মুযাফফরনগর : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লীলাভূমি

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক 556 বার পঠিত

উপস্থাপনা :

মুসলমান কর্তৃক দীর্ঘদিন স্পেন শাসিত হওয়ার পর সেখানে মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। সাথে সাথে মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু ভারতে দীর্ঘ দিনের মুসলিম শাসনের পতন ঘটলেও এ দেশ থেকে মুসলিম চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। অথচ স্পেনের চাইতে ভারত থেকে মুসলিম জাতির চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ ছিল। স্পেন ভেঙ্গে নতুন কোন দেশ তৈরী না হলেও ভারত ভেঙ্গে শুধু মুসলমানদের জন্য একটি দেশ তৈরী হয়, যা পাকিস্তান নামে পরিচিত। তারপরে আজও ভারতের বিশ কোটি মুসলিম পাকিস্তানী, বাংলাদেশী ইত্যাদি অভিযোগ, হিন্দু কট্টরপন্থীদের হামলা, গুজরাট, আসাম ও মুযাফফরনগর সহ হাযারো দাঙ্গা ও ফাসাদের সাথে লড়াই করে টিকে আছে। এজন্য এই দেশীয় মুসলমানদের সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তাদের ভাষায়, ‘হাম ভাগ কার পাকিস্তান নাহি গায়ে, এ মূলক হামারা থা হামারা হ্যাঁয় হামারা রাহেগা’ অর্থাৎ ‘আমরা পালিয়ে পাকিস্তান যায়নি; এদেশ আমাদের ছিল, আছে, থাকবে’।  আজকের প্রবন্ধে শত বছরের ঐতিহ্য বিজড়িত ভারত ও এদেশীয় মুসলমানদের দুঃখ-সুখ বিশেষ করে মুযাফফরনগরের দাঙ্গা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।                

ভারত পরিচিতি :

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি দেশ ভারত। যাকে ইংরেজীতে ইন্ডিয়া এবং উর্দূ ও হিন্দিতে হিন্দুস্তান বলা হয়। তবে হিন্দিতে ভারতও বলা হয়। এ দেশের নামেই দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত উপমহাদেশ বলা হয়। অতীতে আফগানিস্তানের গযনী থেকে আরাকান পর্যন্ত এবং কেরালা থেকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত ভারত হিসাবে গণ্য করা হত। আজ এ দেশেরই খন্ডিত অংশ হিসাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা ও মায়ানমার-এর কিছু অংশ আলাদা আলাদা দেশে পরিণত হয়েছে। ২৮টি প্রদেশ, ৭টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ও ৬২২টি যেলা নিয়ে গঠিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই দেশটি ৩,২৮৭,২৬৩ বর্গ মাইলের এরিয়া নিয়ে গঠিত। সরকারী হিসাব অনুযায়ী শতকরা আশি জন হিন্দু এবং ১৩ জন মুসলমান। কিন্তু মুসলমানদের দাবী অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশী তথা শতকরা ২৫/৩০ জন মুসলমান অর্থাৎ পঁচিশ কোটি মুসলমান এই দেশে বসবাস করে। অমুসলিম অধ্যুষিত দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের সংখ্যা হিসাবে ভারত সবার শীর্ষে। প্রদেশ হিসাবে সবচেয়ে বেশী মুসলমান বসবাস করে কাশ্মীরে। তারপর আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, বিহার ও উত্তর প্রদেশে। এ দেশের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য হ’ল, এখানে শত জাতের শত ভাষার মানুষ বসবাস করে। এত জাতি, গোত্র ও ভাষার মানুষ মিলে গঠিত দেশের নযীর ভারত ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোথাও নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেখানে মোট তেরটি ভাষা চালু রয়েছে।

ভারতের সংবিধান মোট ৪৪৮টি ধারা (Article) নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধান। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকে ৩রা জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত ৯৮বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। সংবিধানে ভারতকে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সংবিধানে ভারতকে বলা হয়েছে, রাজ্য সমূহের সমষ্টি বা রাজ্যসংঘ (Union of States)। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো অনুসারে কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যে রাজ্য সরকার গঠিত হয়।  ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অঙ্গ রাজ্যগুলোর শাসনভার সেখানকার নির্বাচিত সরকারের ওপর ন্যস্ত। ক্ষমতা বিভাজনের ক্ষেত্রে সংবিধানে তিনটি তালিকা আছে। যথা : (ক) কেন্দ্রীয় তালিকা  (খ) রাজ্য তালিকা ও (গ) যুগ্ম তালিকা । কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো কতকগুলো বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করে ও আইন প্রণয়ন করে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়, মুদ্রা, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি ৯৭টি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আছে। একে কেন্দ্রীয় তালিকা বলে। রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন প্রভৃতি মোট ৬৬টি বিষয়ের ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলোর উপর, একে রাজ্য তালিকা বলে। এছাড়া বিচারব্যবস্থা, সংবাদপত্র, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সেচ প্রভৃতি ৪৭টি বিষয়ে যুগপৎ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলো আইন প্রণয়ন করতে পারে, একে যুগ্ম তালিকা বলে। ভারতীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও দেশের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে থাকে। যাতে দেশের ঐক্য ও সংহতি কোনো রূপেই বিঘ্নিত না হয়। একারণে সংবিধান রচয়িতাগণ কেন্দ্রের হাতে অধিকতর ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান হলেও ভারতীয় সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু আছে। ভারতের মন্ত্রিসভা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে নিযুক্ত হয়। লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রপতি হলেন নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান। রাজ্যগুলোতেও এই প্রথা চালু আছে।

এটা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করতঃ পৃথিবীর বুকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। স্বাধীনতার সময় ভারত বর্ষে দু’টি মতবাদ প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল। ১. দ্বিজাতি তত্ত্ব বা ধর্মের উপর ভিত্তি করে আলাদা দেশ গঠন। এর অধীনে একদল মুসলিম ছিলেন, যারা নিজেরা আলাদা দেশ চাইতেন। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও তার দল মুসলিম লীগ। অন্যদিকে একদল হিন্দু ছিল, যারা এই দেশ থেকে মুসলিমদের তাড়িয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চাইত। তখন এই গ্রুপটির সাংগঠনিকভাবে কোন অস্তিত্ব না থাকলেও পরবর্তীতে এরা এস এস, শিব সেনা, বাজরাং দল, বিজেপি নামে অস্তিত্ব লাভ করে এবং আজও তারা ইয়া তো পাকিস্তান যা ইয়া কবরস্থান যা অর্থাৎ ‘হয় পাকিস্তানে যা না হয় গোরস্থানে যা’ এই সেলাগান নিয়ে মুসলিমদের উপর অন্যায় ও অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে যাচ্ছে। ২. অন্য একটি মতবাদ ছিল সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ, যারা ‘অখন্ড ভারত’-এর দাবী নিয়ে দেশ ভাগের বিরোধিতা করেছিল। এই গ্রুপে হিন্দু মুসলিম উভয়ে ছিল। মুসলিমদের মধ্যে থেকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও হোসাইন আহমাদ মাদানী এবং হিন্দুদের পক্ষ থেকে মোহন চাঁদ ও করম চাঁদ গান্ধী। এরাই ভারতে কংগ্রেস পার্টি নামে পরিচিত। নেহরু ও গান্ধী পরিবারের সদস্যগণ এই সংগঠনের ধারক ও বাহক। ভারতের মুসলিমরা এই দুই দলের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। তারা বিজেপিকে ভোট দিতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে মন্দের ভাল হিসাবে কংগ্রেসকে ভোট দেয়। কিন্তু তারা মুসলিমদের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সব সময় মুসলিমদেরকে নিজেদের ভোট ব্যাংক হিসাবে ব্যবহার করছে। এবার কিছু দিন হ’ল ‘আম আদমী পার্টি’ নামে একসময়ের আন্না হাজারের সহযোগী রাজনীতির মাঠে এলাহী কারবার করে ফেলেন। অনেকেই বিশেষ করে মুসলমানরা আবেগের বশবর্তী হয়ে তার দলে যোগ দিচ্ছে, কিন্তু তার সম্পর্কে এখনই কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

মুযাফফরনগর দাঙ্গা :

মুযাফফরনগর উত্তর প্রদেশের একটি অন্যতম যেলা, যার উত্তরে সাহারানপুর এবং দক্ষিণে মীরাঠ। মুযাফফরনগর থেকে ‘দিল্লি এক্সপ্রেস’ ট্রেনে দুই ঘণ্টার রাস্তা। উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের মুযাফফরনগর সহ অন্যান্য যেলা শুগার বেল্ট বা চিনি কলের শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিত। শুধু মুযাফফরনগর যেলাতেই ১১টি চিনিকল আছে। উত্তর প্রদেশে যে দলের সরকার থাকে কেন্দ্র সরকারের উপর তাদের অনেকটা প্রভাব থাকে। কেননা রাজধানী দিল্লি উত্তর প্রদেশের মধ্যে, যদিও দিল্লিতে আলাদা সরকার গঠিত হয়। বর্তমান উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আছে ‘সমাজবাদী পার্টি’, যার নেতা হচ্ছে ইয়াদো (যাদব) পরিবার। সমাজবাদী পার্টির এই সরকার মুসলমানদের প্রতি দয়ার্দ্র বলে পরিচিতি ছিল এবং এই কারণেই মুসলমানরা তাকে বিপুল পরিমাণ ভোট দিয়ে মায়াবতীর সরকারকে হটিয়ে তাদেরকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু তারা মুসলমানদের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে গত আগস্ট মাসে হয়ে যাওয়া মুযাফফরনগর দাঙ্গা তাদেরকে হিন্দুস্তানের দ্বিতীয় মোদি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

দাঙ্গার পিছনের কারণ হিসাবে বিভিন্ন পত্রিকাতে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হল, ২৭ আগস্টে কিয়াল গ্রামের একজন যুবক জাঠ সম্প্রদায়ের এক তরুণীকে ইভটিজিং করে। ফলে ঐ তরুণীর চাচাত ভাই ও বন্ধুর সাথে এই ছেলের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নিলে মেয়েটি নিহত হয়। কাকতালীয়ভাবে ছেলেটি ছিল মুসলিম। এরপর নিহতের গ্রামের লোকজন হত্যাকারী জাঠকে হত্যা করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা শুরু হয়। কিন্তু দাঙ্গাটি মূলতঃ পরিকল্পিত ছিল। কারণ দাঙ্গার আগে থেকেই সাহারানপুর, মুযাফফরনগর, মীরাঠ ইত্যাদি জায়গায় ট্রেনে মাদরাসার ছাত্রদের বিভিন্ন দিনে হিন্দু কট্টরপন্থীরা প্রহার করে। ফলতঃ এই অঞ্চলগুলোতে আগে থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দাঙ্গার আগের দিন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ের জন্য আমার মযাফফরনগর যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। আমি যেদিন যাই, সেদিনের অবস্থা অনেক উত্তেজিত ছিল। অথচ তখনও উপরে উল্লেখিত ঘটনা ঘটেনি। উত্তেজনার কারণ ছিল, আগের দিন দিল্লি থেকে মুযাফফরনগর হয়ে সাহারানপুর আসার পথে একজন মাদরাসার ছাত্রকে হিন্দুরা ট্রেনের মধ্যে ব্যাপকহারে প্রহার করে। সে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে কোনও মতে নিজের প্রাণ বাঁচায়। এছাড়া উপরে উল্লেখিত ঘটনার সাথে সাথে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়নি। বরং উক্ত ঘটনাকে সামনে রেখে কিছু হিন্দু কট্টরপন্থী নেতার উত্তেজনা মূলক অডিও/ভিডিও বক্তব্য হিন্দু তরুণদের মাঝে অজ্ঞাত কারো মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ফলে তারা উত্তেজিত হয়ে মুসলমানদের প্রতি হামলা করে। অতঃপর দেখতে দেখতেই এই দাঙ্গা মুযাফফরনগর থেকে আগুনের মত আশেপাশের দুই তিন যেলায় প্রসারিত হয়। দাঙ্গার আতংকে ভীতিকর অবস্থার মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে কোনদিন হয়নি। এটা সত্যিই আশ্চর্য এবং দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। যে শহর ও বাজারকে আগের দিন পর্যন্ত গভীর রাতেও মানুষের হাসি-আনন্দে গম গম করতে দেখতাম, আজ সেই একই বাজারে মাগরিব হতেই একটা পোকার আওয়াজও পাওয়া যায় না; যে রাস্তায় দিনে রাতে নির্ভয়ে চলতাম, সেই রাস্তায় আজ আর চলার সাহস হয় না; যে রুমের জানালা গরমের কারণে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত খুলে রাখতাম, সেই জানালা সন্ধ্যা হতেই বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাসার মালিকের ভয়ার্ত ঘোষণা; যে বন্ধুদের মাদরাসার বাইরের মসজিদগুলোতে ইমামতি ও মুয়ায্যিনী করতে দেখতাম, তাদেরকে মাদরাসায় রাত্রি যাপন করতে দেখলাম; জিজ্ঞেস করলে জানায় মুতাওয়াল্লী দাঙ্গার আশঙ্কায় মসজিদে থাকতে নিষেধ করেছেন। এমনকি পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়াল যে, হিন্দু কট্টরপন্থীরা নাকি সরাসরি মাদরাসাতেই আক্রমণ করবে। পরিস্থিতির আলোকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের মাদরাসার বাইরে যাওয়া নিষেধ করে দিল। এমনকি কুরাবানীর ছুটিতে মাদরাসার ছাত্ররা কিভাবে বাড়ীতে যাবে এই আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছে। কেননা  বের হলেই রাস্তা-ঘাটে হিন্দুদের আক্রমণের ভয়। এই আশঙ্কায় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কুরবানীতে ছুটি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অথচ মাদ্রাসাটি ছিল দারুল ঊলূম দেওবন্দ, যার সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা হিন্দুরা কোনদিন এখানে আক্রমণ করেনি এবং করার সাহসও কোনদিন করবে না। কেননা সরকারের সাথে তাদের আগে থেকেই ভাল সম্পর্ক। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে দাঙ্গার প্রভাবে দেওবন্দের দুই-তিন জায়গায় হিন্দুরা মুসলিম যুবকদের গুলি করে হত্যা করলেও মদারাসা পর্যন্ত তা গড়ায়নি। 

সত্যিই এটি ছিল নতুন পরিবেশে নতুন অভিজ্ঞতা। চারিদিকে শুধু ভীতি আর ত্রাস। ভাবতাম, যাকে কোনদিন দেখিনি, যার সাথে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, কোনও লেনদেন নেই, গন্ডগোল নেই। অথচ সে আমাকে সুযোগ পেলেই হত্যা করবে শুধু এই জন্য যে, আমি একজন মুসলিম। সত্যিই দুঃখজনক। এটাই নাকি আবার সেক্যুলার রাষ্ট্র! যারা একজন নিরীহ মুসলিমের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা সেক্যুলার কেমনে হয়! এই সেক্যুলারিজমকে ধিক্কার জানাই! দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, এই ভারতকে ইসলাম ৭৫০ বছর শাসন করছে। এই ঘৃণ্য চিত্র সুদীর্ঘ ইতিহাসে একটা গুজরাট, একটা আসাম বা মুযাফফরনগর নেই। নেই মুসলিমদের আক্রমণে নিরস্ত্র নিরীহ হিন্দুদের রক্তের স্রোত। নেই হিন্দু নারীর আহাজারি, অবুঝ শিশুর আর্তচীৎকার, বরং আছে ঠিক এর উল্টা। আর সেক্যুলারিজম মাত্র ষাট বছরে ছোট বড় সব মিলিয়ে তেইশ হাযারেরও বেশী দাঙ্গার জন্ম দিয়েছে। বাবরী মসজিদকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করেছে। গুজরাট, আসাম ও মুযাফফরনগরে হাযার হাযার মা-বোনের ইয্যত লুটেছে। এটা যদি সেক্যুলারিজম হয়, তাহলে এই সেক্যুলারিজমকে ধিক শত ধিক!!

পরে ধীরেধীরে পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, প্রায় ষাট জনের মত মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং পঞ্চাশ হাযারের মত মানুষ তাদের ঘর বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং কত মা-বোনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কোন্ মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছে, কেউ মাঠের মধ্যে তাঁবু টানিয়ে দিনাতিপাত করছে, কেউ বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে চলে গেছে। শিবিরে আশ্রয় নেয়ার পর সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে ৮৫ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তাদের বাবা-মা। এর মধ্যেই উপস্থিত হল শীত। এখান থেকে হিমালয় পর্বত নিকটে হওয়ায় শীত বেশি পড়ে। এই কনকনে ঠান্ডা শীতেও সরকার মুসলমানদের ঘরে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেনি। এমনকি উল্টা প্রায় ৪২০ টি পরিবারকে তাঁবু থেকে উচ্ছেদ করে দেয় এবং বুল্ডোজার দিয়ে তাদের তাঁবুকে গুঁড়িয়ে দেয় (দৈনিক ইনকিলাব, উর্দূ, ১/১/২০১৪, পৃষ্ঠা : ১)

এই দিকে মুসলমানদের এই দুঃখ-দুর্দশার মাঝে কাঁটা ঘায়ে নূনের ছিটা দেয়ার মত আঘাত করে কংগ্রেসের তরুণ লিডার রাহুল গান্ধী বলেন, যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে, তারা আই. এস. আই. এবং লস্করে তৈয়্যেবার সাথে জড়িত (দৈনিক ইনকিলাব, উর্দূ, ১৬/১/২০১৪ পৃঃ ৭)। অন্য দিকে সমাজবাদী পার্টির লিডার মুলায়িম সিং ইয়াদো (যাদব) বলেন, যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে তারা বিজেপি ও কংগ্রেসের এজেন্ট (প্রাগুক্ত)। তাদের এই মন্তব্য সত্যিই দুঃখজনক। এছাড়া এই অবস্থার মধ্যেই যেখানে মুযাফফরনগরে মুসলিম নারী শিশু না খেয়ে এবং শীতের প্রকোপে মারা যাচ্ছে, সেখানে মুযাফফরনগর থেকে অনতিদূরে সাইফাইতে সমাজবাদী পার্টির পক্ষ থেকে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়, যেখানে বলিউডের নামীদামী নায়ক-নায়িকারা আসেন এবং প্রায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়। সেই দিনের দৃশ্য সত্যিই আশ্চর্যজনক ও মানবতাবিরোধী।

সুধী পাঠক! এই হল সমাজবাদী পার্টি ও মুলায়িম সিং ইয়াদোর আসল চেহারা।  প্রশাসনের পক্ষ থেকে সান্ত্বনার মত বলতে যা আছে, তা হচ্ছে ১৮শ’ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৫ লাখ রূপি করে ক্ষতিপূরণ প্রদান। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা যেখানে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশী, সেখানে এই টাকা দিয়ে কী হবে?      

ইসলামী দলগুলোর কার্যক্রম :

বিভিন্ন ফাসাদ বা দাঙ্গার পরেই হিন্দুস্তানের ইসলামী দলগুলো মুসলিমদের সেবায় মাঠে নেমে আসে। নিম্নে সাংগঠনিক পরিচয় সহ তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হল :

জমঈয়তে উলামায়ে হিন্দ : এ সংগঠনটি ভারতে মুসলমানদের অধিকার আদায়ের নিমিত্তে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হ’ল যে, বর্তমানে এই দলটি একটি নির্দিষ্ট মাসলাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। শধু তাই নয়, তা একটি নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যে গন্ডীবদ্ধ হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘জমীয়তে উলামায়ে হিন্দ’-এ আয়োজনে দেওবান্দে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে এক বিশ্ব সম্মেলন আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রায় ৫ হাযার আলেম অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এই সম্মেলনের কিছুদিন পরেই আরশাদ মাদানী, যিনি হোসাইন আহমাদ মাদানীর ছেলে ও মাহমুদ মাদানী, যিনি হোসাইন আহমাদ মাদানীর পৌত্র আলাদা হয়ে যান। উভয়ে নিজেকে আসল ‘জমঈয়তে ঊলামায়ে হিন্দ’-এর উত্তরসূরী মনে করতে থাকেন এবং অদ্যাবধি উভয়ে আলাদা আলাদা জমীয়ত চালাচ্ছেন। ফলতঃ ভারতে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি একটি পারিবারিক কোন্দলে আজ দু’ভাগে বিভক্ত, যা ভারতের মুসলমানদের সীমাহীন ক্ষতি করেছে এবং এখনো করে চলেছে এবং দিন দিন উভয় জমীয়তের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে।

মুযাফফরনগর ফাসাদে উভয় জমঈয়তই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অর্থ, শীতবস্ত্র ও ফ্ল্যাট বাড়ী দিয়ে সহযোগিতা করে, যা বিভিন্ন পত্রিকায় বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দুস্তানের মুসলমানরা বহুদিন থেকে ‘ইন্সিদাদে ফিরাকা ওয়ারানা ফাসাদাত বিল’ বা মাঝারী দাঙ্গা দমন বিল’ ভারতের সংসদে পাশ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। অনেকের ধারণা জমঈয়ত যদি এক থাকত, তাহলে কেন্দ্র সরকার এই বিল পাশ করতে বাধ্য হত। এরপরেও বিভিন্ন দিক থেকে চাপের মুখে পড়ে ও ভোট ব্যাংক হাছিলের উদ্দেশ্যে সোনিয়া গান্ধী আগামী অধিবেশনে এই বিল সংসদে পেশ করার আশ্বাস দিয়েছেন। এই বিল যদি পাশ হয়, তাহলে এই জাতীয় দাঙ্গা অনেকটা হলেও কমে যাবে এবং মুসলমানদের জন্য আইনী লড়াই করা সুবিধা জনক হবে। তবে পাশ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। কেননা সোনিয়া গান্ধীর সৎ নিয়ত থাকলে তিনি লোকপাল বিলের জায়গায় এই বিল নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি ওয়াদা দিয়েও গত অধিবেশনে এই বিল না নিয়ে এসে লোকপাল বিল পাশ করান। অথচ বর্তমান হিন্দুস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দাঙ্গা।

মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ :

ভারতের সবচেয়ে পুরাতন ইসলামী সংগঠন হচ্ছে মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ হিন্দ। যার পূর্ব নাম অল-ইন্ডিয়া আহলেহাদীছ কনফারেন্স, যা ১৯০৬ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।  সংগঠনটি খাছ দ্বীনি খেদমতের জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তা মাসলাক, মাযহাব নির্বিশেষ মুসলমানদের খেদমতে সর্বদা অবদান রেখেছে। বর্তমান মুযাফফরনগরে ফাসাদ হওয়ার পর মোট তিনবার জমঈয়তের প্রতিনিধি দল অত্র এলাকা পরিদর্শন করে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্ন, বস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। গত ২৯ সেপ্টেম্বরে যে প্রতিনিধি দল সফর করে, তার মধ্যে সভাপতি আল্লামা আছগর আলী উপস্থিত ছিলেন (তরজুমান, অক্টোবর)। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী হিন্দ সহ অনেক সংগঠন ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

ভারতের মুসলমানদের এই অবস্থার কারণ :

১. দ্বিজাতি তত্ত্ব : আমাদের কাছে দ্বিজাতি তত্ত্ব আশির্বাদ হলেও ভারতীয় মুসলমানদের দৃষ্টিতে এটা তাদের জন্য অভিশাপ। তাদের মতে আজ যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ষাট কোটি মুসলমান তাদের সাথে থাকত, তাহলে ভারত বর্ষের ত্রিশ কোটি মিলে মোট নববই কোটি এবং শতকরা ৫৫/৬০ মুসলমান এই দেশে বসবাস করত। তাহলে মুসলমানরা এই দেশে সংখ্যা লঘু হত না, বরং বলা চলে সংখ্যা গরিষ্ঠই হত এবং ভারত বিভক্তির ফলে তারা যেভাবে কমজোর হয়ে পড়েছে, সেই রকম কমজোর হত না। কেননা পাকিস্তান তৈরির ফলে তারা তাদের জনসংখ্যা যেমন হারিয়েছে, তেমনি অনেক প্রতিভাবান মেধা ও নেতৃত্ব হারিয়েছে এবং ভারত বিভক্তি তাদের উপর ক্বিয়ামত হিসাবে অবতীর্ণ হয়। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ১৯৪৮ সালে দিল্লির শাহী জামে মসজিদে এক ‘ফুড ফর থিংক’ ভাষণ দেন, যার অডিও রেকর্ড আমার কাছে রয়েছে। তার কথার সারমর্ম হচ্ছে, পুরা পৃথিবী আল্লাহর মসজিদ, তাকে পাক ও নাপাকের মধ্যে পার্থক্য করা শরী‘আত বিরোধী, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ভারতে হাযার বছর থেকে বসবাসকারী মুসলমানদেরকে একদিনের মধ্যেই নিজেকে নিজ দেশে পরদেশী করে দেয়, বরাবর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে একদিনেই সংখ্যা লঘুতে পরিণত করে দেয়।    

এই দিকে ভারত বিভক্তির ফলে ভারতীয় মুসলমানদের যা ক্ষতি হওয়ার তাতো হয়েছেই, সাথে আহলেহাদীছদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আহলেহাদীছ-এর শিক্ষা কেন্দ্র ‘জামিয়া রহমানিয়া দিল্লি’-এর মুহতামিম পাকিস্তান চলে যাওয়ায় জামেয়া রহমানিয়া বন্ধ হয়ে যায় সেই সাথে মাদরাসার অত্যন্ত মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ লাইব্রেরী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে যায়, যার কিছু ধ্বংসাবশেষ এখন দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ভার্সিটির লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এই মাদরাসা বন্ধ হওয়ার পর থেকে ‘জামিয়া সালাফিয়া’ প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে আহলেহাদীছদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। অন্যদিকে জমঈয়তে আহলেহাদীছের সেক্রেটারী জেনারেল, দুনিয়ার বুকে খতমে নবুওয়াতের এক অনন্য মু‘জেযা, কাদিয়ানিরা যার নাম শুনলে আজও কাঁপে  সেই ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ)-এর মূল্যবান লাইব্রেরী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি রাতের অন্ধকারে নিজের জান নিয়ে পাকিস্তান চলে যান। তার লাইব্রেরীকে রক্ষা করার জন্য মাওলনা আবুল কালাম আযাদ দিল্লি থেকে একদল পুলিশ পাঠালেও তারা পৌঁছার আগেই শিখরা তা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। মাওলানাকে তার লাইব্রেরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা সীমাহীন কষ্ট দিয়েছিল। এই কারণেই তার বিখ্যাত ‘আখবারে আহলেহাদীছ’ পত্রিকা অনেক দিন যাবৎ বন্ধ থাকে।

অন্যদিকে দ্বিজাটি তত্ত্ব ভারত বর্ষের আলেম-ওলামাদের মাঝে কঠিন মতপার্থক্য তৈরী করে। আহলেহাদীছদের মধ্যে মাওলানা সাইফ বানারাসী ও আবুল কালাম আযাদ কংগ্রেসের সাথে থেকে ভারত বিভক্তির বিরোধিতা করেন এবং ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটি, আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী ও মাওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগের সাথে থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রাখেন। এদিকে দেওবন্দী আলেমদের মধ্যে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ও সাবিবর আহমাদ ওছমানী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকেন, অন্যদিকে মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানী ও তার অনুসারীরা ভারত বিভক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান করেন। এভাবে তখন ভারতের আলেম সমাজ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভারতের মুসলমানরা এক প্রকার নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে তারা তাদের অনেক দুর্লভ প্রতিভাকে পাকিস্তানের কাছে হারিয়ে বসে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের মুসলমানরা আর কোনো পাঞ্জেরী বা পথের দিশারী খুঁজে পাইনি।

উল্লেখ্য যে, অনেকেই মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে আহলেহাদীছ মনে করেন না। বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীরা এবং ভারতের আহলেহাদীছরা তাকে নিজেদের গর্বিত ইতিহাসের অংশ মনে করে। মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী-এর উর্দূ তরজমাকৃত ইলামুল মুয়াক্কিঈন-এর ভুমিকা তারই লেখা, যা পড়লে প্রত্যেক মানুষের ভুল ধারণা ভাঙতে বাধ্য এবং মিয়াঁ নাযির হোসাইন দেহলভীর লিখিত ‘মিয়াঁরে হক’ সম্পর্কে তার উচ্চ প্রশংসা ও তার আহলেহাদীছ হওয়ার বড় প্রমাণ বহন করে।

২. অশিক্ষা : ভারতে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে মুসলিম সমাজ। আমি একদিন দুধ কিনতে গেলে এক ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মাওলানা যারা কালেমা শিখা দো’। উল্লেখ্য, খানে মাদরাসার ছাত্রদের মাওলানা বলা হয়। আমি তো হতবাক ত্রিশ চল্লিশ বছরের একজন মুসলিম কালেমাও জানে না! এই ধরণের মুসলিম বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কিন্তু এখানে অহরহ এ ধরণের মুসলিম পাওয়া যাবে। শুধু ইসলামী শিক্ষা নয়, দুনিয়বী শিক্ষা থেকেও মুসলিমরা অনেক অনেক পিছিয়ে। মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা সহ বিভিন্ন বড় শহরে যাদেরকে সড়কে রিকশা চালাতে, হোটেলে কাজ করতে, মানুষের বাড়ীতে কাজ করতে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই মুসলমান এবং অনেকের কাজের বয়সই হয়নি। রাস্তা-ঘাটে চলতে ফিরতে একজন শিখ ভিক্ষুক দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু মুসলমনদের দেখলে মনে হবে সব মুসলমানই হয়তোবা শুধু ভিক্ষা করে। এই দেশে মুসলিমদের শিক্ষার জন্য মাত্র ৪ টি সংখ্যালঘু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। যেগুলো হল আলীগড়, জামিয়া মিলিলয়া, মাওলানা আযাদ ন্যাশনাল উর্দূ ও মাওলানা জওহর আলী ভার্সিটি, যা মুসলমানদের সংখ্যার তুলনায় একদম কম। এই জন্য মুসলিম নেতাদের উচিৎ সামনে এগিয়ে আসা। গত কয়েকদিন আগে কিশানগঞ্জে মাওলানা আসরারুল হক কাসেমীর প্রচেষ্টায় মুসলমানরা মাযহাব-মাসলাক ভুলে যেভাবে আলীগড় ভার্সিটির শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে এবং সফল হয় তা ভারতীয় আলেম সমাজ ও মুসলিম নেতাদের জন্য শিক্ষণীয়। আজও যে মুসলমানরা এক থাকলে সফল হবে এটা তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

৩. নিজের আদর্শ হারিয়ে ফেলা : আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনও জাতির সাথে চলে সংখ্যালঘুদের নিজস্ব আদর্শ ধরে রাখা যে কত কঠিন তা ভারতের মুসলমানদের দেখলে বুঝা যাবে। এই দেশের অনেক মুসলমান শধু নামেই মুসলমান আছে। তারা সব ক্ষেত্রে হিন্দু ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ শুরু করেছে। যেমন আমাদের দেশে বিবাহে গান-বাজনা হলেও যখন বউকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার পিছনে ঢাক-ঢোল নিয়ে তরুণ-তরুণী মিলে হাঁটতে হাটতে নাঁচতে নাঁচতে যাওয়া হয় না। মূলতঃ এটা হিন্দুদের আদর্শ। কিন্তু মুসলমানরাও এখন বিনা দ্বিধায় তা করছে। আমদের দেশে মেয়েদের সাইকেল চালানো সামাজিকভাবে দৃষ্টিকটু, কিন্তু এখানে হিন্দুদের মত মুসলিম মেয়েরাও আমভাবে সাইকেল, মোটর সাইকেল সব চালাচ্ছে। আমার তো মনে হয় রাস্তা-ঘাটে যারা বিড়ি সিগারেট, তামাক খায় তাদের অধিকাংশই মুসলমান। এই রকম কত শত আদর্শ আছে, যা অনেক মুসলমান জানেই না।

৪. শিরক-বিদ‘আত : ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ব্রেলভী বা কবর পূজারী। দেওবান্দীরা আদর্শিকভাবে কবর পূজারী না হলেও তাদের ‘আম জনতা ও ব্রেলভীদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। এটা তাদের শিরক-বিদ‘আতের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শনের ফল। একমাত্র মুহাদ্দিছদের আন্দোলনের ফলে যারা শিরক-বিদ‘আত থেকে মুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে তারাই এ থেকে বেঁচে আছে। তাদের সংখ্যা অন্য মুসলমানদের তুলনায় অনেক কম। তবে আলহামদুলিল্লাহ পৃথিবীর সব দেশের মত ভারতেও এই আন্দোলনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। ফালিল্লাহিল হামদ।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সেই ঐতিহাসিক উক্তি : ‘যিস মুল্ক মেঁ রাসূল (ছাঃ) কে হাদীছ পার দুসরে ইমাম কে কাউল কো তারজীহ দি জাতী হে, উস্মে কাব তাক ইসলাম বাকী রাহেগা’ অর্থাৎ যে দেশে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের উপর অন্য ইমামের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হয় সেখানে কতদিন ইসলাম বাকী থাকবে?’ মুহতারামের কথা সত্যে পরিণত হয়েছে আজকে এই মুল্কে, সেখানে ইসলাম বাকী থাকেনি বরং মুসলমানরা গোলামে পরিণত হয়েছে। তাইতো দেখি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পৌত্র এ দেশে হাদীছের উপর আমলের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তারা জানতেন কেবল এই পথেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আফসোস! কবে এই হাদীছ বিরোধী ও গণতন্ত্র পন্থীদের বোধোদয় হবে!  

৫. অনৈক্য : বানারাস ডালমন্ডি (কাপড়ের আড়ৎ) থেকে গেলাম জালালীপুরা। একটা রুম খুঁজছি, সাথে বাথরুম থাকবে। এক মহল্লায় গেলাম। অনেককে খোঁজাখুজির একপর্যায়ে এক ভাই আশ্বাস দিল পাওয়া যাবে। কিন্তু হটাৎ করে কী যে হল, ভাইটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন মাযহাবের? ব্রেলভী? আমি বললাম, না। তখন তিনি বললেন, ইস্কা মাতলাব তুম ওহাবি হো, জলদী এহা সে ভাগো, অরনাহ তুম পে বাজেগা। তুমহে পাতা নাহি এ সুন্নিও কা হে? আমি তো হতবাক। এখানে শধু হিন্দু-মুসলিম আলাদা মহল্লা নয়। মাযহাবের উপর ভিত্তি করে আলাদা মহল্লা হয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে এটাই বাস্তবতা শী‘আ-সুন্নী আলাদা আলাদা মহল্লা অনেক আগে থেকেই, কিন্তু এখন অন্য মাযহাবের উপর ভিত্তি করেও আলাদা আলাদা মহল্লা দেখা যায়। ভারতের মুসলমানদের এই অবস্থার সবচেয়ে বড় কারণ হল, অনৈক্য ও দলে দলে বিভক্ত হওয়া। এর জন্য মুসলিম নেতাদের আমিত্ব ও নিজের যাত বা সত্ত্বাকে মাটির সাথে মিশিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানদের অবস্থা কতটা আশংকাজনক হতে পারে তা কল্পনার বাইরে।

৬. নীচতা হীনতা : আসলে যখন কোনও পরিবার, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের শান-শৈকত খুব উঁচু পর্যায়ে থাকে, তখন তাদের এই পদমর্যাদা তাদের মাঝে একটা আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করে, যা তাদের হৃদয়কে বড় করে এবং আত্মমর্যাদায় আঘাত এলে আহত বাঘের মত হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক এর বিপরীতে কোনও কওম যখন নিজের ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলে তখন কওমের লোকেদের উপর এর প্রভাব পড়ে। যা হয়েছে মুসলমানদের। লাখ লাখ মা-বোনের ধর্ষিতা চেহারা, গগণবিদারী আর্তচীৎকার এদের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানা তো অনেক দূরের কথা বরং জমীয়তে ঊলামায়ে হিন্দের আমীর আরশাদ মাদানীর বলা তথ্য অনুযায়ী হিন্দুস্থানের জেলের শতকরা আশি জন মুসলমান নিজের মুসলিম ভাইয়ের সাথেই মারামারি-গন্ডগোলের অভিযোগে জেল খাটছে।

সমাধান :

সিংহ শার্দূল মুহাম্মাদ বিন কাসিমের হাত ধরে এই দেশে ইসলামের প্রকাশ্য যাত্রা থেকে শুরু করে ইংরেজদের জাহাজ নোঙ্গর ফেলার আগ পর্যন্ত মুসলমানরা এই দেশে অত্যন্ত আব ও তাব এর সাথে শাসন চালিয়ে এসেছে। দিল্লির জামে মসজিদ, লালকেল্লা, কুতুব মিনার, আগ্রার তাজমহল আজও সেই শানদার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শাহী জামে মসজিদ আজও সেই রকম থাকলেও তার মুহাফিয ও মুছল্লী সেরকম নেই। কুতুব মিনার থাকলেও কুতুবুদ্দিন আইবেকের উত্তরসূরীরা অসহায় ও নির্লিপ্ত। কোন এক অজানা ঝড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। একদিনের রাজা আজ প্রজা। এক দিনের বাদশাহ আজ গোলামে পরিণত হয়েছে। একদিনের মালিক মামলুক হয়ে গেছে।

গুজরাট, আসাম ও মুযাফফরনগর সহ হাযারও দাঙ্গার অসহায় শিকার মুসলিম মা-বোনের আহাজারী, সন্ত্রাসের অভিযোগে জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী হাযারও মুসলিম তরুণের নিভৃত কান্না আজ দিল্লির লালকেল্লা ও শাহী জামে মসজিদে গুমরে মরছে। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিথ্যা আশ্বাস ও ওয়াদার রঙ্গিন ফাঁদের বুলি হচ্ছে এই অসহায় মুসলিম জনতা। অথচ এই দেশের স্বাধীনতায় মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য।

শাহ ইসমাইল শহীদ, সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী, বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী ইংরেজ বিরোধী জিহাদের অনন্য, অপরাজেয় সিপাহীসালার ছিলেন। তাদের লড়াই ছিল স্বাধীন মুসলিম ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। অবশ্য ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এই তিন দেশের মুসলমানগণই নিজ নিজ দেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ণের পিছনে তাঁদের অবদানকে স্বীকার করেন এবং মনে করেন তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের রক্তে এই দেশের মাটিকে রঞ্জিত করেছেন তা সফল হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হ’ল ইংরেজরা যখন ভারতে আসে তখন এই দেশ ছিল মুসলমানদের। অতএব তারা যখন চলে যাবে তখনো এই দেশ থাকবে মুসলমানদেরই হাতে, যা হবে তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। কিন্তু খ্রীস্টান ইংরেজদের হাত থেকে মুশরিক হিন্দুদের হাতে ভারত চলে যাওয়াকে এবং ভারত মুসলমানদের হাতে না আসার ব্যর্থতাকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঢেকে দেওয়াকে কিভাবে তাদের প্রচেষ্টার ফল বলা হয়? তবে এতটুকু বলা যায়, তাদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অন্যতম প্রতিপক্ষকে এই দেশ থেকে বিতাড়নের সফলতা তাদের চেষ্টার ফল কিন্তু স্বপ্নের বাস্তবায়ন নয়। অন্যদিকে যারা ইসলামের নামে শাহ ইসমাইলের প্রচেষ্টাকে নিজেদের ঘরের পুঁজি ও ইতিহাস বানানোর চেষ্টা করেন তাদের সাথে তার কোনও দূরতম সর্ম্পকও ছিল না। তাদের শিরক বিদ‘আতযুক্ত ইসলামকে শাহ ছাহেব ঘৃণা করতেন। তার লেখা ‘তাযকীরুল ইখওয়ান’ বইয়ের ‘তাক্বলীদ ভী এক বিদ‘আত হ্যাঁয়’ অধ্যায়ে তিনি তাক্বলীদে শাখছীকে খর্ব করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন শিরক-বিদ‘আতমুক্ত ভারত গড়তে। তার এই চেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের মুসলমানদের সকল সমস্যার সমাধান। অনেক মুসলিম নেতা সেক্যুলারিজম বা মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক পার্টি থাকাকে একমাত্র সমাধান হিসাবে দেখেন। এটা তাদের দূরদৃষ্টির অভাব। এতে আংশিক সমস্যার সমাধান হলেও পূর্ণ সমস্যার সমাধান কোন দিনও হবে না। যতদিন না মুসলমানরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে শিরক-বিদ‘আত থেকে মুক্ত হয়ে এক ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে জমা না হবে, ততদিন তারা এই চক্র থেকে বের হতে পারবে না। আর এটাই ছিল আমাদের পূর্বসূরী মুজাহিদে মিল্লাতদের স্বপ্ন। তাই ভারতের মুসলমানদের প্রতি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদাত্ত আহববান জানাই। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন! আমীন!!

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

শেষ বর্ষ, দাওরায়ে হাদীছ বিভাগ, দারুল উলূম দেওবন্দ, সাহারানপুর, উত্তর প্রদেশ, ইন্ডিয়া



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও