বাংলাদেশের বাজেট ২০২৩-২৪

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 301 বার পঠিত

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের বেশ ভীতিই শেষ পর্যন্ত সঠিক হ’ল। মানুষের চাওয়া-পাওয়া তো পূরণ হয় নি; বরং আরও বোঝা হয়ে দাঁড়াল। মানুষের চাওয়া ছিল মূল্যস্ফীতি কমানো, চাকরির বাজার বৃদ্ধি, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখা। এই বাজেটে তাদের আকাংখা যথারীতি পূরণ হয় নি। বাজেট আসে, বাজেট যায় সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা অপূর্ণই রয়ে যায়। 

বাজেট ইতিহাস : স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রথম বাজেট ছিল অনেকটাই বিদেশী অনুদান ও ঋণনির্ভর। ১৯৭২ সালের ৩০শে জুন মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিন বছরের ব্যবধানে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ১ হাযার ৮৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে শুরু হয় সামরিক শাসন। ঐ অর্থবছরে ১ হাযার ৯৮৯ কোটি টাকার বাজেট। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাযার ৯৬০ কোটি টাকা। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে বিএনপি সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ১৫ হাযার ৫৮৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। পাঁচ বছর পর ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ে প্রায় দেড় গুণ। আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ঘোষিত বাজেটের পরিমাণ ছিল ২৪ হাযার ৬০৩ কোটি টাকা।

২০০৩ সালে ৩১তম বাজেট প্রথমবারের মত ৫০ হাযার কোটি টাকা ছাড়ায়। ঐ বছর বাজেটের আকার ছিল ৫১ হাযার ৯৮০ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের জাতীয় বাজেটের আকার দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাযার ৮১৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ২২ হাযার ৪৯১ কোটি টাকা।

ধারাবাহিকতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৪ হাযার ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী হিসাবে আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন ৫ লাখ ২৩ হাযার ১৯০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাযার কোটি টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের ৫০তম বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাযার ৬৮১ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের ৫১তম জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাযার ৬৪ কোটি টাকা।

দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট : গত ২৬শে জুন’২৩ দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট পাস হয়। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের ৫২তম জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ৭ লাখ ৬১ হাযার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এই বাজেটের নাম দিয়েছেন ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’। কিন্তু বৃহৎ এই বাজেট পাশ হ’ল এমন সময় যখন করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্ব জুড়েই মন্দা চলছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে।

বাজেটের নানা দিক :

ধনীদের স্বস্তি, করের বোঝা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর : আগামী অর্থবছরে করমুক্ত বার্ষিক আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রস্তাবিত কর ব্যবস্থা অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে ধনীদের ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদের ওপর কোন সারচার্জ দিতে হবে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বর্তমান ৩ কোটি টাকার সারচার্জমুক্ত সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তার আগে এটি ছিল ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে কর কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগের ওপর ট্যাক্স ক্রেডিট বিধিমালায় পরিবর্তন এনেছে। যা উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের উপকৃত করেছে আর নিম্ন আয়ের করদাতাদের ওপর আরও বেশী বোঝা চাপিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিদায়ী অর্থবছরে নিম্ন আয়ের মানুষ কোন স্বস্তি পায়নি।

খাতভিত্তিক বরাদ্দ : আগামী বাজেটে ১৩টি খাতে ৭ লাখ ৬১ হাযার ৭৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। খাতভিত্তিক বরাদ্দ হ’ল (১) জনসেবা খাতে ২ লাখ ৭০ হাযার ২৭০ কোটি টাকা, (২) স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪৯ হাযার ৩৪২ কোটি টাকা, (৩) প্রতিরক্ষা খাতে ৪২ হাযার ১৪২ কোটি টাকা, (৪) জন নিরাপত্তা খাতে ৩২ হাযার ২৬৫ কোটি টাকা, (৫) শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১ লাখ ৪ হাযার ১৩৯ কোটি টাকা, (৬) স্বাস্থ্য খাতে ৩৮ হাযার ৫০ কোটি টাকা, (৭) সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৪০ হাযার ৮৫২ কোটি টাকা, (৮) আবাসন খাতে ৭ হাযার ৪২৮ কোটি টাকা, (৯) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩৪ হাযার ৮১৯ কোটি টাকা, (১০) শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৫ হাযার ৫৮৮ কোটি টাকা, (১১) পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৮৭ হাযার ৬২৫ কোটি টাকা, (১২) কৃষি খাতে ৪৩ হাযার ৭০৩ কোটি টাকা এবং (১৩) বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে ব্যয় ৫ হাযার ৫৬২ কোটি টাকা।

এবারও গুরুত্বহীন স্বাস্থ্যখাত : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে মোট ৩৮ হাযার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের বাজেটে ছিল ৩৬ হাযার ৮৬৩ কোটি টাকা।

শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে : আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ইউনেস্কোর পরামর্শ, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরী শিক্ষার জন্য মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৮৮ হাযার ১৬২ কোটি টাকা শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাযার ৪৪৯ কোটি টাকা।

কৃষি খাতে বরাদ্দ কমেছে : কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারী বরাদ্দের নিরিখে এবার এই খাতে বরাদ্দ শতকরা দশমিক ৩৩ ভাগ কমেছে। আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাযার ৩৭৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের শতকরা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাযার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমেছে : আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ হাযার ৬০৭ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাযার ৭ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ কম। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা বাড়ছে। তাদের জন্য ৬ হাযার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে এবং ৫ হাযার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান আছে।

সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়ছে : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ১১ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৩ হাযার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মোট ১ লাখ ২৬ হাযার ২৭২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ইসির বাজেট বাড়ছে : নির্বাচনী বছরে নির্বাচন কমিশনের মোট বাজেট বাড়ছে ৮৬৮ কোটি টাকা। তবে কমিশনের জন্য উন্নয়ন বাজেট ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিদায়ী বাজেট থেকে ৪৬৭ কোটি টাকা কমছে। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, এই সাংবিধানিক সংস্থাটির পরিচালনা বাজেট আগের বাজেটের চেয়ে ১ হাযার ৩৫৭ কোটি টাকা বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের সামগ্রিক বাজেট বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ১ হাযার ৫৩৮ কোটি টাকা বেড়ে আসন্ন অর্থবছরে দাঁড়াচ্ছে ২ হাযার ৪০৬ কোটি টাকা।

জ্বালানিতে বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে বিদ্যুতে বাড়ছে ৪০ শতাংশ : জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৪ হাযার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ২৬ হাযার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আগামী অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৩ হাযার ৭৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশী। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ২৪ হাযার ১৩৯ কোটি টাকা। জ্বালানি বিভাগের বরাদ্দ আগামী অর্থবছরের জন্য ৪৯ শতাংশ কমিয়ে ৯১১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ বিভাগের বরাদ্দ ছিল ১ হাযার ৭৯৮ কোটি টাকা।

রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা : বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়, মুনাফা বা মূলধনের ওপর কর, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাযার কোটি টাকা। মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, স্ট্যাম্প বিক্রয় ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ২০ হাযার কোটি টাকা। আর লভ্যাংশ ও মুনাফা, সূদ, জরিমানা, দন্ড, সেবা বাবদ প্রাপ্তি, ভাড়া ও ইজারা, টোল, অন্যান্য রাজস্ব প্রাপ্তি ইত্যাদি থেকে আয় ধরা হয়েছে ৫০ হাযার কোটি টাকা।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ের যে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আদায় করা সরকারের জন্য কঠিন হবে। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থতা, যেটা দীর্ঘদিন ধরে আরও বাড়ছে, সেটাই এই বাজেটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে সরকারের সামনে সহজ সমাধান টাকা ছাপানো। কিন্তু তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। কারণ এতে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হবে, বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে। বিদেশী ঋণ ১০ বিলিয়ন ধরা হয়েছে। যা পুরোপুরি আসবে কি-না তা নিশ্চিত নয়। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় করা অর্থের পরিমাণ ক্রমে ৬৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতি ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব না’।

মূল্যস্ফীতি : বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৯৪ শতাংশ, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। মহামারীর কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে পরপর দুই বছর অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, বাংলাদেশের মত অনেক দেশে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে গত একবছর ধরেই আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। কিন্তু তার ফলে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্য পণ্যের দাম উচ্চ মাত্রায় বেড়েই চলেছে।

বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বরং বাজেটে অর্থ সংগ্রহের দিকে বেশী নযর দেওয়া হয়েছে। ফলে বাজেটে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ওপর করারোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়াও বাজেটে ভ্যাট ও শুল্ক-কর খাতে এমন অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যয় বাড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতির যে গভীর সমস্যা চলছে, সেসব সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ এই বাজেটে নেয়া হয়নি। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি, যা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করছে। কিন্তু এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না’।

প্রবৃদ্ধি অর্জন : বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু সেটি অর্জনের কোন সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘এ বছর বাজেটে যে সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, সেটা অর্জন করা সম্ভব নয়, সেটা হবে না। হয়ত ৬ শতাংশও হবে না। অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিয়ে বলছেন, সরকারের উচিত বাজেটের অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা। কিন্তু বেতন-ভাতা, ভর্তুকি দেয়া, প্রশাসনিক খরচের মত অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আসলে হাত বাঁধা, তাকে সেটা খরচ না করে উপায় নেই। ফলে সরকার যদি বাজেট কিছুটা ছেঁটে না ফেলতে পারে, আর রাজস্ব থেকে বা বিদেশী ঋণ থেকে যদি পরিকল্পনা মাফিক অর্থ না আসে, তাহ’লে তো সরকারের সামনে বিশাল অংকের টাকা ছাপানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সেটি ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরী করবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

সক্ষমতায় ঘাটতি : বিশাল আকারের বাজেট দেয়া হলেও তার বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের পুরো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। এই কারণে প্রতিবছরে বাজেটে যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, অনেক দপ্তর সেগুলো পুরোপুরি খরচ করতে পারে না। অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলছেন, ‘গত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, বাজেটে আসলে তিনটা ঘটনা ঘটে। প্রথমে একটা প্রস্তাবিত বাজেট, এর ছয়মাস পরে একটা সংশোধিত বাজেট আমরা দেখি, তার ছয়মাস পরে আমরা একটা মূল বাজেট দেখি। প্রস্তাবিত বাজেটের সাথে মূল বাজেটের তুলনা করলে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটের ৭৭ থেকে ৭৮ ভাগ খরচ করা গেছে। তার মানে বড় একটা পরিমাণ খরচ করা যায় না। এর দুইটা কারণ। রাজস্ব আদায় ঠিকমত হয় না, আরেকটি হ’ল মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা কম। বাজেটের সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হ’লে এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে’।

উপসংহার : অর্থনৈতিক এই টানাপোড়ন থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র সমাধান হল সম্পদে সম্পদের সুষম ও বাস্তবভিত্তিক বন্টন, যা সম্ভব একমাত্র ইসলামী অর্থনীতির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। যখনই রাষ্ট্রে শোষণমূলক পুজিবাদী ব্যবস্থাপনার অবসান ঘটবে, ইসলামী শরী‘আ অনুযায়ী অর্থনীতির সুষম সমন্বয় হবে, ধনী-গরীবের আনুপাতিক ব্যবধান কমে আসবে, সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য ইনসাফভিত্তিক বন্টনব্যবস্থা তৈরী হবে, তখনই অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সহজেই দূর করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।



আরও