পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত : নাটের গুরু কারা

শেখ আব্দুছ ছামাদ 8436 বার পঠিত

পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারী যা ঘটেছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিছু বিষয়ে অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও কয়েকদিন আগেও পাহাড়ী-বাঙালীরা ছিলেন একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। একজন বিপদে পড়লে সহযোগিতার হাত বাড়াতেন অন্যজন। কিন্তু সেই সাধারণ পাহাড়ী-বাঙালীদের এমন সুসম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, কোন স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ী জনপদে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ির দাঙ্গা-হাঙ্গামা। লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের পাশাপাশি চালানো হয় বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ। সরকারী হিসাব মতে সহিংস ঘটনায় উভয় সম্প্রদায়ে নিহতের সংখ্যা ৪ জন। বেসরকারী হিসাবে আরো বেশী। ঘরবাড়ী পুড়েছে প্রায় সাড়ে চারশ’, ১৬শ’র অধিক পাহাড়ী-বাঙালী গৃহছাড়া, ভয়ে-আতঙ্কে গভীর বনে চলে গেছে প্রায় ২ হাজারের বেশী নরনারী ও শিশু।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙালীদের বর্তমান এ করুণ অবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে পাহাড়ী অঞ্চলে তাদের আগমনের ইতিহাস এবং চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। জঙ্গলে ভরা পার্বত্য অঞ্চলে কারা প্রথমে এসে বসবাস করতে শুরু করেছিল, তা নিয়ে নানা অস্পষ্টতা থাকলেও পার্বত্য অঞ্চল বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ীরা বসতি স্থাপন করে ১৬০০ খৃষ্টাব্দে। উপজাতিদের মধ্যে মুরং ও কুকিরা এখানে এসেছে আগে আর চাকমা ও মার্মারা এসেছে অনেক পরে। চাকমারা কুকিদের উত্তর-পূর্ব দিকে তাড়িয়ে দেয় আর মার্মা বা আরাকানি মগরা দক্ষিণ থেকে এসে চাকমাদের সরিয়ে দেয় উত্তর-পূর্বে। মার্মারা এসেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, তার আগে নয়। রাঙ্গামাটি যেলার বাঘাইছড়ি উপযেলার সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এল. থাঙ্গা পাঙ্খো বলেন, বাঙালিরা সাজেক ইউনিয়নে এসেছে ১৯৬০ সালের দিকে আর চাকমারা এসেছে ১৯৯৭-৯৯ সালের দিকে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপযেলা থেকে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যেসব উপজাতি বাস করে তাদের মধ্যে সংখ্যায় বেশী চাকমা, আর তাদের পরেই হল মার্মা বা আরাকানি মগ। সূচনা থেকেই উভয়ের মধ্যে কোন সদ্ভাব ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান থেকে মগরা এসে চাকমাদের তাড়িয়ে দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে। তখন থেকেই এদের মধ্যে মনোমালিন্য। চাকমাদের ভালো চোখে দেখে না পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য উপজাতিরাও। ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চংগা, কুকি, লুসাই, রিয়াং, বনযুগী ও পাংখুরাও পছন্দ করে না চাকমাদের।

উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যারা বসবাস করে তারা উপজাতি নাকি আদিবাসী? এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ও যুক্তি-তর্ক পরিলক্ষিত হয়। কারো মতে তারা উপজাতি আবার কারো মতে তারা আদিবাসী। এ বিষয়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘকে স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, রয়েছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। উপজাতি হিসাবে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে এবং বাংলাদেশ সমমর্যাদার নাগরিক হিসাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বার্থ রক্ষায় বদ্ধপরিকর’। ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ৭ম অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্কারভাবে জানায় যে, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এখানে রয়েছে বিভিন্ন উপজাতি’। এরপর একই বছরের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৩তম অধিবেশনের মতামতের জবাবেও বাংলাদেশে আদিবাসী নেই বলে জাতিসংঘকে অবহিত করা হয়। (আমার দেশ, মঙ্গলবার ২ মার্চ ’১০, পৃ. ১৩)। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক গত ২৮ জানুয়ারী ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়কে আদিবাসী অভিহিত করার অপতৎপরতা’ প্রসঙ্গে যেলা প্রশাসকদের কাছে প্রেরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতি বাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। কোথাও আদিবাসী অভিহিত করা হয়নি। তথাপি কতিপয় নেতা, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি সাংবাদিকরাও ইদানিং উপজাতি না বলে আদিবাসী বলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে প্রজ্ঞাপনে নির্দেশ দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়কে ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের বিশেষ মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), স্বঘোষিত চিটাগাং হিলট্রাক্টস কমিশন (সিএইচটি) ও বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি এনজিও। দেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালীদের সরিয়ে আদিবাসী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এসব সংস্থা সমান্তরালভাবে কাজ করছে বলে মনে করেন দেশের বিশেষজ্ঞ মহল। বাংলাদেশ সরকার উপজাতি সম্প্রদায়কে আদিবাসী বলতে নিষেধ করলেও কয়েকটি মিডিয়া ও তাদের সমর্থক তথাকথিত কতিপয় সুশীল সমাজ উপজাতিদেরকে আদিবাসী হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওদের এসব অপতৎপরতার কারণে দেশের এক দশমাংশ পার্বত্য এলাকা এখন মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে।

জানা যায়, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে ‘আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে’- এমন ক্লজ থাকায় উপজাতীয় কতিপয় নেতা দীর্ঘদিন যাবৎ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদেরকে আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে ব্যাপক লবিং করে আসছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কতিপয় বাম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছেন। এছাড়া ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে একই লক্ষ্যে দেশের কতিপয় মিডিয়া এবং এনজিও আদিবাসীদের নিয়ে আদা-জল খেয়ে ব্যাপক প্রচার প্রপাগান্ডায় মেতেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আদিবাসী স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘পূর্বতিমুর’ এর মতো একটি ‘বাফার স্টেট’[1] প্রতিষ্ঠায় মরিয়া দেশী-বিদেশী এ চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইইউ এবং তথাকথিত সিএইচটি কমিশন। এসব সংস্থার সহায়তায় অন্যান্য কয়েকটি দেশের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে একই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রয়েছে শতাধিক এনজিও। এসব এনজিও পার্বত্য দুর্গম অঞ্চলের উপজাতিদের মাঝে কয়েক বছর থেকেই উদ্দেশ্যমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।

খবরে প্রকাশ, বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার আরম্ভ হলে প্রশাসনকে না জানিয়েই দুর্গম এলাকাগুলোতে সফর করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিশন (ইইউ) ও সিএইচটি কমিশন। সফর শেষে সিএইচটি কমিশন সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালীদের সরিয়ে নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানায়। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত না করেই বিভিন্ন সময়ে এসব গ্রুপ দুর্গম অঞ্চলে এনজিওদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে যায়। এসব মিশন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে আসার পরই সংশ্লিষ্ট এলাকায় উপজাতি ও বাঙালীদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ হতে দেখা যায়। বিদেশী বিভিন্ন মিশন ও এনজিওর এরূপ উদ্দেশ্যমূলক স্বাধীন তৎপরতাই যে পার্বত্য পরিস্থিতি অবনতির জন্য দায়ী তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। তাছাড়া এটি পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষময় ফল বলে রাজনীতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

পার্বত্য অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কেউ কেউ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে দায়ী করছেন। যা আদৌ যুক্তিসংগত নয়, বরং বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক। সম্প্রতি গত ২৬ ফেব্রুয়ারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক ঊর্ধতন প্রতিনিধি ক্যাথরিন অ্যাশটন-এর পক্ষে ব্রাসেলসে দেয়া এক বিবৃতিতে তার মুখপাত্র বলেছেন, ‘১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। .... রাঙামাটি যেলার সহিংস ঘটনায় পাহাড়ী সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য নিহত হয়েছে। চারশ’ পাহাড়ী পরিবারের ঘরবাড়ী ও সম্পদ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ....এ সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা ব্যক্তিরা জড়িত থাকার অভিযোগের ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি অবহিত আছি। ....সেনাবাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ দ্রুত ও স্বাধীনভাবে তদন্তের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাই। বাংলাদেশ সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এ লজ্জাজনক ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে’।

ইইউ’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে কার্যত আমাদের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যা ঘটেছে তা অবশ্যই বেদনাদায়ক। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে সেনাবাহিনী সম্পর্কে এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদানের সাহস ইইউ পেল কিভাবে? মুক্তিযুদ্ধের দুরন্ত শার্দুল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসাবে আমাদের সেনাবাহিনী বিভিন্ন দেশে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে এরই মধ্যে বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জন করেছে এবং প্রশংসনীয়    কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে সেনাবাহিনীকে কলঙ্কিত করার স্থূল প্রচেষ্টা আসলে সেখান থেকে সম্পূর্ণরূপে সেনা প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করার ষড়যন্ত্র বলেই অনুমিত হচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পাশ্চাত্যের খুদ-কুঁড়ো খাওয়া এদেশের কোন কোন বুদ্ধিজীবী ‘বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই’ বলে যে মন্তব্য করেন তাদের সেই মন্তব্য আর ইইউ’র বিবৃতি একই সূত্রে গাঁথা। তাদেরই ষড়যন্ত্রে ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানা হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে সুশীল সমাজ মনে করেন। ৫৭ জন মেধাবী, চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষমতাকে দুর্বল করেছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে হত্যা-সংঘর্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষাকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। সীমান্ত রক্ষায় যে বিডিআর ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলায় বড়াইবাড়ীতে জীবন বাজি রেখে ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেদের দেশপ্রেম ও বীরত্ব প্রমাণ করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যে বিডিআর সীমান্ত রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে, সেই বিডিআরের কিছু বিপথগামী সদস্য দেশী-বিদেশী কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারী পিলখানায় নারকীয় হত্যাকান্ড চালিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর সুদক্ষ অফিসারদের হত্যা করে। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যেকোন বিদেশী আগ্রাসন মোকাবিলা করতেও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই এ কুচক্রীমহল চেয়েছিল বিপথগামী এই বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে। তারা চেয়েছিল বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রোশ-দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে একেবারে নির্মূল করে দিতে। কিন্তু তাতে তারা সফল হতে না পেরে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আবার সেই সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করার হীন কৌশল অবলম্বন করছে। এ দু’টি ঘটনা মূলত একই সূত্রে গাঁথা।

বাঘাইছড়িতে সংঘটিত সহিংস ঘটনার জন্য অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বলছেন। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে যদি সেনাবাহিনী না থাকতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ থাকতো না’। তাঁর মতো অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের ফলে বিভিন্ন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন কোন অঞ্চল। সে পথ বেয়েই অতি সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পাহাড়ী ও বাঙালীদের বসতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়াসহ হত্যা ও লুটপাটের মত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। সেনা প্রত্যাহারের ফলে যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, তার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে আস্থা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত না করে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের যে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে গোটা পার্বত্য অঞ্চল এখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশের অখন্ডতা রক্ষা, পাহাড়ী-বাঙালী উভয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যরুরী ভিত্তিতে আবার সেনা মোতায়েন দরকার। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন,‘প্রয়োজনে আবার সেখানে সেনা মোতায়েন করা হবে’। পরবর্তীতে নয়, বরং এখুনি সেখানে পুনরায় সেনা মোতায়েন করা প্রয়োজন বলে সামরিক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

পার্বত্য অঞ্চলে সহিংস ঘটনার জন্য আসলে কারা দায়ী? কারা পাহাড়ীদের বাড়ীঘরে আগুন লাগিয়েছে? এ প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটি যেলার বাঘাইছড়ি উপযেলার সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এল. থাঙ্গা পাঙ্খো বলেন, ‘চাকমারা নিজেরাই নিজেদের ঘর পুড়িয়ে বাঙালীদের দোষ দিচ্ছে। বাঘাইহাটের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য চাকমাদের অতি বাড়াবাড়িই দায়ী। কারণ, বাঙালীরা যেখানে বসবাস করে সেখান থেকে ঘরপোড়া স্থানের দূরত্ব এক কিলোমিটার। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বর্তমানে তারা সেনা পুলিশ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বসবাস করছে। কাজেই বাঙালীদের পক্ষে সেখানে গিয়ে ঘর পোড়ানো অসম্ভব। ফলে বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, কারা এই আগুন লাগিয়েছে’। (ইনকিলাব, ৮ মার্চ ’১০, পৃ. ১ )। খবরে প্রকাশ, সাজেকে কাচলং নামে একটা নদী আছে। যার একপাশে বাঙালীদের বসবাস আর অন্যপাশে চাকমাদের গুচ্ছগ্রাম, মাঝখানে বাজার। গত ১৯ ফেব্রুয়ারী রাত ১২-টার দিকে চাকমারা বাজার দখলের ঘোঘণা দিয়ে ‘উজাও উজাও’, ‘এ্যাডভান্স এ্যাডভান্স’ বলে সংগঠিত হতে থাকে। এ সময় তারা বাঙালীদের উচ্ছেদ করার জন্য তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন বাঙালীরাও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। গঙ্গারামমুখ এলাকায় চাকমারা নিজেরাই নিজেদের অনেক ঘরে আগুন লাগিয়েছে। পরদিন চাকমাদের গ্রাম থেকে বাঙালীদের দিকে গুলি ছোড়া হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। তারা পোশাকধারী ছিল বলে তাদের ‘কালো কুত্তা’ বলে গালাগালি করতে থাকে চাকমারা। এ সময় সার্জেন্ট রেজাউল নামে এক সেনাসদস্যকে চাকমারা দা দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মত আহত করে। এভাবে চাকমাদের কারণেই পার্বত্য অঞ্চলের সর্বত্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।  

পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটি খৃষ্টান রাষ্ট্র গঠনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যে ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যায় তার সাথে ইইউ’র বিবৃতি হুবহু মিলে যায়। ইইউ উপজাতিদেরকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে পার্বত্য অঞ্চলে অকৃপণ হস্তে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। ফলে পাহাড়ী উপজাতিদের জীবনযাত্রার মান এখন অনেক ক্ষেত্রে সমতল ভূমির মানুষের চেয়ে ভাল। যার ফলে পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে একটি বৈষম্য তৈরী হচ্ছে। আসলে তাদের উদ্দেশ্য পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জনাব অ্যাডবেরী ইন্দোনেশিয়া ভেঙে পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন করেছেন। সেই একই ব্যক্তি এখন আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে সদা তৎপর। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। পাহাড়ীরা আলাদা ভূখন্ডের দাবী তুলে আলাদা পতাকা ব্যবহারের দাবীকেও সামনে নিয়ে আসছে। পাহাড়ীদের এসব কর্মকান্ড এবং ভারতীয় কিছু সংগঠনসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাম্প্রতিক তৎপরতা স্পষ্টতই আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীনতা বিরোধী। এমনকি জাতিসংঘের কিছু অঙ্গসংস্থাও এ ব্যাপারে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ্য, পার্বত্য অঞ্চলে সহিংস ঘটনায় পাহাড়ী-বাঙালী উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়েছে এবং উভয় সম্প্রদায় একে অন্যের ঘরবাড়ীতে আগুন দিয়েছে। কিন্তু ইইউ’র বিবৃতিতে বাঙালীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ না করে শুধুমাত্র পাহাড়ীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি সর্ব মহলে রীতিমতো রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন এনজিওগুলো উপজাতিদের মাঝে যে হারে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছে, সে তুলনায় বাঙালীদের মাঝে করছে যৎসামান্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চক্রান্তের সঙ্গে দেশের চিহ্নিত একটি মহলের অপতৎপরতাও সবিশেষ লক্ষ্যণীয়। আলাদা রাষ্ট্রের দাবীতে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার কথা বিশেষভাবে বলছে জ্যোতিবিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) অনুসারীরা। সন্তু লারমার সাথীরা কলকাতায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, আবার অস্ত্র ধারণের সম্ভাবনার কথা। কিন্তু আরাকানী মগরা চাকমাদের মতো স্বাধীন হতে চাচ্ছে না। চাচ্ছে না অস্ত্র ধারণ করতে। বর্তমানে চট্র্গ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যা ঘটছে, তা ঘটে চলেছে প্রধানত চাকমাদের জন্য। অন্য কোন পাহাড়ী উপজাতিদের কারণে নয়। সন্তু লারমার সাথীরা ভারতের কলকাতায় সংবাদ সম্মেলন করে বলছে, গোটা পাহাড়ী অঞ্চলকে তারা পরিণত করবে ভিয়েতনামে। কিন্তু সন্তু লারমার সাথীদের মনে রাখা উচিত যে, এটা ভিয়েতনাম নয়, বরং এটা ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। ভিয়েতনামের অবস্থা আর বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা এক নয়।

পরিশেষে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান, বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে পাহাড়ী-বাঙালী ভাই ভাই মনে করে সবাইকে মিলেমিশে থাকাটাই অধিক শ্রেয়। কারণ, পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সব মহলের জন্য প্রভূত কল্যাণ।

[1]. দু’টি বৃহৎ বিবদমান রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ বা সংঘাত এড়ানোর জন্য দু রাষ্ট্রের মাঝখানে সাধারণত যে-ক্ষুদ্ররাষ্ট্র সৃষ্টি করা বা বজায় রাখা হয়, সেই রাষ্ট্রকেই বলা হয় বাফার স্টেট (Buffer State)। দ্র. রাজনীতিকোষ, পৃঃ ২৬৯।



বিষয়সমূহ: নীতি-নৈতিকতা
আরও