পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন ও তা থেকে মুক্তির উপায় (২য় কিস্তি)

মফীযুল ইসলাম 8727 বার পঠিত

দৃষ্টিশক্তির উপর ক্ষতিকর প্রভাব :

ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার ৯০% কল্যাণ বা অকল্যাণ লাভ করে থাকে দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে। দৃষ্টিশক্তিই সকল অঘটন ঘটানোর অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। পর্ণোগ্রাফীর কারণে যত পাপ সংঘঠিত হয় তার মূল দায়ী চোখ। কারণ সর্বপ্রথম চোখই অনলাইনে বা মিডিয়া ছড়িয়ে থাকা জঞ্জাল দেখে ও অন্তরে কামন-বাসনা সৃষ্টি করে এবং শরীরের বাকী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যভিচারের মত অশ্লীল পথ বেছে নেয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ  বলেন, قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ-وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا- ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত’ (নূর ২৪/৩০-৩১)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ، وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ -  ‘লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, চক্ষু অবনত রাখবে এবং হাতকে সংযত রাখবে’।[1] রাসূল (ছাঃ) কুদৃষ্টিকে চোখের যেনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি বলেন, إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ حَظَّهُ مِنَ الزِّنَى أَدْرَكَ ذَلِكَ لاَ مَحَالَةَ فَزِنَى الْعَيْنَيْنِ النَّظَرُ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক আদম সন্তানের জন্য যেনার কিছু অংশ নির্ধারণ করেছেন। যা সে অবশ্যই করবে। চোখের যেনা হ’ল অবৈধভাবে কারোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া।[2] অতএব টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন নগ্ন-অর্ধনগ্ন, যৌন উত্তেজনাকর দৃশ্য দেখা চোখের যেনা। লাখো যুবক-যুবতী চোখের যেনা করছে এরই মাধ্যমে। এজন্য পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন থেকে বাঁচার প্রধান  মাধ্যম হ’ল দৃষ্টিশক্তি সংযত রাখা।

নগ্নতা দেখার প্রতি তীব্র আকর্ষণ :

বিশ্বায়নের এই যুগে ইন্টারনেটে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সামনে খুলে যাচ্ছে গোটা এক পৃথিবী। অনলাইনে ছড়িয়ে থাকা পর্ণো মানুষের জমি-জায়গা দখল না করলেও অশ্লীলতা দেখার মন-মানসিকতা দখল করতে সক্ষম হচ্ছে। যার ফলে এ দেশে নগ্নতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা দিন দিন ব্যাপকহারে বেড়েই চলেছে।

সময় ক্ষেপণ :

মানুষের জীবন হলো সময়ের সমষ্টি, যা অতি মূল্যবান। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সময়ের মূল্যায়ন শিক্ষা দেওয়ার জন্য সূরা আছর নাযিল করেছেন। কিন্তু বনী আদম আজ ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কুফলে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ক্ষেপণ করছে। এমনকি ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো নষ্ট করছে। ক্বিয়ামতের মাঠে তাকে গোটাজীবনের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে তা সে ভুলে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ-  ‘কিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগপর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে সরতে পারবে না। ১. তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে অতিবাহিত করেছে? ২. তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কি কাজে তা বিনাশ করেছে। ৩. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা হতে তা উপার্জন করেছে ৪. এবং তা কি কি খাতে খরচ করেছে ৫. এবং সে যত টুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মুতাবিক কি কি আমল করেছে’।[3]

অতএব অশ্লীলতা দেখে মূল্যবান সময় নষ্ট করা এবং আল্লাহর কাছে হিসাব দেয়া থেকে সাবধান থাকুন। আরবী প্রবাদ রয়েছে, الوقت كالسيف، إن لم تقطعه قطعك- 

‘সময় তলোয়ারের ন্যায়। যদি তুমি তাকে কাটতে না পার (ভালো কাজে নিঃশেষ করতে না পার)। তবে সে তোমাকে কেটে ফেলবে (ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পোঁছিয়ে দিবে)’।

শত্রুকে বন্ধু রূপে গ্রহণ :

রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُوشِكُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمُ الأُمَمُ مِنْ كُلِّ أُفُقٍ كَمَا تَدَاعَى الأُكَلَةُ عَلَى قَصْعَتِهَا. قَالَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَمِنْ قِلَّةٍ بِنَا يَوْمَئِذٍ قَالَ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ وَلَكِنْ تَكُونُونَ غُثَاءً كَغُثَاءِ السَّيْلِ يَنْتَزِعُ الْمَهَابَةَ مِنْ قُلُوبِ عَدُوِّكُمْ وَيَجْعَلُ فِى قُلُوبِكُمُ الْوَهَنَ. قَالَ قُلْنَا وَمَا الْوَهَنُ قَالَ حُبُّ الْحَيَاةِ وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ. ‘অদূর ভবিষ্যতে সকল জাতি চতুর্দিকে পরস্পরকে আহবান করে তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। যেভাবে ভোজনকারীরা ভোজনপাত্রের উপর একত্রিত হয়ে, এক সাথে মিলে ভোজন করে। কোন এক ছাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কি আমরা সংখ্যায় কম থাকব, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, না কিন্তু তোমরা হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত। তোমাদের শক্রুদের হৃদয় থেকে তোমাদের প্রতি ভীতি তুলে নেওয়া হবে এবং তোমাদের হৃদয়ে দুর্বলতা প্রক্ষিপ্ত হবে। আর সে দুর্বলতা হল, দুনিয়াকে ভালোবাসা মরণকে অপসন্দ করা’।[4] মহান আল্লাহ বলেন,لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَه-‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী  এমন কোন দল তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালোবাসে’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)। প্রতিনিয়ত চলমান সিনেমা, টিভি সিরিজ যা আমরা দেখছি আসলে তা আমাদের চিরশক্রদের তৈরী ফাঁদ। ফলে আমাদের জান-মালের চিরশক্র শুধু আমাদের ঘরেই নয় বরং আমাদের অন্তরাত্মায় ঢুকে বন্ধুর মত অবস্থান করছে এবং আমাদেরকে তাদের অপসংস্কৃতির নোংরামির মাধ্যমে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে দিচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ ‘তোমরা ইহুদী-খ্রিষ্টানকে বন্ধু রূপে গ্রহণ কর না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। আজ মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্য সকল বাতিল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আর মুসলমান তাদের তৈরীকৃত সিনেমা, নাটক, পর্ণোগ্রাফী দেখে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, অর্থ-সম্পদ ধ্বংস করছে। বিলাসিতায় মেতে উঠছে। হিংসা-বিদ্বেষ নিজেদের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত করছে। ফলে মুসলিম ঐক্যশক্তি ভেঙ্গে খান খান হচ্ছে। এ সমস্ত কারণে মুসলমানরা আজ কাফিরদেরকে ভয় করতে শুরু করছে। অথচ তারাই হলো আদর্শবান জাতি।

ইসলামী আদর্শ ম্লান :

সাম্প্রতিককালে মানুষ হয়ে পড়ছে দুনিয়া পূজারী। মুসলমানরাও তা থেকে পিছিয়ে নেই। তাই তারা দুনিয়া করতে গিয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে নিজেদের ও নিজেদের ছেলে মেয়েদেরকে দূরে রাখছে। ফলে তারা বুদ্ধিহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছে। মুসলিম জাতি আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত, অপদস্থ ও পদদলিত হওয়ার মূল কারণ হল  حُبُّ الدُّنيا وكراهةُ الموتِ ‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মরতে না চাওয়া’।[5] দুনিয়ার শান-শওকত, উন্নত চাকzুর- বাকুরি, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, আনন্দ-বিনোদনের জন্য উন্নত তথ্য-প্রযুক্তি এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত হয়ে পড়ার ফলে প্রকৃত শিক্ষা তারা হারাচ্ছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ ‘মহান আল্লাহ এই গ্রন্থ (কুরআন) দ্বারা কোন জাতিকে উন্নত করেন এবং এরই দ্বারা অন্য জাতিকে অপমানিত করেন।[6] কিন্তু দুনিয়ার লোভ-লালসা ও পর্ণোগ্রাফীর ড্রাগ সে আদর্শ অর্থাৎ কুরআন শিখতে এবং তা অনুসরণ করতে মারাত্মকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে দিন দিন মুসলমানদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র ইসলামী আদর্শ ম্লান হতে শুরু করেছে। আর সেই স্থান দখল করছে শয়তানী আদর্শ। এরই কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ  ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সেই হয় তার সঙ্গী’ (যুখরুফ ৪৩/৩৬)। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সুন্দর এই মুসলিম দেশে শয়তানী আদর্শ যাতে প্রতিষ্ঠিত হ’তে না পারে সে ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানকে সোচ্চার হ’তে  হবে।

অন্তর রোগাগ্রস্ত :

শারীরিক রোগের চেয়ে বহুগুণ জটিল হলো অন্তরের রোগ। গবেষকরা বলেন, পর্ণোগ্রাফী এমন এক রোগের নাম, যা ঘুম নষ্ট করে, ক্ষুধা হ্রাস করে ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং চোখ-কান মোবাইল কার্ড ও ইন্টারনেট কানেকশনের সাথে সংযুক্ত করে। অনলাইন, বিলর্বোড ও পত্র-পত্রিকার লক্ষ পর্ণোগ্রাফী যুবক-যুবতীর অন্তরকে যৌন বিকারগ্রস্ত করছে। আর তাদের অন্তরে ভোগ ও সুখের অলীক অবাস্তব ধারণা সৃষ্টি করছে। মনে রাখা ভালো হবে, আত্মার খোরাক হলো আল্লাহর ইবাদত করা। এটি না করে কেউ কোন দিন দুনিয়া ও আখিরাতে প্রশান্তি লাভ করতে পারে না।

কুমারিত্ব নষ্ট :

যে সমস্ত দেশে পর্ণোগ্রাফী আমদানী হয়ে থাকে, সে দেশের মেয়েরা ১৪ বছর বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তে কুমারিত্ব হারায়। বাংলাদেশের মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের ২০১৫ সালের এক জরিপে জানা যায়, ঢাকার একটি স্কুলে নবম শ্রেণীর মোট ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসরুমে বসে পর্ণো দেখে এ রকম ২৫ জনের মোবাইলে পর্ণোগ্রাফী পাওয়া যায়। সম্প্রতি এক খবরে জানা গেছে যে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদের মোবাইল ফোন ভেঙ্গে দিয়েছেন। কারণ ক্লাসে তাদের মনোযোগ নেই; মোবাইলের পর্ণো দেখায় তারা ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মোবাইলে পর্ণোগ্রাফী পাওয়া যাবে, যা তারা নিত্যদিন উপভোগ করছে। ইন্টারনেট ও ইউটিউবের পর্ণো প্রতিনিয়ত এদেশের লাখ তরুণীর মধ্যে যৌনতার সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ফলে বিবাহের পূর্বেই অনেকেই কুমারিত্ব খোয়াচ্ছেন। যা পরবর্তী বংশধরদের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং ব্যক্তির জন্য পরকালে ভয়ংকর শাস্তি কারণ। মহান আল্লাহ বলেন, الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ‘ব্যভিচারী নারী-পুরুষ তাদের প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত কর’ (নূর ২৪/২)। উবাদা বিন ছামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেছেন, الْبِكْرُ بِالْبِكْرِ جَلْدُ مِائَةٍ وَنَفْيُ سَنَةٍ وَالثَّيِّبُ بِالثَّيِّبِ جَلْدُ مِائَةٍ وَالرَّجْمُ অর্থাৎ ‘অবিবাহিতা যুবক-যুবতীর (ব্যভিচারের) শাস্তি হ’ল একশ’টি বেত্রাঘাত ও এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ ও মহিলার শাস্তি হচ্ছে, একশ’টি বেত্রঘাত ও রজম তথা পাথর মেরে হত্যা’।[7]

মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহা :

মুক্তমনা পর্ণোগ্রাফীর ড্রাগে আসক্ত ব্যক্তিরা বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচারে মুগ্ধ হয়ে লাগামহীন চাল-চলনে দিন দিন মেতে উঠছে। মুসলিম দেশের শারঈ বিধি-বিধান মেনে চলাফেরা তাদের কাছে বড় জ্বালাময়-পীড়াদায়ক। তারা স্বদেশে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘যারা পসন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে। আর আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জান না’ (আম্বিয়া ২৪/১৯)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, وَالَّذِينَ يَمْكُرُونَ السَّيِّئَاتِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَكْرُ أُولَئِكَ هُوَ يَبُورُ ‘যারা অন্যায় কাজের চক্রান্তে লেগে থাকে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (ফাতির ৩৫/১০)। কাফিরদের দুনিয়াবী ভোগ-বিলাসিতা ও অশ্লীল চলাফেরা দেখে যারা আকৃষ্ট ও অনুসারী হয় এবং মুসলিমদেরকে সেকেলে ভাবতে থাকে তারাই বড়ই অভিশপ্ত।

ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু :

আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী, খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরমাণু  বোমার চেয়ে  অধিক শক্তিশালী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষীদের তৈরীকৃত ফিল্ম, পর্ণোগ্রাফী। মুসলমানদের শত্রুরা এই ঘাতক নীরব যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, শক্তি এমন কি তাদেরকে পৃথিবীর  বুক থেকে নৎসাত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। আল্লাহ বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ  ‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায় (অর্থাৎ ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দিতে চায়)। কিন্তু আল্লাহ তার নূরকে পরিপূর্ণ করবেনই যদিও কাফিররা (তা) অপসন্দ করে’ (ছফফ ৬১/৮)। একশ্রেণীর মুসলিম তাদের দেয়া টোপে ফেঁসে গিয়ে ঈমান-আক্বীদা ধ্বংস করে তাদের মত চিরঅভিশপ্ত হচ্ছে।

আর্থিক ক্ষতি :

অনলাইনের অশ্লীলতা দেখতে অভ্যস্ত ভ্যানচালক, রিকশাচালক, ছাত্র-শিক্ষক, জ্ঞানী-মূর্খ, প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষ। এজন্য ইন্টারনেটের কানেকশন ও এমবি কিনতে ব্যয় করছে তারা শত-শত টাকা। ২০১১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সারা বিশ্বের লোক পর্ণো দেখায় ব্যয় করছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। টাকায় যার পরিমান  ১২১৫৭৫০০০০০। এরই মাধ্যমে আমাদের জান ও মালের শত্রুরা আমাদেরকে আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে লাভবান হচ্ছে। পর্ণো ইন্ডাস্ট্রিগুলো কোটি কোটি টাকা আয় করছে ভাসমান এ পতিতা ব্যবসার মাধ্যমে। অশ্লীলতায় আসক্ত বন্ধু! ক্বিয়ামতের দিন আমাদেরকে অর্থ কোন পথে ব্যয় হয়েছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে। কাজেই অবৈধ পন্থায় অর্থ ব্যয় সেদিন ধ্বংসের কারণ হবে।

প্রিয় সঙ্গীর মিলনকে জাগ্রত করণ :

পর্ণোগ্রাফীর পরশে আজ যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী মাঠে নেমেছে অবৈধ সঙ্গীর তালাশে। এরই দৌরাত্বে যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীর মধ্যে অশ্লীল কামনা-বাসনা জাগ্রত হচ্ছে। যার প্রতিফল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরে, উদ্যান-পার্কে দৃশ্যমান। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا تَفْنَى هَذِهِ الْأُمَّةُ حَتَّى يَقُومَ الرَّجُلُ إِلَى الْمَرْأَةِ فَيَفْتَرِشَهَا فِي الطَّرِيقِ، فَيَكُونَ خِيَارُهُمْ يَوْمَئِذٍ مَنْ يَقُولُ لَوْ وَارَيْتَهَا وَرَاءَ هَذَا الْحَائِطِ- ‘সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, এ উম্মত ধ্বংস হবে না যতক্ষণ না কোন এক ব্যক্তি কোন মহিলার সাথে রাস্তায় সঙ্গম করবে। আর তখন সর্বোত্তম লোকটি হলো সে, যে সাহস করে বলবে যে, যদি মহিলাটাকে একটু দেওয়ালের পিছনে নিয়ে যেতে’।[8] হাদীছে আরও এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَتَسَافَدُوا فِي الطَّرِيقِ تَسَافُدَ الْحَمِيرِ قُلْتُ: إِنَّ ذَاكَ لَكَائِنٌ؟ قَالَ: نَعَمْ لَيَكُونَنَّ- আব্দুল্লাহ বিন আমর বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না যতদিন পর্যন্ত না গাধার ন্যায় রাস্তায় সঙ্গম বা যৌন মিলন সংগঠিত হয়। আমি বললাম তা কি অবশ্যই হবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। তা অবশ্যই ঘটবে’।[9] আর এ সমস্ত নোংরামি হলো টিভির সিনেমা, নাটক, বিভিন্ন সিরিয়াল ও পর্ণোগ্রাফী নিয়ে মত্ত থাকার বাস্তব ফসল।

ধর্মান্ধতা সৃষ্টি :

মহান আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ  ‘পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক ৯৬/১)। তিনি আরো বলেন,  فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ অতএব জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারে কোন মা‘বূদ নাই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। বাতিলের নোংরা ছোবল থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। কিন্তু আজ মুসলমানরা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন মনে করছে না। ফলে তারা অন্যায়, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।

অবাধ মেলামেশা :

অনলাইনে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ অবাধ মেলামেশার দৃশ্য, মোড়ে মোড়ে সাঁটানো চলচ্চিত্রের অশ্লীল দৃশ্য প্রতিনিয়ত এদেশের মুসলিম তরুণ-তরুণীকে ব্যভিচারসহ নানা পাপে জড়িয়ে পড়তে উস্কানি দিচ্ছে। ফলে বিবাহ বাড়িতে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, চাকুরির ময়দানে, বিভিন্ন মেলায়-খেলায়, বাজারে-মার্কেটে, উদ্যান-পার্কে চলছে নারী-পুরুষের অবাধ মিলন মেলা। আর আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার প্রভু হারাম করে দিয়েছেন, প্রকাশ্য অপকাশ্য সব ধরণের অশ্লীলতা, পাপের কর্ম’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা গোপনে প্রণয় কর না’ (মায়েদাহ ৫/৫)। শরী‘আত অবাধ মেলামেশার দিকটা কঠোরভাবে দেখলেও পর্ণোগ্রাফীভোক্তারা তাদের পরিবারে তা জিইয়ে রেখেছে।  আল্লাহ এদের শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ  ‘সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (নূর ২৪/৬৩)। এত সতর্কবাণী থাকার সত্ত্বেও এক শ্রেণীর স্বামী রয়েছেন যারা তাদের স্ত্রীদেরকে মাথা, গলা, বুক, পেট, পিঠ আলগা করে বিভিন্ন রংয়ে বিভিন্ন ঢংয়ে সাজিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে, বিভিন্ন পার্টিতে ও উদ্যান-পার্কে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ান। এরাই হলো অশ্লীলতা প্রশ্রয়দানকারী দাইয়ূছ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ثلاثةٌ لا يدخلونَ الجنةَ :  العاقُّ لوالديهِ ، والمُدْمِنُ الْخَمر والدَّيُّوثُ ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। মাতার-পিতার অবাধ্য সন্তান, (নিয়মিত) মদে আসক্ত ব্যক্তি এবং দাইয়ূছ অর্থাৎ এমন বেহায়া ব্যক্তি যে তার পরিবারে অশ্লীলতাকে মেনে নেয় প্রশ্রয়দান করে’।[10]

বেশ্যাবৃত্তির দ্বার উন্মুক্ত :

আমরা এমন দেশে বাস করি যে দেশে বেশ্যাবৃত্তির মতো নোংরা জঘন্য পাপকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাসূল (ছাঃ) বেশ্যাবৃত্তির উপার্জনকে হারাম ঘোষণা করেছেন’।[11] নারীকে যৌনকর্মী নামে দিয়ে দেহব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থকে তিনি ‘খাবিস বা অপবিত্র বলেছেন’।[12] যে সমস্ত ছাত্রীরা পড়লেখার স্বার্থে এই নোংরা কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা অবশ্যই ইহকাল পরকাল বরবাদ করছে। আর এই নোংরামির বড় ইন্ধনদাতা হলো পর্ণোগ্রাফী।

ধর্ষণের শিকার :

অশ্লীল ছবি বা পর্ণোগ্রাফী দর্শকের চরিত্র বিরল প্রকৃতির হয়ে ওঠে। সুতরাং নোংরাকাজ, ইভটিজিং, শিশু অপহরণ ইত্যাদির মতো অপরাধ তার জন্য স্বাভাবিক আচরণ হয়ে যায়। ধর্ষণ, হত্যা, গুম এগুলো দেশের এখন নিত্য দিনের কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ধর্ষণের মূলে রয়েছে নগ্ন-অর্ধনগ্ন পোশাক পওে নারীদের বেপরোয়া চলাফেরা। তাদেরকে নগ্ন-অর্ধনগ্ন হতে শিখিয়েছে পর্ণোগ্রাফী। নারীদের নির্লজ্জ চলাফেরা শত শত যুবকের অন্তরে যৌন কামনা-বাসনা জাগ্রত করছে। ফলে তারা বেছে নিচ্ছে ধর্ষণের মতো নোংরা পথ। ধর্ষণ ঠেকানোর মহা ঔষুধ নাযিল করে মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا  ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, তোমার কন্যাদেরকে ও মুসলিম নারীদেরকে বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদরের  কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয় (যখন তারা বাড়ির বাইরে যায়), এতে তাদের চেনা সহজতর হবে এবং তাদেরকে উত্যক্ত (ইভটিজিং) করা হবে না। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু’ (আহযাব ৩৩/৫৯)।

পর্দাহীনতা :

পর্দা ইসলামী শরী‘আতের একটি আবশ্যকীয় বিষয়। যার অভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কলুষিত হচ্ছে। ইন্টারনেটে যত নারীর ছবি ছড়িয়ে আছে তার সবই প্রায় পর্দাহীন। এছাড়াও বিভিন্ন সিরিয়াল, সিনেমার অভিনেত্রীরা সকলেই বেপর্দানশীল। ফলে তাদের অনুকরণে মুসলিম নারীদের কাছ থেকে পর্দা চিরতরে বিদায় নিচ্ছে। এর পর্ণোর দৌরাত্বে তারা পর্দাপ্রথাকে বিলকুল সেকেলে ভাবতে শুরু করেছে। সভ্যতার নামে নগ্ন লেবাস পরছে। নগ্নতাই যদি সভ্যতা হয়, তাহলে পশুরাই তাদের চাইতে বেশি সভ্য।

বংশের উপর প্রভাব :

মহান আল্লাহ বলেছেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا  ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে  এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও বংশে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার’ (হুজরাত ৪৯/১৩)। বংশ টিকিয়ে রাখার একমাত্র মাধ্যম হলো ইসলামী পন্থায় বিবাহ। কিন্তু আজ পশ্চিমা বিশ্বের মত অবৈধ পন্থায় যৌনতা চরিতার্থ করণের ফলে আমাদের সমাজে বংশগত ধারা মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

পর্ণোগ্রাফীর নেশা :

পর্ণোগ্রাফী আজ ড্রাগের মত কাজ করছে। এটা মাদকের নেশা অপেক্ষা কোন অংশে কম নয়। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষ যখন কোন উত্তেজনাকর ছবি দেখে তখন তার ব্রেনের মধ্যে নানা ধরনের নিউরন সেকরেশন হতে থাকে এবং আশে-পাশে যা কিছু থাকে তার মাধ্যমে সেই ক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায়। এরই ফলে তাদের মধ্যে দেখা যায় অস্থিরতা। শুরু হয় সামাজিক অনাচার। কেউ কেউ আসক্ত হয়ে পড়ে নেশায় এবং সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।[13] পর্ণোগ্রাফীর আসক্তিতে প্রতি বছর আমেরিকার স্কুল পড়ুয়া ২৮,০০০ শিক্ষার্থী গর্ভবর্তী হচ্ছে। অন্য এক জরিপে বলা হয়েছে, ১৪-১৬ বছর বয়স্ক ২৫২ জন তরুণীর মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ তরুণী সিনেমা (পর্ণোগ্রাফী) দেখার ফলে অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হয়েছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর এক জরীপে বলেন, ঢাকায় স্কুল পড়ুয়া অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের শতকরা ৭৭ ভাগ পর্ণোগ্রাফী দেখে। বিদেশী এক বালক তার ই-মেইলে লিখেছেন, আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চাই (অবশ্য আত্মহত্যা মহাপাপ, সে জাহান্নামে যাবে), আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। ১১ বছর বয়স থেকে ইন্টারনেটের নোংরামি-জঞ্জাল দেখছি। আমার বাবা-মা কিছু জানে না। আমি দেখি আর কাঁদি। এ সমস্যা শুধু একজন বিদেশী বালকের নয় বরং শত সহস্র মুসলমান বালক-বালিকারও।

মস্তিষ্কের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব :

নোংরামি, অশ্লীলতা-পর্ণোগ্রাফী দেখা একটি জঘন্য ক্ষতিকর অভ্যাস। যার ফলে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ Fronta Loob নষ্ট হয়ে যায়। Cambridge University -এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, Pornography দর্শনের ফলে দর্শকের মস্তিষ্ক মাদক দ্রব্য সেবনকারীর মস্তিষ্কের মত হয়ে যায়। গবেষক Gordon’s Bruin বলেন, ‘আমরা ২০ বছর নোংরা ফিল্ম দর্শনের অভ্যাসীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে লক্ষ্য করছি। যৌন মিলনের পর্ণো বা ফিল্ম দেখার অভ্যাস মাদক দ্রব্য সেবনের মতো একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি। মাদক সেবন না করে যেমন অভ্যাসীদেও মনে শান্তিত আসে না, ঠিক তেমনই অবস্থা ঘটে পর্ণো দর্শনে অভ্যস্তদের। অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এর মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ২৮,০০০ মানুষ নোংরা সাইটে প্রবেশ করছে এবং পশুবৎ যৌনমিলন দর্শন করছে। ২০০৬ ও ২০১১ সালের এক জরীপে বলা হয়েছে, প্রতি সেকেন্ডে পর্ণো দেখছে ২৮২৫৮ ও ৩৫০০০ মানুষ।[14] এখন তো এর সংখ্যা আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে। দুঃখের বিষয় হলো এদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মহিলা। এর ফলে এত বিশাল সংখ্যক মানুষের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে নোংরা, অকেজো ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী দৃশ্য দেখার সাথে সাথে Dopamine, Oxytocin, Testosterone  পদার্থ ক্ষরণ হতে থাকে এবং এমন তুফান সৃষ্টি করে যা মস্তিষ্ককে তছনছ করে ফেলে। ব্রেনের সিস্টেমকেই অস্বাভাবিক করে তোলে এবং পড়াশোনার সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়ে। তাতে ব্রেনের গুরুত্বপূর্ণ কোষ নষ্ট হতেও পারে। নোংরা, অশ্লীল, যৌনমিলনের ভিডিও দেখার সময় Dopamine পদার্থ খুব বেশী আকারে বের হতে থাকে। আর তার ফলে মস্তিষ্কের সম্মুখ অংশ দুর্বল হতে থাকে। পরিশেষে সর্বনাশই তাদের ভাগ্যে জোটে।[15]

সারশূন্য ইবাদত :

দিন দিন আল্লাহর ইবাদত ও শুকর গুযারকারী বান্দার সংখ্যা কমে আসছে। যারা ইবাদত-বন্দেগী করছেন তাদের অধিকাংশের আমলের মধ্যে ইখলাছ, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতার অভাবে ইবাদত হচ্ছে সারশূন্য। আর এর অন্যতম কারণ হলো পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন ও অশ্লীলতা দর্শন। আজ প্রায় প্রতিটি মুসলিম যুবক ব্যবহার করছে স্মার্টফোন, টিভি, কম্পিটার, ল্যাপটপ। প্রতিনিয়ত তাতে চর্চা হচ্ছে ছায়াছবি, বিভিন্ন নোংরা সিরিয়াল, নীলদর্শন, নোংরা ফিল্ম ও পর্ণোগ্রাফীর। অশ্লীলতার দর্শক নারী-পুরুষ মুছল্লী ছালাতের মধ্যেও ঐ সমস্ত নোংরামির ধ্বংসাত্মক ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ছালাতের মধ্যে ঐ সমস্ত নোংরামী চিন্তা তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। ফলে ছালাতের পরিপূর্ণ ছওয়াব থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يا أيها الناس أخلصوا أعمالكم للّه عزّ وجل فإن اللّه لا يقبل من الأعمال إلا ما خلص له ‘হে মানব জাতি! একানিষ্ঠভাবে আমল কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ একনিষ্ঠ আমল ছাড়া কোন আমল কবুল করেন না’।[16]  অন্যত্র তিনি বলেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ  ‘তুমি এমনভাবে ইবাদত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, আর যদি তা না হয় তাহলে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[17] ইবাদতে স্মরণ থাকবে একমাত্র আল্লাহর, অন্য কোন কিছুর নয়। অবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দৈহিক আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন’।[18]

পরিবারে অধঃপতন :

পরিবার হলো দুনিয়ার শান্তি-সুখের নীড়। কিন্তু মানুষরূপী শয়তানরা একে বিভিন্ন মাধ্যমে অশান্তির নীড়ে পরিণত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত আছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি পরিবারে বা ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পর্ণোগ্রাফী নামক সংক্রামক ব্যাধি। যে ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে পরিবারের সদস্যরা। যার কারণে অধিকা       ংশ পরিবার থেকে বিদায় নিচ্ছে  নৈতিকতা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাঁটল ধরছে এবং একে অপরের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ঝগড়া-ফাসাদ, গালি-গালাজ, একে অপরের উপর চড়াও হওয়া প্রভৃতি পরিবারে সদস্যদের নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,  الْمُسْتَبَّانِ شَيْطَانَانِ يَتَهَاتَرَانِ ‘উভয় গালমন্দকারী দুই শয়তান। এরা পরস্পরের উপর মিথ্যা দোষারোপ করে এবং অসত্য বলে’। [19]

সংসারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করণ :

শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গ প্রতিনিয়ত আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিটি সংসারে দ্বন্দ্ব সংঘাতের আগুন দাঊ-দাঊ করে প্রজ্জ্বলিত করার অপতৎপরতায় লেগে আছে। আর সেই আগুনে জ্বলে ছারখার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

إِنَّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِىءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُولُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِىءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ - قَالَ - فَيُدْنِيهِ مِنْهُ وَيَقُولُ نِعْمَ أَنْتَ . قَالَ الأَعْمَشُ أُرَاهُ قَالَ  فَيَلْتَزِمُهُ

‘ইবলীস শয়তান পানির উপর তার সিংহাসন রেখে (ফিতনা ও পাপের) অভিযানে সৈন্য পাঠায়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তার নৈকট্য লাভ করে সে, যে সবচেয়ে বড় ফিতনা সৃষ্টি করতে পারে। অতঃপর প্রত্যেকে কাজের হিসাব দেয়, বলে, আমি এই করেছি। সে বলে, তুমি  কিছুই করনি। একজন এসে বলে, আমি এক দম্পতির মাঝে ঢুকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহ বাধিয়ে পরিশেষে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছেড়েছি। তখন শয়তান সিংহাসন ছেড়ে উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ। (তুমিই কাজের মত) কাজ করেছ’।[20]

শয়তানের অনুসরণ :

যে খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে সে মূলত শয়তানের অনুসরণ করে। আর পর্ণোগ্রাফীভোক্তার অধিকাংশ সময় মন যা চায় তাই করে। মূলত শয়তানই হলো এর হোতা। আল্লাহ বলেন, الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ ‘শয়তান নোংরা, অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়’ (নূর ২৪/২১)। (চলবে)

 [লেখক : ৪র্থ বর্ষদাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]


[1]. হাকেম হা/৮০৬৬; মিশকাত হা/৪৮৭০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৭০।

[2]. আবু দাউদ হা/২১৫২।

[3]. তিরমিযী হা/২৬০১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৪৬; মিশকাত হা/৫১৯৭।

[4]. আহমাদ হা/২৩০৬০; আবু দাউদ হা/৪২৯৭; মিশকাত হা/৫৩৬৯।

[5]. আবু দাউদ হা/৪২৯৯; আহমাদ হা/২২৩৯৭।

[6]. মুসলিম হা/৮১৭।

[7]. মুসলিম হা/১৬৯০; আবু দাউদ হা/৪৪১৫; তিরমিযী হা/১৪৩৪;  ইবনু মাজাহ হা/২৫৯৮।

[8]. মুসনাদে আবী ই‘আলা হা/ ৬১৮৩।

[9]. মুসলিম হা/২৯৩৭; ইবনু হিববান হা/৬৭৬৭; মিশকাত হা/৫৪৭৫।

[10]. আহমদ হা/৫৩৭২, ৬১১৩;  মিশকাত হা/৩৬৫৫; ছহীহুল জামে হা/৩০৫২।

[11]. ছহীহুল জামে হা/৩০৭৬।

[12]. ছহীহুল জামে হা/৩০৭৭।

[13]. ‘‘সোনামণি প্রতিভা’’ পত্রিকা নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যা, ২০১৬।

[14]. তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট।

[15] .তথ্য সূত্রে ইন্টারনেট ও আব্দুল হামিদ প্রনীত ‘পাপ,তার শাসিত্ম ও মুক্তির উপায়’ পৃ.৬৪-৬৯।

[16]. আত-তারগীব পৃ. ১/৫৫; নাসাঈ হা/৩১৪০।

[17]. বুখারী হা/৫০,৪৭৭৭,৪৪৯৯।

[18]. বুখারী হা/৫১৪৪; মুসলিম হা/২৫৬৪; তিরমিযী হা/ ১১৩৪।

[19]. আহমাদ হা/১৭৯৫২; ছহীহুল জামে হা/৬৬৯৬।

[20]. মুসলিম হা/৭২৮৪।



বিষয়সমূহ: পাপ
আরও