পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন : মুসলমানদের সংস্কৃতি নয়

লিলবর আল-বারাদী 2002 বার পঠিত

বাংলা নববর্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

মোঘল সম্রাটদের শাসনকার্য হিজরী সন অনুযায়ী পরিচালিত হ’ত। এতে খাজনা আদায়ে অসুবিধা দেখা দিত। কারণ চান্দ্রবর্ষ প্রতি বছর ১০/১১ দিন এগিয়ে যায়। ফলে ফসল ওঠা ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর সৌরবর্ষের হিসাবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।[1]

সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মোতাবেক হিজরী ৯৬৩ সালের মুহাররম মাসে। তখনও বঙ্গে শকাব্দ চালু ছিল। যার শুরুর মাস ছিল চৈত্র। শকাব্দ হ’ল মধ্য এশিয়ার প্রাচীন রাজা ‘শক’ কর্তৃক প্রবর্তিত সাল।

আকবরের সিংহাসনারোহণের মাস মুহাররমের সাথে শকাব্দের বৈশাখ মাস পড়ে যাওয়ায় তিনি ফসলী সন শুরু করেন বৈশাখ মাস দিয়ে। সেই থেকে চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখ দিয়ে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ।

পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৬৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটি ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী বাংলা সনের সংস্কার সাধন করেন। যেখানে বছরের প্রথম পাঁচ মাস বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র গণনা হবে ৩১ দিনে। পরের সাত মাস আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র গণনা হবে ৩০ দিনে। অতঃপর ইংরেজী লিপ ইয়ারে বাংলা ফাল্গুনের সাথে ১ যোগ হয়ে ৩১ দিনে হবে।

এই সংস্কারের ফলে এখন প্রতি ইংরেজী বছরের ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নেতারা এ সংস্কার গ্রহণ করেননি। ফলে তাদের ১লা বৈশাখ হয় আমাদের একদিন পরে।

পহেলা বৈশাখ : পহেলা বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ, বাংলা সনের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসাবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। এদেশে বর্তমানে পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে মোট ৩টি সন গণনা পদ্ধতি চালু আছে। হিজরী বা আরবী সন, বাংলা বা ফসলী সন ও ইংরেজি বা গ্রেগোরিয়ান সন। এই পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয়। তন্মধ্যে হিন্দুয়ানী গুণে গুণান্বিত সম্রাট আকবর উদ্ভাবিত মিকশ্চার ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র মত সব ধর্মের অংশগ্রহণে একটি উৎসব পালন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে ‘পহেলা বৈশাখ’ মূলতঃ হিন্দুদের তথা অমুসলিমদের উৎসব। কেননা এতে বয়েছে- ১. হিন্দুদের ঘটপূজা ২. গণেশ পূজা ৩. সিদ্ধেশ্বরী পূজা ৪. ঘোড়ামেলা ৫. চৈত্রসংক্রান্তি পূজা-অর্চনা ৬. চড়ক বা নীল পূজা ৭. গম্ভীরা পূজা ৮. কুমীরের পূজা ৯. অগ্নিপূজা ১০. ত্রিপুরাদের বৈশুখ ১১. মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব ১২. চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পূজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি) ১৩. হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপূজা ১৪. মজূসী তথা অগ্নিপূজকদের নওরোজ ১৫. হিন্দুদের বউমেলা ১৬. হিন্দুদের মঙ্গলযাত্রা ১৭. হিন্দুদের সূর্যপূজা ইত্যাদি উৎসব।

১. বৈশাখী প্রভাতের ঊদিত সূর্য পূজা : বাংলাভাষীরা অবশ্যম্ভাবীভাবেই নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’ গানটিকে বেছে নিয়েছে। জাতীয় সংগীত বাদে আর কোন বাংলা গান এতবার এত কণ্ঠে গাওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। আসলে গানটি বৈশাখী অনুষ্ঠানের এক ধরনের এনথেম-এ পরিণত হয়েছে। চারুশিল্পীরা রমনার বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে এই গানের মাধ্যমে প্রভাতের উদীয়মান সূর্য পূজার দ্বারা দিনের শুরু হয়। এই দিনে অনৈসলামিক বিভিন্ন উৎসবে মুসলিম ও অমুসলিম পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে।

২. নতুন পোশাকে আকর্ষণীয় সাজসজ্জা : অনেকে পহেলা বৈশাখকে ঈদের মত মর্যাদা দিয়ে জাতীয়ভাবে নতুন পোশাক পরিধান করে। যাতে প্রিন্ট করা থাকে তবলা, বেহালা, হারমনিয়াম, একতারা ও বাউল-সন্ন্যাসীদের মত নানা ছবি। আর ধারণা করা হয় যে, এটা বাঙালীদের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব! হিন্দুদের বারো মাসে ১৩ পূজার আদলে কোন মুসলিমের জন্য ‘পহেলা বৈশাখ’কে আরেকটি বাৎসরিক উৎসবের দিন ধার্য করা জায়েয নয়। ইদানীং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে অতি তোড়জোড় দেখে মনে হয় তারা এটাকে দেশের মানুষের প্রধান উৎসব হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং অনেকক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঘোষণাও করছে।

৩. শরীরে উল্কি অংকন ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি তৈরি : উল্কি (Tattoo) হচ্ছে এক ধরনের শিল্প, যেখানে অমোচনীয় কালি শরীরের ত্বকের রং পরিবর্তন করার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ত্বকের ওপরাংশে ব্যবহার করা হয়। উল্কি মানুষের শরীর সাজানোর একটি অংশ এবং প্রাণীদের ক্ষেত্রে উল্কিকরণ করা হয় মূলত নির্ধারণ ও ব্র্যান্ডিং-এর জন্য। বিশ্বজুড়েই উল্কি প্রচলন দেখা যায়। জাপানের আদি জাতিগোষ্ঠী আইনু ঐতিহ্যবাহীভাবে তাঁদের মুখে উল্কি ব্যবহার করে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে অনেক যুবক-যুবতী তদের গালে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে উল্কি অঙ্কন করে। উল্কি অঙ্কনের ক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গের হাত ব্যবহার করা হয়। যা প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতেও উল্কি অঙ্কন ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়াও বিভিন্ন জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরী করা হয়। এগুলোকে বৈশাখী প্রেমিকরা নিজেদের মুখোশ তৈরী করে বানর, হনুমান, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি সাজে এবং এগুলো নিয়েই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। যদিও ইসলামে উল্কি অংকন ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি কিংবা জীবন্ত বস্ত্তর ছবি তৈরি করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

৪. মঙ্গল শোভাযাত্রা : প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাদোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং একে ঘিরে আয়োজিত অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে। নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়।[2] সেই বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা প্রতি বছর বের করে। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ বিশালকার চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ ও সাজসজ্জাসহ বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য।[3] পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।[4] ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নামে আশরাফুল মাখলূকাত হয়েও জাহিলী যুগের মানুষের ন্যায় বর্তমান যুগে তথাকথিত শিক্ষিত মহল বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরে, অশ্লীল নৃত্য ও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে থাকে এবং একে লক্ষ্য করে মঙ্গল লাভের আশা করে। অথচ এটা স্পষ্ট শিরক।

৫. মিলন মেলা : অনেক মেয়ে পহেলা বৈশাখের নামে অর্ধ নগ্ন হয়ে বের হয়। গরমের দিনে তথাকথিত পহেলা বৈশাখের সাদা শাড়ি ঘামে ভিজে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অত্যন্ত নোংরাভাবে দৃশ্যমান হয়। তাছাড়া নারী-পুরুষ ঢলাঢলির মাধ্যমে ব্যভিচারের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র তৈরি হয় পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতিতে। যুবতী মেয়েদের হাতে পান্তা ইলিশ খেয়ে মনের নোংরা চাহিদা মেটায় অনেকে। বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে তরুণ-তরুণীরা জোড়ায় জোড়ায় মিলিত হয়ে নীরবে-নিভৃতে প্রেমিক-প্রেমিকার খোশগল্প, অসামাজিকতা, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, বেহায়পনা ও নগ্নতায় জড়িয়ে পড়ে। এ হ’ল বৈশাখের বাস্তব চিত্র। এছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় আনন্দ পার্টি বা মিলন মেলা। মিলন মেলায় নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত হয়। এসব পার্টিতে আয়োজকরা নিজেদের ব্যবসার জন্য ভাড়া করে আনে কলগার্ল। আর এদের মধ্যে কিছু হাই সোসাইটির গার্লও থাকে। পানীয় হিসাবে থাকে দেশী-বিদেশী মদ। পার্টিতে কিছু স্পেশাল টিকেট থাকে, যার মূল্য ২০ থেকে ৫০ হাযার টাকা। এই টিকেট কিনলে বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগ করতে দেয়া হয়। তন্মধ্যে একটি হ’ল পার্টি শেষে শহরের হাই সোসাইটির গার্লদের সাথে রাত্রি যাপন করা। এরা কোন এক ভদ্র ফ্যামিলির সন্তান। কোন সভ্য শিক্ষিত মা-বাবার কলিজার টুকরো। শুধু মাত্র নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে নিজের নেশার চাহিদা মেটাতে এক রাতের জন্য নিজেকে বিক্রি করে। ঐসব পার্টিতে নাচতে নাচতে তাল হারিয়ে ফেলে তরুণ-তরুণীরা। শুরু হয় যত প্রকারের নোংরামি। এই পার্টিগুলোর কমন দৃশ্য হচ্ছে একটা গ্রুপে ১০-১৫টা ছেলে থাকে, মাঝখানে ২-৩টা মেয়ে থাকে। তারপর দল বেঁধে নাচে। অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেদের অনেকেই গার্ল-ফ্রেন্ড নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করতে পার্টিতে আসে। আবার অনেকে আসে একাকী। একাকী যারা আসে, তাদের জন্যই পার্টিতে থাকে চিয়ার্স গার্লরা। উচ্চবিত্ত পুরুষরাই থাকে চিয়ার্স গার্লদের মূল টার্গেট। আয়োজকরাই ইশারায় চিয়ার্স গার্লদের চিনিয়ে দেয় তাদেরকে। ব্যাস, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে বেড পর্যন্ত যাবার জন্য শুরু হয় দর কষাকষি। অভিযোগ আছে, বেশিরভাগ চিয়ার্স গার্লই ইয়াবা আসক্ত। ফিগার ঠিক রাখা ও রাত জাগার জন্য তারা নিয়মিতই ইয়াবা সেবন করে। এদের অনেকেই আবার মাদক সিন্ডিকেটের ডিলার বা এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে জন্ম নেয় হিংস্রতা। যাতে নেশা করতে করতে এতটাই আসক্ত হয়ে যায় যে, ঐশীরসহ নিজের পিতামাতাকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না।

এই উৎসবে সমাজে দায়-দায়িত্বহীন অবৈধ যৌনতার প্রসার ঘটে এবং বিবাহ নামক পবিত্র দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত বৈধ সম্পর্কের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আধুনিক প্রগতির নামে যুবক-যুবতীরা নতুনত্ব খোঁজে। ফলে মানব সমাজ ও সভ্যতা ধীরে ধীরে দায়-দায়িত্বহীন অসভ্য-বর্বর পাশবিক সমাজের দিক দ্রুত ধাবিত হয়। মনুষত্ব হারিয়ে পশুত্ব বরণ করে নেয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক পবিত্র বন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাঁধাহীন অশ্লীলতার মারাত্মক সয়লাবে কলুষিত সমাজে ধর্ষণ, পরকীয়া, অবৈধ গর্ভধারণ, অবৈধ গর্ভপাত, আত্মহত্যা, মানসিক বিকৃতি, সংসার ভাঙ্গন ও অবৈধ সন্তানের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে।

৬. পান্তা-ইলিশ ভোজে একদিনের বাঙ্গালী : পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আর পান্তা-ইলিশ ভোজন করে এক দিনের বাঙ্গালী হওয়া কোন কালেই বাঙ্গালী সংস্কৃতি ছিল না। অথচ রমনার বটমূল থেকে শুরু করে বাংলার আনাচে-কানাচে পান্তা-ইলিশের হিড়িক পড়ে যায়। ফলে অপচয় হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় মাটির সাণকিতে পান্তা বিক্রয় করা হয় ১০০-৫০০ টাকায় এবং ইলিশ ৫০০-১২০০০ টাকায়। আর হুজুগে বাঙ্গালীরা তা উৎফুল্লচিত্তে ক্রয় করতে প্রতিযোগিতা শুরু করে। শুধু অপচয় আর অপচয়! বাংলাদেশের এই মৌসুমটা ইলিশের প্রজননের সময়। সরকারীভাবে নিষেধ থাকলেও পহেলা বৈশাখের চাহিদা মেটাতে ও অধিক মুনাফার আশায় জেলেদের মাছ ধরা কিন্তু থেমে থাকে না। বৈশাখের সকালে তথাকথিত সংস্কৃতি প্রিয় বাঙ্গালীরা খুব আরাম করে পান্তা আর ডিম ওয়ালা ইলিশ ও জাটকা খাচ্ছে। এতে ব্যহত হচ্ছে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা, ধ্বংস হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। অন্যদিকে বিরাট অংশ অপচয় হচ্ছে।

ইসলামী দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ :

পহেলা বৈশাখ মুসলমানদের সাংস্কৃতি নয়। এটা হচ্ছে মজূসীদের নওরোজ পালনের অনুষ্ঠান। সেই সাথে এটা হিন্দুদের ঘটপূজা, বৌদ্ধদের উল্কি অঙ্কন দিবস। তারা নওরোজ বা নববর্ষ পালন উপলক্ষে পান্তা খায়, গান-বাজনা করে, র‌্যালী করে, জীব-জানোয়ারের মুখোশ পরে মিছিল করে, শরীরের নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গে উল্কি অাঁকে, ডুগডুগি বাজিয়ে নেচে নেচে হৈহুল্লোড় করে, পুরুষরা ধুতি ও কোণাকাটা পাঞ্জাবী (যা হিন্দুদের জাতীয় পোশাক) পরে, মেয়েরা লাল পেড়ে সাদা শাড়িসহ হাতে রাখি বাঁধে, শাঁখা পরে, কপালে লাল টিপ ও চন্দন এবং সিথিতে সিঁদুর দেয়, বেপর্দা, বেহায়া হয়। যা ইসলামী শরী‘আতে সম্পূর্ণরূপে হারাম। বিজাতীয় অশ্লীল, নোংরা সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখ ইসলাম বিরোধী।

ইসলামী শরী‘আতে যেকোন দিবস ও বর্ষ পালন করা বিদ‘আত। ইসলামে কোন নির্দিষ্ট দিবস পালনের বিধান নেই। আর এই অনৈসলামিক সংস্কৃতি পালন করে মানুষ নিজেকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। মুসলমান আধুনিক প্রগতির নামে বিজাতীয় মতবাদকে মেনে নিতে পারে না। কেননা এটা জান্নামে যাবার অসীলা হ’তে পারে। সুতরাং তাদের কোন মতামত ও সাদৃশ্য মুসলমানদের সমাজে থাকতে পারে না। এমর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির (কওম) সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন) তাদের দলভুক্ত হবে’।[5] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান (সময় ও স্থান) নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যা তাদেরকে পালন করতে হয়’ (হজ্জ ২২/৬৭)। মূলতঃ দুই ঈদ ব্যতীত মুসলিমদের অন্য কোন ধর্মীয় উৎসব নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুসলিমদের দু’টি আনন্দের দিন ১. ঈদুল ফিতর ও ২. ঈদুল আযহা’।[6]

আমরা যদি দ্বীন ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য ধর্মের সাংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করি, তবে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম (বিধান) তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে সে একজন মুসলিম’।[7]

সুতরাং বৈশাখ উদযাপন বা ‘বর্ষবরণ’-এর অনৈসলামী প্রথা থেকে মুসলিমকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন মদীনাবাসীদের দু’টি উৎসব পালন করতে দেখে তিনি তাদের বলেন, তোমাদের এ দু’টি দিন কেমন? তারা বলল, জাহেলী যুগে আমরা এ দু’দিন উৎসব পালন করতাম (অর্থাৎ সৌরবর্ষের প্রথম দিন এবং ‘মেহেরজান’ অর্থ বছরে যেদিন রাত্রি-দিন সমান হয়। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এ দু’দিনের পরিবর্তে দু’টি উত্তম উৎসব দান করেছেন। আর তা হ’ল ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা’।[8]

মুবারকপুরী বলেন, ‘উক্ত হাদীছ দ্বারা নবী করীম (ছাঃ) উক্ত দুই দিন ব্যতীত অন্য দিনে যাবতীয় উৎসব রহিত করেছেন এবং তার মুকাবিলায় উক্ত দু’টি দিনকে নির্ধারণ করেছেন। মাযহার বলেন, ‘নওরোয’ (নববর্ষ) ও মেহেরজান সহ কাফিরদের অন্যান্য উৎসবকে সম্মান প্রদর্শন করা যে নিষিদ্ধ উক্ত হাদীছে তার দলীল রয়েছে’। ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘মুশরিকদের উৎসব সমূহে খুশী করা কিংবা তাদের মত উৎসব করা উক্ত হাদীছ দ্বারা অপসন্দনীয় প্রমাণিত হয়েছে’। শায়খ আবু হাফছ আল-কাবীর নাসাফী হানাফী বলেন, ‘এসব দিনের সম্মানার্থে মুশরিকদের যে ব্যক্তি একটি ডিমও উপঢৌকন দিল, সে আল্লাহর সাথে কুফরী করল’। কাযী আবুল মাহাসেন হাসান বিন মানছূর হানাফী বলেন, ‘এ দিনের সম্মানার্থে কেউ যদি ঐসব মেলা থেকে কোন বস্ত্ত ক্রয় করে কিংবা কাউকে কোন উপঢৌকন দেয়, সে কুফরী করল। এমনকি সম্মানার্থে নয় বরং সাধারণভাবেও যদি এই মেলা থেকে কিছু ক্রয় করে কিংবা কাউকে এই দিন কিছু উপঢৌকন দেয়, তবে সেটিও মাকরূহ’।[9]

সাংস্কৃতির নামেই হোক আর ধর্মের নামেই হোক ঈদুল ফিতর ও আযহার উৎসব ছাড়া সব ধরনের উৎসবই পরিত্যাজ্য। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে মানুষ অজান্তেই বহু পাপে নিমজ্জিত হচ্ছে। অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলের বিষক্রিয়ায় তারা আজ জর্জরিত। মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরে, অশ্লীল নৃত্য ও ঢাক ঢোল পিটিয়ে এক শ্রেণীর লোক যাত্রা করে থাকে এবং এর মাঝে জীবনের মঙ্গল কামনা করে। অথচ এটা সকল শুভ-অশুভ, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক আল্লাহ তা‘আলা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শুনে রাখ! তাদের অশুভ আলামতের চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহরই হাতে রয়েছে। অথচ এরা জানে না’ (রাফ ৭/১৩১)। এমর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘অশুভ আলামত বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখল, সে মূলতঃ শিরক করল’।[10]

পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি ধারণ এবং যুবক-যুবতীরা শরীরে উল্কি অংকন করে থাকে। যা ইসলামে নিষিদ্ধ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে নারী দেহে কিছু অঙ্কন করে এবং অন্যের দ্বারা করিয়ে নেয় উভয়ের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ’।[11] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে (জীবন্ত বস্ত্তর) ছবি নির্মাতারা।[12] তিনি আরো বলেছেন, ‘যে কেউ ছবি তৈরী করল, আল্লাহ তাকে (ক্বিয়ামতের দিন) ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন, যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে। আর সে কখনই তা করতে সমর্থ হবে না’।[13]

ইসলামে বাদ্য-বাজনা হারাম। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞভাবে অনর্থক কথা (বাদ্য-বাজনা) করে এবং তাকে আনন্দ-ফূর্তি হিসাবে গ্রহণ করে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (লুকবমান ৩১/৬)। এমর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক এমন হবে যারা যেনা, রেশমী পোশাক (পুরুষের জন্য), মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’।[14]

আল্লাহ যেনা-ব্যভিচার হারাম করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا  ‘তোমরা যিনা-ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, কেননা তা অত্যন্ত নির্লজ্জ কাজ এবং খুবই নিকৃষ্ট পথ’ (ইসরা ১৭/৩২)। কোনভাবেই এই অশ্লীলতার নিকটে গমন করা যাবে না, এসম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ ‘লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে, তার নিকটবর্তী হবে না, তা প্রকাশ্যেই হোক অথবা অপ্রকাশ্যে হোক’ (আনআম ৬/১৫১)

আর পান্তা-ইলিশ খাওয়ার নামে যে অপচয় করা হয় তা শয়তানী কর্ম বৈ কিছুই নয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা ‘তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় কর না, তিনি অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না’ (রাফ ৭/৩১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই...’ (বানী ইসরাঈল ১৭/২৭)। এধরনের সংস্কৃতির নামে বিলাসিতায় লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় না করে যদি অসহায় গরীব-দুঃখীদের সাহাযার্থে খরচ করা হ’ত তাহ’লে কতইনা ভাল হ’ত!

শেষ কথা : অমুসলিমদের উৎসবের সাথে মুসলমানদের কোনরূপ সম্পর্ক রাখা কিংবা সহযোগিতা করা জায়েয নয়। বৈশাখ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি মূলতঃ হিন্দুয়ানী প্রথা থেকে এসেছে। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। তাই আসুন, বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে নিজে ও সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন-আমীন!

লেখক : অর্থ সম্পাদক, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, রাজশাহী মহানগরী।


[1]. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ই এপ্রিল ২০১৪, পৃ. ৭।

[2]. রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, নওয়াজেশ আহমদ, দৈনিক প্রথম আলো ১৪ই এপ্রিল ২০০৮

[3]. পহেলা বৈশাখ উদযাপিত, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ এপ্রিল ১৯৮৯। পৃ. ৭।

[4]. মাহবুব জামাল শামীম, একান্ত সাক্ষাৎকার, ৩১ মার্চ ২০০৯।

[5]. আবুদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭ পোষাক অধ্যায়; বঙ্গানুবাদ হা/৪১৫৩; ছহীহুল জামে হা/২৮৩১

[6]. বুখারী হা/৫৫৭১

[7]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪

[8]. আবুদাঊদ হা/১১৩৪, মিশকাত হা/১৪৩৯, ছালাতুল ঈদায়েন অধ্যায়

[9]. মিরআত শরহ মিশকাত, ছালাতুল ঈদায়েন অধ্যায় ৫/৪৪-৪৫ পৃঃ

[10]. মুসনাদে আহমাদ ২/২২০

[11]. বুখারী হা/৫৯৩৩; মুসলিম হা/৫৬৮৭

[12]. মুসলিম হা/৫৬৫৯

[13]. বুখারী হা/২২২৫; মুসলিম হা/২১১০

[14]. বুখারী ২/৮৩৭ পৃঃ



বিষয়সমূহ: সমাজ-সংস্কার
আরও