মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 607 বার পঠিত

[দেশের একজন কৃতি সন্তান তদানীন্তন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর অন্যতম কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা জনাব মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান (৮৬)। তাঁর সংগ্রামী জীবনেতিহাস নিয়ে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাকের নির্বাহী সম্পাদক মুখতারুল ইসলাম]

তাওহীদের ডাক : আপনি এখন কেমন বোধ করছেন?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। আমীরে জামা‘আত কেমন আছেন?

তাওহীদের ডাক : আলহামদুলিল্লাহ, আমীরে জামা‘আত ভালো আছেন। প্রথমেই আপনার জন্ম সাল ও জন্মস্থানের ব্যাপারে জানতে চাই।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আমার জন্ম সেই ব্রিটিশ বাংলায়। আমার সার্টিফিকেটে ১৯৪০ জন্মসাল হিসাবে দেওয়া আছে। আমার জন্ম মূলতঃ ১৯৩৬ সালের ১০ই ডিসেম্বর। গ্রামের বাড়ি গোবিন্দগঞ্জের ফুলবাড়িতে, যা আমার বর্তমান বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-রংপুর রোডের উপরে কাটাখালী ব্রীজ সংলগ্ন। প্রাচীন ফুলবাড়ি গ্রামটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসরতা। যে সময় গ্রামে সাধারণত নাম স্বাক্ষর করা লোক ছিল খুবই বিরল। অথচ তদানীন্তনকালে আমাদের গ্রামে শিক্ষিত লোক ছিল অনেক। তার বড় সাক্ষী হ’ল দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর একটি ছিল প্রাইমারী স্তরের মাদরাসা এবং আরেকটি হাইস্কুল। পড়াশোনার আকালের যুগে এটা সত্যই খুবই অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিল। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হ’ল আমার গ্রামে অন্য ধর্ম তো দূরের কথা, কোনদিন অন্য মাযহাবের লোকেরও বসবাস ছিল না। পুরোটাই ছিল আহলেহাদীছের বসবাস। আমার আববা বলতেন, তাঁর দাদার পূর্বপুরুষেরাও আহলেহাদীছ ছিলেন। বর্তমানে ফুলবাড়ি গ্রামে দুইটা আহলেহাদীছ মসজিদ আছে। তন্মধ্যে একটা মসজিদ আমীরে জামা‘আতের করা। আর আরেকটা দেড়শত বছরের পুরাতন ব্রিটিশ আমলের মসজিদ।

তাওহীদের ডাক : আপনার পিতার পেশা বা জীবনবৃত্তান্ত যদি কিছু আমাদের শুনাতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আমার আববা তাঁর সামান্য কৃষি জমি ছিল, যাতে তিনি আবাদ করতেন। পিতার পরিবার ছিল বড়। তাঁরা ছিলেন ছয়-ভাইবোন। আববা ছিলেন সবার বড়। ১৯১৭ সালে আববা যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী, তখন দাদা মারা যান। ফলে তাঁর পক্ষে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ১৯১৮ সালে পরীক্ষা দিয়েছিলেন; কিন্তু কৃতকার্য হননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আববাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম। পাকিস্তানী আর্মি একদিন আমাকে ধরার জন্য বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করে এবং আববাকে বলে, ‘আপকা ব্যাটা কো হামারে পাস ভেজ দো’। আমি তখন পাবনায় ছিলাম। তাই আমাকে না পাওয়ায় তারা আববাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৭ই মে বগুড়ায় ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে আরো অনেকের সাথে তারা আববাকেও হত্যা করে। শুধু তাই নয়, আববার সাথে আমার এক ভাতিজাকেও হত্যা করা হয়। ছেলেটা খুবই মেধাবী ছিল। হাইস্কুল থেকে সেই সময় ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল এবং একটি চাকুরীও পেয়েছিল। তাদের লাশগুলো পর্যন্ত আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। কোথায় তাদের লাশ ফেলা হয়েছিল, তাও কোনদিন জানতে পারিনি। আমার সারা জীবনের দুঃখ পিতা ও ভাতিজার এই মর্মান্তিক মৃত্যু।

তাওহীদের ডাক : আপনার আম্মা, ভাই-বোন?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আমরা ২ ভাই ২ বোন। আমার মা মোছাম্মাৎ ছাবেরুন্নেছা। আমার নানার নাম ছিল মুহাম্মাদ আছমতুল্লাহ মুনশী। আমার ছয় বছর বয়সে আমার নানা মারা যান। আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আমার বড় ভাই আজমাল হোসাইন আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলিকাতা বোর্ডে থার্ড স্ট্যান্ড করেছিল। কিন্তু রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার তিন/চার দিন আগে সার্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৮ সালে মারা যায়। প্রথম সন্তান মারা যাওয়ার ফলে আমার বাবা ও মা খুবই কষ্ট পান। এমনকি আমার প্রাণপ্রিয় জননী পুত্র হারানোর বেদনা সহ্য করতে না পেরে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুস্থ হ’তে পারেননি। আমার বোন বড় ভাইয়ের পাঁচ বছরের ছোট আর আমি আমার বড় ভাইয়ের এগারো বছরের ছোট ছিলাম।

তাওহীদের ডাক : আপনার পড়াশোনা ও ছাত্রজীবন সম্পর্কে যদি কিছু আমাদের জানাতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : ফুলবাড়ি ইউনিয়ন নাছির উদ্দীন জুনিয়র মাদরাসায় আমার ছাত্রজীবন শুরু। আমি নির্দিষ্ট বয়সের বেশ পরে নয় বছর বয়সে ভর্তি হই। কেননা আমার বয়স যখন ছয়, তখন থেকে নয় বছর পর্যন্ত আমি কালা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলাম। ফলে তিন বছর সময় নষ্ট হয়ে গেছে। মাদরাসায় আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করি। পরে আমি ১৯৫২ সালে গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। আমার ছাত্রজীবন খুব ভালো কেটেছে। ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হতাম। জীবনে কখনো সেকেন্ড হয়েছি বলে মনে পড়ে না। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেই। এরপরে জুলাই মাসে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হই। তদানীন্তনকালে রংপুরে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না। বাড়িতে বের হয়ে রংপুর পৌঁছতে তিনদিন সময় লেগে যেত। তারপর কারমাইকেল থেকে আমি এইচএসসি পাশ করি ১৯৫৮ সালে। এইচএসসি পাশ করার পর আমার লেখাপড়া সেখানেই শেষ হয়ে যায়।

তাওহীদের ডাক : পড়াশোনায় ইতি টেনে কি আপনি কর্মজীবনে পা রেখেছিলেন?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : হ্যাঁ, ইন্টার পাশ করে আমাকে বসে থাকতে হয়নি। তবে আমার জীবনটা বেশ বৈচিত্র্যময়।  দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে আমি বেশ অনেকগুলো চাকুরী করেছি।

ইন্টার পাশ করার পরপরই যোগ দেই পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে। একবার সেখানে আমার পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসারের সাথে বাদানুবাদ হ’ল। কোন কারণ ছাড়াই সে আমাকে ভীষণ গালাগালি করল। সে আমাকে বাঙ্গালী হিসাবে ঘৃণাভরে বিশ্রী গালি দিয়ে বলে ফেলল, ‘বাইঞ্চোদ! তুঝে উর্দূ কিউ নেহি আতী?’ এই কথাতে আমি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি। দিনটা ছিল শুক্রবার সকাল। আমি তাকে বললাম, ‘সামভালকে বাত কিয়ে, তু জানতে হ্যায় ম্যায় কোন হুঁ? তু এক হাবিলদার হ্যায় আওর ম্যাঁয় এক পাইলট হুঁ!

উর্ধ্বতন অফিসারের মুখের উপরে এই কথা বলার পর সে আমার বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিল। এতটুকু অপরাধেই কোর্ট মার্শালে সামরিক শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে আমার বিচারের রায় হ’ল মৃত্যুদন্ড। তখন আইয়ুব খানের আমল। দেশে ‘মার্শাল ল’ চলছে। রাষ্ট্রপতির প্রধান আইন প্রশাসক এমএজি ওসমানী সাহেব (পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক) তখন ওখানে ছিলেন। এছাড়াও সহযোগিতা করেছিল আমার এক বন্ধু যিয়াউল হক। একই সঙ্গে আমরা দু’জনই চাকুরীতে যোগদান করেছিলাম। ট্রেনিং-য়ে আমরা ছয়জন জিডি পাইলট হওয়ায় পূর্ব পাকিস্থানের স্পেশাল ব্যাচে চান্স পেয়েছিলাম। বন্ধু যিয়াউল হকের বাড়ি হ’ল বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানায়। সে ১৯৭০ সালে পাবনায় মারা যায়। ওর পিতা ছিলেন জসীমুদ্দীন ছাহেব, তিনি তাঁর ছেলে মারা যাওয়ার পর আমাকে নিজের ছেলে মনে করতেন। যাইহোক আমার যখন প্রাণদন্ডের আদেশ হয়, তখন ওসমানী ছাহেবের প্রচেষ্টায় এক দরখাস্ত লিখে আমাকে সই করতে বলা হয়, যেখানে লেখা ছিল যে, আমি আপনার কাছে প্রাণভিক্ষা চাচ্ছি। এটা দেখে আমি তাদের বলেছিলাম, নাহ! প্রাণভিক্ষা কোন মানুষের নিকট চাওয়া যায় না; শুধু চাওয়া যায় আল্লাহর কাছে। ছোটকাল থেকেই আমি একটু ঘাড় ত্যাড়া স্বভাবের ছিলাম। সত্য জিনিসকে আমি সবসময় সত্যই মনে করতাম। তাতে প্রাণ যায় যাক। শুধু তাই নয়, আমি এমন ছিলাম যে, সহজে কারও অসত্য মতামত গ্রহণ করতাম না। ওসমানী ছাহেব আমার এ আচরণে একটু রেগে গিয়েছিলেন। আসলে বাঙ্গালী ভাই হিসাবে এটা ছিল তাঁর একান্ত অনুকম্পা। আমি তাঁকে বললাম, দেখেন আমার নছীবে যদি মৃত্যু থাকে, তাহ’লে আপনি তা কোনদিনই ঠেকাতে পারবেন না। আমি আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

তিনি বললেন, তুমি যদি প্রাণভিক্ষা চাইতে না পারো, তাহ’লে তুমি নিজেই লেখ কি লিখবে? তখন আমি আমার বন্ধু যিয়াউল হকের সহযোগিতায় লিখলাম যে, আমি ছোট অপরাধ করেছি। কিন্তু অন্যায়ভাবে আমাকে গুরুদন্ড দেওয়া হচ্ছে। আমি আমার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। আমাকে মুক্তি দেওয়া হোক। পিতাকে না জানিয়ে আমি এয়ার ফোর্সে এসেছি। আমি অন্যায় করেছি। মনে হয় সেটাই আমার পাপ। সেই পাপে আমার শাস্তি হচ্ছে। তাছাড়া আমি আমার ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলেছি। আমি বড় কোন অপরাধ করিনি। উনি আমাকে বলেছেন, উর্দূ জানো না কেন? বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমাকে উর্দূ জানতে হবে কেন? শুধু তা-ই নয়, তাকে আমি বলেছিলাম পাকিস্তানের ৫৬% মানুষের ভাষা বাংলা আর বাকীরা হ’ল উর্দূভাষী। তার মধ্যে আমি নতুন। তার কথাই ভালো করে বুঝতে পারিনি’। এই চিঠি লেখার পর আমার প্রাণদন্ডের আদেশ স্থগিত করেন মান্যবর আইয়ুব খান। আমার মনে আছে, সেদিন সোমবার সকাল ১১-টায় আমার বন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর উদ্দেশ্যটা ভালো, তোকে ক্ষমা করা হয়েছে।

এই ঘটনার পর আমি দেশে ফিরে আসি। কিন্তু পাকিস্তান সরকার একটা শর্ত জুড়ে দেয় যে, সেনাবাহিনীতে আমি আর কখনো চাকুরী করতে পারব না। তারপর দেখি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন ৬২টি থানায় এডিশনাল এসপি পদে পুলিশে লোক নিচ্ছে। ফলে সেখানে দরখাস্ত করি। সেখানে এক বছর ছয় মাস ট্রেনিং করার পর আমার চাকরী হ’ল। কিন্তু আমার চাকুরী তিন মাস পূর্ণ হ’তে না হ’তেই একটা ধর্ষণের মামলা আমার হাতে এসে পড়ল। সেই কেসে একজন পুলিশ অফিসারও জড়িত ছিল। আমি সেই ভিকটিম মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারিনি। কিন্তু আমি মেয়ের বাবাকে কথা দিয়েছিলাম যে, যেভাবে হোক আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমার মেয়েকে উদ্ধার করবো। তিনদিন পর মেয়েটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল উল্লাপাড়া রেলস্টেশনের ধারে। তখন আমি মনের ক্ষোভে পুলিশের চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি চলে আসি। সময়টা ১৯৫৮-১৯৬০-এর মধ্যে হবে। তো সেখান থেকে চলে এসে বাড়ি বসে আছি। বন্ধু-বান্ধবরা সবাই বলল, তুই একটা আহাম্মক। এত বড় চাকরী তুই ছেড়ে দিলি। তুই পরবর্তীতে আইজি বা ডিআইজি হতিস। আমার পিতাকে আমি ‘বাজান’ বলে ডাকতাম। বাজান বলল, তুমি ভালো কাজ করেছো। লেখাপড়া শিখে পুলিশ হবে তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। যেই আল্লাহ মুখ দিয়েছেন, সেই আল্লাহ খাবার দিবেন।

তারপর দেখলাম সমবায় বিভাগে লোক নিচ্ছে থানার সহকারী অফিসার পদে। দরখাস্ত করলাম। বেতন খুব কম, মাত্র ১১০ টাকা। ১৯৬০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণের জন্য ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ কলেজে ভর্তি হ’লাম ঢাকার ধানমন্ডিতে গ্রীণ রোডে। এই কলেজে আমিই প্রথম পা রাখি। ১২০ জন ছাত্রের মধ্যে আমি প্রথম ছাত্র আমাদের ব্যাচে। আমাকে দিয়ে ক্লাস উদ্বোধন করা হয়। তখন গভর্ণর ছিলেন আযম খান (১৯৬০-৬২)।

সেখানে এক বছর ট্রেনিং-য়ে ৬ মাসের থিয়োরেটিক্যাল ও ৬ মাসের প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে ১৯৬১ সালের ১৫ই আগস্ট নিয়োগ পেয়ে ১৬ই আগস্টে রংপুর যেলায় যোগদান করলাম। সেখান থেকে আমাকে পোস্টিং দেওয়া হ’ল ডিমলায়। চাকুরীর সুবাদে প্রথম ডিমলার সাথে আমি পরিচিত হলাম। অথচ ইতিপূর্বে এর নামও কোনদিন শুনিনি। তখনকার বৃহত্তর রংপুর যেলার সর্বশেষ বর্ডার থানা হ’ল ডিমলা। আর ডিমলায় সেসময় কুষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। ভয়ে লোক সেখানে যেত না। আমি বরাবরই অ্যাডভেঞ্চারাস স্বভাবের লোক ছিলাম। আমার ডিস্ট্রিক্ট অফিসার সেখানে ছিলেন এম মুযাক্কির ছাহেব। সিলেটের মানুষ। আমাকে বললেন, ডিমলায় তোমাকে পোস্টিং দিল আর তুমি চলে এলে? বললাম, কি করবো স্যার পোস্টিং দিয়েছে। আল্লাহর উপর ভরসা করে চলে এসেছি। আমি ডিমলা থেকে বদলী হয়ে জলঢাকা থেকে আবার বদলি হয়ে গোবিন্দগঞ্জ চলে আসি। তারপর আমাকে আবার পোস্টিং দেওয়া হল ডোমারে। ১৯৬৫ সালের ৩১শে মার্চ আমি ডোমারেই বিয়ে করি।

১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে আমার প্রমোশন হ’ল মিনিট কোটায়। ২৪৬ জনকে ডিঙ্গিয়ে আমাকে প্রমোশন দেওয়া হ’ল বগুড়া সদরে। আমাকে মহকুমা অফিসার পর্যায়ের সম্মান দেওয়া হ’ল। এখানে আমি ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত থাকি। এরপর আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয় পাবনায়। পাবনায় গুরুদায়িত্ব ছিল গ্রামীণ ঋণ প্রদান করা। আমার ৩২টা দায়িত্বের মধ্যে প্রথম দায়িত্ব ছিল সময়মত অনাদায়ী ঋণ আদায় করা। আমি কৃতিত্বের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমার বস পালিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। ফলে সব দায়-দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ল।

তাওহীদের ডাক : আপনি এদেশের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের শুরুটা কেমন ছিল?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : পাবনায় আমার অফিস প্রধান ছিলেন নূরুল হক ছাহেব নোয়াখালীর লোক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হ’লে তিনি পালিয়েছিলেন। অবশেষে ডিসি নূরুল কাদের খান (কুমিল্লা)-কে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়লাম। তিনি তার নামের শেষে ‘খান’ কথাটা বাদ দিলেন। কেননা পাকিস্তানীদের নামের শেষে ‘খান’ ব্যবহার হতো। এভাবে আমরা পাবনা, নগরবাড়ী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করেছি। অবশেষে দেশ স্বাধীন হ’ল।

তাওহীদের ডাক : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বিশেষ কোন স্মৃতি যদি আমাদের শোনাতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেকের মধ্যে আমি যে কাপুরুষতা দেখেছি, তা খুবই লজ্জার। বিশেষ করে আমার যেলা অফিসার শাহ আখতারুযযামান ছাহেবের কথা বলতে হয়। তাঁর বাড়ি জামালপুর। উনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার ভাবগতিক দেখে পালিয়েছিলেন। যাইহোক যুদ্ধ শুরু হ’ল। প্রথমেই আমরা পাবনায় যুদ্ধ করি এবং সফল হই। বিশেষতঃ নগরবাড়ীর যুদ্ধের কথা আমার মনে পড়ে। একবার রাত আড়াইটায় একজন মেজরের অধীনে ১৫০ জন পাকিস্তান আর্মি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের দলে একজন কুখ্যাত ডাকাত টিপু বিশ্বাস ছিল। প্রথমে তাকে কেউ আমাদের সাথে নিতে চাচ্ছিল না। আমি সবার মাঝে সমন্বয় করে তাকে মুক্তিযুদ্ধে শরীক করি। আমি সকলকে বুঝালাম যে, এখন বাঙ্গালী সকলে ভাই ভাই। ভালো মানুষ আর চোর-ডাকাতের ভেদাভেদ আমরা করব না। পাক আর্মিদের অতর্কিত আক্রমণে সবাই আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। অবশেষে সেই কুখ্যাত টিপু বিশ্বাসই সেদিন তার নিজের তৈরী হাত বোমা দিয়ে পাকিস্তানী আর্মিকে কুপোকাত করেছিল। পরে তার সাহসী পদক্ষেপেই আমরা সেদিনের যুদ্ধে জয় পেয়েছিলাম। সেই যুদ্ধের স্মৃতি হিসাবে আমার মাথায় আঘাতের চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি।

তাওহীদের ডাক : দেশে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে আপনার চাকুরী ছিল, নাকি অন্য কোন পেশায় জড়িয়ে পড়েছিলেন?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : মুক্তিযুদ্ধের পর আমি চাকুরী থেকে রিটায়ার করেছিলাম। খুলনার প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা আইয়ূব আলী আমাকে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে ডেকে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন উনার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল। আমি সেখানে মুক্তিযুদ্ধের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কাজ শুরু করি।

তাওহীদের ডাক : মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখেছেন? যে প্রত্যাশা নিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন, তার প্রাপ্তি কতটুকু?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ বিষয়ে কি আর বলব! বড় দুঃখ হয়। যাইহোক দু’টি ঘটনা বলি-

১. মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। উনি আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমি তাকে বললাম, আপনারা কি ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য নিচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের স্বাধীনতার দরকার আছে। আমাদেরকে বিশ্ব দেখবে। আমি বললাম, আপনার মত পাগল আর কেউ নেই। আপনি সাহায্য নিন। কিন্তু ইন্ডিয়ার সাহায্য নেবেন কেন? একবার আমরা পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে দেখেছি। ইন্ডিয়া আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তিনদিকে ইন্ডিয়া আর একপাশে বঙ্গোপসাগর। ইন্ডিয়া আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের মত গাদ্দারী করলে সাগরে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আমাদের থাকবে না। আর সাহায্য যদি নিতে হয় তাহ’লে রাশিয়ার কাছ থেকে অথবা চীনের কাছ থেকে নিন। আমি বলছি এ জন্য যে, আমাদের গ্রামে একটা কথা আছে, ‘গরীবের সুন্দরী বউ সবার ভাবী’। সুতরাং ইন্ডিয়া এখন বন্ধুত্ব দেখাবে, সাহায্য করবে বটে; কিন্তু ভবিষ্যতে তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। আজও ইন্ডিয়ার সাহায্য নেয়ার মাশূল আমাদের দিতে হচ্ছে তাদের গোলামী করে।

২. বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, অন্ধকার ঘরে সাপ, মানে সারা ঘরেই সাপ। এই কথাটি আমি নিজেই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম।

১৯৭৩ সালের ২৪শে আগস্ট সকাল ৯টায় আমরা এ্যারোফ্লোটের একটি ফ্লাইটে রাশিয়ার মস্কোতে যাচ্ছিলাম। তার পূর্বে ২৩শে আগস্ট আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা ও দো‘আ নিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর প্রস্ত্ততি চলছে। আমার কাছে বিষয়টা যেন কেমন ঠেকল। কারণ আমার মনে হ’ল প্রথমে রাজাকারদের তালিকা হওয়া দরকার। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অনুমতি চেয়ে বললাম, আমি কি আপনাকে সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করতে পারি? তিনি বললেন, তুমি সৎসাহস নিয়ে যা ইচ্ছা আমাকে বল। আমি বললাম, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরী না করে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের তালিকা তৈরী করা উচিত। তিনি বললেন, কেন? মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই অসহায় অবস্থায় আছে, তালিকা না হলে কিভাবে তাদের সাহায্য করব? আমি বললাম, ওটা তো খুব সহজ। আমাদের সমাজকল্যাণ ও সমবায় বিভাগ এটা করবে। তাকে আমি উপরের প্রবাদটা শুনালাম এবং বললাম তা না হলে অনেক রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নাম লিখাবে’। তিনি আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন। আমার মনে হয় উনি জীবিত থাকলে আমার কথার বাস্তবতা দেখে যেতে পারতেন। কেননা আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে সত্যিকারের সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ হাযার বা সাড়ে পাঁচ হাযারের বেশী নয়। কিন্তু এখন প্রায় দুই-আড়াই লাখ সনদ দেওয়া হয়েছে। আরও তিন চার লাখ ওয়েটিং লিষ্টে আছে। সব ভুয়া, সব ভুয়া। ফলে এখন মুক্তিযোদ্ধা নয়, সার্টিফিকেট বাহিনী দেশে গড়ে উঠেছে।

তাওহীদের ডাক : আপনি কি মুক্তিযুদ্ধের কোন সার্টিফিকেট নিয়েছেন?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : না, আমি নেইনি। কারণ সার্টিফিকেটের জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কম্যান্ড কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারী ১৯৯৭ সালে আমার যেলায় এসেছিল এবং আমাকে দরখাস্ত করতে বলেছিল। সে সবার সামনে বলে গিয়েছিল, গাইবান্ধায় কেউ খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা থাকলে নাকি আমিই এক নম্বর। পরে আর কোন খবর নাই। আমি মনে করি আমি মুসলমান। আমার মুসলমানিত্বের জন্য কোন সার্টিফিকেটের দরকার আছে? নিশ্চয়ই নাই। অতএব এগুলোতে আমার কোন যায় আসে না।

আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। এতসব সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে প্রখ্যাত কাদের বাহিনী, আমার কমান্ডার অফিসার, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী স্যার, আইয়ূব আলী খান বাঙ্গালী, নূরুল কাদের খান স্যারেরা পর্যন্ত সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারেননি।

তাওহীদের ডাক : পেশাগত কাজে আপনি রাশিয়া, জামার্নিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। এসব সফরের ব্যাপারে যদি আমাদের কিছু বলতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : সরকারী কাজে আমি পাঁচটি মহাদেশের ২৩-২৪ টা দেশ ঘুরেছি। সর্বপ্রথম আমি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সরাসরি সিলেকশনে ইকনোমিক ম্যানেজমেন্ট এন্ড কো-অপারেটিভে বিশেষ কোর্স করার জন্য রাশিয়ার মস্কোতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে পাঁচজনকে তিনি পড়াশোনার জন্য ডিপ্লোমা কোর্সে পাঠিয়েছিলেন। এর পিছনে একটা ইতিহাস আছে যা না বললেই নয়। তৎকালীন সময়ে রংপুর পীরগঞ্জের মতীউর রহমান সরকার পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। উনি আমাকে বললেন, তুমি একজন ভালো মুক্তিযোদ্ধা। তুমি বিদেশ যাও। আমি বললাম, সেটা কিভাবে? তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু বেশকিছু যোগ্য লোককে রাশিয়া পাঠাচ্ছেন উচ্চতর ডিপ্লোমার জন্য। এভাবে আমি রাশিয়াতে গিয়েছিলাম। আর জামার্নিসহ আরো অন্যান্য দেশে সরকারী কাজে যাওয়া হয়েছিল।

তাওহীদের ডাক : বিভিন্ন দেশের কোন বিশেষ স্মৃতি আছে কি?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : স্মৃতি তো অনেক আছে। এখন অনেক কিছু ভুলে গেছি। ইদানিং সব ভুলে যাচ্ছি। রাশিয়াতে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বাড়ি দেখেছি। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় লাইব্রেরী দেখেছি। মহান আল্লাহ নগণ্য বান্দাকে দুনিয়াতে অনেক কিছু দেখার সুযোগ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় পাকিস্তানের পক্ষে মিঃ নিয়াযী এবং বাংলাদেশের পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা স্বাক্ষর করলেন। ব্যাপারটা আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : এ বিষয় বলার অনেক আছে। কিন্তু আমি ওসমানী ছাহেবের মুখ থেকে এ বিষয়ে কোন কথা শুনিনি। এগুলো রাজনৈতিক বিষয়। এগুলোর মূল ইতিহাস জানা বেশ দুরূহ। এ বিষয়ে আমি অনেক বক্তব্য শুনেছি, সবটার সাথে আমি একমত নই। তবে মনে করি, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ছাহেবের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়েছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনি বলেছিলেন, জীবনে ৪/৫ বার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে মহান আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি যদি একটু ব্যাখ্যা করে বলতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : প্রথমতঃ পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ফায়ার স্কোয়াড থেকে আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। দ্বিতীয়তঃ স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে মহান আল্লাহ মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তৃতীয়তঃ ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রবল বন্যায় আমি গ্রামের বাড়ি থেকে মটর সাইকেল যোগে ফিরছিলাম। বিশ্বরোডও পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় একটি বাস আমার হোন্ডাকে চাপা দিয়েছিল। গুরুতর আহত হয়েছিলাম। একটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে, নূরুল ইসলাম প্রধান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। কিন্তু অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসার পর মহান আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। আমি আবার সুস্থ জীবন লাভ করি। আলহামদুলিল্লাহ।

চতুর্থতঃ ২০১০ সালে ৪ঠা মার্চ চন্ডিপুর মসজিদ কমিটির অনুরোধে খুৎবা দেওয়ার দাওয়াত পাই। তারা বলল, আপনার খুৎবা আমাদের খুব ভালো লাগে। আমি সুন্নাত পড়ে বসে আছি। আমার বুকে হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা। আমার ছেলে বগুড়া জিএম হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, বাড়ি নিয়ে কবর দিয়ে দাও, উনি আর বেঁচে নেই। আমার ছেলে খুব জেদি টাইপের। সে আমাকে ঢাকায় হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে ভর্তি করায়। ২১শে এপ্রিল আমার জ্ঞান ফিরে। আমার এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর মেয়ে ডা. ফজিলাতুন নেসা অপারেশন করে। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার সময়  আমাকে প্রশ্ন করে, চাচা ভয় পাচ্ছেন? আমি তাকে বললাম, আম্মু আমি কেন ভয় পাব। বরং তোমারই বেশী ভয় পাওয়ার কথা। কেননা রুগী মারা গেলে তোমারই বেশী দুশ্চিন্তা, তাই নয় কি? তখন আমার প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছিল, ‘নূরুল ইসলাম ইজ এ লার্জ হার্টেড জেন্টলম্যান’। পরবর্তীতে আমি সুস্থ হয়ে উঠি, আলহামদুলিল্লাহ।

সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চ মাসে আমি তাহাজ্জুদ পড়তে উঠব। তখন আমার স্ট্রোক করে। আমি আর কিছু বলতে পারিনা। আল্লাহ আমাকে আবার হায়াত দারায করেছেন। ফলে তোমাদের সাথে কথা বলতে পারছি।

তাওহীদের ডাক : আপনি অতীতে কোন আহলেহাদীছ সংগঠনের সাথে পরিচিত ছিলেন কি?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছ সংগঠনের সাথে আমাদের পারিবারিক ও সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিল। আমি যখন পাবনায় ছিলাম ১৯৫৩ সালে, সেখানে আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শীর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। আমার বাবাও মাঝে-মধ্যে তাঁর কাছে যেতেন। কেননা তিনি আমার পিতার বন্ধু মানুষ ছিলেন, আর তিনি ছিলেন আমার শিক্ষকের মতো। আমি একবার হযরত আদম (আঃ)-কে দুনিয়াতে পাঠানোর কারণ সম্পর্কে কাফী ছাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বললেন, হযরত আদম (আঃ)-এর ভুলের কারণে মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যাখ্যার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি এর ব্যাখ্যা কি হবে বলে মনে কর। আমি বললাম, বেহেশতে হ্যাঁ-না শুধু একটাই। আর তা হ’ল গাছের নিকট না যাওয়া। মহান আল্লাহ যেহেতু তাঁকে বিপদসংকুল মাটির দুনিয়ায় পাঠাবেন, সেহেতু তাকে বেহেশতে কিছু শিক্ষা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন’। তিনি আমার মতকে সঠিক হিসাবে গ্রহণ করলেন।

আমি তাকে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলাম। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন কেন? তিনি বললেন, বাবা তুমি কি ইংরেজী জান? আমি বললাম, জী। তিনি বললেন, ইংরেজীতে ‘ইউ’ মানে তুমি। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে আপনি অর্থে ব্যবহার হয়। বিষয়টি আসলে এমনই।

তাওহীদের ডাক : ড. আব্দুল বারী স্যারের সাথে আপনার কোন পরিচয় ছিল?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : জ্বী, তাঁর সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল। সংগঠনের অভ্যন্তরে যখন গোলযোগ হয়, তখন আমি একবার তাঁকে এক সঙ্গে কাজ করার অনুরোধ করেছিলাম। আমি তাঁকে আরাফাত পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধপত্র লিখতে বলেছিলাম। তিনি বললেন, আপনার প্রস্তাব খুব ভালো। ঠিক আছে বাদ আছর আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব। তারপর দেখি আছর পর মন ভার করে তিনি আমার সামনে হাযির হলেন এবং বললেন, ভাই, এটা সম্ভব নয়। এখন তো উনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর কিছু বলার নেই। আল্লাহ উনাকে মাফ করুন।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের সাথে প্রথম কখন, কোথায় আপনার সাক্ষাৎ ঘটে?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ছাহেবকে আমি আগে থেকেই চিনতাম এবং তাঁর বক্তব্য ও লেখনী পড়তাম। তবে সরাসরি আমার পরিচয় হয় ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধার ফুলবাড়ি মাদ্রাসার মাহফিলে। সেই মাহফিলে আমি সভাপতি ছিলাম। এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া অনেক কথা। তবে চাকুরী ছেড়ে অবসরে যাওয়ার পর থেকে দিনে দিনে তাঁর প্রতি আমার মহববত দৃঢ় থেকে দৃঢ়তরই হয়েছে। এই মহববতের গভীরতা যে কত বেশী তা প্রকাশের সাধ্য আমরা নেই, কেবল তা অনুভবই করতে পারি। আমার সৌভাগ্য যে, আমীরে জামা‘আতের আববাকেও আমি দেখেছি এবং তাঁকে বহু পূর্ব থেকেই বড় আলেম হিসাবে জানতাম। আমার মনে আছে, আমার শিক্ষক মাওলানা নযরুল হোসেন এবং আমার আববা একবার আল্লামা কাফী ছাহেবের সাথে পাবনায় দেখা করতে গেলেন। সাথে আমিও ছিলাম। আমরা সেখানে কাফী ছাহেবের দফতরে আমীরে জামা‘আতের আববা মাওলানা আহমাদ আলীকে দেখেছিলাম। এটা আরো নিশ্চিত হলাম কয়েকদিন আগে তাঁর জীবনী পড়ে।

তাওহীদের ডাক : আপনি তো শিকড় সন্ধানী একজন বোদ্ধা পাঠক। আমীরে জামা‘আতের বক্তব্য ও লেখনী আপনার কেমন লাগে?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : খুবই ভালো লাগে। খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর লেখনী, তাঁর সম্পাদকীয়গুলো পড়ি। কোথাও কোন পরামর্শ দেওয়ার থাকলে আমি স্বল্পজ্ঞানে তাঁকে বলার চেষ্টা করি। আজকে সকালেও তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি জয়পুরহাট যেলা সম্মেলনে বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয়, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবে না কেন?’ কথাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমি মনে করি তাঁর এ যুক্তি খন্ডন করার কোন সুযোগ নেই। যদিও আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। আমি দেশে-বিদেশে অনেক বিতর্ক অনুষ্ঠানে যুক্তি দিয়ে বিজয়ী হয়ে©র্ছ। বির্তক প্রতিযোগিতায় আমি কোনদিন হারিনি। আমার মনে পড়ে একবার মস্কোতে থাকাকালীন সময়ে ‘আল্লাহর অস্তিত্ব আছে কি নেই’-এ বিষয়ে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে আমি বিজয়ী হয়েছিলাম।

তবে সবকিছুর চাইতে তাঁর ব্যক্তিত্ব আমার নিকট খুব প্রিয়। তাঁর মত মানুষ হয় না। আমি উনাকে ভালোবাসি নিজের চাইতে বেশী। কারণ নির্লোভ ব্যক্তি হিসাবে আমার এই ৮৬ বছরের জীবনে আমি এই একজনকেই পেয়েছি। আর তিনি যে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, মহান আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন!

তাওহীদের ডাক : গোবিন্দগঞ্জ ইসলামী কমপ্লে∙ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : গোবিন্দগঞ্জ খুব ক্রিটিক্যাল একটা জায়গা। ১৯৯৩ সালে আমীরে জামা‘আত এই কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিরোধীরা হামলা করে মসজিদের ক্ষতি সাধন করেছিল। বর্তমানে আমাদের স্বপ্ন এখানে একটা মসজিদ, মাদরাসা ও মার্কেট হবে, যা সংগঠনের দাওয়াত প্রচার-প্রসারে সহায়ক হবে। বিশেষ করে আমাদের যুবসংঘের কিছু ছেলের কর্মসংস্থানও হবে। আলহামদুলিল্লাহ আমীরে জামা‘আত এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। তিনি আমার অন্তিম স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের আশেপাশেই কিছু নামধারী আলেম আছে, যারা শুধু অর্থ ও দুনিয়ার পিছনে ঘুরে। তাদের নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না। যাইহোক আমি চাই এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, আমার এই স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রূপ নেবে ইনশাআল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : আপনার দীর্ঘ জীবনের পথ চলার অভিজ্ঞতা থেকে যুবসমাজের জন্য যদি কিছু নছীহত করতেন।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : সকলের প্রতি একটাই উপদেশ, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার। তাই যৌবন যার, ন্যায় ও সত্যের পথে লড়াই করার সময় তার।

তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পত্রিকার পাঠকদের জন্য কিছু বলুন। 

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : আমি ‘যুবসংঘ’ ও ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি। ‘যুবসংঘ’র এই চমৎকার মুখপত্রটিকে মহান আল্লাহ কবুল করুন।-আমীন!

তাওহীদের ডাক : আপনার নেক দো‘আ কামনা করি। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অনেক শুকরিয়া।

মোঃ নূরুল ইসলাম প্রধান : মহান আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুন। আমি কখনো হায়াত বৃদ্ধির দো‘আ চাই না। আমার দুঃখ-কষ্ট নিয়ে আমার জীবনের ৮৬ বছর কাটিয়েছি। আমি আর হায়াত চাই না। আমি যেন ঈমানের সাথে মরতে পারি, এই বার্তা আমীরে জামা‘আতসহ সকল শুভাকাঙ্খীর নিকট পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ রাখছি।



আরও