পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমাদের জাতিসত্ত্বা

ডা. সাইফুর রহমান 8958 বার পঠিত

বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ এমন কোন সাতসমুদ্র তের নদী পাড়ের দীর্ঘপথ নয়। রাজধানী ঢাকা থেকেও দেশের কোন অংশ নয় অজেয় দূরুত্বে। আজ তথ্য প্রযুক্তির এই অত্যাধুনিক যুগে গোটা বিশ্ব পরিণত হয়েছে একটি ছোট্ট পুকুরের মত; যার এক কোনায় ঢিল ছুড়লে গোটা পুকুরেই ঢেউয়ের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। কিন্তু তার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো দেশের একটি বৃহৎ অংশে (একদশমাংশ) কি ঘটছে, কিভাবে ঘটছে ইতিপূর্বে কি ঘটেছে এবং কারা ঘটিয়েছে, এর বিশেষ কিছুই জানা নেই, জানা নেই এখানে বসবাসরত জাতিসত্তার সঠিক ইতিহাস। কিংবা জানার গরজ অনুভব করেন না এদেশের বেশীর ভাগ জনগণ (বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম)। বঞ্চনার কথিত ইতিহাসের বাইরেও যে রয়েছে প্রবঞ্চনা, প্ররোচনার অকথিক কথকতা তা এখনো রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে। এ দেশের নতুন গজিয়ে উঠা এক শ্রেণীর বৃদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীত ও বর্তমানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে দেশ বাসীকে জানানোর প্রায়োজন অনুভব করেন না। এ সকল বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজ ও রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ পাশ্চাত্যেও সুরে সুর মিলিয়ে কোরাস গাইছে। এই সব বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকগণ যদি নিজ দেশের ঐক্য, সমৃদ্ধি ও সংহতির জন্য স্বীয় গবেষণা, সাহিত্য চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা ও রাজনীতি চর্চা করত তবুও আশঙ্কামুক্ত থাকা যেত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, এ দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের সাহিত্যকর্ম, সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে নির্বাসন দিয়ে ভিন্ন দেশী ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টায় নিরত। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও তারা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা নিয়ে সুখী না হয়ে বির্তকে লিপ্ত। এ ভিন্নতাই বাবুইকে স্বাধীন এবং চড়ুইকে পরাধীন করে রেখেছে।[1]

সম্মানিত সচেতন পাঠকদেরকে উদ্দেশ্যে বর্তমান জাতিসত্তার ইতিহশ্য এবং চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা বিষয়ক আলোচনার অবতারণা করা হ’ল।

ভৌগলিক অবস্থা :

দক্ষিণ পূর্বে এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বে আর বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে প্রায় ২১০২৫’ থেকে ২৩০৪০’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১০৫৫’ থেকে ৯২০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ভৌগলিক অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশের পর্বতসংকুল এলাকা জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা Chittagong hill Tracts-এর অবস্থান। বাংলাদেশের প্রশাসনিক ৩টি যেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের  মোট ১৩,১৪৮ বর্গকিলোমিটার বা ৪,০৮৯ বর্গমাইল এলাকা মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ছিল ৬,৭৯৬ বর্গমাইল। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে এর আয়তনকে কমিয়ে ৫০৮৯ বর্গমাইলে পরিণত করে।[2]

ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব :

বৃটিশ লেখক স্যার রেজিনাল্ড কুপল্যান্ড তার ‘দি কিউটার অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে একটি বিষয়ে আলোচনা আছে তা হ’ল ‘কুপল্যান্ড প্লান’ বা ‘ক্রাউন কলোনী’। ১৯৩০-এর দশকে আসাম প্রদেশের গর্ভনর স্যার রর্বাট রিড এবং স্যার রেজিন্যাল্ড কুপল্যান্ড কর্তৃক যৌথভাবে একটি প্লান দেয়া হয়েছিল।

সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, বৃটিশ কর্তৃক ভারতত্যাগের সময় ভারতকে চারটি মূল অঞ্চলে ভাগ করা হোক। অঞ্চলগুলো হলো নিম্নরূপ (&১) সিন্ধু নদীর উপত্যকা বা দি ইন্ডুজ ভ্যালী; (২) সঙ্গাদীর উপত্যকা বা দি গেঞ্জম ভ্যালী; (৩) দাক্ষিণাত্য বা দি ডেকন ভ্যালি এবং (৪) উত্তর-পূর্ব ভারত নামে পরিচিত পার্বত্য এলাকা। কুপল্যান্ড এবং ডি উভয়েরই যৌথ মত ছিল যে, যেহেতু এই পার্বত্য এলাকাটি আদতেই ভারতের না এবং বার্মারও না; তাই তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়ে লন্ডনের বৃটিশ ক্রাউনের অধীনে রাখা হোক। এই কলোনীর দক্ষিণে থাকত তৎকালীন আরকান ও তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তরে থাকত বর্তমানের ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল। উত্তর সীমান্ত হ’তে তৎকালীন ভারত ও চীনের সীমান্তরেখা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্ত হ’তে বঙ্গোপসাগরের নীল পানি।[3]

যে কারণেই হোক কুপল্যান্ড ও রিডের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এটা পরিস্কার যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত। অঞ্চলটি বিশ্বের তিনটি খুবই গুরুত্ববহ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত। (১) দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক অঞ্চল। (২) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বা আসিয়ান অঞ্চল। (৩) উত্তর-পূর্বের বিশাল চীন অঞ্চল। চীন ইতিমধ্যে পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং ভারত নিকট ভবিষ্যতে পরাশক্তি হ’তে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার উর্ধ্বে এরা কেউই নয়। বিশেষ করে ভারতের কোন প্রতিবেশী তার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। ফলে তাদের কারো সাথে তার সম্ভাব নেই। চীন ও ভারতের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক। ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারের দূরভিসন্ধির কারণে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রামকে এতদঞ্চলে অতীব প্রয়োজনীয় ভূ-কৌশলগত এলাকা হিসাবে বিবেচনা করে।[4]

১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বণ্টন ও হার নিমণরুপ-

জনগোষ্ঠীর নাম          মোট জনসংখ্যা          শতকরা হার

১. বাঙালী ................ ৫,০০,০০০ (প্রায়)..............৬০

২. চাকমা...................২,৪০,০০০ (প্রায়)...............২৪

৩. মারমা...................১,৪৩০০০ (প্রায়)................১৪

৪. টিপার (ত্রিপুরা)..........৬১,০০০ (প্রায়)................০৬

৫. মুরং....................... ২,২০০০ (প্রায়) ............২,২

৬. তনচংগা/ত্যাগনাক........ ১,৯০০ (প্রায়)...............১,১

৭. ব্যোম.......................৭০০০ (প্রায়)...............০,৭

৮. পাংখা......................৪,৫০০ (প্রায়).............০,৩৫

৯. খ্যাং.....................২,০০০ (প্রায়)................০,২০

১০. খুমি...................১,২০০ (প্রায়)................০,২০০

১১. লুমাই..................৬৬২ (প্রায়)...................০,১২

১২. ম্রো (কুকি)........৫,০০০ (প্রায়)...........৮,০০।[5]

তবে বর্তমানে প্রায় ১৩টি উপজাতি মিলে ৫ লক্ষ এবং বাঙালী মুসলমান ৭ লক্ষ; সর্বমোট প্রায় ১২ লক্ষ জনবসতি রয়েছে।[6]

১৩টি উপজাতির মধ্যে চাকমা সম্পাদায় জনসংখ্যা, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী। চাকমা ও মারমা সম্পাদায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ত্রিপুরা সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং লুমাই ও ব্যোম সম্প্রদায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী।                      [7] পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অ-উপজাতীয়দের মধ্যে শতকরা ৯৭ভাগ মুসলমান, ২ভাগ বৌদ্ধ ও ১ভাগ হিন্দু। অন্যদিকে উপজাতীয়দের মধ্যে প্রায় ৫০ভাগ বৌদ্ধ হলেও হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যাও কম নয়। আবার উপজাতি সম্পাদয়ের সবচেয়ে বড় অংশ চাকমা সম্প্রদায়ে সংখ্যা সমগ্র উপজাতীয়দের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ এবং মারমাদের সংখ্যা শতকরা ২০ভাগ।[8]  

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন অধিবাসীরা ছিল মুসলমান :

অনেকে মনে করেন যে, উপজাতিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত মালিক উপজাতীয়রা। বাঙালী মুসলমানরা সেখানে অনাহূত, আগন্তুক। কিন্তু সঠিক ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে  দেখা যাবে যে, উপজাতীয়রাই সেখানে অনাহূত, আগন্তুক এবং মুসলমানরাই প্রাচীন অধিবাসী। এমনকি সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই এখানকার অধিবাসী নয়। কেননা খ্রিষ্টীয় ৯ম-১০ম শতাব্দী থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম শাসনাধিকারে ছিল। এজন্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের ‘দারুল ইসলাম’ বলা হয়। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গবেষকদের মতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলাম এসেছিল আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বাংলাদেশের ‘রাহমী’ বংশীয় রাজা ইসলামের নবী (ছাঃ)-কে এক কলস আদা উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন বলে একটি হাদীছ থেকে জানা যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথেই তাদের প্রথম সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাদের প্রচারের ফলে স্থানীয় বহুলোক ইসলাম গ্রহণ করেন। আধুনিক গবেষণা মতে অনুমান করা হয় যে, এই সব আরব স্থানীয় মুসলিমরা খ্রিষ্টীয় ৯ম ও ১০ম শতাব্দী হ’তে চট্টগ্রাম উপকুলবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে নির্বাচিত আমীরের অধীনে শরী‘আত মোতাবেক পরিচালিত হতেন এবং এদেশীয়দের মধ্যে প্রচারকার্য চালাতেন।[9] যার ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে আরবদের যোগাযোগের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে না সূচক শব্দ ব্যবহার (নিঃসন্দেহে) আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন আলকরণ, সূলক বহর, চাকলিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করে। কোন কোন পন্ডিতের মতে, আরবী শব্দ শাৎ (বদ্বীপ) এবং সংঙ্গ (গঙ্গ) হ’তে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি হয়। এছাড়া হালিশহর, ষোলশহর নামও আরবী থেকে উদ্ভূত। যথা- হাওয়ালে শহর (শহরের উপকন্ঠ)।[10]

বান্দরবন যেলার রামুর মুসলিম জনগোষ্ঠী :

রাজা ‘মহত ইং’-এর রাজত্বকালে কয়েকটি আরব বাণিজ্যতরী রামব্রী (রাম) দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙ্গে পড়ে এবং তৎকালীন আরাকানের অন্তর্গত রামুতে আশ্রয় লাভ করে। ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস রাজমালাতে রয়েছে যে, ১৫১৩ খৃষ্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য (১৪৯০-১৫২৬) রামু পর্যন্ত অধিকার করেন। তখন রামু ও চকরিয়া নিয়ে গঠিত আরাকানের করদ রাজ্যের শাসক ছিলেন আদম শাহ। ড. মুহাম্মাদ এনামুল হকের মতে, ৯৫১ থেকে ১০০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে চট্টগ্রামের আরব বসতি স্থাপনকারী মুসলমানরা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমন্বয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে, যার প্রধানের পদবী ছিল সুলতান। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. মোহর আলীও এ মতকে সমর্থন করেছেন।[11]

সোনারগাঁ এর মুসলিম সুলতান ফখর উদ্দীন মুবারক শাহ তাঁর সেনাপতি কদল খাঁ গাজীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অধিকার করেন ১৩৪০ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রামের শহরের কাতালাগঞ্জ ও রাউজানের বদলপুর গ্রাম তার স্বীতিবহ। সোনারগাঁয়ের সুলতান জালালুদ্দীন ১৪২০ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে নিজ নামে মুদ্রা চালু করেন। ১৫০৯ থেকে ১৫১৬ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত চট্টগ্রাম। ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের দখলে ছিল। ১৫১৬ সালে মুবরাজ নুশরাত শাহ চট্টগ্রামকে জয় করে দারুল ইসলামে পরিণত করেন’।[12]

মূলত ইসলাম ধর্মের গুরুত্ব থেকেই আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য বসতি গড়ে তুলেছিল। তাদের মাধ্যমেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধারণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ৯৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বেশীরভাগ সময়ে রাজনৈতিকভাবে মুসলমানরা চট্টগ্রামের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ফলে ১৮৭২ সালের আদমশুমারীতে চট্টগ্রামের মুসলিমরা সংখ্যাধিক্য ছিল।

উপজাতীয় গোত্রদের চট্টগ্রাম আগমনের ইতিহাস :

সকল ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণনাতীতকাল থেকে বসবাস করে না। তাদের সকলেই বহিরাগত বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এই অনুপ্রবেশ স্মরণনাতীতকাল  পূর্বে ঘটেনি। মাত্র কয়েক’শ বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উপরোক্ত বাংলাদেশের এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃত নয়।[13]

মূলত, ১৮৬০ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক কোন অস্তিত্ব ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য বৃটিশ সরকার চট্টগ্রামকে কেটে পার্বত্য  চট্টগ্রাম নামে আলাদা যেলা সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন Act (আইন)-এর মাধ্যমে উক্ত যেলা থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ও পার্শ্ববর্তী আরাকান থেকে উপজাতিদের আমদানি করে। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শক্তি এবং পববর্তী ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়া যে সব জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসরাঈল, পূর্ব-তিমুর বা দক্ষিণ সুদানে পরিণত করার ঘৃণ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সে সব উপজাতি গোত্রদের চট্টগ্রাম আগমনের ইতহাস নিম্নরূপ-

(ক) চাকমা : চাকমা লেখক বিরোজ মোহর দেওয়ান লিখেছেন, একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, চাকমারা পার্বত্য  চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র নয়। তারা এর মূল আদিবাসীও নয়। বার্মা কর্তৃক আরাকান আক্রান্ত হ’লে চৌদ্দ শতকের গোড়ার দিকে চাকমারা চট্টগ্রাম এসে বাংলার সুবেদারদেও নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। বাংলার সুলতান মানবিক কারণে তাদেরকে টইনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। তখন তাদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য’।[14]

১৪০৬ খৃষ্টাব্দে বার্মার রাজা মোংশো আই (১৪০১-১৪২২) আরাকান আক্রমন করলে আরাকানের রাজা পালিয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেন। বোধগম্য কারণেই ধরে নেয়া যায় যে, যেখানে প্রাণভয়ে রাজা গৌড়ে পলায়ন করেছেন সেখানে প্রজারা নিশ্চয়ই অস্তিত্ব রক্ষার্থে সীমান্ত পার হয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।

১৫৫০ খৃষ্টাব্দে Joao De Barros নামক একজন পর্তুগীজ নাগরিক তার অাঁকা একটি মানচিত্রে CHACOMAS নামক একটি রাজ্যের উল্লেখ করেছেন। উক্ত রাজ্যটির অবস্থান ছিল শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরার দক্ষিণ-পূর্বে এবং আরাকানের উত্তরে দু’টি নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। স্থানটি নিশ্চিতভাবে তৎকালীন লুসাই হিলস বা বর্তমান মিজোরাম  রাজ্য।[15]

১৬০৭ খৃষ্টাব্দে আরাকানের রাজা সেলিম শাহ (মঘীনাম-রাজ্যগ্রী) (১৫৯৩-১৬১২) জনৈক পুর্তগীজ PHILP DE BRITO NICOTE’-এর নিকট লিখিত চিঠিতে নিজেকে The highest and the most powerful king of Arakan of Chocomas and Bangla’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।[16]

১৭৮৭ খৃষ্টাব্দের ২৪ই এপ্রিল চাকমা কর্তৃক আরাকান দখলের পর বার্মার রাজা তুরবুয়ামা চট্টগ্রামের ইংরেজ কমিশনারের কাছে লিখেন, আরাকানে বসবাসকারী চাকমারা সীমান্তের জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। মূল চিঠিটি ফার্সী ভাষায় ছিল। উল্লেখ্য যে, ১৪৩০ খৃষ্টাব্দে থেকে বৃটিশ কর্তৃক বার্মা দখল (১৮২৩-২৪) পর্যন্ত আরাকানে প্রশাসনিক ভাষা ফার্সী ছিল।

উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী উক্ত পলাতক আরাকানবাসীদের বার্মার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধে লিপ্ত রেখে ছিল। তাদেরকে চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আরাকানে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করে সমগ্র বার্মা ও আরাকানকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত করে অবশেষে ১৮২৩-২৪ সালে সমগ্র বার্মা দখল করে নিয়েছিল। উক্ত সময়কালে যে সব মগ পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বর্তমানে মারমা (মগ) নামে পরিচিত। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, চাকমাদের একটি রাজ্য ছিল যা সিলেট ও ত্রিপুরার দক্ষিণ-পূর্বদিকে ও আরাকান রাজ্যের উত্তরে অবস্থিত মিজোরাম রাজ্য। উক্ত রাজ্যসমূহ দীর্ঘদিন যাবৎ আরাকানের করদ-রাজ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। সুতরাং চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগন্তুক জাতিগোষ্ঠী।

(খ) কুকি : পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি জাতি বহিভূর্ত অন্য সকল উপজাতীয় গোষ্ঠীই এখানে তুলনামূলকভাবে নতুন বসতি স্থাপনকারী, এখানকার আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ম্রো, খ্যাং, পাংখো এবং কুকিরা মূল কুকি উপজাতির ধারাভুক্ত। ধারণা করা হয় যে, এরা প্রায় ২০০ থেকে ৫০০ বছর আগে এখানে আগমন করে।[17]

বিশস্ত সূত্রানুযায়ী এই কুকী গোত্রের উপজাতিরা মায়ানমার, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারত হ’তে এসে প্রথমে এখানে বসতি স্থাপন করে’।[18]

(গ) মারমা (মগ) : পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা জনগোষ্ঠী ষোড়শ ও সপ্তদশ খৃষ্টাব্দের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে ১৭৮৪ সালের বার্মা যুদ্ধে এ অঞ্চলে দলে দলে প্রবেশ বাধ্য হয়।

এরা ধীরে দীরে এখানে অধিপত্য বিসত্মার করেছে। বর্তমানে এরা তিনটি ধারায় বিভক্ত যেমনঃ জুমিয়া, রোয়াং ও রাজবংশী মারমা’।[19]

 (ঘ) ব্যোম : হব্যামরা মায়ানমার-চীন থেকে তাশন পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্যাম (CHT) আগমন করে। খৃষ্টান মিশনারী তাৎপরতার ফলে এদের অধিকংশই এখানে ধর্মান্তরিত খৃষ্টান। রুসাইরাত্ত এখন অধিকাংশ খৃষ্টান CHT   এর বড় জনগোষ্ঠি মুংরা এখনও প্রকৃতি পূজারী, এদের কোন ধর্মগ্রন্থও নেই।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতির মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় জনসংখ্যা, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী। চাকমা ও মারমা সম্প্রদায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী।[20]

 (ঙ) নৃতত্ত্ববিদ ও বৃটিশ প্রশাসক T.H Lewin এর মতে Agueater portion of the Hill tracts at present living in the CHT Undoubtedly come about two generation ago from Arakan, this is asserted both by their own traditions and by Records in Chittgong Collectorate.[21]

পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এদের প্রায় সবাই যুদ্ধ বিগ্রহ ও হিংস্র দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলে তাদের পুরাতন বসতিস্থল থেকে এখানে পালিয়ে এসেছে। নতুবা নতুন জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর পশ্চাতধাবন করে আক্রমণকারী হিসেবে এদেশে প্রবেশ করেছে।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, দিনাজপুর পূর্ব সাংগঠনিক যেলা]


[1]. সময়কালীন সংলাপ, এস .এম নজরুল ইসলাম (ইতিহাস অন্বেষা, তৃতীয় সংস্করণ : ২০১৭), পৃষ্ঠা ২৫-২৬।

[2]. সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও আকার, এস .এম নজরুল ইসলাম, (সাগরিকা প্রিন্টার্স, আন্দরকিল্লা চট্টগ্রাম; ২য় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০১৭), ১৭১ পৃঃ।

[3] . প্রবন্ধ : রোহিঙ্গাবিহীন রাখাইন এবং বাঙ্গালীবিহীন পার্বত্য চট্টগ্রাম, সৈয়দ মুহাম্মাদ ইব্রাহীম বীর প্রতীক (দৈনিক নয়াদিগন্ত ঢাকা, ৪ অক্টোবর ২০১৭), ৮ পৃঃ।

[4]. সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও আকার, এস. এম নজরুল ইসলাম, পৃ. ১৭১।

[5]. মাসিক আত-তাহরীক, সম্পাদকীয় ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছর পর’; ২১ তম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা এপ্রিল ২০১৮।

[6]. মাসিক আত-তাহরীক, সম্পাদকীয়, ২১তম বর্ষ ৭ম সংখ্যা।

[7]. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী ও মানবাধিকার, লে. আবু রূশদ (অবঃ), (জেড আর প্রকাশনা, ২য় সংস্করণ-১১. এপ্রিল ১৯৯৭), পৃ. ৮।

[8]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।

[9]. ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলনঃ উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ (২য় প্রকাশ, জানুয়ারী ২০১১ খৃ.), পৃ. ৪০৩।

[10]. খাল কেটে কুমির আনার পরিণাম, এস .এম নজরুল ইসলাম, (ইতিহাস অন্বেষা, প্রথম প্রকাশ : ২০১৫), পৃ. ১৮৮।

[11]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮।

[12]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮।

[13]. বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন?, মেহেদী হাসান পলাশ, মাসিক আত-তাহরীক, ২২তম বর্ষ সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৮, পৃ. ২৬।

[14]. খাল কেটে কুমির আনার পরিণাম, এস .এম নজরুল ইসলাম, পৃ: ১৮৯।

[15]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।

[16]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।

[17]. সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও আরাকান, এম.এম নজরুল ইসলাম, পৃ. ১৭৬।

[18]. পার্বত্য চট্টগ্রাম, শান্তি বাহিনী ও মানবাধিকার, লে. আবু রূশদ (অব.), পৃ. ০৮।

[19] . খাল কেটে কুমির  আনার পরিনাম, এস.এম নজরুল ইযলাম, পৃ. ১৯১।

[20]. পার্বত্য চট্টগ্রাম,শান্তি বাহিনী ও মানবাধিকার, লে.আবু রূশদ(অব.), পৃ. ৮।

[21] সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও আরাকান, এম.এম নজরুল ইসলাম, পৃঃ ১৭৭।



আরও