প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 1120 বার পঠিত

[‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে’র এই সৃনতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর পক্ষ থেকে মুযাফফর বিন মুহসিন ও নূরুল ইসলাম ]  

*তাওহীদের ডাক : ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র প্রথম মুখপত্র ‘তাওহীদের ডাক’ (জানু-ফেব্রু’৮৫) আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে পুণরায় যুবসংঘের পক্ষ থেকে ‘তাওহীদের ডাক’ নামক মুখপত্রটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এ মূহূর্তে আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কি?

আমীরে জামা‘আত :  অনেকটা হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার মত।

*তাওহীদের ডাক : তৎকালীন প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপটের মধ্যে বিশেষ কি ধরনের তফাৎ দেখছেন?

আমীরে জামা‘আত :  তখন আমাদের মাথার উপর কোন ছাতা ছিল না। কেবলমাত্র আল্লাহর রহমত ব্যতীত। ছিল না উৎসাহ দেওয়ার মতো কোন অভিভাবক। বাধা ছিল বহুরূপ। আলহামদুলিল্লাহ আজকের দিনে পরিস্থিতি বহুগুণ অনুকূলে এসেছে।

*তাওহীদের ডাক : মুখপত্রটি প্রকাশের সময় কোন প্রেরণাটি বেশী কাজ করেছিল?

আমীরে জামা‘আত : ‘শতদল ফুটতে দাও’-এই অনুপ্রেরণা এবং আহলেহাদীছ আন্দোলনের দা‘ওয়াত জনগণের কাছে পেঁŠছে দেওয়া।

*তাওহীদের ডাক : যুবসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমীরে জামা‘আত :  আমার পিতা মাওলানা আহমাদ আলীর (১৮৮৩-১৯৭৬) নিবিড় সংস্পর্শে শৈশবেই দ্বীনের পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে মাদরাসা ও কলেজ জীবনে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ইসলামী সাহিত্য ও বামপন্থী বই-পত্র পড়াশোনা করার সুযোগ হয়। সেই থেকেই নিরপেক্ষভাবে কুরআন ও হাদীছের অনুসরণের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়। কিন্তু এ বিষয়ে সুলিখিত সাহিত্য তখন সহজপ্রাপ্য ছিল না। অন্যদিকে আহলেহাদীছ একটি ‘রফা‘দানী’ ফের্কার রূপ ধারণ করায় অন্যদের থেকে তার পৃথক বৈশিষ্ট্য খুব কমই অনুভূত হত। খুলনার এমএম সিটি কলেজে আসার পর কয়েকজন সমমনা বন্ধুদের নিয়ে অনেকটা অবচেতন ভাবেই ‘আঞ্জুমানে শুববানে আহলেহাদীছ’ নামে ঘরোয়াভাবে একটি প্লাটফর্ম তৈরী করে নিজেদের মাঝে দা‘ওয়াতী কাজ শুরু করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী কয়েকজন সাথীভাই মিলে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠন করি। যাত্রাবাড়ী থেকেই বংশাল, নাজিরাবাজার, বাংলাদুয়ার, সুরীটোলা, মালিটোলা, মোগলটুলী এলাকার যুবকদের সাথে যোগাযোগ করতাম। মসজিদে অথবা বৈঠকখানাতেই আমাদের দা‘ওয়াতী প্রোগ্রামগুলো হত। প্রায়ই মীরপুরে যেতাম। সেখানে স্বল্প সময়েই আমাদের আটটি শাখা গঠিত হয়েছিল। পার্শববর্তী পাঁচরুখী, দোলেশ্বর, বেরাইদ, ধামরাই প্রভৃতি এলাকাতেও আমরা সফর করতাম। একবার ময়মনসিংহের ভালুকায় যাই এবং যুবসংঘের শাখা গঠন করি। সাপ্তাহিক আরাফাতে আমাদের রিপোর্ট প্রকাশের ফলে সারাদেশে আহলেহাদীছ যুবকদের মাঝে প্রাণের সাড়া জাগে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তারা শাখা গঠন করতে থাকে। সারাদেশ থেকে আগত চিঠিপত্রের জওয়াব লিখতেই আমরা গলদঘর্ম হয়ে যেতাম। ঢাকার যাত্রাবাড়ী পোষ্ট অফিস বলা যায় যুবসংঘের ব্যাপক চিঠি-পত্র আদান-প্রদানের কারণেই টিকে যায়। এজন্য পোষ্টমাষ্টারের পক্ষ থেকে আমাদের প্রায়ই ধন্যবাদ জানানো হ’ত। যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় শিক্ষকতা, এম.এ শেষ বর্ষে থিসিস লেখা, বিভিন্ন লাইব্রেরীতে যেয়ে পড়াশোনার ফাঁকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সাংগঠনিক সফর করতাম। যাতায়াত ব্যবস্থার দুর্দশার মধ্যে দুরূহ হলেও আল্লাহর রহমতকে পুঁজি করে আমরা দা‘ওয়াতী কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে চলেছিলাম। ১৯৭৮ সালের ১২ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফ অঞ্চলে বাস্ত্তচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থী মুসলমানদের মাঝে যুবসংঘের ত্রাণ তৎপরতা, ১৯৭৯ সালের জুনে কবরপূজার বিরুদ্ধে রাজধানীতে যুবসংঘের বিরাট মিছিল, ১৯৮০ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে যুবসংঘের উদ্যোগে ‘তাওহীদের শিক্ষা ও আজকের সমাজ’ শীর্ষক সেমিনার ও পরদিন ঢাকা যেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলন ও সম্মেলনপরবর্তী ট্রাক মিছিল রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে আহলেহাদীছদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, এতে অপ্রত্যাশিতভাবেই ‘যুবসংঘ’ অনেকের শত্রুতার মুখে পড়ে যায়। ফলে এক পর্যায়ে ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে আমি চলে আসতে বাধ্য হই। অতঃপর ২৫ সেপ্টেম্বর’৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খন্ডকালীন লেকচারার হিসাবে যোগদান করি এবং পুনরায় যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় ফিরে যাই। কিন্তু ডিসেম্বরে একই কারণে আবারও চলে আসতে বাধ্য হই। শেষ পর্যন্ত ঢাকা ত্যাগ করে ১০ ডিসেম্বর’৮০-তে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক হিসাবে অস্থায়ীভাবে যোগদান করি। যুবসংঘের কেন্দ্রীয় অফিস তখন ৭৮ উত্তর যাত্রাবাড়ী অর্থাৎ যাত্রাবাড়ী মাদরাসা থেকে মাদরাসাতুল হাদীছ, নাজিরাবাজার, ঢাকায় ৯৪, কাযী আলাউদ্দীন রোডে    স্থানান্তরিত হয়। যুগ্ম-আহবায়ক মাওলানা শামসুদ্দীন সিলেটী তখন মাদরাসাতুল হাদীছের শিক্ষক ছিলেন এবং উনার ঠিকানাতেই চিঠি আদান-প্রদান হ’ত। পরে ১৯৮৪ সালের ৩০ মে যুবসংঘের কেন্দ্রীয় অফিস মাদরাসা মার্কেট (৩য় তলা), রাণীবাজার, রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। এখানেও নানাবিধ বাধার শিকার হওয়ার পর পরিশেষে ১৯৯৩ সালে নওদাপাড়ায় কেন্দ্রীয় অফিস স্থানান্তরিত হয়। সংক্ষেপে বলা চলে যে, ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরটা আমরা নিরুপদ্রবভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম। ফলে দ্বিতীয় বছর সাথীদের মাঝে উদ্দাম গতি ছিল। কিন্তু অচিরেই পরবর্তী বছরগুলোতে নানামুখী বাধা আমাদের ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এজন্য শেষ পর্যন্ত ঢাকা ছাড়তেও বাধ্য হ’তে হয়। একই বাধার কবলে পড়ে ১৯৮৫ সালে যুবসংঘের মুখপত্র ‘তাওহীদের ডাক’ সরকারী নিবন্ধন পেতে ব্যর্থ হয়। সেই যুবসংঘের পক্ষ থেকেই ২০১০ সালে এসে এই পত্রিকাটির পুনঃপ্রকাশ আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছে।

*তাওহীদের ডাক : আন্দোলন পরিচালনার শুরুতে প্রতিকূল পরিবেশে অনেক দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হ’তে হয়েছিল আপনাকে। দু’একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন। 

আমীরে জামা‘আত :  আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পূর্বেই বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তার একটি ছিল ১৯৭৪ সালে খুলনা হাদীস পার্কে আহলেহাদীছ ঈদের জামা‘আত প্রতিষ্ঠার ঘটনা। আমি তখন ৬৯ খান জাহান আলী রোডে অবস্থিত একমাত্র আহলেহাদীছ মসজিদের দোতলায় থাকতাম। পড়াশোনার ফাঁকে সমমনা যুবকদের নিয়ে প্রথমে খুলনা শহরে আহলেহাদীছ জনসংখ্যার একটা হিসাব করার চিন্তা করি। এজন্য ফরমও ছাপি। মসজিদে প্রতি সপ্তাহে দেয়ালিকা টাঙাতে থাকি। এক পর্যায়ে চিন্তা আসে যে, মহানগরীর সকল আহলেহাদীছকে এক ময়দানে নিয়ে একত্রে ঈদের ছালাত আদায় করব। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। উৎসাহ পেলাম। কথায় কথায় চারিদিকে প্রচার হয়ে গেল। ডি.সি. ছাহেবের অনুমতি নেওয়ার জন্য খুলনার প্রভাবশালী জনৈক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়া হ’ল। কিন্তু ডি.সি. ছাহেব ছিলেন ঘোর আহলেহাদীছ বিদ্বেষী। তিনি অনেক আজে-বাজে কথা বলে তাকে ফিরিয়ে দিলেন। অতঃপর ঈদের জামা‘আতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সিটি আহলেহাদীছ মসজিদের ইমাম বরাবর একটা চিঠি পাঠালেন। শুধু তাতেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না; রাতে ড্রাইভারকে খালি গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন ইমাম ছাহেব ঐ রাতেই আহলেহাদীছ মুছল্লীদের বাড়ী বাড়ী যেয়ে নিষেধ করে আসেন। আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। হর্ণের একটানা শব্দে জেগে উঠলাম। তারপর নীচে নেমে এসে চিঠি পেলাম যে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করা হবে। চিঠিটা পকেটে রেখে ড্রাইভারকে বললাম, ডি.সি. ছাহেবকে সালাম দিয়ে বল, গাড়ী লাগবে না ইমাম ছাহেব নিজেই ব্যবস্থা নিবেন।

রাতেই ইমাম ছাহেব এ বিষয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করলেও আমি এড়িয়ে গেলাম। ফজরের জামা‘আতেও কাউকে বললাম না। কেবল মুতাওয়াল্লী ও ক্যাশিয়ার দু’জন মুরুববীকে বললাম। শুনে তারা ভীত হয়ে পাশর্ববর্তী ঈদগাহে চলে গেলেন। আমি সময়মত বিশ্বস্ত কয়েকজন সাথীকে নিয়ে হাদীস পার্ক অভিমুখে চললাম। উৎসাহী দু’আড়াইশ মুছল্লী তখন অকুস্থলে পৌঁছে গেছেন। অল্প দূরে সার্কিট হাউস ময়দানের জামা‘আতের আধা ঘণ্টা আগে আমাদের জামা‘আতের সময় দেওয়া ছিল। ইতিমধ্যে দুই ট্রাক পুলিশ দুই গেইটে এসে অবস্থান নিয়েছে। জামা‘আতের প্রাক্কালে আমি ডি.সি. ছাহেবের চিঠিটা পকেট থেকে বের করে সবাইকে পড়ে শুনালাম এবং বললাম, যারা আজকে ছালাত আদায় করে আমার সাথে জেলে যেতে চান, কেবলমাত্র তারাই থাকেন, বাকীরা চলে যেতে পারেন। একথায় সবাই যেন চেতনা ফিরে পেল। আলহামদুলিল্লাহ সবাই জামা‘আতে শরীক হ’ল। কেউ চলে যায়নি। ছালাত শেষে আহলেহাদীছ আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর খুৎবা দিলাম। শেষে বললাম, এ দেশে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে কিন্তু আহলেহাদীছদের নেই। এমনকি এই সরকারী মাটিতে আমরা বছরে দু’দিন ঈদের ছালাত আদায় করব, সেখানেও সরকারের আপত্তি। আমরা আজ এখানে ঘোষণা দিতে চাই যে, এই হাদীস পার্কে এখন থেকে প্রতি বছর আহলেহাদীছদের ঈদের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। এজন্য সরকারী যে কোন নির্যাতন ভোগ করতে আমরা প্রস্ত্তত আছি। উপস্থিত মুছল্লীরা সোচ্চারভাবে আমার এ প্রস্তাব সমর্থন করল। আলহামদুলিল্লাহ আজ পর্যন্ত খুলনা হাদীস পার্কের ময়দানে আহলেহাদীছ ঈদের জামা‘আত অব্যাহতভাবে চলে আসছে।

ছালাত শেষে বের হবার সময় পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বশীল ভদ্রলোক নতমুখে সালাম করে বললেন, আমাদের মাফ করবেন। আমরা সবই শুনলাম। শান্তি ভঙ্গের কিছুই এখানে ঘটেনি। আমরা ডি.সি. ছাহেবকে গিয়ে বুঝিয়ে বলব।

আরেকটি ঘটনা- ঢাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন ডি.জি. এ জেড এম শামসুল আলমের উদ্যোগে ১৬টি ইসলামী দলের সমন্বয়ে ‘সিসকো’ (CISCO) নামের একটি সংস্থা গঠিত হ’ল। উদ্দেশ্য বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া। ১৬টি দলের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ একটি। একদিনের ঘটনা। ডি.জি. ছাহেবের উদ্দেশ্যে আহলেহাদীছ যুবসংঘের পক্ষ থেকে আমরা তিনটি প্রস্তাব রাখলাম। (১) বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বড় পীরের মাযারের গিলাফ সরাতে হবে যেখানে তখন আগর-বাতি, মোমবাতি দিয়ে প্রায় পূজা-অর্চনা শুরু হয়ে গিয়েছিল (২) বায়তুল মোকাররম মসজিদে মহিলাদের ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের জন্য একটা পৃথক ফ্লোর দিতে হবে (৩) বায়তুল মুকাররম মার্কেট শুক্রবার বন্ধ রাখতে হবে যাতে জুম‘আর ছালাতে পরিবেশ সুন্দর থাকে।    প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে তিনি সকলের মতামত চাইলেন। কেউ চুপিসারে দু’একটি মন্তব্য করলেন। তখন ডি.জি. ছাহেব আমাকে আমার প্রস্তাবগুলির পিছনে যুক্তি পেশ করতে বললেন। আমি সাধ্যমত দলীল পেশ করলাম। হাউজ চুপ। ডি.জি. সাহেব উৎফুল্ল। বিনা বাধায় প্রস্তাব তিনটি গৃহীত হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ সেদিন থেকে অদ্যাবধি বায়তুল মুকাররমে উক্ত সিদ্ধান্তগুলো বহাল রয়েছে। এবার ডি.জি. ছাহেব অমানবিক হিল্লা প্রথা সম্পর্কে কথা তুললেন। আমি এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রেখে বললাম, এর জন্য দায়ী হল এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক হিসাবে গণ্য করা। এটা দূর না করা পর্যন্ত হিল্লা প্রথা দূর হবে না। সদস্যগণ কিছু কথা বললেন। অবশেষে ডি.জি. ছাহেব আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপনি যুবসংঘের ছেলেদের নিয়ে আমার অফিস অবরোধ করুন। তখন আমি সরকারকে আপনাদের দাবী তুলে ধরব। এতে দ্রুত ফল হবে। তারপর বৈঠক শেষ হল।   

*তাওহীদের ডাক : যুবসংঘের সমাজকল্যাণমূলক কাজে জড়িত হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন।

আমীরে জামা‘আত :  ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল আহলেহাদীছ আন্দোলনকে এ দেশের বুকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া। এজন্য শুরু থেকেই সমাজকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে আমরা জোর দিয়েছিলাম। দলমত নির্বিশেষে আমরা সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। ঐ সময় বার্মা থেকে হঠাৎ রোহিঙ্গা মুসলমান বিতাড়ন শুরু হয়। নির্যাতিত বর্মী মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোকে আমরা দ্বীনী ও সামাজিক কর্তব্য মনে করি। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, নিযামে ইসলাম পার্টির মাওলানা ছিদ্দীক আহমাদ (পটিয়া) ও আলহাজ্জ আকীল (বংশাল) প্রমুখের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ত্রাণ কমিটি গঠিত হয়।  আমরাও তাদের সাথে যুক্ত হ’লাম। নবাবপুর ও বংশাল এলাকায় দোকানে দোকানে ও বাড়ীতে-বাড়ীতে গিয়ে ব্যাপকভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করলাম। দুর্গত মানুষের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে কাজ করার যে প্রেরণা তখন যুবসংঘের ছেলেরা অনুভব করত, তা ছিল অবর্ণনীয়। বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে দুয়ারে-দুয়ারে ব্যানার নিয়ে ঘুরে বহু ত্রাণ সংগৃহীত হ’ল। অতঃপর ১২ মে’৭৮ ঢাকা থেকে আমাদের ত্রাণবোঝাই ট্রাক রওয়ানা হয়। চট্টগ্রাম পেঁŠছে প্রেসক্লাবে ভাষণ দিলেন নেতারা। এরপর তারা বিমানে চড়ে কক্সবাজার গেলেন। আমাকেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের সাথে যেতে হ’ল। এটাই ছিল আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ। কক্সবাজার গিয়ে বিরূপ আবহাওয়া ও প্রচুর ঝড়বৃষ্টিতে নেতারা পিছুটান দিলেন। তাদের সাথে কর্মী ছিল না। ত্রাণসামগ্রীও ছিল কম। ফলে যুবসংঘের দায়িত্বে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ওনারা ওখান থেকেই বিদায় হ’লেন। যুবসংঘের সদস্য আমরা ছিলাম ১২ জন। সঙ্গে পেলাম লালবাগ মাদরাসার একজন শিক্ষককে (দীলখোলা, খুবই বন্ধুবাৎসল এই মানুষটির নাম সম্ভবত ফযলুল হক)। আমরা সবাই অনভিজ্ঞ ও অজানা পথের যাত্রী। নাইক্ষ্যংছড়ি পৌঁছলাম। বৃষ্টি-কাদার মধ্যে মালামাল নামালাম। জঙ্গলের গাছের পাতা দিয়ে দোচালা করে কোনমতে মাথা গোঁজার ঠাই বানালাম। বিস্কুট-পাউরুটি, চিড়ামুড়ি ইত্যাদি শুকনা খাবারই সম্বল। বিদ্যুৎবিহীন বৃষ্টিস্নাত রাতে নিস্তব্ধ বনে রাত্রিযাপনের এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা হল। সকালে গেলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে। তিনি এতগুলো তরুণ মুখ একত্রে দেখে খুবই খুশী হলেন। ত্রাণ অনেকেই দিয়েছেন কিন্তু সেসব বিতরণের জন্য কোন স্বেচ্ছাসেবীর কোন দেখা মিলছিল না। অপরদিকে শরণার্থীদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত অপর্যাপ্ত পুলিশ হিমশিম খাচ্ছিল। তিনি পুলিশের সহায়তায় রাতে ডিউটি করার জন্য আমাদের সাহায্য চাইলেন। আমরা রাযী হ’লাম। এছাড়াও দিনের বেলায় তাদের জন্য ত্রাণ বিতরণ, ঘর নির্মাণ, ছালাতের স্থান তৈরী এবং তাদেরকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার দায়িত্ব নিলাম। একেক এলাকায় তাদের জমা করে নারী-পুরুষ সবার উদ্দেশ্যে উর্দূতে উৎসাহমূলক বক্তব্য রাখতাম। আমাদের দিনরাতের আন্তরিক সেবা ও পরিশ্রমে তারা এতটাই মুগ্ধ হয় যে, ২৪ মে ফেরার দিন তাদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের অনুরোধেই আমরা এতদিন ছিলাম। বিদায় বেলায় তিনিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এ ক’টি দিনের মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা, অসহায় স্বজনহারা, স্বদেশহারা মানুষের চোখের পানি ছিল সেদিন যুবসংঘের জন্য ভবিষ্যতের পাথেয়। এ বিষয়ে ‘করুণ অভিজ্ঞতা’ শিরোনামে আমার একটি লেখা সাপ্তাহিক আরাফাতে পরপর তিন কিস্তিতে বের হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালেও যুবসংঘের আরেকটি টীম টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে গিয়েছিল।   (ক্রমশ)



আরও