পারিবারিক বন্ধন (শেষ কিস্তি)

মুখতারুল ইসলাম 707 বার পঠিত

দুনিয়াতে মানুষের সম্পর্কের প্রথম সংগঠন হল তার পরিবার। অতঃপর সমাজ ও রাষ্ট্রের দেখা মিলে। বনু আদমের কেউই এ ফিৎরাতী সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। নতুবা তার আত্মকেন্দ্রিকতা তাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে। দুনিয়াতে সফল ব্যক্তি তো সেই যে পুরো পরিবার ও সমাজকে বুকে আগলে রাখতে পারে মৌচাকের মত। জাতি, গোষ্ঠীর প্রাচীর টপকিয়ে যে ব্যক্তি পুরো বনু আদম তথা পুরো জগতের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে, ভালবাসা দিতে পারে, ভালবাসা নিতে পারে এবং রহমান প্রদত্ত সম্পর্কের মায়াজালে এক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর একত্ববাদের উপরে সকলকে দাঁড় করাতে পারে সেই-ই সফল নেতা।

কিন্তু মানুষ শয়তানী ফেরেবে পড়ে সবকিছু জলাঞ্জলী দিতে কছূর করেনা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُو أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ ‘যদি তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে সম্ভবতঃ তোমরা জনপদে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ ‘পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অটুট রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে ও পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাৎ এবং তাদের জন্য রয়েছে মন্দ আবাস’ (রা‘দ ১৩/২৫)।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক, ভালোবাসা ও পারিবারিক বন্ধন সৃষ্টির নিমিত্তে الرَّحِمِ থেকে নিজের নাম ধারণ করেছেন রাহীম ও রহমান হিসাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: أَنَا اللَّهُ، وَأَنَا الرَّحْمَنُ، خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَشَقَقْتُ لَهَا مِنِ اسْمِي، فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ، وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ ‘কল্যাণময় মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি আল্লাহ, আমিই রহমান। আমিই ‘রহিম’কে সৃষ্টি করেছি। ‘রহিম’ নামটি আমার রহমান নাম থেকে পরিসৃত। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে, আমি তাকে আমার রহমতের সাথে সংযুক্ত করব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমার রহমত থেকে ছিন্ন করব’।[1]

রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا ‘সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসাবে গণ্য হবে না যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে। বরং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী সে ব্যক্তি যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলেও সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে’।[2]

পারিবারিক বন্ধন মহান আল্লাহর অপার দান। অনেক সময় এর গুরুত্ব না বুঝেই সামান্য কারণেই আমরা তা ছিন্ন করি ফেলি। মানুষের মাঝে যদি ভালবাসার বন্ধন টিকে না থাকে, তবে প্রকৃতার্থে মানুষ ও পশুর মাঝে খুব বেশী ফারাকের জায়গা বাকী থাকবে না। হাদীছে এসেছে, وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي، وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ، وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ. فَقَالَ: لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ، وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছে যাদের সাথে আমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করি; অথচ তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি; অথচ তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে ধৈর্যের পরিচয় দেই; অথচ তারা আমার সাথে কঠোরতা দেখায়। অতএব তাদের সাথে এখন আমার করণীয় কী? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি যদি সত্যি কথাই বলে থাকো তা হলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত ছাই খাইয়ে দিচ্ছো। আর তুমি যতদিন পর্যন্ত তাদের সাথে এমন ব্যবহার করতে থাকবে ততদিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের ওপর তোমার জন্য একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত থাকবে’।[3] রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُلُّوَا أَرْحَامَكُمْ وَلَوْ بِالسَّلَامِ ‘অন্ততপক্ষে সালাম বিনিময় করে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো’।[4]

পারিবারিক বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখার উপকারিতাসমূহ

নেক আমল কবুলের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ

প্রত্যেক মানুষ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য আমলে ছালেহ বা নেক আমলসমূহ করে থাকে। কিন্তু ব্যক্তির ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ও যাকাত তার অজান্তেই মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছাতে পারে না। কেননা সে অনেক বড় ঈমানদার ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও শয়তান সুকৌশলে তাকে সম্পর্কহীনতার পাপে জড়িয়ে আত্মীয় ও সমাজ থেকে বিছিন্ন করে রাখে। প্রকারান্তরে সে মহান আল্লাহর সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকে।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, الرَّحِمُ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تَقُولُ: مَنْ وَصَلَنِي وَصَلَهُ اللَّهُ، وَمَنْ قَطَعَنِي قَطَعَهُ اللَّهُ ‘রহীম তথা আত্মীয়তা আল্লাহ তা‘আলার আরশের নীচে ঝুলন্ত আছে এবং বলছে যে ব্যক্তি আমাকে বহাল রাখবে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখবে। আর যে ব্যক্তি তা ছিন্ন করবে, আল্লাহ তার সাথে ছিন্ন করবে’।[5]

ফলে তার নেক আমলসমূহ যত সুন্দরই হৌক না কেন তা প্রভুর নিকট কবুলযোগ্য নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَعْمَالَ بَنِى آدَمَ تُعْرَضُ كُلَّ خَمِيسٍ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ فَلاَ يُقْبَلُ عَمَلُ قَاطِعِ رَحِمٍ. ‘আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রিতে (আল্লাহ তা‘আলার নিকট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন চ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না’।[6]

পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখা পরিপূর্ণ মুমিনের পরিচায়ক

বিবেকবান ঈমানদাররা আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান হয়। পাশাপাশি তারা সার্বিক বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে। বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অনুকূল-প্রতিকূল সব পরিস্থিতিতে পরকালের জবাবদিহিতার ভয় করে। আল্লাহর ভয় এবং পরকালে জবাবদিহিতার ভয় মানুষকে বিশ্বাস ও বিবেক নির্দেশিত পথে পরিচালিত করে। আল্লাহ তা‘আলা সত্যিকার পরিপূর্ণ মুমিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ ‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে বলেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে এবং ভয় করে তাদের পালনকর্তাকে ও ভয় করে কঠিন হিসাবকে’ (রা‘দ ১৩/২১)

হাদীছে এসেছে, খায়ছামা গোত্রের একজন লোক বলল,قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ؟ قَالَ: إِيمَانٌ بِاللَّهِ. قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ثُمَّ مَهْ؟ قَالَثُمَّ صِلَةُ الرَّحِمِ. قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ الْأَعْمَالِ أَبْغَضُ إِلَى اللَّهِ؟ قَالَ: الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ. قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ثُمَّ مَهْ؟ قَالَ: ثُمَّ قَطِيعَةُ الرَّحِمِ. قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ثُمَّ مَهْ؟ قَالَ: ثُمَّ الْأَمْرُ بِالْمُنْكَرِ وَالنَّهْيِ عَنِ الْمَعْرُوفِ ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনায়ন করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা। আমি আবার বললাম, আল্লাহর নিকট কোন কাজটি অপ্রিয়? তিনি বললেন, শিরক করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, সম্পর্ক ছিন্ন করা। তারপর কোনটি? তার জবাবে তিনি বললেন, খারাপ কাজের আদেশ করা এবং ভাল কাজে নিষেধ করা’।[7]

রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ. وَفِي رِوَايَةٍ بَدَلَ: (الْجَارِ) : وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানের সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। অন্য বর্ণনায় ‘প্রতিবেশী’র স্থলে রয়েছে’। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করে’।[8]

রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ أَكْمَلِ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَأَلْطَفُهُمْ بِأَهْلِهِ. ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রবান এবং তার পরিবারের প্রতি দয়াবান’।[9]

আবেদ ও মা‘বূদের সম্পর্কের কেন্দ্রস্থল

যদি কোন বান্দা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করতে চায়, তবে তাকে পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করণের পথে হাটতে হবে। তবেই সে তার চাওয়া অনুযায়ী মহান আল্লাহর সাড়া পাবে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন, خَلَقَ اللَّهُ الْخَلْقَ، فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوَيِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ: مَهْ، قَالَتْ: هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطْعِيَّةِ. قَالَ أَلَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ، وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ! قَالَ: فَذَاكَ. ‘আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকুল সৃজন শেষে আত্মীয়তার বন্ধন (দাঁড়িয়ে) বলল, এটিই হচ্ছে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর স্থান। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই। তুমি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নও যে, আমি ওর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং আমি ওর সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবে। তখন সে বলল, আমি এ কথায় অবশ্যই রাযী আছি হে আমার রব! তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তা হলে তোমার জন্য তাই হৌক’।[10]

ব্যক্তির জান্নাত ও জাহান্নামের পথ নির্দেশক

বেহেশত থেকে আসা পবিত্র এ পারিবারিক বন্ধনকে ছিন্ন করলে বনু আদমকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ ‘সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবেনা’।[11] রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ وَقَاطِعُ رَحِمٍ وَمُصَدِّقٌ بِالسِّحْرِ ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। নেশাগ্রস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও যাদুতে বিশ্বাসী’।[12]

আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ دُلَّنِى عَلَى عَمَلٍ أَعْمَلُهُ يُدْنِينِى مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِى مِنَ النَّارِ. قَالَ تَعْبُدُ اللَّهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِى الزَّكَاةَ وَتَصِلُ ذَا رَحِمِكَ فَلَمَّا أَدْبَرَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنْ تَمَسَّكَ بِمَا أُمِرَ بِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ. ‘জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, (হে নবী!) আপনি আমাকে এমন একটি আমল বাতলিয়ে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। ছালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে ও নিজ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে। লোকটি রওয়ানা করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সে যদি আদিষ্ট বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রাখে তাহলে সে জান্নাতে যাবে’।[13]

সুসংহত ও কল্যাণকামী জাতি

ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার শিক্ষা দেয়। ইসলাম অন্য মানুষের প্রতি দয়া ও কল্যাণকামিতা শিখায়। তাই ইসলাম মানুষের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে আদেশ করে এবং তা যে কোনো কারণে ছিন্ন করতে নিষেধ করে। আর এভাবেই একটি মুসলিম পরিবার ও সমাজ পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে দৃঢ়, দয়াশীল ও পরকল্যাণকামী হয়। যা অন্য কোনো আধুনিক সমাজে দেখা যায় না। ইসলাম দেখিয়েছে কিভাবে মুহাজির ও আনছাররা পরস্পর পরস্পরে পারিবারিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا، ثُمَّ شَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ. ‘আবু মুসা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য ইমারতের মত। যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় করে। এটা বলে তিনি এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে প্রবেশ করালেন’।[14]

দুনিয়াবী কামিয়াবী :

মানুষের যাবতীয় পাপ কর্মের শাস্তি নির্ধারিত হবে হিসাব দিবসে। কিন্তু সম্পর্কহীনতা ও অত্যাচারের শাস্তি মহান আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই দিবেন।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ، مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ. ‘দু’টি গুনাহ্ ছাড়া এমন কোনো গুনাহ্ নেই যে গুনাহ্‌গারের শাস্তি আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেওয়াই উচিৎ। উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ দু’টি হচ্ছে- অত্যাচার ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা’।[15]

তাহলে একজন ব্যক্তি পারিবারিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতী নিশ্চিত শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে। মহান আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচতে আত্মীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্কই একজন মানুষকে তার দুনিয়াবী প্রভূত কল্যাণ দান করতে পারে।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ؟ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি নিজ জীবিকার প্রশস্ততা ও মরণে বিলম্ব কামনা করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে’।[16]

রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُمَدَّ لَهُ فِى عُمْرِهِ وَيُوَسَّعَ لَهُ فِى رِزْقِهِ وَيُدْفَعَ عَنْهُ مَيْتَةُ السُّوءِ فَلْيَتَّقِ اللَّهَ وَلْيَصِلْ رَحِمَهُ. ‘যে ব্যক্তি নিজ মরণে বিলম্ব, জীবিকার প্রশস্ততা এবং অপমৃত্যু কামনা না করে, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে’।[17]

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন, تَعَلَّمُوا مِنْ أَنْسَابِكُمْ مَا تَصِلُونَ بِهِ أَرْحَامَكُمْ، فَإِنَّ صِلَةَ الرَّحِمِ مَحَبَّةٌ فِي الْأَهْلِ مَثْرَاةٌ فِي الْمَالِ، مَنْسَأَةٌ فِي الْأَثَرِ. ‘তোমরা নিজ বংশ সম্পর্কে জানবে, যাতে তোমরা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে পার। কারণ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের ভালোবাসা পাওয়া যায় এবং ধন-সম্পদ ও বয়স বৃদ্ধি পায়’।[18]

শুধু তাই নয় পরিবার, সমাজ ও দেশের হৃদয়তন্ত্রীতে মৃত্যুর পরে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিতে এবং দুনিয়াবাসীর দো‘আ পেতে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় করার বিকল্প নেই।

কীভাবে পারিবারিক বন্ধন রক্ষা পাবে?

পারিবারিক বন্ধন রক্ষা করার কিছু দিকনির্দেশনা নিম্নে উল্লেখ করা হল-

পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে বার বার সাক্ষাৎ করা, তাদের খবরাখবর নেওয়া, তাদের সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করা, তাদেরকে মাঝে মধ্যে কোনো কিছু উপঢৌকন দেওয়া, তাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান করা, তাদের গরীবদেরকে ছাদাকা-খায়রাত এবং ধনীদের সাথে নম্র ব্যবহার করা, তাদের বড়দেরকে সম্মান করা এবং ছোট ও দুর্বলদের প্রতি দয়া করা, তাদেরকে আপ্যায়ন করা, তাদেরকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করা, তাদের মধ্যে যারা আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তাদের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

সেই সাথে তাদের বিবাহ-শাদীতে অংশ গ্রহণ করা, তাদের দুঃখ-দুর্দশায় পাশে থাকা, তাদের জন্য দো‘আ করা, তাদের সাথে প্রশস্ত অন্তরের পরিচয় দেওয়া, তাদের পারস্পরিক দ্বনদ্ব-বিগ্রহ নিরসনের চেষ্টা করা তথা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করা, তাদের রুগ্নের সেবা করা, তাদের দাওয়াত গ্রহণ করা, হেদায়াতের দিকে ডাকা এবং তাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা ইত্যাদি।

তবে আত্মীয়-স্বজনদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাদের সাথে কখনো কোনোভাবেই দুর্ব্যবহার করা যাবে না। বরং তাদেরকে নম্রতা, কৌশল এবং সদুপদেশের মাধ্যমে ধর্মের দিকে ধাবিত করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে কখনো তাদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। তবে একান্তভাবে তা কখনো করতে হলে ভালোভাবেই করবে।

অনেক দাঈদেরকেই এমন দেখা যায় যে, তার আত্মীয়-স্বজন ও বংশীয়দের মাঝে তার কোনো প্রভাব নেই। তা এ কারণে হতে পারে যে, তিনি তাদেরকে ধর্মের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেন না অথবা তাদেরকে দাওয়াত দেয়ার ব্যাপারে সুন্দর পন্থা অবলম্বন করেন না। তা কখনোই ঠিক নয়। বরং তাদের সামনে বিনম্রভাবে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে যথাযথ গুরুত্ব ও সম্মান দেখাবে। তাহলেই তারা তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে। তেমনিভাবে প্রত্যেক পরিবার ও বংশের কর্তব্য হল- তাঁদের আলিমদেরকে সম্মান করা, তাঁদের কথা শুনা, তাঁদেরকে নগণ্য মনে না করা। কারণ তাঁদের সম্মান তাঁদের বংশেরই সম্মান।

পারিবারিক বন্ধন রক্ষা করার উপায়সমূহ

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহতে পারিবারিক বন্ধন রক্ষার যথাযথ পন্থা বাতলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে কিছু টিপস উল্লেখ করা হল-

১. এ বন্ধন রক্ষা করলে দুনিয়া ও আখিরাতের যে যে লাভগুলো পাওয়া যায় তা সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, কোনো বিষয়ের ফলাফল ও পরিণতি জানলেই তা করার সদিচ্ছা জন্মে এবং তা করতে মানুষ অধিক আগ্রহী হয়। অতএব সে বিষয়ে সকলকে অবহিত করা উচিৎ।

২. এ বন্ধন ছিন্ন করার ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। কারণ তা ব্যক্তি জীবনে একদা বিশেষ চিন্তা, বিষণ্ণতা, লজ্জা ও আফসোস বয়ে আনে। কেননা কোনো জিনিসের ভয়ানক পরিণতির কথা জানা থাকলেই তো তা থেকে দূরে থাকা সহজ হয়।

৩. এ ব্যাপারে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার একান্ত সহযোগিতা কামনা করতে হবে। কারণ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার সকল কাজ সহজ করে দিতে পারেন।

৪. আত্মীয়-স্বজনদের দুর্ব্যবহারকে নিজে ভালো ব্যবহার ও দয়া দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। কেননা ইসলাম সর্বদা ধৈর্য ও ক্ষমার শিক্ষা দিয়ে থাকে। জান্নাত পেতে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের পদক্ষেপ সেদিকেই ধাবিত হবে।

৫. আতমীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুলচুকের কৈফিয়তসমূহ মেনে নিতে হবে। কারণ মানুষ বলতেই তো ভুল হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে ইউসুফ (আঃ)-এর রেখে যাওয়া জ্বলন্ত আদর্শের কথা মাঝে মাঝে স্মরণ করা যেতে পারে। কেননা তিনি এতো কিছুর পরও তাঁর ভাইয়েরা যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছে. তখন তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বরং তিনি তাদের ক্ষমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট একান্তভাবে ফরিয়াদও করেছেন।

৬. আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা না চাইলেও নিজের উদারতাবশতঃ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে হবে এবং তাদের দোষ-ক্রটিসমূহ একেবারেই ভুলে যেতে হবে। কারণ তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উন্নত মানসিকতা ও পরম সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তো সেই যে নিজ আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমা করে দেয় এবং তাদের দোষ-ক্রটিগুলো একেবারেই ভুলে যায়।

৭. নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নম্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দিতে হবে। কারণ এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা তাকে অধিকহারে ভালোবাসবে এবং তার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সর্বদা চেষ্টা করবে।

৮. আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুলচুক সমূহ নিজ চোখে দেখেও তা না দেখার ভান করতে হবে এবং তা নিয়ে কখনো ব্যতিব্যস্ত হওয়া যাবে না। আর এভাবেই তো পরস্পরের ভালোবাসা দীর্ঘ দিন টিকে থাকে এবং পরস্পরের শত্রুতা ধীরে ধীরে লোপ পায়। আর এটি হচ্ছে উন্নত মানসিকতা ও স্বচ্ছতার পরিচায়ক। এতে করে মানুষের মান-সম্মান ক্রমেই বাড়তে থাকে। কখনো তা কমে না।

৯. যথাসাধ্য আত্মীয়-স্বজনদের খেদমত করার চেষ্টা করতে হবে। চাই তা সরাসরি হোক অথবা নিজের ধন-সম্পদ ও পদ-মর্যাদা দিয়েই হোক না কেন।

১০. আত্মীয়-স্বজনদেরকে কখনো নিজ অনুগ্রহের খোঁটা দেওয়া যাবে না। এমনকি তাদের থেকে সমপর্যায়ের আচরণও আশা করা যাবে না। কারণ ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসাবে গণ্য হবে না, যে ব্যক্তি কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই কেবল সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।

১১. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে অল্পতে তুষ্ট থাকার নীতি অবলম্বন করতে হবে। কারণ এ নীতি অবলম্বন করলেই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা সহজতর হয়। নতুবা নয়।

১২. আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থা ও মানসিকতা বুঝেই তাদের সাথে অনুরূপ আচরণ করতে হবে। কারণ আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ তো এমনও রয়েছে যে, তার সাথে বছরে অন্তত একবার সাক্ষাৎ এবং মাঝে মাঝে সামান্য ফোনালাপই যথেষ্ট। আবার কেউ কেউ তো এমনও রয়েছে যে, তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু হাসিখুশি কথা বললেই সে তাতে খুব খুশী। আবার কেউ কেউ এমনও রয়েছে যে, তার সাথে বারবার সাক্ষাৎ দিতে হয় এবং সর্বদা তার খবরাখবর নিতে হয়। নতুবা সে রাগ করে। অতএব আত্মীয়দের প্রত্যেকের সাথে তার মেজায অনুযায়ী আচরণ করতে হবে। তা হলেই তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা অতি সহজেই সম্ভবপর হবে।

১৩. আত্মীয়দের সাথে আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কারণ আত্মীয়-স্বজনরা যখন দেখবে আপনি তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করছেন না, তখন তারা বারবার আপনার সাথে সাক্ষাতে উৎসাহী হবে। আর যখন তারা দেখবে আপনি তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করছেন তখন তারা আপনার সাথে বারবার সাক্ষাতে সঙ্কোচ বোধ করবে এই মনে করে যে, তারা আপনার সাথে বারবার সাক্ষাৎ করে আপনাকে বিরক্ত করছে না তো?

১৪. কোনো কারণে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে একান্ত তিরস্কার করতে হলে তা হালকাভাবে করতে হবে। কারণ সত্যিকারার্থে ভদ্র ব্যক্তি সেই, যে মানুষের অধিকারগুলো পুরোপুরিভাবে আদায় করে এবং নিজের অধিকারগুলো প্রয়োজন বোধে ছেড়ে দেয়। যাতে করে আতমীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে। তবে নিজের অধিকার খর্ব হওয়ার দরুণ কাউকে একান্ত তিরস্কার করতে হলেও তা হালকাভাবে করতে হবে।

১৫. আত্মীয়-স্বজনদের তিরস্কার সহ্য করতে হবে এবং তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও বের করতে হবে। এটি হচ্ছে সত্যিকারার্থে বিশিষ্ট গুণীজনদেরই চরিত্র। যাঁদের মধ্যে মানবিক যাবতীয় গুণাবলী বিদ্যমান এবং যারা শীর্ষস্থানীয় চরিত্রবান তারাই তো সমাজের অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তিবর্গই হয়ে থাকেন। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে তিরস্কার করলে তারা মনে করেন, তাঁদের উক্ত আত্মীয় সত্যিই তাদেরকে অত্যাধিক ভালোবাসেন এবং তাদের বারবার আসা-যাওয়া ও সাক্ষাৎ তিনি অবশ্যই কামনা করেন। তাই তারা তাদের উক্ত আত্মীয়ের নিকট তাদের কৃত অপরাধ স্বীকার করেন। কারণ দুনিয়াতে কিছু লোক তো এমনও রয়েছে যে, তারা অন্যদেরকে খুবই ভালোবাসেন ঠিকই। তবে তারা অন্যের কোনো দোষ-ক্রটি দেখলেই তাকে খুবই তিরস্কার করে।

১৬. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে কোনো ধরনের হাসি-ঠাট্টা করতে তাদের সার্বিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে এবং তাদের মধ্যে যারা হাসি-ঠাট্টা মোটেই পসন্দ করে না তাদের সাথে তা মোটেও করা যাবে না।

১৭. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কোনোভাবেই বাগবিতন্ডা ও তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়া যাবে না। কারণ তা ধীরে ধীরে পরস্পরের মাঝে বিদ্বেষ ও শক্রতা সৃষ্টি করতে পারে। বরং তাদের সাথে এমন সকল আচরণ করা থেকে দূরে থাকতে হবে, যা সাধারণত পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।

১৮. কখনো নিজ আত্মীয়-স্বজনদের কারোর সাথে কোনো ধরণের ঝগড়া-বিবাদ ঘটে গেলে যথাসাধ্য আকর্ষণীয় উপঢৌকনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার পূর্বের ভাব ও সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কারণ হাদিয়া ও উপঢৌকন এমন একটি জিনিস যা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে এবং পরস্পরের মধ্যকার ভুল ধারণাসমূহ নিরসন করে।

১৯. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনরা হচ্ছে নিজের শরীরের একটি অংশের ন্যায়। সুতরাং তাদেরকে পরিত্যাগ করা কখনোই সম্ভবপর নয়। বরং তাদের সম্মানই নিজের সম্মান এবং তাদের অসম্মানই নিজের অসম্মান। বহুদিনে গড়ে উঠা এ সম্পর্ক যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

২০. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা সত্যিই একটি নিকৃষ্ট কাজ। কেউ এতে নিজকে লাভবান মনে করলেও মূলতঃ সে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কেউ এতে নিজকে বিজয়ী মনে করলেও মূলতঃ সে পরাজিত।

২১. বিয়ে-শাদী, আক্বীকা ইত্যাদি তথা যে কোনো অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনদেরকে দাওয়াত দেওয়ার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য সহজ উপায় হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজের সকল আত্মীয়-স্বজনদের একটি তালিকা সংরক্ষণ করবে। যাতে থাকবে তাদের নাম কিংবা মোবাইল নম্বর। আর যখনই কোনো অনুষ্ঠান করার চিন্তা করবে তখনই উক্ত তালিকা খুলে সবাইকে যথাসাধ্য দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। চাই তা সরাসরি হোক অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে। যদি কোনো আত্মীয় কোনোভাবে উক্ত দাওয়াত থেকে বাদ পড়ে যায় তা হলে অতি দ্রুত নিজের ভুল স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে এবং তাকে যে কোনোভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে।

২২. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কোনো ধরনের সমস্যা ঘটে গেলে তাদের মধ্যে যাকে আল্লাহ তা‘আলা সবার ভালোবাসা কুড়ানোর সুযোগ দিয়েছেন তাকে উক্ত সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। তা না করলে একদা উক্ত সমস্যা বড় থেকে বড় হয়ে সবাইকেই জড়িয়ে ফেলবে। পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হবে।

২৩. নিজেদের মধ্যকার কেউ মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি দ্রুত ওয়ারিছদের মাঝে বন্টন করে দিতে হবে। যেন কারোর ওয়ারিছী সম্পত্তি নিয়ে ওয়ারিছী আত্মীয়-স্বজনদের পরস্পরের মাঝে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ সৃষ্টি না হয়।

২৪. আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যকার যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবাই নিজেদের মধ্যে সর্বদা একতা ও সমঝোতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা, পরস্পর দয়া, ভালোবাসা ও পরামর্শ এবং অন্যকে নিজের উপর অগ্রাধিকার দেয়ার প্রতি সর্বদা যত্নবান হতে হবে। প্রত্যেকে অন্যের জন্য তাই ভালোবাসবে যা নিজের জন্য ভালোবাসে এবং প্রত্যেকে নিজের অধিকারের পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতিও যত্নবান হবে।

কখনো কোনো সমস্যা অনুভূত হলে তা অত্যধিক সুস্পষ্টতার সাথে বিশেষ পর্যালোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেককেই নিষ্ঠার সাথে কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। অন্যের কাজের প্রতি বেশী দৃষ্টি দেয়া যাবে না। যে কোনো ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা লিখে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে ইনশাআল্লাহ তাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত ও বরকত নাযিল হবে এবং নিজেদের মধ্যকার ভালোবাসা দীর্ঘ দিন অটুট থাকবে।

২৫. মাসে, ছয় মাসে অথবা বছরে অন্তত একবার হলেও আত্মীয়-স্বজনরা সবাই কোথাও না কোথাও একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে সবাই একত্রিত হলে পরস্পর পরিচিতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে উক্ত বৈঠকগুলোর নেতৃত্বে যদি থাকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা থাকে। দুই ঈদের কোন এক ঈদে এ সুযোগ নেওয়া যেতে পারে।

২৬. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য নিজেদের মধ্যে সর্বদা একটি ফান্ড রাখা উচিত। তাতে সবার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক চাঁদা, নিজেদের মধ্যকার ধনীদের বিশেষ দান-ছাদাকা সংগ্রহ করা যেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে তা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করে সে ব্যাপারে তাকে যথাযোগ্য সহযোগিতা করতে হবে। এতে করে পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা জন্মাবে ও বৃদ্ধি পাবে।

২৭. আত্মীয়-স্বজনদের একটি ফোন বুক তৈরী করে তা কপি করে সবার মাঝে বিতরণ করা ভাল। উক্ত ফোন বুকটি সর্বদা নিজ আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করিয়ে দিবে। এতে করে ফোনের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের খবরাখবর নেওয়া এবং তাদেরকে বিশেষ অনুষ্ঠানাদিতে দাওয়াত দেয়া সহজ হবে। আত্মীয়তার বন্ধনও রক্ষা পাবে।

২৮. আত্মীয়-স্বজনদের যে কাউকে বার বার বিরক্ত করা ও ঝামেলায় ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাউকে তার সাধ্যাতীত কিছু করতে বার বার বিরক্ত করা যাবে না। বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদের কেউ যদি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা ধনী ব্যক্তি হোন তাহলে তাদেরকে এমন কাজ করতে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না, যা তাদের সাধ্যের বাইরে অথবা কষ্টসাধ্য। যদি তারা কোনো কারণে কারোর কোন আবদার রক্ষা করতে না পারে তাহলে তাদেরকে কোন তিরস্কার করা যাবে না। বরং তাদেরকে এ ক্ষেত্রে অপারগ মনে করতে হবে।

২৯. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক পরামর্শ আদান-প্রদানের সুব্যবস্থা থাকা উচিত। বরং তাদের মাঝে একটি স্থায়ী মজলিসে শুরা থাকলে তা আরো ভালো হয়। যাতে করে কারোর কোনো বড় সমস্যা দেখা দিলে তাদের উপযুক্ত পরামর্শ নেয়া যায় এবং এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যাতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকবেন। উপরন্তু আত্মীয়-স্বজনরাও সবাই খুশী থাকবে। তবে মজলিসে শুরার সদস্যরা এমন হতে হবে যাদের রয়েছে অত্যাধিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুর্বার ক্ষমতা। এক কথায় সাংগঠনিক পরিবার ও আবহাওয়াতে নিজেকে জড়ানো।

৩০. তবে উপরোক্ত সকল বিষয়ে এ কথার খেয়াল রাখতে হবে যে, যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক হয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা হয় পরোপকার ও আল্লাহভীরুতার ভিত্তিতে। যেন তা জাহেলী যুগের বংশ ও আত্মীয় প্রেমের ভিত্তিতে না হয়।

জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজিতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের পারিবারিক বন্ধন বেশী শক্তিশালী, তারা তুলনামূলকভাবে রোগে কম আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে পরিবারের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক খারাপ, তারা বেশী মাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বয়স্ক লোকদের মধ্যে যারা রোগাক্রান্ত, তাদের পারিবারিক ইতিহাস খুঁজে দেখা গেছে, প্রত্যেকেই পরিবারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছেন না।

সমীক্ষাটির প্রধান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের সহযোগী অধ্যাপক সারারাহ বি উডস বলেন, আমরা দেখেছি পরিবারের আবেগঘন পরিবেশ ব্যক্তির স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া ২০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর তার স্ট্রোক হতে পারে এবং এটি মাথা ব্যাথায়ও প্রভাব ফেলে।

আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে আরো শক্তিশালী করা উচিৎ। অবসর সময়ে ভার্চুয়াল জগতে পড়ে না থেকে পরিবারের লোকদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের বোঝার চেষ্টা করা এবং তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা সকলকে পারিবারিক আত্মীয়তার এই পরম বন্ধনটুকু ছিন্ন করা থেকে সর্বদা বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন এবং ঈমানের ভিত্তিতে এক প্রাণ ও এক মন হয়ে পরিবারের অনন্য সাধারণ সদস্য হিসাবে কবুল করুন-আমীন!

[লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ]


[1]. আবুদাউদ, মিশকাত হা/৪৯৩০।

[2]. বুখারী, আবুদাউদ, মিশকাত হা/৪৯২৩।

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯২৪।

[4].সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৭৭৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩৮।

[5].বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯২১।

[6].আহমাদ হা/১০২৭৭।

[7].মুসনাদে আবু ইয়ালা হা/৬৮৩৯; তারগীব ওয়াত তারহীব ৩/৩৩৬ পৃ.।

[8]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪২৪৩।

[9]. আহমাদ হা/২৪৭২১; মুসতাদরাকে হাকেম হা/১৭৩।

[10]. বুখারী, মুসলিম,মিশকাত হা/৪৯১৯।

[11]. বুখারী হা/৫৯৮৪; তিরমিযী হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৪৯২২।

[12]. আহমাদ হা/১৯৫৮৭।

[13]. মুসলিম হা/১৪।

[14]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৫।

[15]. তিরমিযী, আবুদাউদ, মিশকাত হা/৪৯৩২।

[16]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯১৮।

[17]. আহমাদ হা/১২১২; তারগীব ওয়াত তারহীব ৩/৩৩৫ পৃ.; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ ৮/১৫২,১৫৩ পৃ.।

[18]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৯৩৪।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও