ওসামা ট্র্যাজেডি এবং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র আরেক ভেল্কি

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম 410 বার পঠিত

গত ১লা মে ২০১১ সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়ার সৃষ্টি তথাকথিত ‘পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম সন্ত্রাসী’ সঊদী নাগরিক ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তত্ত্বের দাবার ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত বহুল আলোচিত, সমালোচিত এই ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুতে সারা বিশ্ব যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। যার ভয়ে পশ্চিমা বিশ্বের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, সেই ওসামাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করে পশ্চিমারা বন্য উল্লাসে ফেটে পড়েছে। তাই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যের অধীশ্বরের উল্লসিত কণ্ঠ ছিল এমন- Justice has been done ‘এই হত্যার মাধ্যমে ন্যায়বিচার সংঘটিত হয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য Death will bring great release -‘এই মৃত্যু বিরাট স্বস্তি আনবে। ওসামা সৃষ্টির অন্যতম নায়ক সেই জর্জ ডব্লিউ বুশের তাৎক্ষণিক বক্তব্য হল- Momentous victory for America ‘এটি আমেরিকার জন্য একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ বিজয়।’ কিন্তু এই কাপুরুষোচিত হত্যাযজ্ঞ কিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল তা জানাই আলোচ্য নিবন্ধের মূল উপজীব্য।

ওসামা বিন লাদেন ১৯৫৭ সালে সঊদী আরবের এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আফগানিস্তান গমন করেন। আমেরিকা আপন স্বার্থের খাতিরে আফগান মুজাহিদদেরকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। আফগান যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ বিজয়লাভের পর ১৯৯০ সালে ওসামা বীর বেশে স্বদেশে ফিরে আসেন। ১৯৯০ সালে আমেরিকার প্ররোচনায় সাদ্দাম কুয়েত আক্রমণ করার পর আমেরিকা ভোল পাল্টিয়ে কুয়েত ও সৌদি আরবের ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়। আমেরিকার এই হীন মুনাফেকী কূটনীতির পিছনে স্বার্থ ছিল, কুয়েত এবং সৌদি আরবে স্বীয় ঘাঁটি স্থাপন করা। অন্যদিকে বাদশাহ ফাহাদও নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাহায্য কামনা করেন। এসময় ওসামা বিন লাদেন বাদশা ফাহাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বিধর্মীদের সাহায্য না নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে সঊদী সরকার আমেরিকানদের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সঊদী সরকারের বিরুদ্ধে জনসম্মুখে কথা বলেন। ফলে ১৯৯২ সালে সঊদী সরকার তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করে এবং তাকে সুদানে নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে সুদান অবস্থানকালে তাঁর সঊদী নাগরিকত্বও কেড়ে নেয়া হয়। ১৯৯৬ সাল তিনি সুদান হতে আফগানিস্তানের জালালাবাদে ফিরে আসেন এবং তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সাথে জোট বাঁধেন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা সংগঠিত হয়, যাতে নিমিষেই গুড়িয়ে যায় আমেরিকার অহংকার দু’টি বিরাটকায় টাওয়ার। অস্বাভাবিক এই হামলার সম্পূর্ণ দায়ভার তাৎক্ষণিকভাবে কোন  তদন্তের পূর্বেই চাপিয়ে দেয়া হয় ওসামা বিন লাদেনের ঘাড়ে। তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ সরাসরি তাঁকে দায়ী করে টেলিভিশনে তাৎক্ষণিক বার্তা প্রেরণ করলেন। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা আজও পর্যন্ত কোন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। তাদের উদ্দেশ্য তখনই যেমন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আজও তা তেমনই সুস্পষ্ট। তা হল টুইন টাওয়ার হামলা ছিল নিছক আইওয়াশ; মূলত: এর পিছনে যারা কলকাঠি নেড়েছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল ওসামার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে মুসলিম জাতিকে নিধনের সুদূরপ্রসারী এক নীল-নকশা অাঁটা। যার মাধ্যমে একদিকে বিশ্বব্যাপী একক কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করা, অন্যদিকে একটি সম্ভাবনাময় মুসলিম সভ্যতার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যেই তারা ৯/১১-এর নাটক মঞ্চস্থ করে এবং এর মাধ্যমে কেবল ওসামা বিন লাদেনকে নয়, বরং সমগ্র মুসলিম জাতিকেই বিশ্বের নিকট সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত করার সুযোগ গ্রহণ করে।

আজ এ ঘটনার ১০ বছর পর এসে আমরা বলতে পারি, আমেরিকা তার অসৎস্বার্থ চরিতার্থ করতে যথেষ্টই সফল হয়েছে। মুসলিমবিশ্বের গায়ে সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে নানা দেশে তারা নীরবে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে নিজেদেরকে শান্তিকামী সাধুর ইমেজেও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। যে ‘শান্তিকামী’ সন্ত্রাসীদের পিছনের ইতিহাস কেবল সন্ত্রাসেরই ইতিহাস, এই অর্জন যে তাদের কাছে বড় তাৎপর্যপূর্ণই হওয়ার কথা, তা আর বলতে কি। নিরস্ত্র ওসামাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা নিজেদের তথাকথিত ’শান্তিকামী’ ইমেজটাই আরেকবার বিশ্ববাসীকে দেখানোর কোশেশ করেছে।

অথচ বিশ্বের এমন কোন দেশ খুঁজে বের করা সত্যিই দুষ্কর যেখানে মার্কিন হস্তক্ষেপ ঘটেনি। জ্বলন্ত প্রমাণগুলোর একটি হল- ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংস পারমাণবিক আক্রমণ। যে আক্রমণে মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ জাপানী মৃত্যুবরণ করে। ১৯৫০-৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে তারা মোট পঁচিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ ভিয়েতনামীকে হত্যা করে। ১৯৫৫-৭৩ সালে কম্বোডিয়ায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে দশ থেকে বিশ লক্ষ কম্বোডিয়কে হত্যা করা হয়। ১৯৫৯-৮০ কিউবার বিপ্লবের পর আমেরিকার রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে বিষাক্ত জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে কিউবায়। ফলে বহু মানুষ ও পশু মারা যায় এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয। ১৯৮১ নিকারাগুয়ায় ফার্ক বিদ্রো্হীদের উস্কানী ও অস্ত্র সহযোগিতা দিয়ে গোপন সন্ত্রাস পরিচালনার মাধ্যমে এ পর্যন্ত আমেরিকা তের হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ১৯৮৯ সাল পানামায় সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮১-৮৯ সি,আই,এ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুআম্মার গাদ্দাফীকে হত্যা করতে গিয়ে তার দু’বছরের শিশুকন্যাকে হত্যা করে। তাদের সামরিক আগ্রাসনে সেই সময় লিবিয়ায় শতশত মানুষ নিহত হয়েছে। বর্তমানে তারা আবার সেই গাদ্দাফীকে সরানোর জন্য গাদ্দাফী বিরোধীকে দিয়ে এবং ন্যাটো বাহিনীর মাধ্যমে হাজার হাজার বনু আদমকে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করছে এবং অগণিত স্থাপনা ধ্বংস করছে। ১৯৬০ সালে কলম্বিয়ায় মাদক চোরাচালান বন্ধ করার নামে মার্কিন অস্ত্র, সেনা এবং প্রশিক্ষণে কলম্বিয়া সরকার সাতষট্টি হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। ১৯৯৯ সালে কসোভোয় আকাশ পথে আক্রমণ চালিয়ে ৩,০০০ এর বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনে তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ইসরাঈলী সেনাবাহিনী কয়েক হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। তেমনিভাবে ২০০১ সালের ৭ই অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলার মাধ্যমে অদ্যাবধি প্রায় ১০ লক্ষ বনু আদমকে হত্যা করেছে এবং ২০০৩ সালের ২৩ শে মার্চ ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আমেরিকার এই নিকৃষ্ট পরিচয় সবারই জানা। কিন্তু তাদের নিখুঁত ভড়ং দেখে প্রায়শই মতিভ্রম ঘটে যায়।

তবে সবার উপর সত্য হল- সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত। তাই মার্কিনীদের টুইন টাওয়ার নাটকের নেপথ্য খোদ সেদেশেরই বুদ্ধিজীবিরা প্রকাশ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫ জনের মত বুদ্ধিজীবি এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন। তাদের নেতৃত্বে আছেন সে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টিফেন জোন্স। ৯/১১ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্কের একটি পত্রিকায় এ সম্পর্কিত এক রিপোর্টে তাঁর উদ্ধতি দিয়ে বলা হয় যে, তিনি বলেন, বিমান দুটি যেভাবে আঘাত হানে, তাতে টুইন টাওয়ার ধসে পড়া অসম্ভব। তার মতে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দখলদারিত্বকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের রণোন্মাদনাই ঘটিয়েছিল এ জঘন্য ঘটনা। বুদ্ধিজীবিদের নিকট হতে আরো বলা হয় যে, ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরী’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের অধীনে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলার অজুহাত সৃষ্টির জন্য ৯/১১ এর ঘটনা ঘটানো হয়। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যও এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলার বৈধতা প্রমাণ করতেই যুক্তরাষ্ট্র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ৯/১১-এর ঘটনা যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের পরিকল্পিত সাজানো নাটকই না হত তাহলে কেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে কর্মরত ৪ হাজার ইয়াহুদীর একজনও ঐ ঘটনার দিন কাজে যোগদান করেনি। বিমান হামলায় যারা আহত এবং নিহত হয়েছিল তাদের মধ্যে কেউই ইয়াহুদী ছিল না। ৯/১১ ঘটনার সময় নিউইয়র্কে ইস্টার্ন কোষ্ট জায়োনিষ্টদের এক জমকালো উৎসবে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল  শ্যারনের। তিনি অনুষ্ঠানটিতে যোগ দেওয়ার জন্য খুবই উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইসরাঈলী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের জেনারেল সিকিউরিটিস এপারেটাস (সাভাক) এরিয়েল শ্যারনকে উক্ত উৎসবে যোগদান করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয় আত্মঘাতী বিমান হামলার চার ঘণ্টা পর টুইন টাওয়ার সংলগ্ন একটি ভবন থেকে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা এফ,বি,আই ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ভিডিও করা অবস্থায় ৫ ইয়াহুদীকে গ্রেফতার করে। এ সময় ইয়াহুদীরা ভিডিও করার সাথে সাথে হাসি-ঠাট্টা করছিল। তাছাড়া হামলাকারী বিমানের চারজন পাইলটই ছিল মার্কিনী। তারপরও কোন প্রমাণ ছাড়াই ওসামাকে দায়ী করে তারা ২০০১ সালের ৭ই অক্টোবর রবিবার রাতের অন্ধকারে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানের উপরে বর্বরোচিত হামলা চালায়। আজও চলছে তাদের এই ধ্বংসাত্মক মরণখেলা। তারা ধ্বংস করে চলেছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলি। হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ বনু আদম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানসহ মধ্যএশিয়ার তৈলসমৃদ্ধ গরীব দেশগুলিকে কব্জা করার জন্য আফগানিস্তানকে তাদের খুবই প্রয়োজন ছিল। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদীরা পুতুল সরকার বসিয়ে আজও আফগানিস্তানকে দখল করে রেখেছে।

তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি; বরং এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলি পঙ্গু করার জন্য মারণাস্ত্রের দোহাই দিয়ে প্রায় দেড় বছরের মাথায় ২০০৩ সালের ২০শে মার্চ দিবাগত রাত্রির শেষ প্রহরে বাগদাদবাসী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তাদের উপর বৃষ্টির মত নেমে আসে হাজার হাজার টন বোমা। নিহত হয় লক্ষ লক্ষ বনু আদম। ধ্বংস করে দেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৪৫ সালে হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার চাইতে ১০ গুণ বেশি বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে কেবল ইরাকেই। হাজার হাজার টন বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে পুরো ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। লুটপাট করা হয় সে দেশের প্রধান খনিজসম্পদসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ। ধ্বংস করা হয় মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি বাগদাদের ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরীসহ বিভিন্ন ঐতিহসিক স্থাপনা। ইতিপূর্বে ১৯৮৯ সালে সিনিয়র বুশ সাদ্দামকে কুয়েতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে পুনরায় নিজেই মধ্যপ্রাচ্যের ত্রাণকর্তা সেজে কুয়েত ও সঊদী আরবের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ গ্রহণ করে। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ইরাকের উপর অবরোধ চাপিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইরাককে পঙ্গু করে রাখে এবং সেখানকার প্রায় পনের লক্ষ বনু আদমকে অনাহারে, অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করে।

এখন তারা টার্গেট করেছে পাকিস্তানকে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান মধ্যএশিয়ার মুসলিমপ্রধান ৬টি দেশ নিয়ে একটি ইসলামী ব্লক গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকার শ্যেনদৃষ্টি পড়ে পাকিস্তানের দিকে। কারণ কোন অঞ্চলে ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটুক, আমেরিকা তথা ইয়াহুদী, খৃষ্টানরা তা কখনো কামনা করেনা। বর্তমানে এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়েছে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ভারত। তাদের উদ্দেশ্য এই সুযোগে কাশ্মীর ও পাকিস্তানকে ঘায়েল করা। কিছু না হোক মার্কিন গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পাকিস্তানের ২৪টি পারমাণবিক বোমা চুরি করা অথবা এর প্রযুক্তি হস্তগত করা। তালেবানদের দমন ও পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তাদানের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কায়েমের পথ সুগম করার নীল নকশা অাঁটছে তারা।

এই সময়ই আমেরিকা পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানা আবিষ্কার করে বসে। তাও আবার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের খোদ এ্যাবটাবাদ সেনাঘাঁটির নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যেই। কাপুরুষোচিতভাবে তারা নিরস্ত্র ওসামার উপর আক্রমণ চালায় এবং তাতে তিনি নিহত হয়েছেন বলে দাবী করে। মার্কিন সূত্রগুলো তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করলেও সারাবিশ্বে এ বিষয়ে ব্যাপক ধূম্রজাল রয়ে গেছে। কেননা তাকে যদি হত্যাই করা হল তাহলে তার লাশের ছবি প্রকাশ করা হল না কেন? তাছাড়া ওবামা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ওসামার ছবি কোনদিন প্রকাশ করা হবে না। এর উদ্দেশ্য কী? আবার জীবিত ওসামার মত মৃত ওসামাও তাদের কাছে ভয়ংকর। তাই এ্যাবোটাবাদ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিয়ে সে লাশ সমুদ্র ফেলে দেওয়া হল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, আসলে পুরো ঘটনাটাই আরেক ধাপ্পাবাজি। রাজনীতি বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার ককবার্ন ‘মিথ্যার আগ্নেয়গিরি’ শিরোনামে লিখিত এক প্রবন্ধে বলেছেন যে, ওবামা, হিলারীসহ শীর্ষ মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টারা অভিযানের ঘটনা সরাসরি দেখেছেন বলে যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে সেটি সম্ভবত ছিল তাদের সবাই মিলে বাস্কেট বল খেলা দেখার দৃশ্য। তার কারণ মার্কিন এক কর্মকর্তা পেনেট্টা বলেন, মার্কিন বাহিনী ওসামার কথিত কম্পাউন্ডে ঢোকার আগেই সরাসরি ভিডিও লিংক বন্ধ হয়ে যায়। তারা প্রথমে দাবি করে ওসামা সশস্ত্র ছিলেন কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তা পেনেট্টা বলেছেন, তিনি ছিলেন নিরস্ত্র। আত্মরক্ষার জন্য তিনি তার স্ত্রীর পিছনে লুকিয়ে তার স্ত্রীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন। পরে বলা হয় তিনি তা করেননি। প্রথমে তারা বলে তার স্ত্রী তাকে রক্ষা করতে আসলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, কিন্তু পরে জানানো হয় তার স্ত্রীর পায়ে গুলির আঘাত লাগে। আর যে মৃত্যুবরণ করেছে সে অন্য একটি মহিলা ছিল। বিস্মিত হতে হয় একটি জিনিস ভেবে যে, যাকে নিয়ে মার্কিনীদের এতটা ব্যগ্রতা, যার কারণে বিশ্ববাসীর নিদ্রা হারাম হয়ে গিয়েছিল, তাকে হত্যার জন্য অভিযানটা পরিণত হল যেমন নির্বিচার ও নির্মম এক হত্যাকান্ডে, তেমনি হল একেবারেই নির্বিঘ্ন ও নিষ্কণ্টকভাবে। ঠান্ডা মাথায় একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে অতি গোপনে ভিনদেশী সৈন্যরা অনুপ্রবেশ করল। অথচ সে দেশের প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই জানতে পারল না। এখান থেকেই সুস্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশের সার্বভৌমত্বকে কতটা হেলাফেলার চোখে দেখে।

যাহোক ওসামার মৃত্যুসংবাদ প্রচার হওয়ার সাথে সাথে সারা বিশেবর মানুষের নিকট বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হতে লাগল যে, এটি ওসামার কততম মৃত্যু? কেননা এর পূর্বে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রিবিউন’ খবর প্রকাশ করেছিল ২০০১ সালের ইসরাঈল ও মার্কিন সেনাদের অভিযানে আফগানিস্তানে ওসামা নিহত হয়। ২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘টাইম ম্যাগাজিন’ খবর দিয়েছিল, আফগানিস্তানে তোরাবোরা পর্বতে মার্কিন অভিযানে আট বছর আগেই ওসামা নিহত হয়। সেই সময় ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এ আরও বলা হয়, ছয়মাস আগেই আফগানিস্তান ও পকিস্তান সূত্রে তারা জানতে পেরেছিল, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ওসামা মারা যায় এবং আফগনিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব পাবর্ত্য এলাকায় তাঁকে দাফন করা হয়। পত্রিকাটি আরও খবর প্রকাশ করে দিয়েছিল যে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এ কথা স্বীকার করেছিলেন। মিসরীয় পত্রিকা ‘আল-ওয়াফদ’ ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর এক রিপোর্ট লিখেছিল, আফগান তালেবানদের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছেন, ১৩ ডিসেম্বর তোরাবোরায় ওসামাকে সমাহিত করা হয় এবং তার জানাযায় ৩০ জন আল-কায়েদা যোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্পেকটটর ম্যাগাজিন’ ২০০১ সালে একজন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও পত্রিকার সিনিয়র অডিটর অ্যাঞ্জেলো এম কোডেভিলার (যিনি বোষ্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকাশ্যে ওসামার উপস্থিতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বস্ত্ততপক্ষে ওসামা ২০০১ সালে হঠাৎ করে মারা যান। ৯/১১ এর সত্য উদঘাটনের আন্দোলনের অন্যতম সদস্য ডেভিড রে গ্রিফিন ‘ওসামা জীবিত না মৃত’ শিরোনামে এক বই লিখেন। তাতেও তিনি প্রমাণ করেন ওসামা মারাই গেছেন। তিনি তার বইতে লিখেছিলেন, ২০০১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ওসামা কিডনি রোগে মারা যান। ওয়াজিরিস্তান সীমান্তে তোরাবোরা পর্বতে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দফন করা হয়। এরপর ওসামার যে সব অডিও-ভিডিও টেপ প্রচার করা হয় তা সবই পশ্চিমাদের বানানো নাটক এবং ইরাক ও আফগনিস্তানে হামলা চালিয়ে যাওয়ার অজুহাতমাত্র। ২০০৯ সালে ৯/১১ বার্ষিকীতে লন্ডনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকার কলামিষ্ট সু রিড লিখেছেন, ৯/১১-এর পর আমরা ওসামার যেসব অডিও টেপ দেখেছি ও শুনেছি তার সবই ণ্টুয়া প্রমাণিত হয়েছ। ওসামার প্রকাশিত টেপ ও ভিডিও সম্পর্কে গ্রিফিন বারাবার বলেছেন, ওসামার ভুয়া ভিডিও প্রকাশ বন্ধুপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার অজুহাতমাত্র। যাইহোক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তথা মুসলমানদেরকে বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতেই পশ্চিমারা ওসামার আর একটি মৃত্যু আবিস্কার করল। এই অজুহাত দেখিয়ে তারা এখন পাকিস্তানে আগ্রাসনের হাত পাকাপোক্ত করবে। কারণ পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামাকে এমন এক অবস্থানে হত্যার দাবী করা হয়েছে যেখান থেকে পাক সেনা প্রশিক্ষণকেন্দ্র অতি নিকটে। ফলে তারা সহজেই প্রমাণ করতে পারবে যে, অ্যাবোটাবাদের সেনাপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছাকাছি রেখে পাকিস্তান ওসামাকে আশ্রয় দিয়েছিল। এটি পাকিস্তানের জন্য হয়ে গেল এক বিরাট দুর্বল পয়েন্ট। যাকে সামনে রেখেই সেখানে নির্বিচারে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, পাইলটবিহীন বিমান হামলার মাধ্যমে মানবহত্যার নতুন লাইসেন্স পশ্চিমারা পেয়ে গেল। আর ভারত ও ইসরাঈল বারবার বলে আসছে যে, পাকিস্তান হল ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয়দাতা। তারা এখন আরো জোরেশোরে তা প্রচার করছে এবং তাদের সমরাস্ত্র ভান্ডার মজুত করছে। মোটকথা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক ওসামা বিন লাদেনের এই মৃত্যুকাহিনী পাশ্চাত্যের জন্য নতুন যুদ্ধক্ষেত্র অনুসন্ধানের পরিকল্পনায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট। একটি সুদূরপ্রসারী রণপরিকল্পনার অংশ হিসাবেই যে তারা এ ঘটনার জন্ম দিয়েছে তা সাদা চোখেই দৃশ্যমান।

পরিশেষে বলব, ওসামা বিন লাদেন যদি সত্যিই মৃত্যুবরণ করে থাকেন তার অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বে তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে। বরং স্বার্থসিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমারা নিজেদের প্রয়োজনে আরো ওসামার জন্ম দেবে এবং জুজুর ভয় দেখিয়ে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করেই যাবে। ফলে এ মৃত্যুতে আমেরিকার স্বার্থ পুরোপুরি উদ্ধার হলেও মুসলিম বিশ্বে এর কোনই প্রভাব পড়েনি। আমেরিকার এই রক্তাক্ত থাবার এ দৃশ্য ক্রমাগত দেখেই যেতে হবে যদি এই দানবের বিরুদ্ধে শতধাবিভক্ত মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ না হয়। অতএব মুসলিম শাসকদের প্রতি আমাদের আকুল আহবান, আসুন বিধর্মীদের পায়রবী থেকে নিজেদের সর্বতোভাবে মুক্ত করি এবং আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর শাসন     বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর বুকে ন্যায় ও কল্যাণের সুরভিত সমীরণ ছড়িয়ে দেই। নিজেদেরকে পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচাই এবং বিশ্বমানবতাকে দাসত্বের কবল থেকে উদ্ধার করি। এক ও অভিন্ন ছায়াতলে একত্রিত হয়ে সকল মুসলমান পৃথিবীর যাবতীয় অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তবেই এ পৃথিবী একদিন সত্যিকার বসবাসযোগ্য পৃথিবীতে পরিণত হবে। যুলুম, অন্যায়, অত্যাচার পরাভূত হবে এবং ন্যায় ও কল্যাণের আলোকমালায় সুশোভিত হয়ে উঠবে বিশ্বজাহান। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।

আব্দু্ল্লাহ বিন আব্দুর রহীম

লেখক: সহ-পরিচালক, সোনামণি, রাজশাহী যেলা। 



আরও