ইয়াকুব আলী মাস্টার (ঝিনাইদহ)

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 167 বার পঠিত

ইয়াকুব আলী মাস্টার (৮২) একজন একনিষ্ঠ সংগঠক ও প্রবীণ শিক্ষক। তিনি দীর্ঘদিন ঝিনাইদহ যেলা ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলনে’র বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ঝিনাইদহ যেলায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে বাড়ীতে অবস্থান করছেন। আল্লাহ তঁাকে সুস্থতা দান করুন। আমীন! তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন ঝিনাইদহ যেলা ‘যুবসংঘে’র সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে পত্রস্থ হ’ল- নির্বাহী সম্পাদক]

তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমার জন্ম ১৯৪২ সালে। আমরা আট ভাই-বোন। ১৯৬৭ সালের ১৩ই অক্টোবর আমি বিবাহ করি। ২০০৮ সালের ১৬ই এপ্রিল আমার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। তার জানাযায় ইমামতি করেন ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে সকলেই বিবাহিত।

তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষা জীবন ও লেখা পড়া কীভাবে শুরু হয়েছিল?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমার প্রথম পড়াশোনা সাগান্না প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পড়াশোনায় ফঁাকি দেওয়ার কারণে ঝিনাইদহ যেলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হ’তে হয়। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন চার বন্ধুর খপ্পরে পড়ে চট্টগ্রামে যাই। আড়াই মাস পর ফিরে আসলে, আববা বাড়িতে জায়গা দিলেন না। তখন আমার বড় বোনের বাড়ি থেকেই ১৯৬৫ সালে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাস করি। এই ছিল আমার শিক্ষাজীবন।

তাওহীদের ডাক : আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে বলুন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমি ১৯৬৭ সালে ২রা সেপ্টেম্বর উত্তর নারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ৬০ টাকা বেতনে চাকুরীতে যোগদান করি। দীর্ঘ ১২ বছর পর ১৯৭৬ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে আমার প্রমোশন হলে ঝিনাইদহ সদর থানার বামনআইল গ্রামে পোস্টিং হয়। প্রায় দেড় বছর পর মিউচুয়াল ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাড়ীর নিকটে নগরবাতান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসি। এরপর আমার জ্ঞানার্জনের প্রথম বিদ্যাপিঠ সাগান্না সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোস্টিং নেই। আর এখানেই আমার এক টানা ২২ বছর কেটেছে। অবশেষে দীর্ঘ ৩৭ বছর ৩ মাস পর ২০০৪ সালের ৫ই ডিসেম্বর আমার শিক্ষকতা জীবন শেষ হয়। এই

ছিল আমার কর্মজীবন।

তাওহীদের ডাক : আপনি কিভাবে আহলেহাদীছ হ’লেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমার বড় ভগ্নিপতি আহলেহাদীছ ও ভারতের লোক। দেশভাগের পর তারা হলিধানী গ্রামে আসেন। কিন্তু গ্রামে কোন জুম‘আ মসজিদ না থাকায় তারা জুম‘আর ছালাত পড়তে পাশের গ্রামে যান। সেখানে তারা ছালাতে জোরে আমীন বললে মসজিদের লোকেরা শাস্তি স্বরূপ তাদের দিয়ে মসজিদ ধুয়ে নেয়। আমি ১৯৬৫-৬৭ সালের মধ্যে বেশকিছু দিন তাদের বাড়ীতে থেকে পড়াশুনার সুবাদে তাদের সবকিছু ভালো লাগত। তাদের দলীল ভিত্তিক জীবনাচার আমাকে খুবই মুগ্ধ করত।

অতঃপর ১৯৮৮ সালে আমরা কয়েকজন আহলেহাদীছ হই। এক দিন আমাদের গ্রামের মসজিদে জামা‘আতে ছালাত পড়া অবস্থায় সেকেন্দার ভাই যখন ‘আমীন’ বলে তখন পাশ থেকে একজন ছালাতরত অবস্থায় ধমক দিয়ে বলে ওঠে, সেদিন একবার নিষেধ করেছি আজ আবার? এরপর আমাদের কয়েকজনকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। ফলে আমরা আলাদা মসজিদ তৈরীর সিদ্ধান্ত নেই। বর্তমানে যেখানে মসজিদ দেখছেন ওইখানে আমরা আখ পাতার ছাউনি ও পাটকাঠির বেড়া দিয়ে প্রথম ছোট্ট একটি মসজিদ স্থাপন করি।

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কোথায় ও কিভাবে?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় যশোর শহরের বকচর আহলেহাদীছ জামে মসজিদে ১৯৮৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর জমঈয়তের মিটিংয়ে। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জমঈয়তের সভাপতি ড. আব্দুল বারী। এছাড়াও সেক্রেটারী আব্দুর রহমান বি.এ.বি.টি, আবু তাহের বর্ধমানী ও আরো অনেকে। দূর্ভাগ্যক্রমে সেখানে ড. আব্দুল বারী ছাহেব আমীরে জামা‘আতের নামে অর্থ কেলেঙ্কারীর অভিযোগ আরোপ করেন। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত যশোরের জনৈক মুরববী ও ‘যুবসংঘে’র সদস্যরা তার কাছে অভিযোগের প্রমাণ চাইলে ড. বারী ছাহেব তা এড়িয়ে যান ও বৈঠক ভঙ্গ হয়ে যায়। পরে জানলাম, কুয়েতী দাতা সংস্থা কয়েক বছর আগে ‘যুবসংঘে’র নাম করে দাওয়াতী কাজে অনুদানস্বরূপ দু’টি হোন্ডা ও ৭৯,৩৭৬/- টাকা ড. বারী ছাহেবের নিকটে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি সেই টাকা আমীরে জামা‘আতের হাতে বুঝিয়ে দেননি। কিন্তু চেকের মুড়িতে ‘বুঝে পেলাম’ বলে আমীরে জামা‘আতের স্বাক্ষর নেন। পরবর্তীতে শুববানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে আমীরে জামাআতের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ চাপানো হয়। এর অংশ হিসাবে ঐ স্বাক্ষরিত মুড়িটিকেও একটি প্রমাণ হিসাবে তিনি দেশের বিভিন্ন যেলায় মসজিদ ভরা লোকদের সামনে সেটি দেখানো এবং হিসাব না দেয়ার অভিযোগ তুলতে থাকেন। যা কিনা অদ্যবধি অনেকের মুখে প্রচারিত হয়। অথচ তা ছিল নিরেট অসত্য রটনা।

দ্বিতীয় বার দেখা হয়েছিল রাজশাহীতে। ১৯৯১ সালের ঘটনা। একদিন হলিধানীতে ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি আবুবকরের সাথে দেখা হয়। আমি আবুবকরকে ডেকে বললাম, আমরা তো আহলেহাদীছ হওয়ার কারণে টিউবওয়েলের পানিও খেতে দিচ্ছে না। আমরা কী করব বল তো দেখি! আবুবকর আমাকে বলল, মামা! আপনি কি আগামীকাল রাজশাহী যেতে পারবেন? আমি বললাম, হ্যঁা; যেতে পারব। সে আমার হাতে একটা চিরকুট লিখে দিল। সেটা নিয়ে আমি পরের দিন শাহ মখদুম (বর্তমান মহানন্দা) ট্রেনে রাজশাহীতে গেলাম। আমার সফরসঙ্গী ছিল ষাটবাড়িয়ার রেযাউল্লাহ। তখন ছিল রামাযান মাস। আমরা ছিয়ামরত অবস্থায় আমীরে জামা‘আতের সাধুর মোড়ের বাসায় পেঁŠছে দেখি তিনি ইফতারের জন্য বসে আছেন। অতঃপর তিনি আমাদের সাথে নিয়ে ইফতার করলেন। রাতে আমীরে জামা‘আত আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করলেন রাণীবাজার মাদ্রাসা মার্কেটের ৩য় তলায় ‘যুবসংঘে’র অফিসে। সকালে আমীরে জামা‘আত অফিসে এসে আমাদেরকে ১টি টিউবওয়েল বাবদ ৩৫০০/- টাকা দিলেন, যা ছিল ঐ সময় সবচেয়ে মূল্যবান চায়না ফনিক্স সাইকেলের দাম। এছাড়া সংগঠনের কিছু বই দিলেন।

তাওহীদের ডাক : আপনি কখন ‘যুবসংঘে’র সাথে যুক্ত হলেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : এটা ছিল ১৯৯১ সালের ঘটনা। এস. এম. আব্দুল বাকী (বোধখানা, যশোর) নামে একজন ব্যক্তি তখন ‘যুবসংঘে’র দাঈ হিসাবে ঝিনাইদহ যেলা ‘যুবসংঘে’র প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করতেন। তিনি একদিন আমাদের মসজিদে এসে পশ্চিম লক্ষ্মীপুরে ‘যুবসংঘে’র মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার আহবান জানিয়ে গেলেন। আমি ও তৎকালীন ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি আবুবকরের ছোট ভাই আব্দুস সাত্তার দু’জনে সেখানে গেলাম। যেয়ে দেখি ‘যুবসংঘে’র কমিটি গঠন উপলক্ষ্যে সভাপতি মনোনয়নের জন্য সকলের মতামত নেওয়া হচ্ছে। আমার কাছেও পরামর্শ চাওয়া হলে আমি আব্দুস সাত্তারের বিষয়ে পরামর্শ দিলাম। কেননা সে খুবই সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারত। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে আমার পরামর্শটা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হ’ল। আর আমি কোন প্রকার দায়িত্ব নিতে না চাইলেও আমাকে ‘যুবসংঘে’র সেক্রেটারী হিসাবে মনোনীত করা হ’ল। আর এভাবেই ‘যুবসংঘে’র সাথে আমার পথচলা শুরু হয়।

তাওহীদের ডাক :২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল বুধবার সাভারের ৯ তলা রানা প্লাজা ধ্বসের ২দিন পর ২৬ এপ্রিল শুক্রবার জুম‘আর খুৎবা শেষে আমীরে জামা‘আত নিহত ১১৩২ জন এবং আহত ও পঙ্গু আড়াই হাযারের অধিক শ্রমিকের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান এবং সোমবার তিনি নিজে রাজশাহী থেকে মাইক্রো নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান। রাস্তায় চলা অবস্থায় মোবাইলে সর্বপ্রথম আপনার পাঠানো ৩০০০/- টাকা আসে। এরপর থেকে ঘটনা স্থলে পৌঁছা পর্যন্ত ২,৪৩,০০০/- জমা হয়ে যায়। আমীরে জামা‘আত আপনার এই দ্রুত সাড়া দানের কথা প্রায়ই বলেন। বিষয়টি আপনার স্মরণ আছে কি?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : নেটে আমীরে জামা‘আতের খুৎবার মাধ্যমে নির্দেশ পেয়েই মোবাইলে টাকা পাঠিয়েছিলাম এটুকুই কেবল মনে পড়ে। আর আমীরের আদেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করাই ছিল আমার নীতি।

তাওহীদের ডাক : আপনি একসময় খুব বই পড়তেন। তন্মধ্যে কোন বইটি আপনার সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমি অনেক ধর্মীয় বই পড়েছি। এর মধ্যে আমার কাছে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের লেখা ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে। মাসিক সম্মেলনে ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটি প্রকাশের পর প্রবীণ সংগঠক হিসাবে আমীরে জামা‘আত সিল ও স্বাক্ষর সহ আমাকে এক কপি উপহার দিয়েছিলেন। সেদিন আমার এত আনন্দ লেগেছিল যে, আমার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়েছিল।

আমি মনে করি যে, আমীরে জামা‘আতের বহু কর্মের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনী গ্রন্থটিই শ্রেষ্ঠ কর্ম। কেননা আমি রাসূলের জীবনী সম্পর্কে অনেকগুলি বই পড়েছি। যেমন ‘সীরাত ইবনে হিশাম’, ‘আর-রাহীকুল মাখতূম’, ‘মোস্তফা চরিত’ অন্যতম। যেগুলোর মধ্যে জাল, যঈফ, বানোয়াট ও কিছু অতিরঞ্জিত কথাও রয়েছে। সেগুলো আমীরে জামা‘আত তুলে ধরেছেন। ‘তাওহীদের ডাক’-এর পাঠকদের ‘সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল।

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে আমীরে জামাআতের গ্রেফতারকালীন সময়ে আপনাকে কোন বিপদের সম্মুখিন হতে হয়েছিল?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : হ্যঁা। সেই সময় স্থানীয়ভাবে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে ২০০৫ সালের ১৮ই আগস্টের ঘটনাটা একটু কঠিনই ছিল। ‘তাওহীদ ট্রাস্ট’-এর পক্ষ থেকে একজন ভদ্রলোক ঝিনাইদহ যেলায় টিউবওয়েল দেওয়ার জন্য এসেছিলেন। তার আগের দিন বর্তমান মেহেরপুর যেলা ‘আন্দোলনে’র সভাপতি তরীকুয্যামান ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। আমি সকালে তঁাকে আসুরহাট, কালীগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরের অনেকগুলি মসজিদ দেখাই।

অতঃপর সন্ধ্যায় ফেরার পথে ‘যুবসংঘের’ বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আসাদুল্লাহ মিলনদের বাড়ির সামনের মোড়ে কিছু লোককে দঁাড়িয়ে থাকতে দেখি। তাদের একজন আমাকে বলল, মাস্টার ছাহেব! দঁাড়ান। এদিকে যাবেন না। আমি বললাম, কেন? সে বলল, নযরুল ইসলাম, রঈসুদ্দীন আর আপনাকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর চাচাতো ভাই আব্দুস সাত্তারও ফোনে একই কথা জানালো। তখনও আমার সাথে সেই ভদ্রলোক ছিল। তাকে বাসে তুলে দিয়ে রাত্রে বাড়িতে ফিরলাম। সেই রাতেই র‌্যাব আমার বাড়িতে এসে আস্তে আস্তে ডাকছে, মাস্টার ছাহেব বাড়িতে আছেন? তখন রাত প্রায় বারোটা। আমি লাইট জ্বালালে ওরা নিষেধ করে বলল, লাইট জ্বালাবেন না। স্যার আপনাকে যেতে বলেছে কিছু কথা শোনার জন্য। তারা সাথে যে মাইক্রো নিয়ে এসেছিলেন সেই মাইক্রোর পেছনের ছিটের ডানদিকে আমাকে বসালেন এবং আমার বামদিকে সিরাজগঞ্জের একজন আগে থেকেই বসা ছিল।

মাইক্রোর মধ্যে একজন আমাকে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের ছবি দেখিয়ে বলল, এই ব্যক্তিকে চেনেন? আমি বললাম, উনি আমাদের আমীর। এরপর আমাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। এরপর বিভিন্ন কথা বলতে বলতে তারা বলল, আপনি আমাদের চেনেন? আমি বললাম, হয়তো আপনারা পুলিশের লোক হবেন। তারা বলল, না; আমরা র‌্যাবের লোক। আমার শুনে সামান্য পরিমাণও ভয় হয়নি। সেদিন রাত্রে আমার ছেলে বাড়িতে না থাকায় সকালে বাড়ী এসে শুনে যে, আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। তখনই এলাকার বকুল মেম্বারকে সাথে নিয়ে আমাকে খুঁজতে বের হয়। প্রথমে ডাকবাংলা ফঁাড়িতে গেলে তারা বলে, তোমার আববুকে তো আমরা নিয়ে আসিনি। তারপরে থানায় গিয়ে দেখল সেখানেও নেই।

এদিকে আমাকে চুয়াডাঙ্গা র‌্যাব অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পর দেখি সবাই ক্যারাম খেলছে। তারা আমাদেরকে বলল, আপনারা চাইলে টিভি দেখতে পারেন। আর ঐ দিকে পানি, জায়নামায ও ছালাতের স্থান আছে। চাইলে ছালাত পড়তে পারেন। আমরা তাহাজ্জুদের ছালাত পড়ে রাত পার করলাম। সকালে একজন অফিসার এসে আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করল। তিনি চলে গেলে আরেকজন এসে আগের লোক যা যা জিজ্ঞেস করেছিল ঠিক তাই তাই জিজ্ঞেস করল। সবকিছু শুনে বলল, আপনার অভিভাবক কে? আমি বললাম, আমার ছেলে। তারা বলল, মাস্টার ছাহেব! আপনার ছেলের মোবাইল নম্বর দেন। তখন আমি আমার ছেলের নম্বর দিলে তারা আমার ছেলের কাছে ফোন দিয়ে বলল, আপনার বাবা আমাদের কাছে আছে। এসে নিয়ে যান। তখন আমার ছেলে বেলা বারোটার দিকে সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসে।

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখ্যযোগ্য কোন স্মৃতি মনে পড়ে কি?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার বহু স্মরণীয় বিষয় আছে এর মধ্যে হ’ল :

১. একবার আমরা সারা দেশ থেকে ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় মানোন্নয়ন পরীক্ষায় ৪২ জনের মধ্যে ২২ জন লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। আমীরে জামা‘আত ২২ জনের ভাইভা নিয়েছিলেন। এর মধ্যে চারজন কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য (১) অধ্যাপক নূরুল ইসলাম (মেহেরপুর) (১) ছফীউল্লাহ (কুমিল্লা) (৩) আবুল কালাম (রাজবাড়ী) এবং (৪) ঝিনাইদহ থেকে আমি। আমাকে ডাকা হ’লে আমি গিয়ে আমীরে জামা‘আতের সামনে বসি। টেবিলের উপর একটা গ্লাসের মধ্যে পাঁচটি কাগজ ছিল। তার মধ্যে থেকে আমাকে একটা কাগজের টুকরা তুলে তাতে লেখা বিষয়ের উপরে পঁাচ মিনিট আলোচনা করতে বললেন। আমার আলোচনার বিষয় ছিল সংগঠনের ‘পঁাচটি মূলনীতি’। এরপর আমাকে ১০টি আয়াত ও ১০টি হাদীছ জিজ্ঞেস করেন। এছাড়াও আরো অনেকগুলি প্রশ্ন করেন। আমীরে জামা‘আত বললেন, মৌখিক পরীক্ষায় আপনি সবচেয়ে বেশী নম্বর পেলেন।

২. ১৯৯৫ সালের দিকে আমীরে জামা‘আত চোরকোল দক্ষিণ পাড়া জামে মসজিদ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। মসজিদটি ইতিপূর্বে আমীরে জামা‘আতের পিতা মাওলানা আহমাদ আলীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে আমীরে জামা‘আত সেটি তাওহীদ ট্রাস্টের মাধ্যমে পাকা করে দেন। আমীরে জামা‘আতের সাথে সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর) ছিলেন। সেসময় কঁাচা রাস্তা অনেক উঁচু-নিচু ছিল।

চোরকোলে এক বাড়ীতে শোওয়ার সময় দেখলাম সেখানে কোন বালিশ নেই। তখন আমীরে জামা‘আত খালি মাদুরের উপর তাঁর ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন। সিরাজ ভাইও একইভাবে শুয়ে পড়েন। সে বাড়ীতে কোন টয়লেট ছিল না। ফলে পার্শ্ববর্তী আখের ক্ষেতে টয়লেট করতে হয়।

সকালে আমরা সেখান থেকে ভ্যান ঠেলে তঁাকে ৬/৭ মাইল দূরে ডাকবাংলা বাস স্টপেজে নিয়ে যাই। অতঃপর তিনি সেখান থেকে রাজশাহী চলে যান।

৩. আমরা রাজশাহীতে বিভিন্ন প্রোগ্রামে গেলে ফজরের ছালাতের পরে আমীরে জামা‘আতের সাথে প্রায় দেড়/ দু’মাইল রাস্তা হঁাটতে যেতাম। আমীরে জামা‘আত এতো জোরে হঁাটতেন যে, আমরা তাঁর সাথে হেঁটে পারতাম না। তখন আমীরে জামা‘আত আমাদের সাথে অনেক উপদেশের কথা বলতেন।

৪. একবার আমীরে জামা‘আত ঝিনাইদহে কর্মী সম্মেলন ও প্রশিক্ষণ শিবিরে এলেন। তখন এখানকার ইউএনও ছিলেন তাঁর নাতনী জামাই। তিনি গাড়ী পাঠিয়ে দেন এবং আমীরে জামা‘আত তার বাসায় যান। আমরা ভাবলাম তিনি ওখানেই থাকবেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি ফিরে আসেন এবং হলিধানীতে আব্দুস সাত্তারের বাসায় খুঁটির চালের নীচে মাটির ঘরে কর্মীদের সাথে রাত কাটালেন। তাঁর এই মিশুক স্বভাব কর্মীদের সাথে সাথে আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।

তাওহীদের ডাক : বর্তমানে কিছু আলেম বলেন সংগঠন করা যাবে না। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : প্রথমত বলব যে, এই কথা যারা বলছেন তারা নিজেরাই একেকটি সংগঠন। বরং একেকটি গ্রুপের নেতা। অথবা কোন না কোন সংগঠনের সাথে জড়িত। বর্তমান সময়টা সাংগঠনিক যুগ। প্রত্যেকটা সেক্টরে যে কোন কাজই মানুষ করে যাচ্ছে সংগঠনের মাধ্যমে। আপনি কি তাহ’লে এদের সামনে একাকী দঁাড়াবেন নাকি সংঘবদ্ধভাবে? দেখুন! বাংলাদেশে অন্য কোন আলেম এই কথা বলেন না। বরং আমাদের সাথে যারা ছিল, তারাই মূলত একথা বলে। এতে বুঝা যায় যে, তারা সংগঠন করত শুধু স্বার্থের জন্য। ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ায় এখন তারা বলছে সংগঠন করা যাবে না। অথচ তাদেরকেই আবার দেখা যায় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে গিয়ে কথা বলতে।

‘যুবসংঘে’র সাবেক একজন সভাপতি, যিনি একবার আমাদের যেলাতে প্রোগ্রামে এসেছিলেন। তাকে ডাকবাংলা বাজার আহলেহাদীছ মসজিদে একজন প্রশ্ন করেছিল যে, ‘শোনা যাচ্ছে আপনারা বলেন, সংগঠন করা যাবে না? তখন তিনি রাগতস্বরে বলেছিলেন, কে বলে এই কথা? আমি তার টঁুটি ছিড়ে ফেলব’। কিন্তু তিনি এখন কোথায়? যিনি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন। তার সামনে কি তিনি এখন মাথা উঁচু করে দঁাড়াতে পারবেন?

তাওহীদের ডাক : বর্তমান সময়ে আমরা অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজে দাওয়াতী কাজ করে থাকি। নববইয়ের দশকে আপনারা এই কাজ কীভাবে করতেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : আমি কর্মীদের নিকট গিয়ে একবার মাসিক মিটিং সম্পর্কে জানিয়ে দিতাম। তখন আমাদের যারা সক্রিয় কর্মী ছিল, তারা ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক চলে আসত। তঁারা কখনও অজুহাত দঁাড় করতো না যে, আমার এই সমস্যা, ঐ সমস্যা। আগে কেন্দ্র থেকে চিঠি ডাকের মাধ্যমে আসত। দেখা যেত, সেগুলো পৌঁছাতে ১০ থেকে ১৫ দিন বা ২০ দিনও লেগে যেত। ফলে যরূরী কথা বলার জন্য আমার বাড়ি থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দূরে ডাকবাংলা বাজারে গিয়ে টেলিফোনের মাধ্যমে মাঝে-মধ্যে কথা বলতাম।

বিভিন্ন মিটিংয়ের জন্য বা সফরের জন্য আমি সচরাচর সাইকেলে যাতায়াত করতাম। এজন্য আমি সব সময় সাইকেল একেবারে টনটনে মযবুত করে রাখতাম। সফরকালীন সময়ে আমার সাইকেল সহজে নষ্ট হ’তে দিতাম না। চলার সময় সাইকেলের টায়ার মাটিতে বসতে দিতাম না। কারণ, যখন সাইকেলের টায়ার বসে যাবে, তখনই কাটা ফুটে যাবে। আর যদি শক্ত থাকে, তাহ’লে ছোট কাটা ভেঙ্গে মাটিতে ঢুকে যাবে। সাইকেলের টায়ারে কিছু হবে না। আগে খুলনা থেকে রাজশাহী একমাত্র মহানন্দা ট্রেন চলত। এখনকার মত এত ধরনের ট্রেন ছিল না। যাতায়াত সব ওটাতেই করতে হ’ত। কোন মেহমান কেন্দ্র থেকে আসলে আমরা তঁাকে রিসিভ করার জন্য মাইক্রো রিজার্ভ করে চুয়াডাঙ্গায় চলে যেতাম। কোনদিন ট্রেন লেট হলে আমাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হ’ত।

তাওহীদের ডাক : অনগ্রসর কর্মীদের উদ্দেশ্যে আপনি যদি কিছু বলতেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : যারা সাংগঠনিক কাজে অনীহা প্রকাশ করে তারা হ’ল ভীরু, কাপুরুষ। যিনি আহলেহাদীছ, তিনি অবশ্যই সক্রিয়ভাবে সংগঠন করবেন। এটা হবে তার পরকালের মুক্তির সোপান। আমি যদি আহলেহাদীছ হয়ে বসে থাকি, তাহ’লে মাযহাবীদের কাছে কে দাওয়াত পেঁŠছাবে? এই কাজে যুবকদের বেশি অগ্রগামী হওয়া উচিত। অবশ্যই দাওয়াতের আগে ইল্ম অর্জন করা আবশ্যক। যে বিষয়ে সে দাওয়াত দিবে, সেই বিষয়ে লেখাপড়া করবে এবং আলেমদের কাছ থেকে জেনে নিবে। একটাই উপদেশ থাকবে, না শিখে কখনো দাওয়াত দিতে যাবে না। যেখানে একাকী থাকবে, সেখানে সে একাকীভাবে দাওয়াত দিবে এবং যেখানে সংঘবদ্ধ, সেখানে সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াত দিবে। আর সর্বত্র একজন নেতা তো থাকবেনই। নেতা না থাকলে আমার কাজ-কর্ম কে দেখবেন? আর দিকনির্দেশনাই বা কে দিবেন? আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তোমরা সংঘবদ্ধ থাক, বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সংঘবদ্ধ জীবন হ’ল রহমত আর বিচ্ছিন্নতা হ’ল আযাব (ছহীহাহ হা/৬৬৭)। আর সংঘবদ্ধতার অর্থই নেতৃত্ব ও আনুগত্য।

অতএব আপনারা সবাই সংগঠনের প্রতি অনুগত ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী হিসাবে কাজ করে যাবেন। কখনো দাওয়াতী সফর বন্ধ করবেন না। কর্মীদের এই কথা বলা উচিত নয় যে, ‘কেউ যাচ্ছে না, তাই আমিও যাব না’। সুতরাং কেউ যদি সাড়া না দেয়, তাহ’লে একাকী দাওয়াতী সফরে যেতে হবে। আপনারা কেউ সংগঠন থেকে দূরে থাকবেন না। একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবেন।

আমি আরেকটা কথা বলব, এখন যারা নতুন আহলেহাদীছ হচ্ছেন, তারা প্রচুর পরিমাণে বই পড়বেন। বিশেষ করে মুহতারাম আমীরের জামা‘আতের লেখা ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইটি। কেননা বিষয়টি যদি আপনি না জানেন, তাহ’লে যে কোন মুহূর্তে আপনি ছিটকে যাবেন। এছাড়াও তাঁর লিখিত থিসিস, ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) অন্যান্য বইগুলি বেশী বেশী পড়ার অনুরোধ রইল। এই সঙ্গে আত-তাহরীকে প্রকাশিত তাঁর অমূল্য সম্পাদকীয় সমূহ।

তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?

ইয়াকুব আলী মাস্টার : একটা সংগঠনকে পরিচিত করতে হ’লে মুখপত্র হিসাবে পত্রিকা বড় একটি ভূমিকা পালন করে। ‘তাওহীদের ডাক’ ‘যুবসংঘ’-এর মুখপত্র ও একটি গবেষণাধর্মী পত্রিকা। এর বহুল প্রচার কামনা করছি। এটা সংকীর্ণ করে রাখলে হবে না। দ্বি-মাসিক থেকে মাসিক পত্রিকা হিসাবে বের করার জন্য আমার পরামর্শ থাকল। যুবকদের প্রতি একটাই পরামর্শ, তোমরা ‘তাওহীদের ডাক’ নিয়মিত পড়বে ও অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিবে। কেননা আল্লাহর নাযিলকৃত প্রথম শব্দ ‘পড়’। দো‘আ করি এই পত্রিকা কলমী জিহাদের ক্ষেত্র হিসাবে টিকে থাকুক ক্বিয়ামত পর্যন্ত। পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি হোক। গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা আরো বৃদ্ধি হোক।

তাওহীদের ডাক : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

ইয়াকুব আলী মাস্টার : তোমাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার মত এতো নগণ্য একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। আল্লাহ তোমাদের সবাইকে ভালো রাখুন। সেই সাথে আল্লাহ তা‘আলা মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে হায়াতে ত্বইয়েবা দান করুন।- আমীন!



আরও