মুহতারাম আমীরে জামা‘আত (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 932 বার পঠিত

[‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে’র এই সৃনতিচারণমূলক সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর পক্ষ থেকে মুযাফ্ফর বিন মুহসিননূরুল ইসলাম]

উত্তর প্রদেশ ভ্রমণ

উত্তর প্রদেশ হ’ল ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ ও আহলেহাদীছের একটি উর্বর এলাকা। এখানে যেমন মুসলমান বেশী, তেমনি আহলেহাদীছও বেশী। আহলেহাদীছ-এর বড় বড় নয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা আমরা থিসিসে দিয়েছি। তন্মধ্যে জামে‘আ সালাফিইয়াহ বেনারস হ’ল সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ। এটাকে আমরা উত্তর প্রদেশে আহলেহাদীছের প্রবেশদ্বার বলতে পারি। দিল্লীতে কাজ শেষ করে ৮.১.৮৯ইং তারিখে ট্রেন যোগে উত্তর প্রদেশের বানারস রওয়ানা হলাম। ভারতীয় ট্রেন বাংলাদেশের চাইতে অপ্রশস্ত। সম্ভবত ন্যারো গেজ লাইন। ভিতর দিয়ে চলাফেরা খুবই সমস্যা। তার উপরে বাহির থেকে বগি চেনা যায় না। ফলে আমি তড়িঘড়ি করে একটা বগিতে উঠে পড়ি। আমার সীট কয়েক বগি পরে। কিন্তু কিতাবের বোঝা নিয়ে কিভাবে যাব? শেষে একজন যাত্রী দয়াপরবশ হয়ে সীট ছেড়ে আমার সীটে চলে গেলেন। লম্বা পথ ভ্রমণ করে বানারস পৌঁছলাম।

বানারস : রেলস্টেশনে মুণীরুদ্দীন (কিষাণগঞ্জ) ও বেলাল হোসায়েন (রসূলপুর, নওগাঁ) আসার কথা। কিন্তু কাউকে পেলাম না। অবশেষে কুলি নিলাম। গেইট পার হওয়ার সময় পুলিশে আটকালো। বুঝলাম মতলব খারাপ। মাথায় খুন চেপে গেল। বুদ্ধি করে ইংরেজীতে কড়া ধমক দিলাম। সে ভয় পেয়ে ক্ষমা চাইল। ভাবল আমি রড় কোন রাজনৈতিক নেতা বা অফিসার হব। বাইরে গিয়ে ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে মাদরাসায় চলে গেলাম। ওরা দু’জন আমার পিছে পিছে এসে পৌঁছল এবং আমাকে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। এই মাদরাসা হ’ল ভারতে আহলেহাদীছদের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘দারুল উলূম আস-সালাফিইয়াহ’ (প্রতিষ্ঠা : ১৩৮৩ হিঃ/১৯৬৩ খৃঃ)। পাশেই ‘বানারস হিন্দু ইউনিভাসিটি’। অন্য পাশে হিন্দুদের তীর্থভূমি গয়া-কাশি। সেখানেও একটা মসজিদ এবং নিয়মিত ছালাত হয়। সামনে ইউনিভার্সিটির প্রাচীর ঘেঁষে শত শত মূর্তি খাড়া করা। বিক্রির জন্য। হতভাগারা এগুলো কিনে সেখানে ফুল দিবে। শ্রদ্ধা দেখাবে। মনের কামনা পেশ করবে। মানুষ যে কতবড় মূর্খ হয়, স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

মাদরাসার প্রধান ফটক পেরিয়ে ভিতরে গেলাম। শায়খুল জামে‘আহর সাথে সাক্ষাৎ হল। ভাল মানুষ। থাকা-খাওয়া ব্যবস্থা হয়ে গেল। রঈসুল জামে‘আহ ডঃ মুকতাদা হাসান আযহারীর সঙ্গে পরদিন দেখা হ’ল। তিনি অবাধে লাইব্রেরী ওয়ার্ক করার ও বই ফটো করার অনুমতি দিলেন। অনেক দুর্লভ বই পেলাম। জীর্ণ-শীর্ণ এসব বই ফটো করা মুশকিল। তবুও লাইব্রেরী সহকারী যুবকটি খুবই আন্তরিকতার সাথে বাহির থেকে ফটো করে এনে দিল। নওয়াব ছাহেবের অনেক বই যা একেবারেই দুর্লভ। সেগুলি নিতে পেরে স্বস্তিবোধ করলাম। পরদিন জুম‘আ ছিল। খুশী হ’লাম এই ভেবে যে, ভারতের নামকরা প্রতিষ্ঠানে আজ জুম‘আ পড়ব ও খুৎবা শুনব। কিন্তু হতাশ হ’লাম। চার পাশে বিল্ডিংভরা ছাত্র-শিক্ষক। তার মাঝেই মসজিদে খুৎবা হচ্ছে ওজস্বিনী ভাষায়। অথচ মুছল্লী নেই। আমাকে দিয়ে গড়ে ১০/১২ জন মুছল্লী। বাকীরা জামা‘আত দাঁড়ানোর পর আসল। আমার সহ্য হলো না। সরাসরি শায়খুল জামে‘আহকে ধরে বসলাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন।

এবার মুণীরকে নিয়ে গেলাম পাশেই বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। উদ্দেশ্য লাইব্রেরী। গোল বাঁধল গেটে গিয়ে। বিশাল উঁচু স্বরস্বতীর মূর্তি। মেইন গেইটের দু’পাশে দুই খাম্বার উপরে দেবীর দুই পা। দুই পায়ের নীচ দিয়ে যেতে হবে। আমি রিকশা থামিয়ে নেমে গেলাম। মুণীরকে বললাম, অন্য কোন গেইট আছে কি-না। নযর পড়ল, পাশের ছোট সাইড গেইটের দিকে। কোনমতে একজন যাওয়া যায়। ঢুকে গেলাম ঐ পথে। প্রহরী পুলিশ হতবাক হয়ে দেখল। মুণীর ভয় পেয়ে গেল। ইশারায় ডেকে নিলাম। পুলিশগুলো কিছু বলল না। মুণীর ভয়ে ভয়ে ঢুকে বলল, ভাই বিদেশে এসে এরূপ করবেন না। কিছুদিন আগে এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে। বললাম আল্লাহ সব জায়গায় থাকেন। তিনিই সর্বোত্তম পাহারাদার।

ভিতরে ঢুকে খেয়াল হ’ল এখানে আমাদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা পিএইচডি করতে আসেন। দেখি কাউকে পাওয়া যায় কি-না। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ করতেই কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। তাদের মাধ্যে ভূগোলের আব্দুল ওয়াহহাব ভাই (ঝিকরগাছা, যশোর) আমার বেশী কাছের। তাকে নিয়ে লাইব্রেরীতে গেলাম। তার আগে উনি বললেন, ভাই! রাজশাহী-বেনারস সব জায়গায় আপনার একই পোষাক? এটা তো হিন্দু ইউনিভার্সিটি। বললাম, আপনার ভয় লাগলে থাকুন, আমি একাই যাচ্ছি। বেচারা লজ্জা পেয়ে সাথে এলেন। নীচে বসা এসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান। অভ্যাসবসে তাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের জওয়াব দিলেন। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিলেন লাইব্রেরিয়ান। তিনি সরাসরি আমার দিকে আসছেন দেখে তাকেও সালাম দিলাম। উনিও সালাম নিলেন। দু’জনেই এবার কথা বলতে শুরু করলেন। আপ শায়েদ বাংলাদেশী হ্যাঁয়? বললাম, জী হাঁ। বললেন, জনাব! এয়সে পোষাক আওর দাড়ি লে কার কোঈ প্রফেসর আ কার হাম কো সালাম কাহনা শায়েদ এহী পহেলা মরতবা হ্যায়। হামারা মোর্দা ঈমান তাযা হো গিয়া হ্যায়। আজ হাম খোদ আপ কি খিদমত কারেঙ্গে। এরপরেও আমি হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে উভয়ে বলে উঠলেন, হাম নাচীয মোর্দা মুসলিম হ্যায়, লেকিন পোষাক মেঁ হাম হিন্দু হ্যাঁয়। হাম কো মাফ ফরমাইয়ে। বললাম, মেরা সাথী এহ প্রফেসর ভি বাংলাদেশী হ্যায় আওর মুসলমান হ্যায়। বললেন, উনকে পাস দাড়ি ভি নেহী হ্যায়, পোষাক ভি নেহী হ্যায়, কেয়সে সামঝূঁ কে ওহ মুসলিম হ্যায়? আব্দুল ওয়াহহাব বললেন, ভাই! আপনার সাথে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম, এখন ভয় কেটে গেছে। হাঁ আব্দুল ওয়াহহাব এর পর থেকে দাড়ি রেখেছেন এবং তার লাইফেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে অল্প দূরেই গয়া-কাশি দেখতে গেলাম। পাশেই মসজিদ দেখলাম। 

আযমগড় : অতঃপর এখানে দুইদিন থেকে লাইব্রেরীর কাজ সারার পর ১০.১.৮৯ ইং তারিখে বেলালকে সাথে নিয়ে আমরা আযমগড় মুবারকপুর রওয়ানা হ’লাম। এখানে আমরা মাদরাসা ‘আরাবিয়াহ দারুত তা‘লীম (প্রতিষ্ঠা : ১৯০৬, সংস্কার : ১৯৮৭)-এর মেহমান হ’লাম। বিকালে শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে বৈঠক করলাম। আহলেহাদীছ-এর আকীদা ও আমল এবং এর দাওয়াত ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করলাম। ওনারা এতই খুশী হলেন, মনে হ’ল এধরনের বক্তব্য ওনারা প্রথম শুনলেন। আবেগে তাঁরা অনেক কথা বললেন। সন্ধ্যার পরে গেলাম মিশকাতের বিশ্বখ্যাত আরবী ভাষ্যগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ (مرعاة المفاتيح)-এর লেখক জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীর (১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ) বাসায়। ছোট একতলা সাধারণ একটা কুঁড়েঘরের মত বাড়ী। হারিকেন নিয়ে এগিয়ে এসে নিজেই আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ছোট-খাট সাইজের মানুষ। নিরহংকার, সাদাসিধে। চাকর-বাকর নেই। সন্তানাদি কাউকে দেখলাম না। নিজেই আমাদের নাশতা করালেন। এমনকি নিজেই উঠানে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে পানি আনলেন। বেলালকে সুযোগ দিলেন না। বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রগতি জেনে খুশী হলেন।

জামা‘আত শেষে দলবদ্ধ মোনাজাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে না-সূচক জবাব দিলেন ও সুন্দরভাবে মুহাদ্দিছসুলভ ব্যাখ্যা দিলেন (সাক্ষাৎকারটি দ্রঃ আত-তাহরীক ১৪/২, পৃঃ/৩৩ নভে’১০ সংখ্যা)। এরপর চলে এলাম। ভাবতে লাগলাম, যার অমূল্য গ্রন্থ ছাপিয়ে প্রকাশকরা কোটিপতি বনে গেছেন, অথচ তাঁর জীবনযাত্রার মান এতই সাধারণ!! আফসোস! যাঁদের মেধায় দ্বীন বেঁচে আছে, তাদের কোন মূল্যায়ন তাদের জীবদ্দশায় মানুষ করেনি।

এবারে গেলাম ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক কাযী আতহার মুবারকপুরীর বাসায়। সালাম-কালামের পর বিদায় হ’লাম সকালে একসাথে ওনার কর্মস্থলে যাব বলে। ফিরে এলাম মাদরাসা আরাবিয়াহ দারুত তা‘লীমে। গিয়েই তথ্য জানলাম যে, এখানেই মুহাদ্দিছ আবদুর রহমান মুবারকপুরীর বাড়ী। চমকে উঠলাম শুনে। একেবারে মসজিদের সাথে লাগানো চুন-সুরকির দেওয়াল ও টালীর ছাউনী দেওয়া একতলা অক্ষত বাড়ীটা। এই বাড়ীতে বসেই তিনি জামে‘ তিরমিযীর জগদ্বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী (تحفة الأحوذي) লিখেছেন। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিলাম সকাল বেলা। এই পরিবারেরই সদস্য মুহাদ্দিছ আবদুল সালাম মুবারকপুরী ও পরবর্তীতে আর-রাহীকুল মাখতূমের (الرحيق المختوم)-এর বিখ্যাত রচয়িতা আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, যাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল পরে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খিদমাতুস সুন্নাহ’ বিভাগে, যখন তিনি সেখানে গবেষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

পরদিন ১১ই জানুয়ারী সকালে মাদরাসার পরিদর্শন খাতায় মন্তব্য লিখে বিদায় হ’লাম। অতঃপর কাযী আতহার মুবারকপুরীর বাসায় গিয়ে তাঁর সাথে হেঁটেই রওয়ানা হ’লাম তাঁর কর্মস্থল দারুল মুছান্নেফীন-এর দিকে। তিনি আমাকে তাঁর লেখা গ্রন্থ رجال السند والهند সহ আরও তিনটি মূল্যবান বই উপহার দিলেন। বইয়ের শীর্ষে স্বহস্তে আমার নামে তাঁর পক্ষ হ’তে হাদিয়া লিখে দিলেন। এমনকি দারুল মুছান্নেফীনের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ফটোগ্রাফ আমাকে দিলেন। এখানে আসার পথে একটা মজার ঘটনা ঘটল। মাওলানা সহ আমরা তিনজন হেঁটে আসছি। মাঝপথে ১০/১২ জন তরুণ ছাত্র পাশ দিয়ে চলে গেল। সবাই টুপী ও লম্বা পাঞ্জাবী পরা। আশ্চর্য হ’লাম ওরা কেউ সালাম দিল না, এমনকি আমাদের দিক থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে গল্প করতে করতে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ওদের ডাকার উপক্রম করতেই মাওলানা আমার হাত চেপে ধরলেন। বললাম আমি ওদের ডেকে শিক্ষা দিতে চাই। উনি বললেন, খবরদার একাজ করবেন না। ওদের হুযুররা জানতে পারলে সবগুলোকে মাদরাসা থেকে বের করে দেবে। কেননা ওরা ব্রেলভী। আর আমি হ’লাম দেওবন্দী। আমার সঙ্গে ওদের সালাম-কালাম নিষিদ্ধ। আমি হতবাক হয়ে বললাম, হিন্দুস্তানে এটাই কি আলেমদের চরিত্র! কেবল দাড়ি-টুপীতে এরা মুসলমান? আচরণে মুসলমান নয়? উনি বাংলাদেশের কথা শুনে খুশী হ’লেন।

মুবারকপুর শহরটিকে ‘প্রতিভাপুরী’ বলা যেতে পারে। এখানে আহলেহাদীছ প্রতিভাগুলির মধ্যে রয়েছে আবদুস সালাম মুবারকপুরী, আবদুছ ছামাদ মুবারকপুরী, আবদুর রহমান মুবারকপুরী, ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী, ছফিউর রহমান মুবারকপুরীর মত বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিছগণ। অন্যদিকে দেওবন্দী প্রতিভার মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক কাযী আতহার মুবারকপুরী, ব্রেলভী প্রতিভার মধ্যে হাবীবুর রহমান আ‘যমী প্রমুখ।

আযমগড়ের ‘দারুল মুছান্নেফীন’ হল মাওলানা শিবলী নো‘মানী ও মাওলানা সুলায়মান নাদভীর স্মৃতিধন্য ভারতের একটি বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম। এর মুখপত্র ‘আল-মা‘আরেফ’ গবেষণা মাসিক এখনো চালু আছে। আমার সফরের সময় কাযী আতহার মুবারকপুরী ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। সীরাতুন্নবী ও সীরাতে নু‘মানের প্রসিদ্ধ লেখক ছিলেন মাওলানা শিবলী নো‘মানী। আর ‘আরযুল কুরআন’ ও ‘আরব ও হিন্দ কে তা‘আল্লুক্বাত’-এর স্বনামধন্য লেখক ছিলেন মাওলানা সুলায়মান নাদভী। উভয়ে এই প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত যোগ্য পন্ডিত ছিলেন। তাঁদের গবেষণা কক্ষটি পূর্ববৎ রয়েছে। চেয়ার-টেবিল দোয়াত-কলম সবই আগের মত। সেখানে কেউ বসেন না শ্রদ্ধার কারণে। অথচ সব ঝকঝকে তকতকে। বুঝা গেল নিয়মিত দেখাশুনা করা হয়। পাশের কক্ষে আতহার মুবারকপুরী বসেন। আমি ওখানে আব্দুল মুঈদ নাদভীকে পেলাম। তিনি ওখানে বসে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর (১৮৬৮-১৯৪৮খৃঃ) উপরে গবেষণাপত্র লিখছেন। প্রকাশ পেলে আমাকে পাঠাবেন বলেছিলেন। কিন্তু পাইনি। মাওলানা ছানাউল্লাহর বিভিন্নমুখী প্রতিভার উপর যদি কোন বাংলাভাষী সত্যিকার অর্থে গবেষণা করত, তাহ’লে জ্ঞানের একটা স্বর্ণদুয়ার এদেশের মানুষের জন্য খুলে যেত। কিন্তু সেরূপ আন্তরিক ও জ্ঞানপিপাসু যোগ্য ছাত্র পাব কোথায়?

মউনাথভঞ্জন : ১১ই জানুয়ারীতে আযমগড় ‘দারুল মুছান্নেফীন’ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সোজা উত্তর প্রদেশের মউ রওয়ানা হলাম। আহলেহাদীছ-এর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। মউনাথভঞ্জন বলে পরিচিত এই শহরে আহলেহাদীছ মাদরাসা ৩টি ও হানাফী মাদরাসা ১টি। যার নাম মিফতাহুল উলূম। সবগুলিই বড় বড়। আহলেহাদীছের সবচেয়ে প্রাচীন মাদরাসা হ’ল জামে‘আ আলিয়া আরাবিইয়াহ, যা ১২৮৫ হিজরী মোতাবেক ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এর সুদৃশ্য তোরণে আরবী ও হিন্দীতে বড় করে মাদরাসার নাম লেখা আছে। এরপরে হ’ল জামে‘আ ইসলামিয়া ফায়যে ‘আম। যা ১৩২০ হিজরী মোতাবেক ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এটিই এখন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এরপর নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত আহলেহাদীছ মহিলা মাদরাসা ও হাসপাতাল। যা মাওলানা মোখতার নদভীর (১৯৩০-২০০৭ খৃঃ) মাধ্যমে সম্ভবতঃ কুয়েতী অর্থ সাহায্যে নির্মিত হচ্ছে। ফায়যে ‘আম-এর ছাদরুল মুদার্রেসীন মাওলানা মাহফূযুর রহমান আমাকে সাথে নিয়ে সব দেখালেন। অতঃপর তাকে নিয়ে মেফতাহুল উলূমেও গেলাম। দেখলাম হানাফী মাদরাসা হলেও সেখানে অনেক আহলেহাদীছ ছাত্র পড়াশুনা করে। তার মধ্যে যুবসংঘের ‘কর্মী’ ঢাকা মাদ্রাসাতুল হাদীছের সাবেক ছাত্র আবুল ফযল (গোদাগাড়ী)-কে পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম। বগুড়ার আব্দুল্লাহ ফারূকও এখানকার ছাত্র। শিক্ষকদের সাথে বসলাম। তাদের ব্যবহারে প্রীত হলাম। ফায়যে ‘আমে রাত কাটালাম।

লাইব্রেরী ওয়ার্ক ছাড়াও অনেক মৌখিক তথ্যবলী সংগ্রহ করলাম। বাঙ্গালী ও বিহারী ছাত্রদের ভিড় জমে গেল। তাদের কাছ থেকে তাদের এলাকায় আহলেহাদীছ-এর প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী নিলাম। মাওলানা মাহফূযুর রহমান রীতিমত বন্ধু বনে গেলেন। আমি চলে আসার পরেও তিনি তাঁর লিখিত একটি বই আমার কাছে পাঠিয়েছেন।

১৩.১.৮৯ ইং তারিখ সকালে আমরা মউনাথভঞ্জন থেকে রওয়ানা হয়ে বানারস চলে এলাম। অতঃপর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এখান থেকে ট্রেনে একাকী কলিকাতা রওয়ানা হ’লাম।

পশ্চিম বঙ্গ ভ্রমণ :

১৪.১.৮৯ ইং সন্ধ্যার কিছু আগে কলিকাতা শিয়ালদহ রেল স্টেশনে নামলাম। শিয়ালদহ নামটা শুনেই প্রাণটা ছ্যাৎ করে উঠল। কেননা এখানেই আমার মেজভাই নূরুল্লাহিল কাফী ছাত্রাবস্থায় ট্রেন থেকে নামার সময় পা পিছলে নীচে পড়ে যান এবং ট্রেন চলতে শুরু করলে তিনি কাটা পড়ে সেখানেই মারা যান। তাঁর লাশটা পর্যন্ত আমার আববা-আম্মা দেখতে পাননি। কেননা টেলিগ্রাম পান অনেক পরে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নছীব করুন-আমীন!

ভেবেছিলাম মাওলানা আয়নুল বারী এখানে আমাকে রিসিভ করবেন। কেননা দিল্লী থেকে ১২ দিন আগে তাঁকে চিঠি পোষ্ট করেছিলাম। পরে শুনলাম ওদেশের ডাক ব্যবস্থা এতই খারাপ যে দিল্লীর চিঠি ১৫ দিনেও কলিকাতায় পৌঁছে না। যাই হোক একাকী বইয়ের দু’তিনটা বড় বড় প্যাকেট ও হাত ব্যাগসহ কুলি নিয়ে বাইরে এলাম। ১নং মারকুইস লেন, মিছরীগঞ্জ জামে মসজিদ আমার গন্তব্যস্থল। ট্যাক্সি আমাকে জায়গামত নামালো। মসজিদের গেইটেই নামলাম। ভিতরে ঢুকতেই একজন মাওলানা ছাহেবকে পেয়ে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি সালাম দিয়ে দৌড়ে বাইরে গেলেন ও ট্যাক্সি থেকে মালামাল নামিয়ে তাকে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। আমি হতবাক। ইতিমধ্যে মসজিদের ইমাম ও দু’একজন এসে আমাকে ইমামের কক্ষে নিয়ে গেলেন। পরে পরিচয় নিলাম। উনি হলেন মাওলানা মুহাম্মাদ হোসায়েন নাদভী। শিক্ষক, ভাদো মাদরাসা এবং সহ-সম্পাদক মালদহ যেলা জমঈয়তে আহলেহাদীছ। উনি আমার লেখনীর সাথে পরিচিত। দেখলাম সকল প্রকার খেদমতের জন্য উনিই যথেষ্ট। মাওলানা আয়নুল বারী সন্ধ্যার পরে এলেন। আমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে পেরে রাতেই আমাকে নিয়ে গেলেন কলিকাতার বহু প্রাচীন গ্রন্থাগার তাঁতীবাগানের ২৬-এ নূর আলী লেনে অবস্থিত হাজী আবদুল্লাহ লাইব্রেরীতে। এখান থেকেই সর্বপ্রথম বাংলা ১৩০৮ মোতাবেক ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আববাস আলী (১৮৫৯-১৯৩২ খৃঃ)-এর সম্পাদনায় আহলেহাদীছদের প্রথম দু’পাতার মাসিক মোহাম্মাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যা ১৯০৩ সালে মাওলানা আকরম খাঁর (১৮৬৮-১৯৬৮ইং) হাতে ন্যস্ত হয়। পত্রিকাটি পরে সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয়। পরদিন কলিকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে গেলাম।

বর্ধমান : ১৭.১.৮৯ ইং তারিখে চললাম কোলকাতা ছেড়ে বর্ধমানের পথে। সেখানে মাওলানা নে‘মতুল্লাহ (১৮৫৯-১৯৪৩ খৃঃ) প্রতিষ্ঠিত আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র কুলসোনা মাদরাসা অবস্থিত। যে ঘরে বসে তিনি দরস দিতেন, সেই দোতলা মাটির ঘরটি এখন ‘কল্যাণঘর’ নামে পরিচিত। মাটির দেওয়াল ও খুঁটির উপর খড়ের চালে আগের মতই ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে। যা এখন দাতব্য চিকিৎসালয়ে পরিণত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। যোগ্য উত্তরাধিকারী বা কর্মতৎপর সংগঠন না থাকলে বড় বড় আলেমদের স্মৃতি এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্ধমান যেলা জমঈয়তে আহলেহাদীছের তাবলীগ সম্পাদক মৌলবী মোযাম্মেল হক (৬০) আমার সাথে থেকে মাওলানার ব্যক্তিগত লাইব্রেরী দেখার সুযোগ করে দিলেন। পাশেই তাঁর রেখে যাওয়া মাদরাসাটি এখন পাকা হয়েছে। সেখানেও গেলাম এবং শিক্ষক ও মুরববীদের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী নিলাম।

নদীয়া : রাতে কলিকাতা ফিরে এসে পরদিন ১৮.১.৮৯ ইং তারিখে গেলাম আরেক দিকপাল মুনশী ফছিহুদ্দীন (মৃঃ ১৯০০খৃঃ)-এর গ্রাম নদীয়া যেলার বড় চাঁদঘরে। যিনি ছিলেন পয়ার ছন্দে মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মাডডার বাহাছনামা ‘ছায়ফল মোমেনিন’ নামক পুঁথি কাব্যের স্বনামধন্য লেখক। সেখান থেকে ফিরে ২০শে জানুয়ারী কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা লাইব্রেরীতে গেলাম। প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক শহীদুল্লাহ খুব খুশী হ’লেন ও তাঁর স্বলিখিত কয়েকটি বই উপহার দিলেন।

মুর্শিদাবাদ : পরদিন ২০.১.৮৯ ইং তারিখে গেলাম মুর্শিদাবাদের লালগোলায়। সেখান থেকে মাওলানা মেছবাহুদ্দীনকে সাথে নিয়ে আশপাশের আহলেহাদীছ মারকাযগুলিতে সফর করলাম। এসময় মাওলানা ইসহাক মাদানী (৩৬) তাঁর ভ্যাসপায় করে আমাকে ধুলিয়ান সহ অনেক স্থানে নিয়ে গেছেন। ২২ তারিখে গেলাম বেলডাঙ্গা, হলদী, দেবকুন্ডে এবং ২৩ তারিখে গেলাম ভাবতার বিখ্যাত জমিদার হাজী আব্দুল আযীযের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, মাদরাসা ও কুতুবখানা দেখতে। সেখানে গিয়ে মাসিক আহলেহাদিস পত্রিকার ১ম সংখ্যা থেকে (১৩২৩ বাং) এক বছরের বাঁধাই করা দুর্লভ সংগ্রহটি পেলাম। তারা খুশীমনে দিলেন। কেননা কুতুবখানায় এখন পাঠকের বড়ই আকাল। দোতলা জীর্ণ-শীর্ণ বিল্ডিং।

মালদহ : ২৪ তারিখে লালগোলা ও ধুলিয়ান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ২৫ তারিখে গেলাম মালদহের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামে‘আ মাযহারুল উলূম বাটনা মাদরাসায়। মাওলানা মোসলেম রহমানী (৭১) তখন মুহতামিম। খুবই সমাদর করলেন। শুনলাম আব্দুল মতীন সালাফী এখানে একসময় ছাত্র ছিলেন। দুর্ভাগ্য প্রতিষ্ঠানের পশ্চিম পার্শ্বে খারেজী মাদরাসার বিপরীতে পূর্ব পার্শ্বে আলিয়া মাদরাসা গড়ে উঠেছে নতুনভাবে। মাওলানা দুঃখ করলেন। বাংলাদেশেও একই হাওয়া বইছে। ঐদিন রাতে গেলাম পার্শ্ববর্তী ভাদো মাদরাসায়। পরদিন সেখানে ক্লাসটাইমে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে আহলেহাদীছ আন্দোলনের উপর বক্তব্য রাখি। অতঃপর তথ্যাদি সংগ্রহ করি।

পশ্চিম দিনাজপুর : পরদিন ভাদো মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মাদ হোসেন নাদভীকে সাথে নিয়ে চলি পশ্চিম দিনাজপুরের ইটাহার থানাধীন মাওলানা আহমাদ হোসায়েন শ্রীমন্তপুরী (৭৯)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। কেননা উনিই হ’লেন চাপাই নবাবগঞ্জের নারায়ণপুরের আহলেহাদীছ আন্দোলনের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ নেতা রফিক মন্ডলের সার্থক জীবন্ত উত্তরসুরী। ২৭ ও ২৮ জানুয়ারী সেখানে থাকি এবং তাঁর পুরা বক্তব্য নোট করি। পরদিন যাই আব্দুল মতীন সালাফীর পৈত্রিক বাড়ী করণদীঘি থানাধীন ভুলকি গ্রামে। তার পিতা যোগ্য আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান ও অন্যান্য মুরববীদের কাছ থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করি। এরপর কলিকাতা ফিরে যাই এবং সেক্রেটারী মাওলানা আয়নুল বারীর নিকট থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক জমঈয়তে আহলেহাদীছ-এর পক্ষ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করি। এরপর এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাই। এরপর প্রাদেশিক জমঈয়ত সভাপতি আব্দুল কাইয়ূম খানের (৭৬) কলিকাতা-১১ এর ৫২, নারিকেলডাঙ্গা নর্থ রোড-এর বাড়ীতে গিয়ে তথ্য নেই।

উত্তর ২৪ পরগণা : অতঃপর তাঁর গ্রামের বাড়ী উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপদহা থানাধীন ঐতিহাসিক হাকিমপুর মারকাযে যাই ৩.২.৮৯ ইং তারিখে। সেখানকার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আযান দিলে ছোট্ট সোনাই নদীর পশ্চিম পাড়ে বাংলাদেশের উত্তর ভাদিয়ালীর লোকেরা শুনতে পায়। মনটা বারবার ব্যাকুল হয়ে উঠছিল যে, ছোট্ট একটু সীমানা পেরিয়ে ওপারে নিজ দেশে যেতে পারছিনা কেবল পরদেশে থাকার কারণে। মানুষের তৈরী এই ভেদরেখা কখনোই হৃদয়ের আকর্ষণ ছিন্ন করতে পারে না। উল্লেখ্য যে, সোনাই নদীর দু’পাশের মুসলমানেরা প্রায় সবাই আহলেহাদীছ মূলতঃ হাকিমপুর মারকাযের বরকতে।

পরদিন কলিকাতা ফিরে এলাম। অতঃপর কাঠমন্ডু ফ্লাইটের টিকেট কেনার জন্য বের হ’লাম। পার্ক স্ট্রীট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ধর্মসভার দিকে একাকী। পুলিশের বেশধারী একজন আমাকে ডাকল। হাতে হ্যান্ডব্যাগ ছিল। কাছে গেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে টাকাগুলো সব বের করে নিল। অতঃপর চাকু বের করে বলল, চলে যাও, বাত মাৎ কারো। সবই হ’ল চোখের পলকে। ভদ্রবেশী পুলিশ চলে গেল। আমিও চলে এলাম ধীর পায়ে মিছরীগঞ্জ মসজিদে। ভুল করেছিলাম একাকী গিয়ে। পরে জানলাম ওটা পুলিশ নয় ঠগ। এটা কলিকাতার নিত্য দিনের ঘটনা। পরদেশী বুঝতে পারলে ওরা পিছে লাগে। খালাতো ভাই আব্দুর রব কানাড়া ব্যাংকে চাকুরী করে। মুসলিম লীগের তুখোড় নেতা। আমার সমবয়সী। ওকে গিয়ে বললাম। নিয়ে গেল আলীপুর থানায়। জিডি করলাম। ব্যস! ঐ পর্যন্তই। এরপর সন্ধ্যায় মেটিয়াবুরুজ হালদারপাড়া মসজিদে গেলাম। এখানে মাওলানা আয়নুল বারীর বাড়ী। মসজিদেই সাক্ষাৎ হ’ল। তারপর চলে এলাম। এভাবে ভারতে আমার ৩২ দিনের স্টাডি ট্যুর শেষ হ’ল।

নেপাল ভ্রমণ   

কাঠমান্ডু : স্টাডি ট্যুরের শেষ পর্যায়ে সার্কভুক্ত তিনটি দেশের সর্বশেষ নেপালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম ৬ই ফেব্রুয়ারী’৮৯ইং তারিখে। মধ্যাহ্ন সূর্য মাথায় নিয়ে দুপুর ১২-টা ২০ মিনিটে কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামলাম। পাহাড়ঘেরা বিমানবন্দরটি যেন দেয়াল ঘেরা খেলার মাঠ। আমাদের বিমানটি হঠাৎ গাছ-গাছালী দিয়ে সাজানো পাহাড়ের মধ্যে টুপ করে ডুবে গেল ও হাঁপিয়ে গিয়ে টারমাকে দাঁড়িয়ে গেল। নতুন দেশ নতুন অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে গেলাম কাঠমন্ডু শহরের ঘণ্টাঘর দেউবন্দী জামে মসজিদে। সেখানে মসজিদের ৪২ বছর যাবৎ ইমাম মাওলানা মুহাম্মাদ হায়াত দেউবন্দীর মেহমান হ’লাম। পাশেই একটা মুসলিম খাবার হোটেল পাওয়া গেল। ফলে সমস্যা হয়নি। মাওলানার হেফাযতে আমার ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে পরদিন ঝান্ডানগর রওয়ানা হ’লাম।

ঝান্ডানগর : কাঠমান্ডু থেকে সড়ক পথে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কপিলবস্ত্ত যেলায় অবস্থিত ঝান্ডানগর। এখানেই ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নেপালের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম মাদরাসা সিরাজুল উলূম। যা একই সঙ্গে নেপালে আহলেহাদীছ আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত। পাশেই কৃষ্ণনগর শহর। মাদরাসায় পৌঁছে বাদ মাগরিব ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে মাদরাসার প্রধান ফটকের ছবি তুললাম। ভারতের উত্তর প্রদেশের বঢ়নী রেল স্টেশনের উত্তর পার্শ্বে ৫ হাতের মধ্যে মাদরাসাটির মূল ফটক ও বিল্ডিং শুরু। মাদরাসার পোষ্ট অফিস হ’ল বঢ়নী। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার। মনেই হয় না যে দু’টি পৃথক দেশ। ভারত ও নেপালের খতীবুল হিন্দ মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরীর পিতা এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি এর পরিচালক। সাথে সাথে রাবেতা আলমে ইসলামীর একমাত্র নেপালী সদস্য। তাঁকে পেলাম না। অন্যান্য শিক্ষকরা সাহায্য করলেন। রাতে আব্দুল্লাহ মাদানীদের তাজ এম্পোরিয়াম কাপড়ের দোকানে গেলাম কৃষ্ণনগর বাজারে। তাঁর দেওয়া সুন্দর ছোট্ট নেপালী তোয়ালেটা আমার রেডিওর ঢাকনা হিসাবে আজও রয়েছে। রেডিওটা আব্দুল মতীন সালাফী ঢাকা থেকে ২৭০০ টাকায় কিনে আমাকে হাদিয়া দেয় সম্ভবত ১৯৮৫ সালে। ’৯৭ সালে তাবলীগী ইজতেমা উপলক্ষে উনারা আমার নওদাপাড়ার বাসায় এলে ছোট বইয়ের আলমারীর উপরে রক্ষিত এক হাদিয়ার উপরে আরেক হাদিয়া দেখে হেসে লুটোপুটি খেয়েছিলেন। আজ যখন এসব লিখছি, তখন আব্দুল মতীন (১৯৫৪-১৬ই জানুয়ারী ২০১০ খৃঃ) চলে গেছেন না ফেরার জগতে (আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নছীব করুন!)। আব্দুল্লাহ মাদানী আজও নেপালের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দাঈ হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের কবুল করুন- আমীন! আব্দুল্লাহ মাদানী ‘নূরে তাওহীদ’ নামে ১৯৮৮ সাল থেকে একটা মাসিক পত্রিকা চালান। যা নেপালের প্রথম ও সেসময় ছিল একমাত্র আহলেহাদীছ পত্রিকা। তার পরে জামে‘আ সিরাজূল উলুম থেকে আস-সিরাজ নামে আরেকটি মাসিক পত্রিকা চলছে গত ১৯৯৪ সাল থেকে।

তাউলিয়া : পরদিন ৮ই ফেব্রুয়ারী’৮৯ইং তারিখে আহলেহাদীছ আন্দোলনের নতুন আরেকটি কেন্দ্র তাউলিয়া মাদরাসার গেলাম। সঙ্গে মাওলানা ঝান্ডানগরীর ভাই মাওলানা আব্দুর রহমান নদভী (৬০), আব্দুল্লাহ মাদানীর চাচা মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রিয়াযী (৫৫), মাওলানা হাকীকুল্লাহ ফায়যী (৫০)। ১৯৮৮ সাল থেকে আব্দুল্লাহ মাদানী তাউলিয়ার আল-মা‘হাদ আল-ইসলামীতে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন। সেখানে যাওয়ার সময় এক মজার ঘটনা ঘটল। বঢ়নী রেল স্টেশন থেকে উঠে ২৫ কিলোমিটার দূরে তাউলিয়া রেলস্টেশনে নেমে ২০ কিলোমিটার দূরে তাউলিয়া মাদরাসায় যাওয়ার পথে গাড়ীতে চেকিং। আমার ব্যাগে চাউলের কৌটা দেখে ওরা সন্দেহ করল। আমি দৈনিক সকালে খালি পেটে চাউল-পানি খাওয়ায় অভ্যস্ত। কিন্তু ওদের বুঝাবে কে? মূর্খ পুলিশগুলো কোন বুঝ মানল না। শেষে পুলিশের গাড়ীতে করে সোজা তাউলিয়া সিডিওর পুলিশ হেড কোয়ার্টার। মাওলানা হারূণ তাউলিয়ার প্রভাবশালী আহলেহাদীছ আলেম। উনি আগেই সেখানে চলে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে আমাকে সেখানে পৌছে আর কারো মুখোমুখি হ’তে হয়নি। পুলিশের গাড়ী থেকে নেমে আলেমগণের সাথে সোজা তাউলিয়া মাদরাসায় পৌঁছি। সেখানে গিয়ে যোহরের ছালাতের পর ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে বক্তৃতা করি উর্দূতে। আজব ব্যাপার এই যে, উনারা নেপালী হলেও সবাই উর্দূভাষী। কেউ নেপালী ভাষা বলেন না। আমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে পেরে সবাই খুব খুশী হলেন। আর আমি সবচেয়ে খুশী হলাম নেপালের শ্রেষ্ঠতম আলেম অশীতিপর বৃদ্ধ মাওলানা আব্দুর রঊফ ঝান্ডানগরী (১৯০৬-৩০শে নভেম্বর, ১৯৯৯ খৃঃ)-কে পেয়ে। ওনার সঙ্গে ইতিপূর্বে দিল্লী ফতেহপুর সিক্রী জামে মসজিদের মেহমানখানায় সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু উনি তখন বের হচ্ছিলেন বলে তেমন কথা বলার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া যুবসংঘের জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে দাওয়াতনামা পাঠানোর কারণে তিনি আমাকে নামে চিনতেন। যদিও তখন জাতীয় সম্মেলন হয়নি। এখানে তাঁকে সহ অন্যান্য আলেমদের পেয়ে আমার নেপাল ভ্রমণ সার্থক হ’ল। তাঁদের সকলের কাছ থেকে সাধ্যমত তথ্যাদি নিলাম।

পরদিন ৯ই ফেব্রুয়ারী সকালে তাউলিয়া থেকে কৃষ্ণনগর যাব। লোকাল বাস ধরতে হবে। দীর্ঘ বিরতিতে চলে। ফলে একটা ধরতে না পারলে পরেরটার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তাতে কৃষ্ণনগর গিয়ে নাইট কোচের টিকিট পাওয়া যাবে না। এদিকে বাস স্টেশন পর্যন্ত দু’তিন মাইল রাস্তা। যাব কিভাবে? আব্দুল্লাহ মাদানী লজ্জায় পড়ে গেলেন। বললাম, আপনাদের এখানে বাই সাইকেল পাওয়া যায় না? একটা পাওয়া গেল। দু’জন ছাত্রকে নিলাম। একজনকে সামনে রডে বসিয়ে এবং একজনকে পিছনে ক্যারিয়ারে বসিয়ে ব্যাগ নিয়ে। এরপর সীটে বসলাম। শিক্ষকরা সব থ’। সামনে পাহাড়ী ঝরণা। ওটা পার হবার কোন ব্রীজ নেই। ঝিরঝিরে পানির ধারা। নীচে নুড়ি-পাথর দেখা যাচ্ছে। ছাত্র দু’জন নামতে চাইল। আমি তাদের না নামিয়ে সোজা চালিয়ে দিলাম পানির মধ্য দিয়ে। পাহাড় ঢালু থাকায় এক টানে গিয়ে উঠলাম ওপারে। ছাত্র দু’জন তো ভয়ে দিশেহারা। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ২২শে জানুয়ারীতে কুয়েতের হোটেল মেরিডিয়ানে সাক্ষাত হলে আব্দুল্লাহ মাদানী খুব রসিয়ে ঐ গল্প বললেন। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও আলেমদের নিকট ঘটনাটি ছিল নাকি আলোচনার বিষয়। ঐ ঝর্ণার ছবি তুললাম। পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণা বয়ে চলেছে ঝিরঝির ধারে মৃদু কলতানে সবুজ যমীনে প্রভাত সূর্যের রঙ মাখানো লালপেড়ে শাড়ী পরে। কি চমৎকার দৃশ্য! এ্যালবামে রাখা ছবিটি দেখে ভাবছি ছবির মত সুন্দর দেশটি আল্লাহর কি এক অপূর্ব সৃষ্টি!! সে সৌন্দর্যের আরো এক ঝলক দেখা গেল পরদিন ভোরে কাঠমন্ডু থেকে ২০ কি.মি. দূরে থাকতে পাহাড়ের মধ্য হ’তে যখন সূর্য কেবল ঘুম থেকে মাথা উঠালো। বরফাবৃত পর্বতমালার শীর্ষে ও ঢালুতে প্রভাত সূর্যের চিকচিকে মনোরম দৃশ্য যে দেখেনি, সে যেন কিছুই দেখেনি। এই অপূর্ব সৃষ্টি যার, তিনি নিজে না জানি কত সুন্দর! ইচ্ছা জেগেছিল ‘মাউন্টেন ফ্লাইটে’ উঠে নেপালের পুরা পাহাড়ী এলাকার দৃশ্য ভালভাবে দেখব। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের মিল হলো না।

দেশে ফেরা : ১০ই ফেব্রুয়ারী’৮৯ দুপুরে কাঠমন্ডু থেকে সরাসরি ফ্লাইটে ঢাকা রওয়ানা হ’লাম। ৫২ দিনের সফর শেষে দেশে ফেরার এক অদম্য অনুভূতি নিয়ে। মনে মনে হিসেব করছিলাম সার্কের ৪টি দেশের মধ্যে কোন দেশটি সবচেয়ে সুন্দর? সফরের শুরুতে ২১শে ডিসেম্বর’৮৮ বিকালে যখন করাচী এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, তখন সেখানকার ধূসর রানওয়ে দেখে মনটা বিগড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল এখানকার মানুষগুলোর অন্তরও ধূসর ও দরদহীন। পরে দিল্লী এয়ারপোর্ট। পার্থক্য তেমন কিছু বুঝিনি। কারণ লাহোর ও দিল্লীর দূরত্ব আধা ঘন্টারও কম। কলিকাতা ও বাগডোগরা এয়ারপোর্টও কেমন যেন রুক্ষ প্রকৃতির। কাঠমান্ডু থেকে ফেরার পথে এদিন ৩৩ হাযার ফুট উপর থেকে বেলা ৩-টার দিকে নীচে তাকিয়ে এভারেষ্ট গিরিশৃঙ্গ ও তার মাথায় জমা বরফের উত্থিত দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই বরফ হাতে পাব। বরফের বুকে সূর্যের কিরণ যে কত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হতে পারে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তা মিলিয়ে গেল। ভারতের লাল ও ধূসর মাটি পেরিয়ে বাংলাদেশের আকাশ সীমায় প্রবেশ করতেই বিমান ক্রমে নীচু হতে লাগল। আর তার সবুজ চেহারা ক্রমেই ভেসে উঠতে থাকল। এতক্ষণে পার্থক্য পরিস্ফুট হয়ে গেল। চক্ষু জুড়িয়ে গেল। হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে গেল। নদী আর সবুজে ভরা এই দেশের কোন তুলনা নেই কোথাও। আল্লাহ তুমি আমাদের দেশটিকে নিরাপদ ও শান্তির দেশে পরিণত কর-আমীন!

সন্ধ্যায় ঢাকায় নেমে পরদিন সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে পত্রিকায় কড়া বিবৃতি দিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ শেষে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পরিশেষে বলব, আমার পিএইচডি গবেষণাটি ছিল আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণের পথে একটি কঠোর সাধনা। স্টাডি ট্যুরের ৫২ দিন ছিল তারই একটা পর্ব মাত্র। সংগঠনের বরকতে ও তাওহীদের ডাক-এর আগ্রহে দীর্ঘদিন পরে সেই ফেলে আসা পর্বটি কাগজ-কলমে বেঁধে ফেলতে পারায় অনেকটা ভারমুক্ত হলাম। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীদের জন্য পাথেয় হবে বলে মনে করি। আল্লাহ আমাদের সকল নিঃস্বার্থ নেক আমল কবুল করুন ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের নির্ভেজাল দাওয়াতকে তার নেক বান্দাদের কবুল করার তাওফীক দিন- আমীন!  (ক্রমশঃ)



বিষয়সমূহ: সাক্ষাৎকার
আরও