হাফেয লূৎফর রহমান

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 8052 বার পঠিত

[আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া, রাজশাহী-এর সর্বজন শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হাফেয মাওলানা লুৎফর রহমান। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই নিবেদিতপ্রাণ এই কর্মবীর শিক্ষকের পথ চলা। দীর্ঘদিনের সুখ-দুঃখের পথ পরিক্রমায় যার মেহনত ও স্নিগ্ধ ভালবাসার পরশ মিশে আছে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কোন এবং অসংখ্য আলেম-ওলামা, লেখক, গবেষক, সংগঠক ও ছাত্রের হৃদয়। সংগঠন ও মুহতারাম আমীরে জা‘মাআতের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা অনুরণিত হয়েছে তার প্রতিটি কথা ও কর্মে। তিনি একজন নিভৃতচারী, তাহাজ্জুদগুজারী ও পরহেযগার ব্যক্তিত্ব। সেই সাথে আদর্শ ছাত্র গড়ার কারিগর। এই বর্ষীয়ান শিক্ষকের অনেক ছাত্রই এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। তাঁর অভিজ্ঞতাপূর্ণ কর্মময় জীবন সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাওহীদের ডাক সহকারী সম্পাদক মুখতারুল ইসলাম। তাওহীদের ডাক পাঠকদের খেদমতে তা পেশ করা হ’ল]

তাওহীদের ডাক : উস্তাদজী, আপনি কেমন আছেন, আপনার অসুস্থতার কথা শুনেছিলাম?

হাফেয লূৎফর রহমান : আলহামদুলিল্ল­াহ, আমি কিছুদিন আগে খুব অসুস্থ ছিলাম। এখন অনেকটা সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। আল্ল­াহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া আদায় করছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।

হাফেয লূৎফর রহমান : আমার জন্মস্থান বগুড়া যেলার গাবতলী থানাধীন মহিশবান ইউনিয়নের পারানীরপাড়া গ্রামে। আমার আববার নাম মহিউদ্দীন। আর আমার আম্মার নাম হল আলেফা বেগম। জন্ম তারিখ আমার সঠিক মনে নেই। কারণ আমি ছোট বেলাতেই আমার বাবা ও মাকে হারিয়েছিলাম। তবে আমার জন্ম আনুমানিক ১৯৫৬ সাল হতে পারে।

আমার পরিবার বলতে আমার বাবা দু’টি বিবাহ করেন। আমরা উভয় পক্ষ মিলে ভাই ৭ জন আর বোন ২ জন। আমার ছোট বোন ও মা কলেরা ও বসন্ত রোগে মারা যান। পরে আমার আববা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। দ্বিতীয় পক্ষের আমরা চার ভাই। আমার প্রথম মায়ের কোন ছেলে-মেয়ে বেঁচে নেই। দ্বিতীয় মায়ের চার ভাই এখন জীবিত আছে। তার মধ্যে আমি দ্বিতীয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার প্রাথমিক শিক্ষা কিভাবে এবং কত বছর বয়সে শুরু হয়েছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : বাল্যকালে পিতামাতার হারানোয় আমার অভিভাবকত্বের দায়িত্বটি মূলতঃ আমার বড় ভাই মুমতাযুর রহমানই পালন করেছিলেন। আমার পিতা জীবিত থাকতেই তিনি পাকিস্তানে পড়তে গিয়েছিলেন। আমার প্রাথমিক শিক্ষাটা একটু বৈচিত্র্যময় ছিল। আমার বড় ভাই ১৯৬৫ সালে যখন আমাকে পাকিস্তানে নিয়ে যান, তার ইচ্ছা ছিল প্রথমে আমাকে তিনি হিফয করাবেন। তারপর কিতাব পড়াবেন। কিন্তু যে মাদ্রাসাতে ভাই ছিলেন সেখানে হিফয বিভাগ ছিল না। বিধায় সেখানকার জনৈক একজন বাংলাদেশী হাফেযের কাছেই খেলাচ্ছলে ঊর্দূ ও আরবী অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে আমার প্রায় ছয় মাস কেটে যায়। অতঃপর আমার যতদূর মনে পড়ে আমার বড় ভাই আমাকে নয় বছর বয়সে স্বনামধন্য হাফেয ক্বারী মাওলানা আব্দুল হাকীমের নিকটে নূরানী ক্বায়দা ও ঊর্দূ পড়তে পাঠায়। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর আমাকে তিনি এক হানাফী মাদরাসায় হিফয বিভাগে ভর্তি করে দেন। এভাবে হিফযের মাধ্যমে আমার প্রাতিষ্ঠানিক জীবন শুরু হয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার পিতৃতুল্য বড় ভাই সম্পর্কে একটু জানতে চাই? তিনি কিভাবে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন?

হাফেয লূৎফর রহমান : আমার বড় ভাইয়ের নাম মাওলানা মুমতাযুর রহমান। উনি আমার দু’বছর আগেই পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। আমার বড় ভাই প্রথমে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে এলাকায় লায়েলপুর যেলা মামূকাঞ্জন থানা দারুল উলূম মাদরাসা থেকে দাওরা হাদীছ পাশ করেন। তিনি করাচিতে বাহরুল উলূম মাদরাসা থেকে পুনরায় দাওরা ফারেগ হয়েছিলেন। অতঃপর ঊনি সঊদী আরব গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে আসার পর তিনি ব্যবসা করতেন। এখন তিনি বেঁচে নেই। এক বছর হ’ল উনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

তাওহীদের ডাক : হিফযের পাশাপাশি আপনার ভাইয়ের মত আপনি উচ্চতর শিক্ষার কোন সুযোগ পেয়েছিলেন কি?

হাফেয লূৎফর রহমান : আমি দুই বছর হানাফী মাদরাসায় ছিলাম। কায়দা ও নাযরানাসহ সেখানে দুই বছরে পাঁচ পারা শেষ করেছিলাম। আমার ভাই দারুল উলূম মাদ্রাসা থেকে ফারেগ হয় এবং তিনি সেখান থেকে করাচিতে চলে গেলেন। তারপর তিনি বাহরুল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। আর আমাকে তিনি দারুল হাদীছ রহমানিয়া মাদ্রাসাতে ভর্তি করে দেন হিফয বিভাগে। যার অধ্যক্ষ ছিলেন তদানিন্তীন প্রখ্যাত আহলেহাদীছ বিদ্বান মাওলানা হাকেম আলী কানাল্লাহু লাহু। যিনি আমাদের সম্মানিত প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফীসহ অনেকের উস্তায ছিলেন। ১৪ বা ১৫ বছর বয়সে হিফয শেষ করার পর আমি পাঞ্জাবে গুজরানওয়ালা মাদরাসায় এক বছর ক্বারিয়ানাতে পড়াশোনা করেছিলাম এবং সে বছরেই দেশে ফিরে আসি।

পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জামিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় গমন করি। তখন জামিয়া ইসলামিয়ার মুহতামিম ছিলেন মতিউর রহমান ছাহেব দেওবন্দী। অতঃপর সেখানে আমি মীযান ও নাহুমীর থেকে পড়া শুরু করি। কেননা আমার কিতাব বিভাগে কোন পড়ালেখা ছিল না। তারপর ময়মনসিংহে আল-জামিআতুস সালাফিয়াহ চকপাঁচপাড়া ত্রিশাল মাদরাসায় গেলাম এবং সেখানে আমি নাসাঈ পর্যন্ত পড়েছিলাম। এভাবে ২২-২৩ বছর বয়সে আমার উচ্চতর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে।

তাওহীদের ডাক :  মারকাযের বর্তমান প্রিন্সিপাল আব্দুল খালেক সালাফী উস্তাদজীর সাথে পাকিস্তানে আপনার সাক্ষাৎ হয় কিভাবে?

হাফেয লূৎফর রহমান : আমি যখন জামেআ রহমানিয়া করাচীতে সম্ভবত ২০ কিংবা ২১ পারা হিফয করেছিলাম, তখন তিনিসহ সাতজন বাঙ্গালী ছাত্র ওখানে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন মাদরাসায় শাখা ছিল দু’টি। একটি দাওরায়ে হাদীছ শাখা আর অপরটি হিফয শাখা। আমি হিফয শাখাতে থাকি আর তাঁরা দাওরাতে থাকেন। এই দুই শাখার দূরত্ব ২ মাইল রাস্তা। এক জায়গায় রান্না হয়, আর দুই জায়গায় খাওয়া-দাওয়া হ’ত। হিফযখানা ছিল আসানমাল উঝা রোড আরামবাগ মৌলভী মুসাফের খানা। আর এটা ছিল পুরাতন মাদরাসা। পাকিস্তান স্বাধীনের পর ভারত থেকে চলে আসা দিল্লীর রহমানিয়া মাদ্রাসার কিছু আহলেহাদীছ সদস্য করাচীতে গিয়ে প্রথমে একটা বিল্ডিং নিয়ে মাদরাসা চালু করেন। পরে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে গেলে সোলজার বাজার করাচী নং ৩ জায়গা কিনে সেখানে নতুন দাওরায়ে হাদীছ মাদরাসা চালু হয়। সেখানে তৎকালীন ২০-২২ বছরের যুবক আমাদের মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল খালেক সালাফী তিরমিযী অথবা আবুদাউদ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। আরও কিছু বাংঙ্গালী ছাত্র সেখানে ভর্তি হয়েছিল। পরবর্তীতে আমাদের হিফযখানাটাও সেখানে স্থানান্তরিত হলে সমন্বিত রহমানিয়া মাদরাসার একই রুমে আমরা থাকতাম।

তাওহীদের ডাক : উস্তাদজী যদি বিশেষ কোন পরহেযগার উস্তাদের গল্প শুনাতেন যা আপনার জীবনকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : আমি পাকিস্তানের যে মাদরাসায় পড়াশোনা করেছিলাম তা ছিল বহুমুখী শিক্ষার কেন্দ্র এবং আহলেহাদীছদের অনন্য একটি মারকায। যেমন সেখানে হিফয বিভাগ, দাওরা হাদীছ, ক্বারিয়ানা বিভাগ ছিল। অত্র মাদরাসায় মাওলানা আব্দুল্লাহ নামে একজন আলেম ছিলেন যিনি খুবই পরহেযগার, আল্লাহওয়ালা ছিলেন। যিনি সবসময় কুরআন পড়তেন, শুধুমাত্র পেশাব-পায়খানা যাওয়া ব্যতীত। এমনকি আমি উনাকে রাস্তায় চলাফেরাতেও কুরআন পড়তে দেখেছি। এতদ্ব্যতীত মুহাতামিম মাওলানা হাকেম আলী কানাল্লাহু লাহু, ক্বিরআত ও হিফয বিভাগের প্রধান আমার উস্তাদ ক্বারী আসলাম ছাহেব মত কিছু আল্লাহওয়ালা আলেম-ওলামার আমল-আখলাক আমাকে খুবই প্রভাবিত ও বিমোহিত করেছিল।

তাওহীদের ডাক : তদানিন্তনকালে পাকিস্তানে কারা বিখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম ছিলেন?

হাফেয লূৎফর রহমান : ঐ সময় আহলেহাদীছ জামা‘আতের বড় বড় আলেম ছিলেন যেমন- হাফেয মাওলানা মুহাম্মাদ গোন্ধলভী, হাফেয আব্দুল কাদের রৌপড়ী, মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন শেইখুপুরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল গাফ্ফার সালাফী, মাওলানা বদিউদ্দীন শাহ রাশীদী, আল্লামা ইউসুফ কালকাত্তাবী, ক্বারী আব্দুল খালেক রহমানী, আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর প্রমুখ।

তাওহীদের ডাক : মাওলানা ইহসান ইলাহী যহীরের সাথে আপনার কখনও সাক্ষাৎ হয়েছিল কি?

হাফেয লূৎফর রহমান : হ্যাঁ, উনার সাথে আমার একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। যখন উনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারেগ হয়ে আসলেন। আসার পরে তিনি রাজনীতিতে নামলেন এবং আহলেহাদীছদেরকে বিভিন্ন দল থেকে বের করে নিয়ে সকলকে একটা প্লাটফর্মে একত্রিত করতে চাইলেন। আর গুজরানওয়ালা মাদ্রাসা অর্থাৎ আমি যেখানে পড়াশোনা করেছি, আল্লামা ইহসান এলাহী যহীর ছাহেব সেখান থেকেই দাওরা হাদীছ ফারেগ হয়েছিলেন।

তাওহীদের ডাক : উস্তাদজী পাকিস্তানে নাকি আপনার আযানে ও ক্বিরাতে বেশ সুনাম ছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : হ্যাঁ, মোটামুটি পাকিস্তানে ছাত্রদের মধ্যে আমার একটা সুনাম ছিল। বিশেষ করে আমরা যত ছাত্র ছিলাম, তাদের মধ্যে আমার ক্বিরাত ও আযান নাকি সবার কাছে ভালো লাগত। এমনকি কোন ক্বিরাত সেমিনার হ’লে আমার নামই বেশী আসত। আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশে এসেও মহান আল্লাহ আমার এই সম্মান বজায় রেখেছেন।

তাওহীদের ডাক : আপনার কর্মজীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : ১৯৮৩ সালে আমি প্রথমে চাকরি শুরু করি বগুড়া যেলার গাবতলী থানাধীন সন্ধ্যাবাড়ী মাদরাসায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমি সেখান থেকে আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেলার নাচোল মাক্তাপুর দারুল কুরআন হাফেযী মাদরাসা চলে আসি এবং দুই বছর চাকুরী করি। সেখান থেকে আমি আবার বগুড়াতে ফিরে গিয়ে শহরে জমঈয়ত পরিচালিত একটি মসজিদ ও মাদরাসায় যোগ দিই এবং ১৯৮৫ সালে বিবাহ করি। সেখানে তিন বছর চাকরি করার পর চলে গেলাম ঢাকা কেরানীগঞ্জ দোলেশ্বর মাদরাসায়। অতঃপর আমি পুনরায় বগুড়ার মাদরাসায় ফিরে আসি।

তাওহীদের ডাক : আপনার সাথে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের কখন কিভাবে সাক্ষাৎ হয়?

হাফেয লূৎফর রহমান : আল-জামিআতুস সালাফিয়াহ চকপাঁচ পাড়া ত্রিশাল মাদরাসায় ছাত্রবস্থায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার ও বর্তমান আন্দোলনের মুবাল্লিগ আব্দুল হামীদ ভাইয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। উনি সেখানে যুবসংঘে’র দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দাওয়াতে অনুপ্রাণিত হয়ে সেখানে আমরা যুবসংঘের শাখা খুলে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। দোলেশ্বরে যাওয়ার পর সেখানে আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। দোলেশ্বরে গিয়েও আমি ও আমার দিনাজপুরের ছাত্র কামারুয্যামান দু’জনে মিলে যুবসংঘে’র শাখা খুলি।

তাওহীদের ডাক : বগুড়ায় জমঈয়তের মাদরাসায় চাকুরী করে যুবসংঘ করতে আপনাকে কি কোন সমস্যায় পড়তে হয়েছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : যুবসংঘে’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব শেখ রফীকুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ হিফযুল উলূম মাদরাসায় ছাত্র থাকাকালীন একবার বগুড়ায় আমার মাদরাসায় সংগঠন বিষয়ক জোরালো বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তাঁর বক্তব্যে আমার ভিতরে খুব রেখাপাত করেছিল। পরবর্তীতে যুবসংঘে’র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে যুবসংঘে’র শাখা খুলে জমঈয়তে আহলেহাদীছের মাদরাসায় যুবসংঘে’র সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করি। জমঈয়ত থেকে আমাদের বলা হ’ল, আপনারা যুবসংঘ করতে চান, সেটা করা যাবেনা। কারণ আমরা যুবসংঘ বাদ দিয়েছি । তাই যুবসংঘ না হয়ে শুববানের শাখা হবে। তখন আমি বললাম, যুবসংঘ আর শুববান তো একই হ’ল। পার্থক্যের কি হ’ল? তখন তারা বলল, যুবসংঘ ড. গালিব ছাহেবের দল, তাই করা যাবেনা। আর আমাদের হ’ল শুববান তাই এখানে শুববানই করতে হবে। তখন তারা যুবসংঘের সাইনবোর্ড খুলে ফেলল। পরে আমি ভাই আনছার আলী মাস্টার, আব্দুর রহীম, আইয়ুব আলীকে খবর দিলে তারা পুনরায় প্রায় ২০/২৫ জন কর্মী নিয়ে এসে মিটিং করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিলেন এবং আইয়ুব ভাই রাস্তার উপর জোরালো বক্তব্য দিয়ে চলে গেলেন। এক পর্যায়ে আমার সাথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তারা আমাকে বললেন, আপনি হয় যুবসংঘ ছাড়বেন, নয়তো মাদ্রাসা ছাড়বেন। তখন আমি নিজ এলাকা হিসাবে সাহস করে বললাম, আমি যুবসংঘও ছাড়ব না, আর মাদরাসাও ছাড়ব না, আপনারা যা খুশী করতে পারেন। তখন তারা বললেল, কি এত বড় কথা? আমাদের মাদ্রাসায় থাকেন আবার আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন? তখন আমি বললাম, মাদরাসা তো আপনাদের না, মাদ্রাসা তো আমার। আপনারা শুধু কমিটিতে আছেন। আর আমিই সব কাজ করি রশিদ বই দিয়ে আদায় করি। তখন উনারা আমার বেতন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবুও আমি রশিদ বইয়ে আদায় করি; হিসাব করি; বই জমা দেই ও বেতন কাটি। কেননা মাদ্রাসার সেক্রেটারীর কাছ থেকে পূর্বেই প্রায় দশটি রশিদ বই আমার কাছে জমা ছিল। এভাবেই প্রায় দশ মাস চলেছে। এক পর্যায়ে সেখানে যুবসংঘের শাখা জোরদার হওয়ার কারণে মসজিদে ফরয ছালাতের পর সম্মিলিত মোনাজাত বন্ধ হয়ে গেল। তারপর দিনাজপুরের মাওলানা যিল্লুর রহমান নাদভীকে ইমাম নিয়োগ করা হ’ল। তিনি ইমাম হিসাবে নিয়োগ হওয়ার পর অসীলা দো‘আ চালু করেন। কিন্তু নিজে সাহস না পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে কাজেমকে দিয়ে বক্তব্য দেওয়ান এবং তিনি দো‘আ সম্পর্কে আলোচনা করেন। শুধুমাত্র যুবসংঘে’র উপর হিংসার বশবর্তী হয়ে এভাবে তারা পুনরায় সম্মিলিত বিদ‘আতী দো‘আ চালুর অপচেষ্টা চালায় এবং আমাকে কোনঠাসা করে রাখে।

তাওহীদের ডাক : আমাদের নওদাপাড়া মাদরাসায় আপনি কখন, কিভাবে যোগদান করলেন?

হাফেয লূৎফর রহমান : বগুড়ায় যখন দ্বন্দ্ব হয়ে গেল, সেখানে থাকা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে গেল। তখন আমি চিন্তা করলাম কি করব? ইতিমধ্যে যুবসংঘে’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি কুষ্টিয়ার আবু বকর ভাইয়ের মাধ্যমে আমীরে জামা‘আত ও আব্দুছ ছামাদ সালাফী ছাহেব জানতে পেরেছিলেন যে, হাফেয ছাহেব ওখানে খুব সংগ্রাম করে টিকে আছেন। এক পর্যায়ে  আবু বকর ভাই বললেন, আপনি যদি এখানে থাকতে পারেন তাহলে আমরাই আপনার বেতন দিব ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেটা সম্ভব হ’ল না। অবশেষে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। পরবর্তীতে আমাকে নওদাপাড়া মারকাযে ডাকা হ’ল। তারপর অনেকের সাথে পরামর্শ করলাম, আমি আসার পূর্বে আমার ছাত্র হাফেয ইউনুছকে পাঠালাম। হাফেয ইউনুছ মারফত আমাকেও কেন্দ্রে ডাকা হ’ল। অবশেষে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে মূলতঃ আমীরে জামা‘আতের প্রতি ব্যক্তিগত ভালোবাসা থেকে আমি কেন্দ্রীয় মারকাযে চলে আসি।

তাওহীদের ডাক : মারকাযে যখন আসেন তখন এখানকার অবকাঠামো কেমন ছিল?

হাফেয লূৎফর রহমান : আমি এখানে এসে হিফযখানার দায়িত্ব গ্রহণ করি। প্রথম প্রথম আমি এখানে থাকতে পারব না বলে মনে করতে লাগলাম। কেননা ছোট থেকেই আমার চা খাওয়ার  অভ্যাস ছিল। সেসময় এখানে একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত ছিল না। নওদাপাড়া ছিল তখন নিছক একটি গ্রাম। কোন দোকান-পাট ছিলনা; বাড়িঘরহীন, জনমানবশূন্য একটি ধূ ধূ প্রান্তরের মত পড়ে ছিল। অবকাঠামো বলতে তখন মাদ্রাসার একতলা নতুন ভবন হয়েছে। কোন কোন ঘরের মেঝে পাকা ছিলো না। ৬০-৭০ জন ছাত্র এবং ১৪ জন শিক্ষক দিয়ে মাদরাসার কিতাব বিভাগ এবং হিফয বিভাগের ক্লাস পরিচালিত হ’ত। ছেলেরা মাটিতে চট বিছিয়ে বসত এবং চাটাইয়ে বসিয়ে ক্লাস হত। তখন মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন আব্দুছ ছামাদ সালাফী ছাহেব। 

তাওহীদের ডাক : আপনার জীবনের বিশেষ কোন স্মরণীয় ঘটনা থাকে জানতে চাই?

হাফেয লূৎফর রহমান : এমন ঘটনা অনেক আছে। যেমন :

১. জামা‘আতে আওয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় এবং কুরআন সুমধুর কন্ঠে তেলাওয়াতের প্রতি আমার ছোট বেলা থেকেই খুবই অনুরাগ ছিল। পাকিস্তানে থাকাবস্থায় আমাদের মাদরাসা থেকে আহলেহাদীছ মসজিদ আধা কিলোমিটার দূরে হওয়ায় জামা‘আতে ছালাত বিঘ্ন ঘটত। ফলে জামা‘আতে ছালাত আদায়ের জন্য মাদরাসা নিকটস্থ হানাফী দেওবন্দী ভাইদের মসজিদে ছালাত আদায় করতে যেতাম। ইমাম ছাহেব একদিন আমাদের বিষয়ে টের পেল যে, আহলেহাদীছ কিছু ছাত্র আমাদের মসজিদে এসে জামা‘আতে ছালাত আদায় করে। তিনি একদিন কৌতূহলী হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের পাশেই মসজিদ থাকতে এখানে আস কেন? আমি বললাম, প্রথমতঃ তারা হানাফী-ব্রেলভী ও কবর পূজারী। তাই তাদেরকে আমরা পসন্দ করি না। তার চেয়েও সত্য কথা হ’ল আপনার কুরআন তেলাওয়াত আমাদের খুব ভাল লাগে। পরবর্তীতে ইমাম ছাহেবের সাথে আমাদের বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তিনি আমাদের সেখানে বার বার যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।

২. আমি যখন বগুড়ায় জমঈয়তের মাদরাসায় কঠিন দিন পার করছিলাম, হঠাৎ একদিন মাওলানা আব্দুল মান্নান হাটহাজারী সালাফী আমাদের মাদরাসায় উপস্থিত হলেন। তিনি সেখানে মসজিদের ইমাম নাদভী ছাহেবকে খুঁজলেন। তিনি বললেন, নাদভী নাকি সম্মিলিত দো‘আ সম্বন্ধে চৌদ্দটা হাদীছ সম্বলিত একটি বই লিখেছেন। সে বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে। নাদভী ছাহেব তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই কেমন আছেন? আলহামদুলিল্লাহ, তো আপনি কেমন আছেন। তারপর ফারসী এক ভাষা বললেন, খাকসার বান্দা যাই হোক আপনি মোনাজাতের বই লিখেছেন, বইটা একটু দেখি। তিনি নাদভী ছাহেবকে প্রশ্ন করলেন, এই বই কি আপনার নিজের লেখা? নাদভী বললেন, হ্যাঁ। তো আপনি বইটা যে লিখেছেন, বইটা কি একবারও আপনি নিজে পড়েছেন? তিনি বললেন, কেন ভাই, কি হয়েছে? হাটহাজারী বললেন, এই বইয়ে যা লিখেছেন তাতে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কথা নাই। এমনকি এর মধ্যে সব মনগড়া কথা লিখে রেখেছেন। হাটহাজারী ছাহেব তাকে তার বইয়ের হাদীছগুলো পড়ে অনুবাদ করতে বললেন। নাদভী ছাহেব তাকে বললেন, আপনারা বড় আলেম ভাই। আমরা খাকসার মানুষ। তখন উনি বললেন, আপনি বড় আলেম হতে পারেননি তাহলে বই লিখতে গেলেন কেন? আপনি শয়তানী দায়িত্ব নিয়েছেন মানুষ বিভ্রান্ত করার জন্য। শয়তান কি আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে? আপনি অতি সত্ত্বর বইটি পুড়িয়ে ফেলুন এবং এক্ষুনি তওবা করুন। নইলে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে পারবেন না। তারপর হাটহাজারী ছাহেব তার বিদ্যাকে চুরফুতি বিদ্যা বলে কঠিনভাবে শাসালেন এবং লাথি দিয়ে পানিতে ফেলার ভয় দেখালেন। এভাবেই সেদিন আমি নিজ চোখে সত্যের বিজয় দেখেছি।

৩. মারকাযে আসার পরে প্রশাসনিক দিকটা আমরা দুই হাফেয দেখাশুনা করছিলাম। ১৯৯৬ সালে পশ্চিম পার্শ্বের বিল্ডিং হয়। তখন কিছু স্থানীয় দুষ্টু ছেলেদের সাথে মাদরাসা ছাত্রদের পানি ফেলা নিয়ে ঝামেলা বেঁধে যায়। স্থানীয় লোকজন এসে ছাত্রদের মারধর করতে লাগল। আমি পূর্বপাশে ছিলাম, শিক্ষকরা কেউ নাই। আমি দৌড়ে গিয়ে ছাত্রদের ঠেকিয়ে দিলাম। সেদিন আমি সময়মত উপস্থিত না হলে হয়ত স্থানীয় দুষ্টু ছেলেরা উত্তেজিত ছাত্রদের হাতে চরম মার খেত। কিন্তু আল্লাহ আমাদেরকে ও মাদরাসাকে বড় ধরণের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। কারোর তেমন কোন ক্ষতি হ’ল না। তবে আমাদের পক্ষের কয়েকজন আহত হয়েছিল।

৪.  ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আতকে তদানিন্তনকালের জোট সরকার অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে যায়। সব বন্ধ হয়ে গেল। বেতন বন্ধ হ’ল অনেক দিন। আমরা খুব কষ্ট করে থাকি। আমাদের বেতন দেওয়ার কেউ নেই। এক পর্যায়ে মাওলানা বদীউযয্মানের পরামর্শক্রমে কিছু রশিদ বই দিয়ে আদায় শুরু করি। এইভাবে বছরখানিক চলল। তখন আমাকে চাকুরীর জন্য বগুড়া ও রংপুর থেকে ডাকছিল। কিন্তু আমি যাইনি। সংগঠন ও আমীরে জামা‘আতের প্রতি ভালোবাসা আমাকে যেতে দেয় নি। অবশেষে সাংসরিক বাস্তবতার কাছে আমি হেরে গেলাম। আমার বাহিরে যাওয়ার কথা ঠিক হয়ে গেল। আমীরে জামা‘আতের বড় ছেলে ছাকিবের সাথে পরামর্শ করলাম। ছাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাহলে আমার ছোট ভাই আর হাফেয হ’তে পারবে না। আববার বড় ইচ্ছা ছিল ছোট ভাইটা হাফেয হোক। এ কথা শুনে মনটা খারাপ হ’ল। মনে মনে ভাবলাম, রুযীর মালিক আল্লাহ। আল্লাহই সব দেখবেন। এই মনোবল নিয়ে সব দুঃখ-কষ্ট বুক পেতে নিলাম এবং মাদরাসা ছেড়ে সবাই চলে গেলেও আমি আর মাদরাসা ছেড়ে যাব না বলে মনস্থির করলাম। একদিন অন্ধকারের ঘোর কেটে গেল। আলহামদুলিল্লাহ আমীরে জামা‘আত মুক্তি পেলেন। আর এভাবেই মারকাযের থাকার সিদ্ধান্তটা আমার জীবনে স্বার্থকতা নিয়ে আসল।

তাওহীদের ডাক : দীর্ঘজীবন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে একজন ভাল শিক্ষকের কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন? 

হাফেয লূৎফর রহমান : একজন আদর্শবান শিক্ষকের করণীয় হবে, অবশ্যই সে একজন ছাত্রকে ছাত্র না ভেবে নিজের সন্তান ও বন্ধু হিসাবে পাঠদান করাবেন। ছাত্রকে নিজের ছেলের মত করেই পড়াশুনা করাতে হবে এবং তার দিকে নজর রাখতে হবে। কারণ ছাত্রদের পিতামাতা দূরে থাকে। এমতাবস্থায় যদি শিক্ষকরা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন না করেন, তবে ছাত্ররা জীবনে কখনো উন্নতি করতে পারবেন না। বরং তারা জীবনে চরম অবনতির স্বীকার হবে যা কখনো একজন আদর্শবান শিক্ষকের কাম্য নয়। জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকরা শুধুমাত্র একজন শিক্ষকই নয় বরং ছাত্রের পরম বন্ধু ও অভিভাবক।

তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পত্রিকার পাঠকদের জন্য আপনার কোন বক্তব্য?

হাফেয লূৎফর রহমান : সুপ্রিয় পাঠক ভাইয়েরা! আপনারা ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর একমাত্র মুখপত্র তাওহীদের ডাক পত্রিকা বেশী বেশী করে পড়ুন এবং অপরকে পড়তে উৎসাহিত করুন। দাওয়াতী কাজ বেশী বেশী করুন। মানুষের দ্বারে দ্বারে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিন।

তাওহীদের ডাক : আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। মহান আল্লাহ আপনাকে শিফায়ে কুল্লিয়া দান করুন।

হাফেয লূৎফর রহমান : আমীন! তোমাদেরকেও আল্লাহ সার্বিক সফলতা দান করুন-আমীন।



আরও