ফিরে দেখা রামাযান ও নফল ছিয়াম প্রসঙ্গ

মুজাহিদুল ইসলাম 8438 বার পঠিত

বারটি মাসের মধ্যে এই রামাযান মাসটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ নে‘মত। রামাযান মাস মুমিন জীবনে একটি আদর্শ মাস। রামাযানের শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে পুরো মুমিন জীবনে। মুমিন তার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নব জীবন লাভ করে এবং বাকি এগোরোটি মাসের জন্য তাক্বওয়ার সবক গ্রহণ করে। তাই মুমিন পরকালীন মুক্তির উদগ্র বাসনা নিয়ে ফরয ছিয়াম পালন করে। নিম্নে এই মাসের প্রশিক্ষণকে পরবর্তী মাসসমূহে কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায়, যে সে ব্যাপারে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো।

ক. ফিরে দেখা রামাযান :

(১) মিথ্যা পরিহার করা : মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষী ও অশালীন কথা-বার্তা পরিত্যাগ করা রামাযানের অন্যতম শিক্ষা।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ- ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[1] 

মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষী অন্যতম কাবীরা গুনাহ। কথায় বলে ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ يَكُ كَاذِبًا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُ وَإِنْ يَكُ صَادِقًا يُصِبْكُمْ بَعْضُ الَّذِي يَعِدُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ- ‘যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার মিথ্যা তার উপরেই চাপবে। আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে সে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছে, তার কিছু না কিছু তোমাদের উপর পড়বেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মুমিন ৪০/২৮)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ- ‘আমরা তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা নিয়েছি। অতএব আল্লাহ (প্রকাশ্যভাবে) জেনে নিবেন কারা (তাদের ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী এবং অবশ্যই জেনে নিবেন কারা (তাতে) মিথ্যাবাদী’ (আনকাবূত ২৯/৩)

আল্লাহ আরও বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)

হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ رضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِى إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِى إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا،وَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِى إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا- আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সত্য নেকীর দিকে পরিচালিত করে আর নেকী জান্নাতে পৌঁছায়। আর মানুষ সত্যের উপর কায়েম থেকে অবশেষে (মহাসত্যবাদী) ছিদ্দীক-এর দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাচার প্রতিপন্ন হয়ে যায়’।[2]

অনুরূপভাবে মিথ্যা সাক্ষীও কবীরা গুনাহর অর্ন্তভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا-‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন আসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়। তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে’ (ফুরক্বান ২৫/৭২)। হাদীছে এসেছে, أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رضى الله عنه قَالَ ذَكَرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْكَبَائِرَ، أَوْ سُئِلَ عَنِ الْكَبَائِرِ فَقَالَ الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ. فَقَالَ أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ قَالَ قَوْلُ الزُّورِ أَوْ قَالَ شَهَادَةُ الزُّورِ. قَالَ شُعْبَةُ وَأَكْثَرُ ظَنِّى أَنَّهُ قَالَ شَهَادَةُ الزُّورِ- আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) কাবীরা গুনাহর কথা উল্লেখ করলেন অথবা তাঁকে কাবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, মানুষ হত্যা করা ও মা-বাপের নাফরমানী করা। তারপর তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের কাবীরা গুনাহর অন্যতম গুনাহ হ’তে সতর্ক করবো না? পরে বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য  দেয়া। শু‘বাহ (রহঃ) বলেন, আমার বেশী ধারণা হয় যে, তিনি বলেছেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া’।[3]

অশালীন কথা-বার্তাও কাবীরা গুনাহর অর্ন্তগত। রাসূল  (ছাঃ) ফুসকে-ফুজুরীর ব্যাপারে সাবধান করেছেন। গালি-গালাজ, ফাহেশী কথা-বার্তা কোন মুসলমানের চারিত্রিক ভূষণ হ’তে পারে না। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ قَالَ لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ  صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلاَ لَعَّانًا وَلاَ سَبَّابًا، كَانَ يَقُولُ عِنْدَ الْمَعْتَبَةِ مَا لَهُ ، تَرِبَ جَبِينُهُ- আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অশালীন, লা‘নতকারী ও গালিদাতা ছিলেন না। তিনি কাউকে তিরস্কার করার সময় শুধু এটুকু বলতেন, তার কী হলো? তার কপাল ধুলিমলিন হোক’। [4]

গীবত- তোহমত মুসলিম জীবনের এক ভয়ানক কীট, যা মুসলমানের আমল-আখলাক সবকিছুকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। অতএব এই জাতীয় কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। অন্যের দোষ চর্চা করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না; এবং একে অপরের গীবত করো না তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহর তাক্বওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী অসীম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)

তিনি আরও বলেন, وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ-الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ-يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ- كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ- ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারীর জন্য। যারা সম্পদ জমা করে ও তা গণনা করে। সে ধারণা করে যে, তার মাল তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে কখনোই না। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুত্বামাহর মধ্যে’(হুমাযাহ  ১০৪/১-৪)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, أَنَّهُ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْغِيبَةُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ. قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ قَالَ  إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ بَهَتَّهُ- একদা রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো, গীবত কী? তিনি বললেন, তোমরা ভাইয়ের ব্যাপারে তোমার এমন কিছু বলা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বর্তমান থাকে? তিনি বললেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহ’লেই তুমি তার গীবত করলে। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিলে’। [5]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত  তিনি বলেন, إِنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم قَالَ أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ مَا الْعَضْهُ هِىَ النَّمِيمَةُ الْقَالَةُ بَيْنَ النَّاسِ. وَإِنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الرَّجُلَ يَصْدُقُ حَتَّى يُكْتَبَ صِدِّيقًا وَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ كَذَّابًا- মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের হুশিয়ার করবনা, চোগলখোরী কী? তা হচ্ছে কুৎসা রটনা করা, যা মানুষের মধ্যে বৈরিতার সৃষ্টি করে। মুহাম্মাদ (ছাঃ) আরোও বলেছেন, নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি সত্য কথা বলায় সত্যবাদী লিপিবদ্ধ হয়; আবার কেউ মিথ্যা কথা বলায় মিথ্যাবাদী লিপিবদ্ধ হয়’।[6]

যেখানে সৃষ্টিকর্তা সত্যবাদী, বিশ্বজাহানের নেতা মুহাম্মাদ (ছাঃ) সত্যবাদী (আল-ছাদিক), সেখানে সেই সৃষ্টিকর্তার বান্দা হিসাবে এই সেই নেতার উম্মত হিসাবে কোন মুসলমানের জন্য একজন মিথ্যাবাদী, মিথ্যুক সাক্ষীদাতা ও অশালীনভাষী হওয়া খুবই অসমীচীন। বরং সে হবে সকলের নির্ভরতার প্রতীক। 

(২) কুরআন তেলাওয়াত করা :

রামাযান মাসে যত নফল ইবাদত রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল কুরআন তেলাওয়াত। কুরআন তেলাওয়াতের ফলে একজন আবেদ আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তি অর্জন করে এবং সাথে সাথে শয়তানের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সক্ষম হয়। এই প্রশিক্ষণ আমাদেরকে অন্যান্য মাসেও জারী রাখতে হবে।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ. ‘কুরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত লেখক ফেরশতাদের সাথে থাকবেন। আর যে কুরআন পড়ে কিন্তু আটকায় এবং কুরআন পড়া খুবই কষ্টদায়ক হয় তার জন্য দুগুণ নেকী রয়েছে’।[7]

এখানে দু’টি দিক আলোকপাত করা হয়েছে। যারা সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াত করতে সক্ষম তাদের জন্য মহা সুখবর রয়েছে। কিন্তু যারা কষ্ট করে কুরআন পড়ে মহান আল্লাহ তাদেরকেও মহান প্রতিদান ভূষিত করেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَأُ بِهَا- ‘ক্বিয়ামতের দিন কুরআনের বাহককে বলা হবে, পাঠ করতে থাক এবং উপরে আরোহন করতে থাক এবং দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে ঠিক সেরূপে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক। যে আয়াতে তোমার পাঠ সমাপ্ত হবে সেখানেই তোমার স্থান’।[8]

হযরত উছমান (রাঃ) হ’তে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়’।[9]

ওকবা ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, আমরা মসজিদের পিছনে বের হয়ে একটি স্থানে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, তোমাদের কে চায় যে, প্রত্যহ সকালে বুতহান অথবা আকীক নামক বাজারে যাবে আর বড় কুঁজের অধিকারী দু’টি উটনী নিয়ে আসবে, কোন অপরাধ না করে ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন না করে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা প্রত্যেকে এমন সুযোগ গ্রহণ করতে চাই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তবে কেন তোমাদের কোন ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে দু’টি আয়াত শিক্ষা দেয় না বা গ্রহণ করে না, অথচ এ কাজ তার জন্য উটনী অপেক্ষা উত্তম। তিন আয়াতে তিনটি, চার আয়াতে চারটি অপেক্ষা উত্তমভাবে যত পড়বে’।[10] হাদীছে এসেছে,

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لاَ أَقُولُ الم حَرْفٌ وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ. ‘যে ব্যক্তি কুরআনের কোন একটি অক্ষর পাঠ করবে তার জন্য একটি নেকী লেখা হবে। আর একটি নেকী দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে। আমি বলছি না ‘আলিফ-লাম-মীম, একটি অক্ষর’।[11]

‘আবু উমামা (রাঃ) বলেন, اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ-  ‘আমি রাসূল (ছাঃ) বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন তেলাওয়াত করো। কেননা কুরআন ক্বিয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে’।[12]

(৩) ক্বিয়ামুল লাইল :

ক্বিয়ামুল লাইল রামাযানের অন্যতম একটি শিক্ষা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلاَمَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصِلُوا الأَرْحَامَ وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلاَمٍ -‘হে মানুষ! তোমরা সালামের প্রচলন কর, খাদ্যদান কর, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা কর, এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা ছালাত পড়। এতে তোমরা নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’।[13]

হাদীছে এসেছে,

আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ فِى الْجَنَّةِ غُرَفًا تُرَى ظُهُورُهَا مِنْ بُطُونِهَا وَبُطُونُهَا مِنْ ظُهُورِهَا. فَقَامَ أَعْرَابِىٌّ فَقَالَ لِمَنْ هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ لِمَنْ أَطَابَ الْكَلاَمَ وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ وَأَدَامَ الصِّيَامَ وَصَلَّى لِلَّهِ بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ.    ‘জান্নাতের মধ্যে একটি কক্ষ আছে, যার বাইরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে। একজন বেদুঈন দাঁড়িয়ে বললেন, সে কক্ষ কার জন্য হবে হে রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, খাদ্যদান করে, নিয়মিত ছিয়াম পালন করে এবং রাত জেগে ছালাত আদায় করে যখন মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে’।[14]

আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأْبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ وَمَكْفَرَةٌ لِلسَّيِّئَاتِ وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ. ‘তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদত করবে। কেননা উহা তোমাদের  পূর্ববর্তী সৎ-কর্মপরায়ণগণের অভ্যাস, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের উপায়, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং পাপ কর্মের প্রতিবন্ধক’। [15]

(৪) দান-ছাদাক্বা করা :

দান ছাদাক্বা ও রামাযানিক শিক্ষার একটি। আল্লাহর পথে আল্লাহর দেয়া রিযিক্ব থেকে ব্যয় করার মাধ্যমে বিশেষ রহমত পাওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ- ‘যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে’ (বাক্বারাহ ২/৩)। 

‘আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا صَنَعَتْ يَمِينُهُ وَقَالَ اللَّهُ تَعَالَى وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ- ‘যে ব্যক্তি গোপনে ছাদাক্বা করল এমনভাবে যে তার ডান হাত যা ব্যয় করেছে বাম হাত তা জানতে পারেনি’। এবং আল্লাহর বাণী : ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে সাদকা কর তবে তা ভালো আর যদি তা গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্থকে দাও তবে তা তোমাদের জন্য আরো ভালো এবং তিনি তোমাদের কিছু কিছু পাপমোচন করবেন, তোমরা যা কর আল্লাহ তা সম্যক অবহিত’(বাক্বারাহ ২/২৭১)।[16]

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ- (ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর ছায়ায় স্থান পাবে তন্মধ্যে) ‘যে ব্যক্তি গোপনে ছাদাক্বা করল এমনভাবে যে তার ডান হাত যা ব্যয় করেছে বাম হাত তা জানতে পারেনি’।[17]  

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثٍ صَدَقَةٌ جَارِيَةٌ وَعِلْمٌ يُنْتَفَعُ بِهِ وَوَلَدٌ صَالِحٌ يَدْعُو لَهُ. ‘মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার কাজ (কাজের সকল ক্ষমতা) ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি কাজের ছওয়াব বাতিল হয় না। ছাদাকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে।[18]

দান-ছাদাক্বা করলে কখনো সম্পদ কমে যায় না। বরং সেটা পরকালের জন্য সঞ্চিত থাকে। এমনকি দুনিয়াতেও সম্পদে আল্লাহ তা‘আলা বরকত দান করেন। ক্ষমার বিনিময় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সম্মান বৃদ্ধি কর দেন।

তাড়াতাড়ি দান করা ভাল। কারণ মানুষের উপর এমন এক সময় আসবে  যে সময় মানুষ দান নিয়ে ফিরবে। কিন্তু দান করার মত কাউকে পাবে না।

(৫) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামাআতের সাথে আদায় করা :

জামা‘আতবদ্ধ পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত রামাযানের অন্যতম শিক্ষা। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الصَلاَةُ ، فَإِنْ صَلَحَتْ صَلَحَ سَائِرُ عَمَلِهِ، وَإِنْ فَسَدَتْ فَسَدَ سَائِرُ عَمَلِهِ- ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার ছালাতের। ছালাতের হিসাব সঠিক হ’লে তার সমস্ত আমল সঠিক হবে। আর ছালাতের হিসাব বেঠিক হ’লে তার সমস্ত আমল বরবাদ হবে’।[19]

রাসূল (ছাঃ) বলেন,  مَنْ صَلَّى فِىْ يَوْمٍ وَ لَيْلَةٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً بُنِيَ  لَهُ بَيْتٌ فِى الْجَنَّةِ، أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَهَا وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلاَةِ الْفَجْرِ- ‘যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। যোহরের পূর্বে চার, পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পরে দুই ও ফজরের পূর্বে দুই’।[20]

খ. নফল ছিয়ামসমূহ :

নফল ছিয়ামসমূহ মুমিন জীবনের বড় সম্বল যা তাকে বেহেশতের কুঞ্জ-কাননে পোঁছিয়ে দিতে সক্ষম। রামাযানের ফরয ছিয়ামের আদায়ের পরও নফল ছিয়াম আদায়ে মাধ্যমে মুমিন নিয়মিত তাক্বওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা অব্যাহত করা রাখতে পারে। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য একদিন ছিয়াম পালন করবে আল্লাহ  জাহান্নামকে তার নিকট হ’তে সত্তর বছরের পথ দূর করে দিবে’।[21]

সর্বোত্তম নফল ছিয়াম হল এক দিন পর পর নফল ছিয়াম রাখা। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, أَفْضَلُ الصَّوْمِ صَوْمُ أَخِى دَاوُدَ كَانَ يَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا وَلاَ يَفِرُّ إِذَا لاَقَى- ‘আমার ভাই দাউদ (আঃ)-এর ছিয়াম হলো সবচেয়ে উত্তম ছিয়াম। তিনি একদিন ছিয়াম পালন করতেন এবং একদিন পালন করতেন না। আর যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মুখোমুখী হলে তিনি পালাতেন না’।[22]

এছাড়া বৃহস্পতি ও সোমবার ছিয়াম রাখার ব্যাপারেও তাক্বীদ এসেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَالْخَمِيسِ فَأُحِبُّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِى وَأَنَا صَائِمٌ- প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহ তা‘আলার দরবারে) আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমার আমলসমূহ যেন ছিয়াম পালনরত অবস্থায় পেশ করা হোক এটাই আমার পসন্দনীয়’।[23]

রাসূল (ছাঃ) সোমবারের ছিয়াম সম্পর্কে বলেন, ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَىَّ فِيهِ- ‘সোমবারের ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ দিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং এ দিনই আমি নবুঅতপ্রাপ্ত হয়েছি বা আমার উপর (কুরআন) নাযিল করা হয়েছে’। [24]

এছাড়া প্রতিমাসে আইয়ামে বীযের তিনটি ছিয়ামও অনেক ফযীলতপূর্ণ। আবু যার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَامَ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ فَذَلِكَ صِيَامُ الدَّهْرِ. فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ تَصْدِيقَ ذَلِكَ فِى كِتَابِهِ (مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا) الْيَوْمُ بِعَشْرَةِ أَيَّامٍ. প্রতি মাসে যে লোক তিন দিন ছিয়াম পালন করে তা যেন সারা বছরই ছিয়াম পালনের সমান। আল্লাহ তা‘আলা এর সমর্থনে তার কিতাবে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, ‘কোন লোক যদি একটি ছওয়াবের কাজ করে তাহলে তার প্রতিদান হচ্ছে এর দশ গুণ’ (আনআম ১৬০)। সুতরাং একদিন দশ দিনের সমান’।[25]

ইবনু মিলহান আল-ক্বায়সী (রাঃ) হ’তে তার পিতা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْمُرُنَا أَنْ نَصُومَ الْبِيضَ ثَلاَثَ عَشْرَةَ وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ وَخَمْسَ عَشْرَةَ.قَالَ وَقَالَ هُنَّ كَهَيْئَةِ الدَّهْرِ ‘রাসূল (ছাঃ) আইয়ামে বীয অর্থাৎ চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ ছিয়াম পালনে আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, এগুলো সারা বছর ছিয়াম রাখার সমতুল্য’। [26]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, كَانَ رَسُولُ اللهِ  صلى الله عليه وسلم لاَ يَدَعُ صَومَ أَيَّام الْبِيْض فِي سَفَرٍ وَلاَ حَضَرٍ- রাসূল (ছাঃ) সফরে অথবা বাড়িতে আইয়্যামে বীযের ছিয়াম কখনো ছাড়েননি’।[27]

এছাড়া আরও বেশকিছু নফল ছিয়াম রয়েছে। যেমন-

(১) শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম :

আবু আইয়ূব আল-আনছারী (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ- ‘রামাযানের ছিয়াম পালন করে অতঃপর শাওয়াল মাসের ছয়টি ছিয়াম পালন করা সারা বছর ছিয়াম পালন করার মত’।[28]

ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, جَعَلَ اللهُ الْحَسَنَةَ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، الشَّهْرُ بِعَشْرَةِ أَشْهُرٍ، وَصِيَامُ سِتّة أَيَّامٍ بَعْدَ الشَّهَرِ تَمَامُ السَّنَةِ- ‘মহান আল্লাহ একটি ভাল কাজের ছওয়াবকে দশ গুণ করেছেন। অতএব একটি মাস দশ মাসের সমান। আর একমাস ছিয়ামের পর ছয়টি ছিয়াম পূণ এক বছরের সমান’।[29]

ছাওবান (রাঃ) আরও বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,  صِيَامُ رَمَضَانَ بِعَشْرَةِ أَشْهرٍ، وَصِيَامُ السِّتَّةِ أَيَّام بِشَهْرَينِ، فَذَلِكَ صِيامُ السَّنَةِ- ‘রামাযানের ছিয়াম দশ মাসের সমান এবং ছয়টি ছিয়াম দুই মাস সমতুল্য। অতএব পুরো বছরের ছিয়াম’।[30]

(২) আরাফা ও আশুরার ছিয়াম :

আবু ক্বাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-কে আরাফার ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেন, يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ وَالْبَاقِيَةَ. قَالَ: وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، فَقَالَ يُكَفِّرُ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ- ‘পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা। আর আশুরার ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে’।[31]

সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ صَامَ يَوْمَ عَرَفَة غُفِرَ لَهُ سَنَتَينِ مُتَتَابِعَتَينِ ‘যে ব্যক্তি আরাফার ছিয়াম রাখে তার দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়’।[32]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, مَا رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ، إِلاَّ هَذَا الْيَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَهَذَا الشَّهْرَ . يَعْنِى شَهْرَ رَمَضَانَ- ‘আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে ‘আশূরার  দিনের ছিয়ামের উপরে অন্য কোন দিনের ছিয়ামকে প্রাধান্য প্রদান করতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রামাযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)’।[33]

সালমা ইবনু আকওয়া (রাঃ) বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, أَمَرَ النَّبِىُّ  صلى الله عليه وسلم رَجُلاً مِنْ أَسْلَمَ أَنْ أَذِّنْ فِى النَّاسِ أَنَّ مَنْ كَانَ أَكَلَ فَلْيَصُمْ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ، وَمَنْ لَمْ يَكُنْ أَكَلَ فَلْيَصُمْ، فَإِنَّ الْيَوْمَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ- ‘নবী কারীম (ছাঃ) আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে লোকজনের মধ্যে এ মর্মে ঘোষণা দিতে আদেশ করলেন, যে ব্যক্তি খেয়েছে, সে যেন দিনের বাকি অংশে ছিয়াম পালন করে, আর যে খায়নি, সেও যেন ছিয়াম পালন করে। কেননা আজকের দিন ‘আশূরার দিন’।[34]

(৩) মুহাররমের মাসের ছিয়াম :

আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ- ‘রাসূল (ছাঃ) বলেন, রামাযান মাসের ছিয়ামের পর সর্বোৎকৃষ্ট ছিয়াম হলো আল্লাহ তা‘আলার মাস  মুহাররমের ছিয়াম। ফরয ছালাতের পর সর্বোৎকৃষ্ট ছালাত হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) ছালাত’।[35] 

(৪) শাবান মাসের ছিয়াম :

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَإِنَّ أَفْضَلَ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْمَفْرُوضَةِ صَلاَةٌ مِنَ اللَّيْلِ. لَمْ يَقُلْ قُتَيْبَةُ شَهْرِ. قَالَ رَمَضَانَ- ‘রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট সকল মাসের মধ্যে শা‘বান মাসে অধিক ছিয়াম রাখা অধিক পসন্দনীয় ছিল। তিনি এ মাসে ছিয়াম অব্যাহত রেখে তা রামাযানের সাথে যুক্ত করতেন’।[36] 

উসামা ইবনু যায়েদ (রাঃ) বর্ণনা করেন তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, يَا رَسُولَ اللهِ! لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْراً مِنَ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ؟ قَالَ ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَب وَرَمَضَانَ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنِ، فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ- ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনাকে তো শা‘বান মাসে যে পরিমাণ ছিয়াম পালন করতে দেখি বছরের অন্য কোন মাসে সে পরিমাণ ছিয়াম পালন করতে দেখি না। তিনি বললেন শা‘বান মাস রজব এবং রামাযানের মধ্যবর্তী এমন একটি মাস যে মাসের (গুরুত্ব সম্পর্কে) মানুষ খবর রাখে না অথচ এ মাসে আমলনামা সমূহ আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিকটে উত্তোলন করা হয়। তাই আমি পসন্দ করি যে, আমার আমলনামা আল্লাহ তা‘আলার নিকট উত্তোলন করা হবে আমার ছিয়াম পালনরত অবস্থায়’।[37]

উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, مَا رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَصُومُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ إِلاَّ شَعْبَانَ وَرَمَضَانَ ‘আমি শা‘বান ও রামাযান ছাড়া রাসূল (ছাঃ)-কে একটানা দু‘মাসের ছিয়াম পালন করতে দেখিনি’।[38] 

(৫) শীতকালীন ছিয়াম :

ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (ছাঃ) বলেন, الْغَنِيمَةُ الْبَارِدَةُ الصَّوْمُ فِى الشِّتَاءِ ‘শীতকালের ছিয়াম হচ্ছে বিনা পরিশ্রমে যুদ্ধলব্ধ মালের অনুরূপ’।[39]

অর্ধ-দিনের ছিয়াম :

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (ছাঃ) আমার কাছে এসে বললেন, دَخَلَ عَلَيَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ:هَلْ عِنْدَكُمْ شَيْءٌ؟ فَقُلْنَا: لَا، قَالَ: فَإِنِّي إِذَنْ صَائِمٌ ثُمَّ أَتَانَا يَوْمًا آخَرَ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ،أُهْدِيَ لَنَا حَيْسٌ فَقَالَ: أَرِينِيهِ، فَلَقَدْ أَصْبَحْتُ صَائِمًا فَأَكَلَ-  ‘তোমাদের কাছে কিছু আছে কি? আমরা বললাম না। তিনি বললেন, তাহ’লে আমি ছিয়াম পালন করলাম। আর একদিন তিনি আমাদের কাছে আসলেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে ‘হায়স’ (ঘি বা পনির মিশ্রিত খেজুর) হাদিয়া দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আমাকে তা দেখাও; অবশ্য আমি সকালে ছিয়ামের নিয়ত করেছি। অতঃপর তিনি তা খেলেন’।[40]

عَنْ أُمَّ هَانِئ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا :

উম্মে হানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলতেন, الصَّائِمُ الْمُتَطوِّع أَمِيرُ نَفْسِهِ، إِنْ شَاءَ صَامَ وَإِنْ شَاءَ أَفْطَر- ‘নফল ছিয়াম পালনকারী নিজের আমানতদার। সে ব্যক্তি চাইলে ছিয়াম পূর্ণও করতে পারে আবার ভাঙ্গতেও  পারে’।[41]

অতএব আসুন! আমরা রামাযানের শিক্ষা অবলম্বনে সারাবছর তাক্বওয়ার চর্চা অব্যাহত রাখি এবং ফরয ছিয়ামের সাথে সাথে নফল ছিয়ামেও অভ্যস্থ হই। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদের মধ্যে অন্তুর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী মহানগরী পূর্ব সাংগঠনিক যেলা]

[1]বুখারী হা/১৯০৩
[2]বুখারী হা/৬০৯৪মিশকাত হা/৪৮২৪
[3]বুখারী হা/৫৯৭৭
[4]বুখারী হা/৬০৪৬ ; মিশকাত হা/৫৮১১
[5]আবুদাঊদ হা/৪৮৭৪
[6]. মুসলিম হা/১০২ছহীহুল জামে‘ হা/২৬৩০সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৪৬
[7]. বুখারীমুসলিম মিশকাত হা/২১১২
[8]. আবুদাউদ হা/১৪৬৬
[9]. বুখারী হা/৫০২৭
[10]. মিশকাত হা/২১১০
[11]. তিরমিযী হা/৩১৫৮;মিশকাত হা/২১৩৭                                                                                  
[12]. মুসলিমমিশকাত হা/২১২০   
[13]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩৭৪মিশকাত হা/১৯০৭  
[14]. তিরমিযী হা/২১১২মিশকাত হা/১২৩২   
[15]. তিরমিযী হা/৩৫৪৯ 
[16]. বুখারী হা/১৩
[17]. বুখারী হা/১৪২৩মিশকাত হা/৭০১
[18]. তিরমিযী হা/১৩৭৬                                                  
[19]. তিরমিযীমিশকাত হা/১৩৩০    
[20]. মুসলিমমিশকাত হা/১১৫৯    
[21]. বুখারী হা/২৮৪০    
[22]. তিরমিযী হা/৭৭০                  
[23]. তিরমিযী হা/৭৪৭মিশকাত হা/২০৫৬   হা/২৮০৪   
[25]. তিরমিযী হা/৭৬২   
[26]. আবুদাউদ হা/২৪৪৯     
[27]. ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮৪৮  
[28]. মুসলিম হা/১১৬৪তিরমিযী হা/৭৫৯মিশকাত হা/২০৪৭ 
[29]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৯৪  
[30]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩৮৫১     
[31]. মুসলিম হা/১১৬২  
[32]. আত-তারগীব ওয়াত- তারহীব হা/১০১২  
[33]. বুখারী হা/২০০৬মিশকাত হা/২০৪০    
[34]. বুখারী হা/২০০৭ছহীহুল জামে‘ হা/৮৫০ 
[35]. মুসলিম হা/১১৬৩   ; তিরমিযী হা/৪৩৮   
[36]. আবুদাউদ হা/২৪৩১  
[37]. নাসাঈ হা/২৩৫৭সিলসিলাতুছ ছহীহাহ হা/১৮৯৮   
[38]. তিরমিযী হা/৭৩৬মিশকাত হা/১৯৭৬  
[39]. তিরমিযী হা/৭৯৭মিশকাত হা/২০৬৫                                                        
[40]. মুসলিম হা/১১৫৪আবুদাউদ হা/২৪৫৫ 
[41]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/১৫৯৯তিরমিযী হা/ ৭৩২ 




আরও