স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে ছিয়ামের উপকারিতা

ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর 1407 বার পঠিত

বান্দার জন্য ছিয়াম সাধনা করা মহান আল্লাহর এক অন্যতম নির্দেশ। আর আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি বিধানই মানবকুলের জন্য কল্যাণকর। নিঃসন্দেহে ছিয়ামও মানব জাতির জন্য কল্যাণকর এক ইবাদাত। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘বেশী বাঁচবি তো কম খা’। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য। একাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সীনা তাঁর রোগীদের তিন সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের পরামর্শ দিতেন (সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, ৩১ ডিসেম্বর-৬ জানুয়ারী ১৯৯৮ ইং, পৃঃ ১১)। মাঝে মধ্যে ছিয়াম পালন করা মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী-সেকথাই উপরের বাক্যে ফুটে উঠেছে। ছিয়াম অবস্থায় কিছু লোক ঘন ঘন থুথু ফেলেন। তাদের ধারণা থুথু গিললে ছিয়াম ভঙ্গ হয়ে যায়। এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। ঘন ঘন থুথু ফেলা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। থুথুর সাথে দেহের অনেক মূল্যবান পদার্থ যেমন ‘টায়ালিন’ (Ptyalin) বেরিয়ে যাওয়ায় শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। এ বদঅভ্যাস অবশ্যই পরিত্যাজ্য। নিম্নে ছিয়ামের স্বাস্থ্যগত উপকার তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

বদ্হজম

মানুষের অতি সাধারণ এবং বহুল পরিচিত রোগ বদ্হজম। যে রোগ সাধারণত ক্ষুধার পূর্বে খাওয়া, অধিক পরিমাণে আহার করা, পরিশ্রমের পর বিশ্রামের পূর্বেই আহার করা ইত্যাদি কারণে হয়ে থাকে। এই অতিরিক্ত খাবার দ্রুতগতিতে ক্ষুদ্রান্ত্রের নিচের অংশে নেমে আসে ফলে ঐ খাদ্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় এনজাইম সুষ্ঠুভাবে ক্রিয়া করতে না পারায়, উক্ত খাদ্যের সঙ্গে সিকামে অবস্থিত জীবাণু দ্বারা গ্যাস সৃষ্টি হয়। এর ফলে পেট ব্যাথা, পেট ফাঁপা, দুর্গন্ধযুক্ত বায়ু নিঃসরণ হওয়া, বমি হওয়া, এমনকি শুরু হতে পারে ইনডাইজেসটিভ ডায়রিয়া। আর ডায়রিয়া থেকে শুরু হয় ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। পরিণামে মৃত্যুও হতে পারে (মর্ডাণ মেডিসিন, গৃহীত : মাসিক আত-তাহরীক, জানুয়ারী ১৯৯৮, পৃঃ ১৯)। ছিয়াম সাধনারত ব্যক্তি সাধারণত এসব সমস্যা থেকে বেঁচে থাকে। যা স্বাভাবিকভাবে বদ্হজম দূর হওয়ার প্রধান অবলম্বন।

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র

ছিয়াম মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের নানাভাবে উপকার করে। ছিয়াম মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে, তাকে উজ্জীবিত ও উর্বর করে। এর ফলে মানুষের ধ্যান-ধারণা, মন-মানসিকতা পরিচ্ছন্ন হয় এবং স্নায়ুবিক অবসাদ ও দুর্বলতা দূর করে, সুদীর্ঘ অনুচিন্তন ও ধারণ সম্ভব হয়। যার ফলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহের এক অতুলনীয় ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, যা সুস্থ স্নায়ুবিক প্রক্রিয়ার পথ প্রদর্শন করে এবং সূক্ষ্ণ অনুকোষগুলি জীবাণুমুক্ত ও সবল রাখে (ডাঃ মুহাম্মাদ তারেক মাহমুদ, সুন্নাতে রাসূল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান (ঢাকা : আল-কাউসার প্রকাশনী, রমজান ১৪২০), ১ম ও ২য় খন্ড, পৃঃ ১৫১)। পন্ডিতগণ বলেছেন, Empty stomach is the power house of knowlege. ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের অাঁধার’। ছিয়াম সাধনায় মানুষের মানসিক ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। মনোসংযোগ ও যুক্তি প্রমাণে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আর স্নায়ুবিক প্রখরতার জন্য ভালোবাসা, আদর-স্নেহ, সহানুভূতি, অতিন্দ্রীয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। তাছাড়া ঘ্রাণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বোধশক্তির তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে ডাঃ আলেক্স হেইগ বলেন, ‘ছিয়াম হতে মানুষের মানসিক শক্তি ও বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলি উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়’ (অধ্যাপক সাইদুর রহমান, মাহে রমজানের শিক্ষা ও তাৎপর্য (ঢাকা : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৮৫ ইং), পৃঃ ১৭)

হৃদপিন্ড ও ধমনীতন্ত্র

ছিয়াম সাধনা হৃদপিন্ড ও ধমনীর সচলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানব দেহে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমার কারণে রক্তে কলেস্টেরল (Cholesterol) বেশী থাকে। রক্তে স্বাভাবিক কলেস্টেরলের পরিমাণ হল ১২৫-১৫০ মিলিগ্রাম ১০০ মিলিমিটার সিরামে (পাজমে)। এর বেশী হলে হৃদপিন্ড, ধমনীতন্ত্র ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি মারাত্মক রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করে এবং ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যেমন- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, পিত্তথলিতে পাথর, বাত প্রভৃতি মারাত্মক জটিল রোগ। কিন্তু নিয়মিত ছিয়াম পালনের ফলে দেহে অতিরিক্ত মেদ জমতে পারে না এবং রক্তের কলেস্টেরলের পরিমাণ স্থিতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে (নূরুল ইসলাম, প্রবন্ধ : সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিয়াম সাধনা, মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ২০০১, ৫ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃঃ ৪-৫)। ছিয়াম পালন করার কারণে সারাদিন না খাওয়ায় এবং দীর্ঘ এক মাস এই প্রক্রিয়া চালু থাকায় তাদের শরীরে নতুন করে কোন কোলেস্টেরল জমা হওয়ার সুযোগ পায় না। বরং আগের জমাকৃত কোলেস্টেরলগুলিও ব্যয়িত হয়ে তার পরিমাণ কমে যায়। ফলে ড্রেজার দিয়ে নদী ড্রেজিং করলে সেখানে যেমন পানির প্রবাহ বেড়ে যায়, তেমনি এই শিরাগুলির রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে তারা এসব ভয়াবহ রোগের হাত থেকে মুক্তি পায় (ডাঃ (ক্যাপ্টেন) আব্দুল বাছেত, প্রবন্ধ : মেডিকেল দৃষ্টিতে সিয়াম, দৈনিক ইনকিলাব, ২৭ নভেম্বর ২০০০, পৃঃ ১০)। তাছাড়া হৃদপিন্ডের ধমনীসহ সকল প্রকার ধমনীতন্ত্রগুলিও স্বাভাবিক পরিষ্কার, স্বচল ও সক্রিয় রাখে।

লিভার ও কিডনী

লিভার ও কিডনী মানুষের শরীরের অন্যতম দু’টি ইঞ্জিন। যকৃত (Liver) মানব দেহের এক বৃহত্তম গ্রন্থি। যকৃতের ডান অংশের নীচে পিত্তথলি থাকে। যকৃত কর্তৃক ক্ষারিত পিত্ত জীবদেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। যকৃতের কার্যক্ষমতা লোপ পেলে জন্ডিস, লিভার সিরোসীস সহ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হয়। স্নেহ পদার্থ শোষণে পিত্তলবর্ণ অংশ নেয়। এ ছাড়াও ল্যাক্সেটিভ কাজে অংশ নেয় এবং কলেস্টেরল লিসিথিন ও পিত্তরঞ্জক দেহ হতে বর্জন জরে। (শরীর বিদ্যা, সেলফ্ এসেসমেনট (মাসিক কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স, নভেম্বর ২০০২), পৃঃ ৩২)। কিন্তু ছিয়াম সাধনার ফলে এই কার্যক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় এবং সকল অঙ্গগুলি সক্রিয় হয়ে উঠ। অন্যথায় ছিয়ামের অসীলায় যকৃত ৪ হতে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত স্বস্তি গ্রহণ করে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দাবী খুবই যুক্তিযুক্ত যে, যকৃতের এই অবসর গ্রহণের সময়কাল বছরে কমপক্ষে একমাস হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। (সুন্নাতে রাসূল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৪৮)। কেননা যকৃতের দায়িত্বে খাবার হযম করা ব্যতীত আরো পনের প্রকার কাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে (ঐ, পৃঃ ১৪৭)। তাছাড়া যকৃত স্বীয় শক্তিকে রক্তের মধ্যে Globunin সৃষ্টিতে ব্যয় করতে সক্ষম হয় (ঐ, পৃঃ ১৪৮)

অনুরূপ কিডনীও (Kidney) শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম। কিডনীকে জীবনও বলা হয়। কিডনী দেহে ছাকনী হিসাবে কাজ করে। যাকে রেচনতন্ত্র বলা হয়। কিডনী প্রতি মিনিটে ১ হতে ৩ লিটার রক্ত সঞ্চালন করে। রক্তের অপদ্রব্য পৃথকীকরণের মাধ্যমে মূত্রথলিতে প্রেরণ করে (শরীর বিদ্যা, পৃঃ ৩০-৩২)। ছিয়াম অবস্থায় কিডনী বিশ্রামে থাকে (সুন্নাতে রাসূল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৪৯)। কিন্তু তার রেচনক্রিয়া অব্যাহত রেখে প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ করে যার জন্য মানুষ সুস্থ থাকে এবং রক্ত পরিষ্কার ও বর্ধিত হয়।

পাকস্থলী ও অন্ত্র

ডাঃ সলোমান তার গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিধিতে মানব দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ‘ইঞ্জিন রক্ষা কল্পে­ মাঝে মাঝে ডকে নিয়ে চুল্লি­ হতে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাষিত করা যেমন আবশ্যক, উপবাস দ্বারা মাঝে মাঝে পাকস্থলী হতে অজীর্ণ খাদ্য নিষ্কাশিত করাও তেমনি আবশ্যক’ (মিশকাত, ছিয়াম পর্ব, (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী ১৯৯৬), পৃঃ ২১২)। যকৃত ও পাকস্থলীর অবস্থান পাশাপাশি। কখনো বিভিন্ন খারাপ খাদ্যের প্রভাব যকৃতের উপর পড়ে। পাকস্থলী স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড মেশিন। যার ভিতরে অনায়াসে বিভিন্ন প্রকার খাবার হজম হয়। পাকস্থলীসহ অন্যান্য অঙ্গ সক্রিয়ভাবে ২৪ ঘণ্টা কর্তব্যরত থাকা ছাড়াও স্নায়ুচাপ ও খারাপ খাদ্যের প্রভাবে এতে এক প্রকার ক্ষয় সৃষ্টি হয় (ঐ, পৃঃ ১৪৭)। আবার অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর আয়তনও বৃদ্ধি পায়। আর এই আয়তন বর্ধিত হওয়াতে মানুষের শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর (শরীর বিদ্যা, পৃঃ ৩০-৩২)

কিন্তু দীর্ঘ একমাস ছিয়াম সাধনা পাকস্থলীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। শরীরের অন্যান্য পেশির মত পাকস্থলীকে খাদ্যমুক্ত বা বিশ্রামে রাখা প্রয়োজন। এতে করে ক্ষয় পূরণ ও পুনর্গঠন কাজে সাহায্য করে। তাছাড়া গ্যাষ্ট্রিক জুইস এনালাইসিস করে যে এসিড কার্ভ পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে, ছিয়াম অবস্থায় পাকস্থলীর এসিড সবচেয়ে কম থাকে। আমরা ধারণা করি যে, ছিয়াম অবস্থায় এসিডিটি বেড়ে যায়। এ ধারণা সম্পূর্ণ  ভ্রান্ত। প্রকৃত সত্য হল, ছিয়াম অবস্থায় এসিডিটি বাড়ে না, বরং কমে যায় এবং পেপটিক আলসার নির্মূলে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে ডাঃ মুহাম্মাদ গোলাম মুয়াযযম দীর্ঘ গবেষণা করে (১৯৫৮-১৯৬৩ পর্যন্ত) বলেন, ‘শতকরা প্রায় ৮০ জন ছিয়াম পালনকারীর পাকস্থলীতে অম্লরসের এসিডিটি স্বাভাবিক। আবার প্রায় ৩৬% জনের অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক রয়েছে। প্রায় ১২% ছায়েমের এসিডিটি সামান্য বেড়েছে। তবে কারো ক্ষতির পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং ছিয়াম পালনকারীর পেপটিক আলসার হতে পারে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও মিথ্যা (ডাঃ মুহাম্মাদ গোলাম মুয়াযযাম, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ইসলাম (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, নভেম্বর ১৯৯৭ ইং), পৃঃ ৮-৯)

উত্তর নাইজেরিয়ায় অবস্থিত জারিয়ার Wusasa Hospital-এর ডাক্তার E. T. Hess ১৯৬০ সালে লিখেছেন, As regards your inquiry reference cases of peptic the incidence of this disease here amongst the Africans living in a tribal manner appears to be absolutely nill. অর্থাৎ ‘পেপটিক আলসার রোগীর অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ অঞ্চলে দেখা গেছে যে, উপজাতীয় জীবনধারায় যারা জীবন-যাপন করে তাদের মধ্যে একজনও পেপটিক আলসারের রোগী নেই’ (Scientific Indication in the Holy Quran, (Dhaka : Inlamic Foundation Bangladesh, June 1995), p. 63.)। কারণ উপজাতীয়রা ছিয়াম পালন করত এবং মদ ও তামাকযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। তাই তাদের পাকস্থলীতে কোন প্রকার জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়নি।

অগ্নাশয় ও কোষ নিয়ন্ত্রণ

অগ্নাশয় (Pancreas) মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর গ্রন্থিরসে ইনস্যুলিন (Insulin) নামক এক প্রকার হরমোন তৈরী হয়। এই ইনস্যুলিন রক্তের মাধ্যমে দেহের প্রত্যেক কোষে পৌঁছে এবং গ্লুকোজেন (Glycogen) অণুকে দেহ কোষে প্রবেশে সাহায্য করে। অন্যথায় ইনস্যুলিন তৈরী ব্যাহত হলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ডায়াবেটিস রোগ হয় (শরীর বিদ্যা, পৃঃ ৩১)। কিন্তু ছিয়াম সাধনার ফলে পাকস্থলী বিশ্রামে থাকে হেতু সেখানে খাদ্যরস বা গ্লুকোজ তৈরী ব্যাহত হয়। পক্ষান্তরে অগ্নাশয়ে ইনস্যুলিন তৈরী অব্যাহত থাকে। যার কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয় না এবং ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য মারাত্মক রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা সিংহভাগ কমে যায়।

দেহের কোষের (Cell) মধ্যে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গেলে, শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় এবং কোষগুলি পূর্বের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়। এছাড়া শরীরে বাড়তি মেদ (চর্বি) জমতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং ক্যালোরির অভাবে মেদ ক্ষয় হতে থাকে। যার জন্য স্থূলকার কমে যায় এবং স্বাস্থ্য স্বাভাবিক সুঠাম হয়। শরীরের অধিক ভার কমানোর জন্য এটাও এক প্রকার ‘থেরাপিউটিক’ ব্যবস্থা (Scientific Indication in the Holy Quran, p. 62-63.)। জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একথা স্বাভাবিকভাবে বলা যায় যে, লালা তৈরীকারী কোষগ্রন্থি, গর্দানের কোষগ্রন্থি এবং অগ্নাশয়ের কোষগ্রন্থি সমূহ অধীর আগ্রহের সাথে মাহে রামাযানের অপেক্ষায় অপেক্ষমান থাকে (সুন্নাতে রাসূল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৫০)। আর এভাবেই ছিয়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও স্থুলকার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আবার ওযন কমেও মানুষ দুর্বলবোধ করে না। বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সুস্থতাবোধ করে।

জিহবা ও লালাগ্রন্থি

জিহবা মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। জিহবা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ দান। জিহবায় অসংখ্য কোষের সমষ্টি স্বাদ নলিকা রয়েছে। এগুলি দ্বারা খাবারের বিভিন্ন স্বাদ গ্রহণ করা যায়। স্বাদ নলিকা চার ভাগে বিভক্ত। যথা- জিভের গোড়ায় ঝাল-মিষ্টি, পেছনের অংশে তেতো, দু’পাশে নোনতা, টক ও কষা। তবে জিভের ঠিক মাঝখানে কোন স্বাদ নলিকা না থাকায় সেখানে কোন স্বাদ পাওয়া যায় না (শরীর বিদ্যা, পৃঃ ৩৩)। ছিয়াম সাধনায় ছায়েমের জিহবা ও লালাগ্রন্থিগুলি বিশ্রাম গ্রহণ করে। যার দরুণ জিহবার ছোট ছোট স্বাদ নলিকাগুলি সতেজতা ফিরে পায় এবং খাবারের প্রতি রুচিরও প্রবলতা ফিরে আসে। তাছাড়া আহারের সময় খাদ্যদ্রব্য চিবাতে, গলধঃকরণ ও হযম করতে লালা গ্রন্থিগুলি থেকে এক প্রকার রস নিঃসৃত হয়। ছিয়াম পালনের ফলে এ রস বেশী বেশী নির্গত হয়। ফলে পাকস্থলীর হযম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন প্রকার রোগ-ব্যাধি দূর হয় (তদেব)

মনের প্রতিক্রিয়া

শারীরিক কতগুলি রোগ-ব্যাধির উৎসের অন্যতম কারণ হল মানসিক অশান্তি বা অমানবিক পীড়া। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, কতগুলি শারীরিক ব্যাধির কারণ হচ্ছে ‘মানসিক পীড়া’। এগুলিকে পৃথক রোগ সাইকোসোমেটিক (Psychosomatic) ব্যাধি হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন-হাঁপানী, গ্যাসটিক-আলসার, বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেন, হৃদরোগ, হিপার থিরোডিজম, কোরনারী, মাসিক ঋতুর অনিয়ম প্রভৃতি।

সাধারণত মানুষ পরস্পর বিরোধী দু’টি স্বভাব, পশুত্ব ও মানবিক দিক দ্বারা পরিচালিত হয়। কোন ব্যক্তির উপর যদি পশুত্বের প্রভাব বেশী পড়ে, তবে মানুষ পশুসুলভ হয়। পক্ষান্তরে মানবিক দিকের প্রভাব বেশী প্রাধান্য পেলে সে আদর্শবান, নিষ্ঠাবান, সৎ ও ধার্মিক হয়।

রামাযানের একমাস ছিয়াম সাধনা মানুষের মনের সকল প্রকার পশুত্বকে ভস্মীভূত করে এবং মানবিক দিক সমূহ উন্মোচিত করে। যার কারণে মানুষ আল্লাহর দিকে ধাবিত হয় এবং আদর্শবান মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে। এ বিষয়ে The Cultural History of Islam গ্রন্থে যথার্থই বলা হয়েছে- The fasting of Islam has a wonderful teaching for establishing social unity, brotherhood and equity. It has also an excellant teaching for building a good moral character. অর্থাৎ ‘সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় ইসলামের ছিয়ামে রয়েছে এক অভাবনীয় শিক্ষা। এতে উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠনের এক চমৎকার শিক্ষাও রয়েছে’ (নূরুল ইসলাম, প্রবন্ধ : সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিয়াম সাধনা, মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ২০০১, পৃঃ ৪)

নেশা পরিহারের সুবর্ণ সুযোগ

আমরা জানি ধূমপান সহ সর্বপ্রকারের মাদকতা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যার শেষ পরিণাম মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। ‘ধূমপানে বিষপান’ একথাটি সর্বাংশে সত্য। বরং সিগারেটের ধোঁয়া একজন অধূমপায়ী ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বেশী ক্ষতি করে। যদিও অন্যের ক্ষতি করার কোন অধিকার কারো নেই, তথাপি ধূমপায়ী লোকেরা বাসে-ট্রেনে, লঞ্চে-স্টিমারে, অফিসে-ক্লাবে একাজটি করে থাকে সর্বদা মহা স্বস্তিতে বঙ্কিম ভঙ্গিতে ধোঁয়া উড়িয়ে। তিনি নিজে ধূমপান করেন ও অন্যের দেহে বিষপ্রয়োগ করেন। রামাযানুল মোবারাকে বাধ্যতামূলকভাবে সারাদিন ধূমপান না করায় ফুসফুস দীর্ঘ সময় ধরে নিকোটিনের বিষক্রিয়া হতে মুক্ত থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হয় (মাসিক আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ২০০০, পৃঃ ২)। তাছাড়া যারা ধূমপান ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য রামাযান একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়। ছিয়ামের এক মাসের প্রশিক্ষণ বাকী এগারটি মাসে কাজে লাগাতে পারলে চিরদিনের জন্য ধূমপান সহ সর্বপ্রকারের মাদকতা পরিহার করা সম্ভব।

শেষকথা

ছিয়াম পালনের মধ্যে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যা কতিপয় অমুসলিম পন্ডিতের গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে। প্রফেসর মুর পাল্ড দিল ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র পরিচিত নাম। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমি ইসলামী বই-পত্র অধ্যয়ন করেছি। যখন ছিয়ামের অধ্যায়ে পৌঁছলাম তখন আমি বিস্মিত হলাম যে, ‘ইসলাম স্বীয় অনুসারীদেরকে এক মহৎ ফর্মুলা শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম যদি স্বীয় অনুসারীদেরকে অন্য আর কিছুই শিক্ষা না দিয়ে শুধুমাত্র এই ছিয়ামের ফর্মুলাই শিক্ষা দিত তাহলেও এর চেয়ে উত্তম আর কোন নেয়ামত তাদের জন্য হত না। আমি চিন্তা করলাম যে, ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এভাবে আমি মুসলমানদের পদ্ধতিতে ছিয়াম রাখা শুরু করে দিলাম। আমি দীর্ঘদিন যাবত পেটের ফোলা (Stomach Inflammation) রোগে আক্রান্ত ছিলাম। অল্পদিন পরেই অনুভব করলাম যে, রোগ অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। আমি ছিয়াম অনুশীলন অব্যাহত রাখলাম, কিছুদিনের মধ্যে শরীরে আমূল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলাম। এভাবে চলতে থাকলে দেখতে পেলাম আমার শরীর স্বাভাবিক হয়ে গেছে এবং দীর্ঘ একমাস পর শরীরে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে’ (সুন্নাতে রাসূল (সাঃ) ও আধুনিক বিজ্ঞান, পৃঃ ১৪৩)। একজন অমুসলিমের পরীক্ষিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ছিয়াম পালনের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্যগত যে উপকার সাধিত হয় তা বর্ণনাতীত। মানুষ রামাযানের ছিয়ামের পাশাপাশি অন্যান্য নফল ছিয়ামগুলি পালন করলে এমনিতেই নানান রোগ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!

লেখক : কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি; শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।

ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর

লেখক : কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি; শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।



বিষয়সমূহ: ছিয়াম-রামাযান
আরও