ব্যক্তিস্বার্থ, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতি

মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 428 বার পঠিত

ভূমিকা : ব্যক্তিস্বার্থ, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব হ’ল অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির আরেক রূপ। কারও মধ্যে কম অথবা বেশী এই মন্দ গুণগুলি বিদ্যমান। মূলকথা হ’ল- ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, যোগ্য-অযোগ্য যাচাই-বাছাই না করে অন্ধভাবে নিজেকে, আত্মীয়দের অথবা কোন স্বপক্ষের কাউকে প্রাধান্য দেওয়াটা এক ধরনের অপরাধ। রাজনীতি-প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে এই মন্দগুণ। যা ধ্বংস করে দিচ্ছে ন্যায়নীতি, ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতার আদর্শকে। বর্তমান অবস্থা এমন যে, সপক্ষের লোক যতই অন্যায় বা দুর্নীতি করুক, বিভিন্ন দিক থেকে অন্যায়ভাবে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে মুক্ত করা হয়। পক্ষান্তরে শুধু নিজের পক্ষপাতিত্বকে ঠিক রাখার জন্য অন্যের ওপর যুলুম-নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়। জাহেলী যুগে ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বিবেচনা না করে শুধু নিজ গোত্রীয় পক্ষপাতিত্বের মনোভাব নিয়ে আরবগণ বছরের পর বছর এক গোত্র অন্য গোত্রের সাথে হত্যাযজ্ঞ, মারামারি-কাটাকাটিতে লিপ্ত থাকত। যা আমাদের সমাজেও কমবেশী বিদ্যমান।

ব্যক্তিস্বার্থ : কোন কাজে নিজের দিকটাকে সর্বদাকে অগ্রাধিকার দেওয়াকে ব্যক্তিস্বার্থ বা Selfishness বলে। ব্যক্তিস্বার্থ একটি মন্দ গুণ। এই মন্দ গুণের দেখা মিলে স্বার্থ কেন্দ্রিক কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। ফলে কোন প্রতিষ্ঠান, অফিস বা পরিবারে কারও ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগলে, তখনই তার আসল রূপ ফুটে উঠে, আর তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে যা যা করা দরকার তা করে থাকে।

ব্যক্তিস্বার্থ বনাম ইসলাম : ইসলাম হ’ল মানবতার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ফলে ইসলাম ব্যক্তিস্বার্থ কখনও মূখ্য নয়; বরং ইসলামের উত্তম একটি দৃষ্টান্ত হ’ল স্বার্থত্যাগ করা। ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহান কিছু অর্জন করা যায়; যা স্বার্থপরতায় সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়’ (নিসা ৪/১৩৫)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, সত্য কথা বল যদিও তা তিতা হয়’।[1]

ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ছাহাবীদের দৃষ্টান্ত : (১) আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা যখন মদীনায় আসি, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার এবং সা‘দ ইবনু রাবী‘ (রাঃ) এর মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন করে দেন। পরে সা‘দ ইবনু রাবী‘ বললেন, আমি আনছারদের মধ্যে অধিক ধন-সম্পত্তির অধিকারী। আমার অর্ধেক সম্পত্তি তোমাকে ভাগ করে দিচ্ছি এবং আমার উভয় স্ত্রীকে দেখে যাকে তোমার পছন্দ হয়, বল আমি তাকে তোমার জন্য পরিত্যাগ করব। যখন সে ইদ্দত পূর্ণ করবে, তখন তুমি তাকে বিবাহ করে নিবে। আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, এসব আমার কোন প্রয়োজন নেই। বরং (আপনি বলুন) ব্যবসা বাণিজ্য করার মতো কোন বাজার আছে কি? তিনি বললেন, কায়নুকার বাজার আছে...।[2]

(২) যুদ্ধের সময় হুযায়ফা (রাঃ) আহতদের মধ্যে তার চাচাতো ভাইকে খুঁজতে থাকেন। তার সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফার চাচাতো ভাইয়ের শরীর দিয়ে অবিরত ধারায় রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশংকাজনক। হুযায়ফা (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি পানি পান করবে? সে হ্যঁা সূচক ইঙ্গিত করল। আহত সৈন্যটি হুযায়ফার কাছ থেকে পানি পান করার জন্য পাত্র হাতে নিতেই তার পাশে এক সৈন্যকে পানি পানি বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের আর্তনাদ শুনে তিনি আগে তাকে পানি পান করানোর জন্য হুযায়ফাকে ইঙ্গিত দিলেন। অতঃপর হুযায়ফা তার নিকট গিয়ে তার হাতে পানির পাত্র দিলে তিনি পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পাশ থেকে অন্য একজন সৈন্যের চিৎকার শুনতে পেলেন। তখন তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, তার দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো।

হুযায়ফা আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি মারা গেছেন। অতঃপর দ্বিতীয় জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন, তিনিও মারা গেছেন। অতঃপর চাচাতো ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন। পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফার হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেক জনের পানির পিপাসা মিটাবার জন্য এতই পাগলপারা ছিলেন যে, অবশেষে কেউ সে পানি পান করতে পারেননি। অথচ সবারই প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত।[3]

(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে আসল। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে লোক পাঠালেন। তারা জানালেন, আমাদের নিকট পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কে আছ যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন এক আনছার ছাহাবী [আবু ত্বালহা (রাঃ)] বললেন, আমি। এ বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মেহমানকে সম্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনছার বললেন, তুমি আহার প্রস্ত্তত কর, বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সে বাতি জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াল এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত করল। বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে, তারাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তারা উভয়েই সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কান্ড দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশী হয়েছেন এবং এ আয়াত নাযিল করেছেন। ‘আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্তত যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)[4]

স্বজনপ্রীতি : সামাজিক অঙ্গনে স্বজনপ্রীতিও একটি মন্দ দিক। যা আত্মীয়দের অন্যায়ভাবে অগ্রাধিকার দেওয়াকে Nepotism বা স্বজনপ্রীতি বলে। স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হ’তে একটি হাদীছ এসেছে, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) আমাদের বলেছেন,إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ بَعْدِى أَثَرَةً وَأُمُورًا تُنْكِرُونَهَا- ‘আমার পরে তোমরা অবশ্যই স্বজনপ্রীতিকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করবে। এবং এমন কিছু বিষয় দেখতে পাবে, যা তোমরা পছন্দ করবে না’।[5]

পক্ষপাতিত্ব : স্বপক্ষের কাউকে প্রাধান্য দেওয়াকে পক্ষপাতিত্ব বা Favoritism বলে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا كُوْنُوْا قَوَّامِيْنَ لِلّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوْا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (মায়েদা ৫/৮)

উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত জনৈক আনছার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করল এবং বলল আপনি ওমুককে যেভাবে কর্মচারী নিযুক্ত করেছেন, সেভাবে আমাকেও কি কর্মচারী নিয়োগ করবেন না? তখন তিনি বললেন,‏إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِي أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِي عَلَى الْحَوْضِ- ‘আমার পরে তোমরা অনেক পক্ষপাতিত্ব দেখবে তখন তোমরা ধৈর্যধারণ করবে, যে পর্যন্ত না তোমরা হাউয (কাওছার)-এবং আমার সাথে মিলিত হও’।[6]

স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপতিত্বের রোষানলে পতিত হ’লে করণীয় : 

এমতাবস্থায় সাধ্যমত ধৈর্যধারণ করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) সর্বদা ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের ব্যাপারে ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়েছেন, যাতে করে ফিৎনার বিস্তার বৃদ্ধি না পায়। যেমন জুনাদাহ ইবনু আবু ওমাইয়া (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা ওবাদাহ ইবন ছামিত (রাঃ)-এর নিকট ছিলাম। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। আমরা বললাম, আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দিন। আপনি আমাদের এমন একটি হাদীছ বর্ণনা করুন, যদ্দবারা আল্লাহ আপনাকে উপকৃত করবেন এবং যা আপনি নবী করীম (ছাঃ) থেকে শুনেছেন। তিনি বললেন, আমাদের থেকে যে ওয়াদা তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছিল যে, بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا، وَعُسْرِنَا، وَيُسْرِنَا، وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا، وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ، إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا، عِنْدَكُمْ مِنَ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ- ‘আমরা আমাদের সুখে-দুঃখে, বেদনায় ও আনন্দে আমাদের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিলেও পূর্ণরূপে শোনা ও মানার উপর বায়‘আত করলাম। আরও (বায়‘আত করলাম) যে আমরা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঝগড়া করব না। অতঃপর তিনি বললেন, কিন্তু যদি স্পষ্ট কুফরী দেখ, তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহ’লে ভিন্ন কথা’।[7] 

ওয়ায়েল হাযরামী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘সালামাহ ইবনু ইয়াযীদ আল জুফী (রাঃ) রসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এ মর্মে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর নবী! যদি আমাদের উপর এমন শাসকের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যে, তারা তাদের হক তো আমাদের কাছে দাবী করে; কিন্তু আমাদের হক তারা দেয়না (পক্ষপাতিত্ব করে)। এমতাবস্থায় আপনি আমাদেরকে কী করতে বলেন? তিনি তার উত্তর এড়িয়ে গেলেন। তিনি আবার তাকে প্রশ্ন করলেন। আবার তিনি এড়িয়ে গেলেন। এভাবে প্রশ্নকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারও একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। তখন আশআস ইবনু কায়স (রাঃ) তাকে টেনে নিলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা শুনবে ও মানবে। কেননা তাদের দায়িত্বের বোঝা তাদের উপর এবং তোমাদের দায়িত্বের বোঝা তোমাদের উপর বর্তাবে’।[8]

পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতির পরিণতি :

ইমাম আবুদাউদ (রহঃ) একটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন (بَابٌ فِي الْعَصَبِيَّةِ) দলপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব। এরপর তিনি একটি হাদীছ নিয়ে এসেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,مَنْ نَصَرَ قَوْمَهُ عَلَى غَيْرِ الْحَقِّ، فَهُوَ كَالْبَعِيرِ الَّذِي رُدِّيَ، فَهُوَ يُنْزَعُ بِذَنَبِهِ- ‘যে ব্যক্তি তার কওমের লোকদেরকে অন্যায়ভাবে সাহায্য করে, সে ঐ উটের মত, যেটিকে গর্তে পড়ার পর তার লেজ ধরে টানা হচ্ছে’।[9] অর্থাৎ লেজ ধরে টেনে উটকে উদ্ধার করা যেমন সম্ভব নয়, ঐরূপ ব্যক্তিকে তেমন জাহান্নাম থেকে বাঁচানোও কঠিন।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত মাখযূম গোত্রের এক নারী চোরের ঘটনা কুরায়শের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয়তম উসামা বিন যায়েদ এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথা বললেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন কারিণীর সাজা মওকুফের সুফারিশ করছ? অতঃপর তিনি খুৎবায় দাঁড়িয়ে বললেন,إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ- تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ، وَايْمُ اللهِ، لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ ابْنَةَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا- ‘তোমাদের পূর্বের জাতিসমূহ ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোন সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার উপর হদ জারি করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তাহ’লে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম’।[10]

পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতিরকুফল :

স্বজনপ্রীতির কারণে যোগ্য ব্যক্তি থাকতেও অযোগ্য লোকেরা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) লোকেদের সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় এক বেদুইন এসে প্রশ্ন করল, ক্বিয়ামত কখন হবে? উত্তরে তিনি (ছাঃ) বললেন, আমানত যখন নষ্ট করা হবে তখন ক্বিয়ামতের প্রতীক্ষা কর। লোকটি প্রশ্ন করল, তা কিভাবে নষ্ট করা হবে? তিনি (ছাঃ) বললেন, কাজের দায়িত্ব যখন অনুপযুক্ত লোককে দেয়া হবে তখন ক্বিয়ামতের প্রতীক্ষা কর’।[11]

স্বার্থবাদিতার ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে পরিত্রানের উপায় :

১. অন্তরের কার্পণ্য দূর করা : মানুষ স্বভাবতই ব্যক্তিস্বার্থ, স্বজনপ্রীতি দ্বারা প্রভাবিত হবে। আল্লাহ বলেন, وَاُحْضِرَتِ الْاَنْفُسُ الشُّحَّ- ‘অন্তর সমূহে লোভ (ব্যক্তিস্বার্থ) বিদ্যমান থাকে (যা পরস্পরকে সন্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে)’ (নিসা ৪/১২৮)। যদিও মানুষের মধ্যে এসব বদগুণ বিদ্যমান থাকবেই, তথাপিও নিজেকে হেফাযত করার জন্য প্রয়োজন এসব বদগুণসমূহকে সাধ্যমত প্রশ্রয় না দেওয়া। তাহ’লেই আমরা সফলকাম হ’তে পারব ইনশাআল্লাহ। কেননা আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘বস্ত্ততঃ যারা হৃদয়ের কার্পণ্য (ব্যক্তিস্বার্থ) হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لِأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘অতএব তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর কথা শোন ও মান্য কর এবং (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্ত্ততঃ যারা তাদের হৃদয়ের কার্পণ্য (ব্যক্তিস্বার্থ) থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)

২. অযোগ্যদের সুযোগ না দেওয়া : যারা উপযুক্ত নয় তাদেরকে সুযোগ না দেওয়া। কেননা যখন নবী নূহ (আঃ) তার পাপী সন্তানের বিষয়ে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করলে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ বললেন, হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অসৎ কর্মপরায়ণ। অতএব তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ে আবেদন করো না যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (হুদ ১১/৪৬)

৩. আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা : কখনও কোন পদক্ষেপ ভুল হ’লে তা থেকে তওবার মাধ্যমে ফিরে আসা আবশ্যক, যেমনটি নূহ (আঃ) করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন বিষয়ে আবেদন করা থেকে, যে বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই। এক্ষণে যদি তুমি আমাকে ক্ষমা না কর এবং আমার প্রতি দয়া না কর, তাহ’লে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (হুদ ১১/৪৭)

৪. যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া : আদী ইবনে আমীরাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আমরা তোমাদের মধ্যে যাকে কোন কাজে নিযুক্ত করি, অতঃপর সে আমাদের কাছে সূঁচ অথবা তার চেয়ে বেশী (কিংবা কম কিছু) লুকিয়ে নেয়, তো এটা খিয়ানত ও চুরি করা হয়। ক্বিয়ামতের দিন সে তা সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হবে। এ কথা শুনে আনছারদের মধ্যে একজন কৃষ্ণকায় মানুষ উঠে দাঁড়ালেন, যেন আমি তাকে (এখন) দেখছি। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি (যে কাজের দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করেছিলেন) তা আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন’। তিনি বললেন, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি আপনাকে এ রকম কথা বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, আমি এখনো বলছি যে, যাকে আমরা কোন কাজে নিযুক্ত করি, সে যেন অল্পবেশী (সমস্ত মাল) আমার কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর তা হ’তে তাকে যতটা দেওয়া হবে, সেটাই সে গ্রহণ করবে এবং যা হ’তে তাকে বিরত রাখা হবে, সে তা থেকে বিরত থাকবে’।[12]

৫. পরকালীন স্বার্থে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা : যদি কেউ স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্বের কারণে কোন অন্যায় করে, তাহ’লে তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্নের সম্মুখীন হ’তে হবে। হাদীছে এসেছে, আনাস বিন মালেক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ سَائِلٌ كُلَّ رَاعٍ عَنْ مَا اسْتَرْعَاهُ حَفِظَ ذَلِكَ أَمْ ضَيَّعَ؟- ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রক্ষককে তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে এবং প্রত্যেক তত্ত্বাবধায়ক ও অভিভাবককে তার তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। যথার্থই কি তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে, নাকি অবহেলা হেতু তা নষ্ট করেছে?[13]

৬. দায়িত্বের খেয়ানত না করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মনে রেখ তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের উপরে দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের উপর দায়িত্বশীল। সে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[14]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ وَالٍ يَلِى رَعِيَّةً مِنَ الْمُسْلِمِينَ، فَيَمُوتُ وَهْوَ غَاشٌّ لَهُمْ، إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ- ‘কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল এবং তার মৃত্যু হ’ল এ হালতে যে, সে ছিল খেয়ানাতকারী, তাহ’লে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’।[15]

উপসংহার :

বর্তমান যুগ স্বার্থপরতার যুগ। ব্যক্তিস্বার্থ, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব যেন সর্বত্র অনুপ্রবেশ করেছে। এ কারণে যোগ্য ব্যক্তিরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের কারণে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে অন্তরের এই ধ্বংসাত্মক রোগ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[লেখক : কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]


[1]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫২৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৬৬।

[2]. বুখারী হা/২০৪৮।

[3]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭/৮-১১ প্রভৃতি দ্র.।

[4]. বুখারী হা/৩৭৯৮; মুসলিম হা/২০৫৪।

[5]. বুখারী হা/৭০৫২; তিরমিযী হা/২১৯০।

[6]. মুসলিম হা/৪৬৭৩; তিরমিযী হা/২১৮৯।

[7]. বুখারী হা/৭০৫৬।

[8]. মুসলিম হা/৪৬৭৬, ৪৬৭৭।

[9]. আবুদাউদ হা/৫১১৭।

[10]. বুখারী হা/৩৪৭৫।

[11]. বুখারী হা/৬৪৯৬; মিশকাত হা/৫৪৩৯।

[12]. মুসলিম হা/১৮৩৩; মিশকাত হা/৩৭৫২।

[13]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৪৯৩; ছহীহাহ হা/১৬৩৬।

[14]. বুখারী হা/৭১৩৮; মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।

[15]. বুখারী হা/৭১৫১ ‘জনগণের নেতৃত্ব পাওয়ার পর তাদের কল্যাণ কামনা করা’ অনুচ্ছেদ-৮।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও