ইসলামী বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (শেষ কিস্তি)

মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 828 বার পঠিত

ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সুফল :

মহান আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপনের জন্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন (নাহল ১৬/৩৬; হাদীদ ৫৭/২৫)। নবী ও রাসূলগণ সমাজ ব্যবস্থাকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। যাতে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আধ্মাতিক, নৈতিক ও বৈষয়িক কল্যাণের সমন্বয় ঘটে। তারা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবন্ধক না হয়। বরং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের আচার-আচরণে স্থিতিশীলতা তথা ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারে। কেননা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুবিধ কল্যাণ লাভ করা যায়।

যেমন মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ- ‘মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ব্যতীত নয়। অতএব তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর। তাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র আদর্শ জীবন ব্যবস্থা। একমাত্র ইসলামই বিপথগামী সমাজকে কল্যাণমুখী সমাজে রূপান্তরিত করতে পারে। নিম্নে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সুফল আলোচনা করা হ’ল।

১. জীবনের নিরাপত্তা :

মানব রচিত মতবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থায় জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। আর ইসলাম যে কোন ব্যক্তিকে আত্মসম্মান ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। সবলরা দুর্বলের ওপর নির্যাতন করলে ইসলামে রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান। আবার কেউ কাউকে হত্যা করলে শাস্তিস্বরূপ হত্যাকারীকে হত্যা কিংবা তার থেকে ‘দিয়াত’ (রক্তপণ) নেয়ার বিধান রয়েছে। এ মর্মে আল্লাহর বাণী- كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ ‘নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের কিছাছের বিধান দেয়া হয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৭৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَاأُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘আর হে জ্ঞানীগণ! হত্যার বদলে হত্যার মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে। যাতে তোমরা সাবধান হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا- ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হ’ল জাহান্নাম। সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাৎ করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্ত্তত রেখেছেন’ (নিসা ৪/৯৩)। এ সমস্ত শাস্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

২. বাসস্থানের নিরাপত্তা :

প্রত্যেক মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তির সাথে নিজগৃহে বসবাস করতে চায়। আর এটাই কল্যাণমুখী সমাজের দাবী। তাই ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিটি মানুষের বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রতিবেশীর প্রতি অপর প্রতিবেশীর দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন। বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। কোন বাড়িতে আলো-বাতাস প্রতিরোধমূলক কাজ করতেও নিষেধ করেছেন। এমনকি একজন মুসলিমের কাছ থেকে অপর মুসলিমকে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা দান করেছেন। হাদীছে এসেছে- الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘মুসলমান সেই ব্যক্তি যার কথা ও হাত থেকে অপর মুসলমানগণ নিরাপদ’।[1] ইসলামে কোন কাজটি উত্তম- প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ- ‘যার জিহবা ও হাত হ’তে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে’।[2]

৩. স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের ব্যবস্থা :

সমাজে মানুষকে একত্রে বসবাস করতে হয়। পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়া সমাজে বাস করা যায় না। স্বাধীনভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে কেউ যেন কাউকে উৎপীড়ন না করে, কষ্ট না দেয় এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ রয়েছে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ- ‘আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর শপথ! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! কে সে লোক? তিনি বললেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না’।[3] আরো বর্ণিত হয়েছে, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ‏لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ- ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[4]

৪. মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা : ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম মানুষকে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। হাদীছে এসেছে,كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ مَالُهُ، وَعِرْضُهُ، وَدَمُهُ حَسْبُ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ- ‘একজন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্পদ, সম্মান ও রক্ত (জীবনে হস্তক্ষেপ করা) হারাম। কোন ব্যক্তির নিকৃষ্ট প্রমাণিত হওয়ার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে’।[5]

৫. মান-সম্মানের নিরাপত্তা : সমাজে মানুষ তার আত্মসম্মান, ইয্যত-আব্রু ইত্যাদি নিয়ে গৌরবের সাথে বসবাস করতে চায়। ইসলামী বিচার ব্যবস্থা মানুষকে আত্মসম্মান নিয়ে জীবন যাপনের নিরাপত্তা প্রদান করে। যেমন-

মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ- ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হ’তে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হ’তে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা করে না তারাই যালেম’ (হুজুরাত ৪৯/১১)।

হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমদের গালি দেওয়া ফাসিক্বী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’।[6] অপর এক হাদীছে এসেছে,عَنْ حُذَيْفَةُ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ ‏لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ- ‘হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বললেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, চোগলখোর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[7] অন্যত্র এসেছে,عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِيءِ- ‘আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মু’মিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হ’তে পারে না, অভিসম্পাতকারী হ’তে পারে না, অশ্লীল কাজ করে না এবং কটূভাষীও হয় না’।[8]

৬. মত প্রকাশ ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা :

ইসলামী বিচার ব্যবস্থা মানুষকে তার স্বাধীন মতামত ও স্ব স্ব ধর্মীয় জীবন যাপনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। কাউকে জোর করে ধর্ম পালনে বাধ্য করা ইসলামে নিষিদ্ধ। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। যেমন আল্লাহর বাণী,لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ- ‘তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে’ (কাফিরূন ১০৯/৬)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, ইসলামের কোন বিধান লঙ্ঘন করার অধিকার রাখে না।

৭. অধিকার প্রদানে সমতা :

ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষই সমান। মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ইসলাম সকলের প্রতি সমান আচরণ করে থাকে। তাই ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় কোন লোক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। কেউ কোনভাবে নিগ্রহের শিকার হয় না। ফলে সমাজ জীবন শান্তিময় হয়ে উঠে। আল্লাহ বলেন,الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا- ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (নারীদের ভরণ-পোষণের জন্য) তাদের মাল-সম্পদ হ’তে ব্যয় করে থাকে। অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাযত করেছেন, আড়ালেও (সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে। আর যদি তোমরা তাদের অবাধ্যতার আশংকা কর, তাহ’লে তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের বিছানা পৃথক করে দাও এবং (প্রয়োজনে) প্রহার কর। অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তাহ’লে তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোচ্চ ও মহীয়ান’ (নিসা ৪/৩৪)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ- ‘আর কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (মায়েদা ৪/৮)

৮. সম্পদের সুষম বণ্টন :

ইসলামের আরও একটি কল্যাণমুখী অবদান হচ্ছে সম্পদের সুষম বণ্টন। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورً- ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২৭)। সম্পদ রক্ষার জন্য ইসলামে অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের মধ্যে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। কারণ সম্পদ অল্পসংখ্যক লোকের হস্তগত হয়ে যায়। তাই ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সমাজের সমগ্র সম্পদ যাতে পুঞ্জিভূত না থাকে সেজন্য আল্লাহ দুস্থ ও অসহায়দের মধ্যে সম্পদ বণ্টন করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (মধ্যে মীরাছ বণ্টনের) ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। যদি তারা দুইয়ের অধিক কন্যা হয়, তাহ’লে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি কেবল একজনই কন্যা হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক।

মৃতের পিতা-মাতার প্রত্যেকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ করে পাবে, যদি মৃতের কোন পুত্র সন্তান থাকে। আর যদি না থাকে এবং কেবল পিতা-মাতাই ওয়ারিছ হয়, তাহ’লে মা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু যদি মৃতের ভাইয়েরা থাকে, তাহ’লে মা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ মৃতের অছিয়ত পূরণ করার পর এবং তার ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী, তা তোমরা জানো না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। আর তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তোমরা অর্ধেক পাবে, যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি থাকে, তবে তোমরা সিকি পাবে, তাদের অছিয়ত পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। আর তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্ত্রীরা সিকি পাবে, যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। (নিসা ৪/১১-১২)। কোন বিত্তবান ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে তার সম্পদের বণ্টন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ এমনকি হত্যাকান্ডও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকার আইন ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়পরায়ণতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।

৯. যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা :

কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলাম যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্পদশালীদের উপর ইসলাম যাকাত ফরয করেছে। যেমন আল্লাহর বাণী- وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ‘ ‘তোমরা ছালাত প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত দাও’ (বাক্বারাহ ২/৪৩)

হাদীছে এসেছে, ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয (রাঃ)-কে ইয়ামানে প্রেরণকালে বললেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। তুমি (সর্বপ্রথম) তাদেরকে এ সাক্ষ্য দিতে আহবান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি (মুহাম্মাদ) আল্লাহর রাসূল। তারা তোমার এ কথা মেনে নিলে তাদেরকে অবহিত করবে, আল্লাহ তাদের উপর তাদের মালের যাকাত প্রদান ফারয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হবে এবং তাদের গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হবে’।[9]

১০. চুরি, ডাকাতি ও লুণ্ঠন প্রতিরোধ :

প্রাক-ইসলামী যুগে সম্পদের কোন নিরাপত্তা ছিল না। তখন মানুষ ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ইসলাম চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদি কঠোর হস্তে দমন করে এসব অপরাধীদের কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করেছে। পবিত্র কুরআনের বাণী-وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘আর যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে, তাদের হাত কেটে ফেল, তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আর আল্লাহ অতিশয় ক্ষমতাবান, মহা প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৫/৩৮)

চুরির শাস্তি প্রদান সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, ক্বাতাদাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত যে, আনাস (রাঃ) তাদেরকে বলেছেন, উকল এবং উরায়না গোত্রের কতিপয় লোক মদীনাতে নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করল। এরপর তারা নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা দুগ্ধপানে অভ্যস্ত লোক, আমরা কৃষক নই। তারা মদীনার আবহাওয়ায় তাদের নিজেদের জন্য অনুকূল বলে মনে করল না। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে একজন রাখালসহ কতগুলো উট দিয়ে মদীনার বাইরে মাঠে চলে যেতে এবং ঐগুলোর দুধ ও পেশাব পান করার নির্দেশ দিলেন। তারা যেতে যেতে হার্রা নামক স্থানে পৌঁছে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় কাফের হয়ে যায়। নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি তাদের অনুসন্ধানে তাদের পিছনে লোক পাঠিয়ে দেন। (তাদের পাকড়াও করে আনা হ’লে) তিনি তাদের প্রতি কঠিন দন্ডাদেশ প্রদান করলেন। ছাহাবীগণ লৌহ শলাকা দিয়ে তাদের চক্ষু উৎপাটিত করে দিলেন এবং তাদের হাত কেটে দিলেন। এরপর হার্রা এলাকার এক প্রান্তে তাদেরকে ফেলে রাখা হ’ল। অবশেষে এ অবস্থায়ই তারা মারা গেল। ক্বাতাদা (রহঃ) বলেন, এ ঘটনার পর নবী করীম (ছাঃ) প্রায়ই লোকজনকে ছাদাক্বা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতেন এবং মুছলা বা অঙ্গচ্ছেদ থেকে বিরত রাখতেন’।[10]

একটি দৃষ্টান্ত :

ইসলামী বিচার ব্যবস্থা ও প্রচলিত মানবরচিত বিচার ব্যবস্থার পার্থক্য হিসাবে আমরা সঊদী আরবের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারি। যানবাহন দুর্ঘটনাজনিত অপরাধসহ অন্য সকল প্রকার অপরাধ প্রবণতার হার সারা বিশ্বে কেবল বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশেও অপরাধ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান অবস্থায় রয়েছে। এমতাবস্থায় সঊদী আরবে সকল প্রকার অপরাধ প্রবণতার হার হ্রাস পাওয়া সত্যিই একটি বিস্ময়কর খবর বৈকি। সঊদী আরবে অপরাধের সংখ্যা কম হবার পেছনে যে দু’টি বিষয় কাজ করেছে। তন্মধ্যে একটি হ’ল, সেখানে কুরআনের আলোকে প্রচলিত অপরাধ দমনের বিজ্ঞানসম্মত আইন, অপরটি সে আইনের ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান সেখানে যতটুকু চালু আছে তার যথাযথ প্রয়োগ। এর সুফল প্রমাণ করে যে, কোন দেশে ইসলামী জীবন বিধান চালু থাকা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস বা নির্মূলে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। আইন শত ভাল হ’লেও তার যথাযথ প্রয়োগ না হ’লে তাতে আইন প্রণয়নের লক্ষ্য অর্জিত হয় না। অনেকেই আবার চোরের হাত কাটা ও ধর্ষকের বেত্রাঘাতের মত প্রকাশ্য শাস্তিদানের বিধিকে অমানবিক বলে অভিহিত করতে চান। তারা সুযোগ পেলেই এর বিরোধিতা করেন। তাদের ব্যাপারটা একান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত। আসলে তারা অপরাধের ফলে সৃষ্ট মানুষের দুঃখ-বেদনা ও ক্ষতির চাইতে শাস্তিকেই যেন বেশী খারাপ চোখে দেখেন। এটা তাদের এক প্রকার অপরাধ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ কি-না জানি না, তবে আল্লাহর দন্ডবিধির পেছনে যে মানবিক তাৎপর্য রয়েছে তা থেকে তারা চোখ বন্ধ করে রাখেন। কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে আসলে আল্লাহ রাববুল আলামীন অপরাধের বিলোপ করতে চেয়েছেন। যা সুস্থ সমাজ ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য অপরিহার্য। 

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায়, বিচার করা এবং শাস্তি প্রয়োগ করার মধ্যেই ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি নিহিত। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতীত কোন ব্যক্তির জন্য কোন প্রকার শাস্তি কার্যকর করা বৈধ নয়। আর দ্রুত বিচার কার্যকর করা তো ইসলামী বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। তথাকথিত প্রগতিশীলদের ধারণায় যেটা প্রগতির অন্তরায়। আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে যে বিচার ব্যবস্থা পেয়েছি তাতে বিচারকাজ খুবই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। অপরাধী হাতেনাতে ধরা পড়লেও সহজে তার শাস্তি হয় না। তাৎক্ষণিক অপরাধ অস্বীকার করতে না পারলেও পরবর্তীতে সে কথা ঘুরিয়ে ফেলে। এর সাথে যুক্ত রয়েছে ওকালতি পদ্ধতি। নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর অপরাধীও সেরা উকিল পেয়ে যায়। কালক্ষেপণের সাথে সাথে বাড়তে থাকে দুর্নীতি ও কালোটাকার খেলা। অন্যদিকে নিরীহ বিবাদী মামলা ও উকিলের খরচ বহন করে নিঃস্ব হ’তে থাকে। আল্লাহর দন্ডবিধান অনুপস্থিত বলেই আমাদের জীবন এবং সমাজে আজ অশান্তি, আতঙ্ক ও চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। দয়াময় আল্লাহ, সরকার, প্রশাসন ও জনগণকে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

-মুহাম্মাদ আব্দুন নূর

[লেখক : কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।]


[1]. বুখারী হা/১০।

[2]. বুখারী হা/১১।

[3]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৯৬২।

[4]. মুসলিম হা/৭৬।

[5]. আবূদাউদ হা/৪৮৮২।

[6]. বুখারী হা/৬০৫৬।

[7]. বুখারী হা/৬০৫৬।

[8]. তিরমিযী হা/১৯৭৭।

[9]. বুখারী হা/১৩৯৫; মুসলিম হা/১৯; মিশকাত হা/১৭৭২

[10]. বুখারী হা/৪১৯২; নাসাঈ হা/৩০৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৫০৩।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও