকে আবেগাপ্লুত করল। সবশেষে শরীফুল ইসলাম মাদানী এবং ড. ছাকিব ভাই নছীহতমূলক বক্তব্য রাখলেন।

ইতিমধ্যে রাতের খাবার চলে এলো। খাবার শেষে ঝর্ণার কোলঘেঁষে নির্মিত এ টং ঘরে ঘুমিয়ে পড়ি। ঝর্ণা-ঝিরিধারার পানিপতনের শব্দে দিনের আলো ফোঁটার পূর্বেই সবার ঘুম ভাঙ্গে। বাদ ফজর তিনটি টং ঘরে পৃথকভাবে দারস দেন যথাক্রমে আবুল কালাম, শরীফুল ইসলাম মাদানী, সোহেল বিন আকবর মাদানী ও আরজু হাসান সাবিবর। আমাদের আচরণে মুগ্ধ হয়ে খৃষ্টধর্মাবলম্বী ঘরের মালিক কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী আবুল কালাম  ভাইকে এক ছড়ি কলা উপহার দেন। তিনি বলেন, এখানে অনেক পর্যটক দল আসে। কিন্তু আপনাদেরকেই প্রথম দেখলাম যারা গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের বদলে আল্লাহর প্রশংসা করছেন। তারপর ভোরের সূর্য উদয়ের পূর্বেই বেরিয়ে পড়লাম নাফাখুম দর্শনে।

মারমা ভাষায় ‘খুম’ শব্দের অর্থ ঝর্ণা বা জলপ্রপাত বা জলপতন। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ পাথুরে পথে নামতে গিয়ে চমৎকার এই জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে। তখনো আশেপাশের অনেক পাহাড় মেঘের চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। ২০-৩০ ফুট উপর থেকে দ্রুত গতিতে নেমে আসা পানির ফোয়ারা সূর্যের আলোয় বাষ্প হয়ে প্রতিনিয়ত রংধনু খেলা করছে। মেঘের আড়ালে যখন সূর্য হেসে উঠলো, তখন সে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে পুরো পাহাড়তটে। ঝর্ণার সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য নির্মিত ঝুলন্ত ব্রীজে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ উড়ে আসা জলকণা বাষ্পে ভেসে শরীরে এসে পড়লো। ক্ষণিকের জন্যে সম্বিত হারিয়ে ফেললাম। রোমাঞ্চকর সে অনুভূতি। পাশেই একটি ছোট্ট টং দোকান। উদাস মনে ভাবছিলাম, জান্নাতে সবুজ গালিচার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ঝর্ণার পাশে যদি আমার একটি চায়ের টং দোকান থাকে, সাপ্তাহিক হাটের দিনে ছাহাবীরা নিশ্চয়ই সেখানে চা খেতে আসবে। মাঝেমধ্যে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে দাওয়াত দিব।

ইতোমধ্যে নাশতার জন্য ডাক আসলো। নাশতা সেরে সকাল সাড়ে আটটায় নাফাখুমকে বিদায় জানালাম। খরস্রোতা নদী, পাথুরে ঝিরি আর পাহাড়ের পাশ দিয়ে সবুজে মাখামাখি করে চলতে চলতে মনে হল, জন্মভূমির এমন শোভা আগে কেন দেখিনি? সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি ওয়া সুবহানাল্লাহিল আযীম।

জুমক্ষেতের পাশে ছবির মতো সাজানো এ পাহাড়ি গ্রাম পেরিয়ে সরু ট্রেইল ধরে কিছুক্ষণ হাটার পর আমরা নৌকার কাছে পৌছলাম। অতঃপর রেমাক্রিতে এসে আবার যাত্রাবিরতি দেওয়া হল। রেমাক্রিতে এবার কেউই গোসলের সুযোগ হাতছাড়া করলো না। একে একে সবাই নেমে পড়লো। সবাইকে গোসল করতে নেমে এবার আত্মবিশ্বাস আরো তুখোড় হল। সাংগু নদীর  স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে সাতার কেটে নদীর ওপারে চলে গেলাম কয়েকজন। খরস্রোতা এ নদীতে সাতার প্রথমে চ্যালেঞ্জিং মনে হলেও পরক্ষণে ভয় কেটে যায়।

গোসলের শেষ প্রান্তে খেয়াল করলাম কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক আজমাল ভাই সবাইকে ক্যামেরাবন্দী করছে। ঝরণার পিচ্ছিল অংশে ছবি তুলতে গিয়ে ফোন হাতে আজমাল ভাইয়ের আছাড় খাওয়ার মনোরম দৃশ্য দেখে তার সাথে খুঁনসুটি আরও বাড়িয়ে দিলাম। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম পাহাড়ি জোকের কামড়ে শাকির ভাইয়ের পা থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে। যদিও এটা তেমন আতংকের কিছু না, তবুও কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে পাহাড়ি জোঁকেরাও রক্তদান সংস্থা আল-আওনের একজন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলের রক্ত সহযোগিতা পেয়ে ধন্য হয়েছে।

যাত্রাবিরতি শেষে আবার শুরু হল থানচির পানে দীর্ঘ নৌকা ভ্রমণ। ফেরার পথে সাংগুকে আরও বেশী খরস্রোতা মনে হলো। কিছু কিছু জায়গা এতো ভয়ংকর ছিলো যে নৌকা থেকে নেমে নদীর তীর ঘেষে হেটে পার হতে হল। দুপুর ১২টা নাগাদ সবাই থানচি বাজারে এসে পৌছালাম।

জুম‘আর ছালাতের পর শুরু হল আমাদের দাওয়াতী কার্যক্রম। পুরো থানচী বাজার জুড়ে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) আত-তাহরীক, তাওহীদের ডাক সহ হাদীছ ফাউন্ডেশনের বই সমূহ বিতরণ করা হ’ল। স্থানীয়রাও আগ্রহভরে তা গ্রহণ করলো। আমাদের বই পেয়ে অনেকেই যারপরনাই খুশী হলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো প্রশাসনের দায়িত্বশীল ভাইরা। তাদের আচরণ দেখে মনে হলো ভিন্ন মহাদেশ থেকে এসে এখানে মিশনারী কার্যক্রম পরিচালনা করা জায়েয হলেও মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া যেন শিরোধার্য অপরাধ। দুপুরের খাবার খেয়ে পাহাড়ি পথ ধরে চান্দের গাড়ি যোগে সবাই রওনা দিলাম বান্দরবানের পথে। পুরো পথ জুড়ে সুরে বেসুরো কন্ঠে বেজে চলছে আল-হেরার জাগরণী।

দিগন্ত জোড়া সবুজ পাহাড় আর বিস্তীর্ণ প্যানারামার মাঝে যেনো কয়েকটা খেলনার গাড়ি ছুটে চলছে। বিকাল নাগাদ নীলগিরির নীল ক্যাফে সাময়িক বিরতি দেওয়া হল। প্রকৃতি এখানে খুবই বৈচিত্র্যময় এবং ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত নীলগিরিতে দাঁড়িয়ে সহসাই দেখা মিলে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকাহাফং, বগালেক এবং কেওক্রাডং। নীচের দিকে তাকালে মনে হয় যেনো সবুজের গালিচা বিছিয়ে রেখেছে কেউ। সন্ধ্যার পর সবাই নীলাচল এসে পৌছালাম। রাতের অন্ধকারে টিকেট কেটে ভিতরে প্রবেশের আগ্রহ জাগলো না। মাগরিবের ছালাত শেষে শুরু হল কেন্দ্রীয় সভাপতির  সমাপণী ভাষণ। অবশেষে বেজে উঠলো বিদায়ের ঘনঘটা। সবাই সবাইকে আল্লাহর যিম্মায় সঁপে দিয়ে রওনা দিলাম আপন গন্তব্যে। এত অল্পসময় অথচ কত আপন হয়ে গেল এ মানুষেরা। আমরা ভিন্ন মায়ের সন্তান কিন্তু সংগঠন আমাদেরকে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। বাসে ফেরার পথে রাজ্যের সমস্ত ঘুম চোখে নিয়ে ঝিমাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম- যে বান্দরবান দেখেনি, সে বাংলাদেশ দেখেনি।

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়




বিষয়সমূহ: ভ্রমণস্মৃতি
আরও