ইসলামী বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা (২য় কিস্তি)

মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 765 বার পঠিত

মানুষের জন্য শুধু বিচার নয় বরং সুবিচারের ব্যবস্থা থাকা যরূরী। যে সমাজে যুলম, নির্যাতন, ধর্ষণ, মারামারি, হানাহানি, চুরি-ডাকাতি হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ জনগণ সুবিচার পায় না, সে সমাজ মনুষ্য বসবাসোপযোগী সমাজ হতে পারেনা। পক্ষান্তরে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় বিচারের ক্ষেত্রে রয়েছে সবোর্চ্চ ন্যায়সংগত, নিরপেক্ষ ও আদর্শ ভিত্তিক সুবিচার ব্যবস্থা। 

ইসলামী বিচার ব্যবস্থার স্বরূপ:

ইসলামী বিচার ব্যবস্থা আদর্শিক নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। যেমন :

(১) পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা:

ইসলামী জীবন দর্শনে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থায় মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের যাবতীয় বিষয়ের নির্ভুল ও সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে ফয়ছালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করাতেই রয়েছে মানুষের যাবতীয় কল্যাণ।

আল্লাহ বলেন, وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ- ‘আর আমরা নির্দেশ দিচ্ছি যে, তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করবে এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো যেন তারা তোমাকে আল্লাহ প্রেরিত বিধানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে না ফেলে। কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখ যে, আল্লাহ চান তাদেরকে তাদের কিছু কিছু পাপের দরুন (পার্থিব জীবনে) শাস্তি প্রদান করতে। বস্ত্ততঃ বহু লোক নাফরমান হয়ে থাকে’ (মায়িদা ৫/৪৯)।

অন্যত্র বলেন, فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)।

উল্লেখ্য যে, দুই বদরী ছাহাবী যুবায়ের ও হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ (রাঃ)-এর মধ্যে জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া হয়। রাসূল (ছাঃ) উপরের জমিওয়ালা হিসাবে যুবায়ের (রাঃ)-এর পক্ষে রায় দেন এবং তার পানি সেচের পর নীচের জমিওয়ালার ভূমিতে পানি ছাড়তে বলেন। কিন্তু নীচের জমিওয়ালা তা মানতে চাননি। তখন অত্র আয়াত নাযিল হয়।[1] এ আয়াতের মধ্যে কবীরা গোনাহগারকে কাফের প্রমাণ করা ও তার রক্ত হালাল বলার কোন সুযোগ নেই। সেকারণ এখানে لاَ يُؤْمِنُونَ অর্থ لاَ يَسْتَكْمِلُونَ الْإِيمَانَ ‘তারা পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না’ (ফাৎহুল বারী)।

মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।

আর মুমিনদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হতে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরাই হল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)

(২) আমানতদারী ও ইনসাফ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা:

ইসলামী বিচার ব্যবস্থা ন্যায়ের ভিত্তিতে ফয়সালা করে এবং আমানতসমূহ হকদারের নিকটে পৌঁছে দেয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)।

ন্যায়বিচারকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে,وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ- ‘আর যদি ফায়ছালা কর, তবে ইনছাফপূর্ণ ফায়ছালা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার কারীদের ভালবাসেন’ (মায়িদা ৫/৪২)।

ন্যায়বিচার করার ক্ষেত্রে বাদী অথবা বিবাদী, ধনী হৌক বা গরীব হৌক, আতমীয় হৌক বা অনাত্মীয় হৌক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাংখী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)।

মহান আল্লাহ তা‘আলা কিতাব নাযিল করেছেন যাতে মানুষ ন্যায়বিচার পায়। আল্লাহ বলেন,لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ- ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও মীযান। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এজন্য যে, আল­াহ জেনে নিবেন কে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে না দেখে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্ল­াহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)।

ন্যায়বিচার আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (মায়িদা ৫/৮)।

ইনছাফ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার কয়েকটি দৃষ্টান্ত-

আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,جَلَدَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فِي الْخَمْرِ بِالْجَرِيدِ وَالنِّعَالِ وَجَلَدَ أَبُو بَكْرٍ أَرْبَعِينَ ‘মদপানের অপরাধে নবী (ছাঃ) গাছের ডাল এবং জুতা দিয়ে পিটিয়েছেন। আবূ বকর (রাঃ) চল্লিশটি চাবুক মেরেছেন।[2]

হাদীছে এসেছে, ‘সাইব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,كُنَّا نُؤْتَى بِالشَّارِبِ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَإِمْرَةِ أَبِي بَكْرٍ وَصَدْرًا مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ فَنَقُومُ إِلَيْهِ بِأَيْدِينَا وَنِعَالِنَا وَأَرْدِيَتِنَا حَتَّى كَانَ آخِرُ إِمْرَةِ عُمَرَ فَجَلَدَ أَرْبَعِينَ حَتَّى إِذَا عَتَوْا وَفَسَقُوا جَلَدَ ثَمَانِينَ রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর যুগে ও আবূ বকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে এবং ‘উমার (রাঃ)-এর খিলাফতের প্রথম দিকে আমাদের কাছে যখন কোন মদ্যপায়ীকে আনা হত তখন আমরা তাকে হাত দিয়ে, জুতা দিয়ে এবং আমাদের চাদর দিয়ে মারতাম। অতঃপর উমার (রাঃ)-তাঁর খিলাফাতের শেষ সময়ে চল্লিশটি ক’রে চাবুক মেরেছেন। আর এ সব মদ্যপায়ী যখন বাড়াবাড়ি করেছে এবং পাপে লিপ্ত হয়েছে তখন আশিটি করে চাবুক মেরেছেন।[3]

আশরাফ-আতরাফ (উঁচু-নীচু) সকলের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীআতের শাস্তি কায়েম করতে হবে। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেননা কোন সম্মানিত লোক যখন চুরি করত তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোন নীচু শ্রেণীর লোক চুরি করত তখন তার উপর ইসলামী শরী‘আতের শাস্তি প্রয়োগ করত।

হাদীছে এসেছে,عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّتْهُمْ الْمَرْأَةُ الْمَخْزُومِيَّةُ الَّتِي سَرَقَتْ فَقَالُوا مَنْ يُكَلِّمُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَمَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكَلَّمَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَتَشْفَعُ فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ ثُمَّ قَامَ فَخَطَبَ قَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا ضَلَّ مَنْ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ الضَّعِيفُ فِيهِمْ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم سَرَقَتْ لَقَطَعَ مُحَمَّدٌ يَدَهَا- আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। মাখযুমী গোত্রের এক মহিলার ব্যাপারে কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল, যে চুরি করেছিল। ছাহাবীগণ বললেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর সঙ্গে কে কথা বলতে পারবে? আর রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর প্রিয় জন উসামা (রাঃ) ছাড়া এটা কেউ করতে পারবে না। তখন উসামা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথা বললেন। এতে তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর শাস্তির বিধানের ব্যাপারে সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়িয়ে খুৎবা দিলেন এবং বললেন, হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা গোমরাহ হয়ে গিয়েছে। কারণ কোন সম্মানী ব্যক্তি যখন চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত তখন তার উপর শরীআতের শাস্তি কায়েম করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে অবশ্যই মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর হাত কেটে দেবে।[4]

হাদীছটি থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। যেমন :

(১) বিচারকের একই বিষয়ের ফায়সালায় দ্বৈত নীতি অবলম্বনের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন। (২) হুদূদ বা দন্ডের ব্যাপারে সুপারিশ নিষিদ্ধ। (৩) শাসকের কাছে বিচার পৌঁছলে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল হদ্দ কায়েম করা। (৪) চোরের তাওবা কবূল হওয়া। (৫) চুরির হদ্দ বা শাস্তির ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার একই বিধান। (৬) উসামা (রাঃ)-এর মর্যাদা। (৭) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ফাতেমা (রাঃ)-এর সুঊচ্চ মর্যাদা। (৮) হদ্দ বা দন্ড কায়েমের পরে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য কষ্ট অনুভব করা জায়েয। (৯) পূর্ববর্তী জাতির পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেয়া, বিশেষ করে যারা শারঈ বিধান লঙ্ঘন বা অমান্য করেছিল। (১০) হদ্দ বা দন্ড অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এমন ব্যক্তির উপর হদ্দ কায়েমের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব পরিহার করা, যদিও সে তার ছেলে অথবা নিকটাত্মীয় অথবা মর্যাদাবান ব্যক্তি হোক না কেন। (১১) হদ্দ কায়েমের ব্যাপারে খুব জোর দেয়া এবং যারা এ ব্যাপারে নমনীয় তাদের প্রত্যাখান করা। (১২) হদ্দ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সুপারিশের জন্য যারা হস্তক্ষেপ করে তাদেরও প্রত্যাখান করা (ফাতহুল বারী)।

(৩) পরামর্শ ভিত্তিক ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে বিচার ব্যবস্থা :

ইসলামে পরামর্শের গুরুত্ব অনেক। এমনকি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানুষ প্রেরণের ব্যাপারে ফেরেশতাদের নিয়ে পরামর্শ বৈঠক করেছিলেন। এর মাধ্যমে মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণ করেছেন এবং ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে-وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ- ‘আর তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (ইমরান ৩/১৫৯)।

আবার বিচারের কাজটি সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের উপরই নির্ভরশীল। সাক্ষীর সত্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে বিচারকার্য সঠিক হয়, মিথ্যা সাক্ষ্যের দরুণ আবার অন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামে এ ব্যাপারটির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে’ (নিসা ৪/১৩৫)।

যারা দুনিয়ার লোভে পড়ে অথবা স্বার্থ হাসিলের জন্য মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে তাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) কঠোর সতর্কারোপ করেছেন। হাদীছে এসেছেأَبِى بَكْرَةَ عَنْ أَبِيهِ - رضى الله عنه - قَالَ قَالَ النَّبِىُّ - صلى الله عليه وسلم « أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ » ثَلاَثًا . قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ «الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ» . وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ « أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ » . قَالَ فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ) এর কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ সম্পর্কে বলব না? এরূপ তিনবার বললেন। আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অথবা মিথ্যা কথা বলা। রাসূল (ছাঃ) হেলান দেয়া ছিলেন, তিনি বসলেন এবং বারবার একথা পূনরাবৃত্তি করলেন, এমনকি আমরা বললাম, হায়! যদি তিনি চুপ থাকতেন’।[5]

বর্ণিত আয়াতদ্বয়ে সাক্ষ্যদাতাকে আল্লাহ তা‘আলা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও কল্যাণে ন্যায়বিচারের স্বার্থে সাক্ষ্যদাতাকে সত্য সাক্ষ্য দিতে হবে। এজন্য কুরআনের বক্তব্যের দৃষ্টিতে সাক্ষীদেরকে আল্লাহর সাক্ষী হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে; কোন বিশেষ পক্ষের সাক্ষী নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচারককে যেমন ন্যায়পন্থী হওয়া যরূরী; তেমনি সাক্ষীকেও ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া আবশ্যক।

পবিত্র কুরআনে যারা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করেনা, তাদেরকে আল্লাহর নেক বান্দা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়। তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে’ (ফুরকান ২৫/৭২)।

অনুরূপভাবে সাক্ষ্যদানে কোন কিছু গোপন করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ- ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (বাক্বারা ২/২৮৩)।

(৪) ইজতিহাদ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা :

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় ইজতিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। কোন ক্ষেত্রে সরাসরি শরীআতে কোন আইন বর্ণিত না হলে সেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মৌলিক নীতিমালার আলোকে ইজতিহাদের সাহায্যে সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। ইসলামী শরী‘আতের এ অংশের আইন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল।

ইজতেহাদ ইসলামী শরী‘আতে যেহেতু এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই যে কেউ ইজতেহাদ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে এমন নয়। এজন্য বিশেষ কিছু যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকারী হওয়া যরূরী। এ কারণে শরী‘আতে ইজতেহাদকারীর জন্য বেশকিছু শর্ত বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতের উপর মুজতাহিদের দৃঢ় ঈমান থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী হতে হবে। ইজতেহাদকারীর আররী ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। কারণ কুরআন মাজীদ এবং মহানবী (ছাঃ) এর সুন্নাহর ভাষা আরবী। এমনকি ইসলামী আইনের উপর এ পর্যন্ত যেসব মৌলিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার ভাষাও আরবী। কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে ইজতিহাদ কারীর গভীর প্রজ্ঞা থাকতে হবে। যাতে তিনি তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে পারেন ও মর্মমূলে পেঁŠছাতে সক্ষম হন।

(ক্রমশঃ)

মুহাম্মাদ আব্দুর নুর

লেখক : কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ


[1]. বুখারী হা/৪৫৮৫; মুসলিম হা/২৩৫৭; ইবনু আবী হাতেম হা/১৭৭৪; তাফসীর ইবনু কাছীর।

[2]. বুখারী হা/৬৭৭৬।

[3]. বুখারী হা/৬৭৭৯।

[4]. বুখারী হা/৬৭৮৮।

[5]. বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৮।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও