আফগানিস্তান : আরেক সাম্রাজ্যবাদের পতন

মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত 736 বার পঠিত

ভূমিকা : হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে এশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত একটি দেশ আফগানিস্তান। পর্বতমালা বেষ্টিত এ দেশটির সবচেয়ে বড় জাতি পশতুন, যাদেরকে আফগানীও বলা হয়। আপাত সরল ও নিরীহ এই মানুষগুলো আদতে প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন। আফগানিস্তান অর্থ ‘আফগানদের ভূমি’। তবে পশতুন ছাড়াও আরো অন্যান্য জাতি এখানে রয়েছে। আফগানীদের যুদ্ধের ইতিহাস নতুন নয়, বেশ পুরোনো। প্রাচীন কাল থেকে গোত্র শাসিত এ অঞ্চলের রীতি-নীতি নির্ধারণ করে এখানকার গোত্র নেতারা। আরবদের পর যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে লড়াকু এবং জেদী বলা যায় আফগানদের। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনবরত লড়ে যাওয়ার ইতিহাস এদের বহু পুরোনো। যারাই এই ভূখন্ড দখলের চেষ্টা করেছে, তারাই এখানে নাকানি-চুবানি খেয়েছে। দূর অতীতের আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, চেঙ্গিস খান থেকে শুরু করে নিকট অতীতের ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সদ্য পরাজিত সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পতনের দিকে দৃষ্টি দিলেই এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। বক্ষমান প্রবন্ধে আফগানদের হাতে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের পতনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত উল্লেখ করা হ’ল।

আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল : ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে এবং ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এখানে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ৯ম থেকে ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব পারস্য ও মধ্য এশিয়ার তুর্কীরা আফগানিস্তান শাসন করে। ১২১৯-২১ পর্যন্ত বিশ্বখ্যাত মঙ্গলীয় বীর চেঙ্গিস খান এখানে অভিযান পরিচালনা করেন। ১৫শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত এখানকার কর্তৃত্ব নিয়ে পারস্য ও মোগল সম্রাটদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এরপর ১৭শ শতকের মাঝামাঝিতে দুর্রানী সম্রাট আহমাদ শাহ আবদালী প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানকে একটি সুসংগঠিত সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।

১৮শ শতকের শুরুর দিক থেকে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে এবং ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় (কার্যত আক্রমণ করে)। ব্রিটিশ আক্রমণে পলাতক শাসক দোস্ত মুহাম্মাদের ছেলে ওয়াযির আকবর খান ১৮৪২ সালে ব্রিটিশদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন, যা ‘১ম এ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা পরাজিত হয়। বেশীরভাগ সেনাই মারা যায়। কথিত আছে, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় মাত্র একজন বৃটিশ সৈন্য নাকি আফগানিস্তান থেকে ভারতে ফিরতে পেরেছিল। ১৮৭৮ সালে ‘২য় এ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ’ সংঘঠিত হয় এবং আফগানরা পরাজিত হয়। কিন্তু তবুও তারা আফগানিস্তানে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি। ব্রিটিশরা আফগান পররাষ্ট্র নীতি নিজেদের হাতে রেখে আমীর আব্দুর রহমানকে আফগানের শাসক হিসাবে মেনে নিতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে তৎকালীন আমীর আমানুল্লাহ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ‘৩য় এ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ’ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির পর ব্রিটেন ঐ একই সালের আগস্ট মাসে আফগানিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। সাম্রাজ্যবাদের প্রধান পুরোহিত ব্রিটেনের তৎকালীন বিশাল সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত না গেলেও বহু চেষ্টায়ও আফগানিস্তানে তাদের সাম্রাজ্যবাদের সূর্য সফলভাবে উদয় হয় নি।

১৯২৬ সালে আমীর আমানুল্লাহ আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৪৬ সালে আফগানিস্তান জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকে। এরপর দাউদ খান রাশিয়ার সম্মতিতে বিপ্লবের মাধ্যমে বাদশাহ যহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানকে রাজতন্ত্র থেকে ‘প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেন এবং নিজে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭৮ সালের ২৭শে এপ্রিল আফগানিস্তানে এক সশস্ত্র সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হয়। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় দাউদ খানকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসে রাশিয়ার একান্ত অনুগত আফগান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নূর মুহাম্মাদ তারাকী। তারাকী ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার ঘোষণা দেন। ১৯৭৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফিযুল্লাহ আমীন ক্ষমতা দখল করে এবং নূর মুহাম্মাদ তারাকী সংঘর্ষে নিহত হন। এরপর ১৯৭৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। এর মাত্র দুই দিন পরে ২৭শে ডিসেম্বর আরো একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাফিযুল্লাহ আমীন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নিহত হন এবং বারবাক কারমাল ক্ষমতা হাতে নেন। তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১ লাখ ২০ হাযার সৈন্য আফগানিস্তানে প্রবেশ করায়। পশ্চিমা ও মুসলিম বিশ্ব থেকে রাশিয়ার এই পদক্ষেপের নিন্দা জানানো হয় এবং আফগানিস্তান থেকে রুশ বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার দাবী উত্থাপন করা হয়। কিন্তু উত্তরে রাশিয়া জানায়, ‘হাযার হাযার সশস্ত্র বিদ্রোহী আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছে। তাই কারমাল সরকারের অনুরোধে রাশিয়া বাধ্য হয়ে আফগানিস্তানে এসেছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ও পাশ্চাত্য একে রাশিয়ার আগ্রাসন হিসাবে উল্লেখ করে। এসময় তৎকালীন বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠান্ডা যুদ্ধের (Cold War)-এর কেন্দ্র বনে যায় আফগানিস্তান। আমেরিকার পুঁজিবাদী নয়া সাম্রাজ্যের পথে সমাজতন্ত্র ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। তাই আমেরিকা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার পতন চাইছিল। আর আমেরিকার সেই আকাংঙ্খা বাস্তবায়নের সুযোগ আসে আফগানিস্তানে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রক্সি যুদ্ধে (Proxy War) আফগান মুজাহিদরা সবচেয়ে সফলভাবে কাজে আসে। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় প্রচুর পরিমাণে মার্কিন অর্থ ও সামরিক সহায়তা আসতে থাকে আফগান মুজাহিদদের হাতে। আমেরিকার সাথে সমান তালে সঊদী আরবও সহায়তা পাঠাতে থাকে। পাকিস্তান কর্তৃক প্রশিক্ষিত মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা তৎপরতা চালাতে আরম্ভ করে। এ সময় জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু তরুণ আরব, পাকিস্তান সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হ’তে আফগানিস্তানে আসতে থাকে। এসব যোদ্ধাদের মধ্যে বিন লাদেন ছিলেন অন্যতম একজন, যিনি সোভিয়েত বিরোধী জিহাদে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। এদিকে ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারবাক কারমাল মস্কোয় নির্বাসিত হ’লে গোয়েন্দা প্রধান মুহাম্মাদ নাজিবুল্লাহ দেশের ক্ষমতা দখলে নেন। কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি জনগণের মন জয় করতে দেশকে ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানকে সাংবিধানিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। অন্যদিকে মুজাহিদরা সোভিয়েত বাহিনীকে দেশছাড়া করার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ চালাতে থাকে। ফলে প্রবল আগ্রাসন চালানোর পরও একসময় মুজাহিদদের প্রতিরোধের মুখে রুশদের অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়। মুজাহিদরা রুশ হেলিকপ্টারগুলোকে পঙ্গপালের মতো ভূপাতিত করতে থাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ এই যুদ্ধের অসারতা বুঝতে পারেন। একদিকে রুশ সেনাদের ব্যর্থতা, অপর দিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাধ্য করে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে। গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্রান্তির কথা স্বীকার করেন এবং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করেন।

১৯৮৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সোভিয়েত বাহিনীর সর্বশেষ সৈন্যটিও আফগানিস্তান ত্যাগ করে। কিন্তু এই ভুল যুদ্ধে জড়ানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে মাশুল দিতে হয় খুব চড়া মূল্যে। কেননা এর মাধ্যমে শক্তিশালী বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদীদের পতন হয় এবং ১৫টি টুকরোতে বিভক্ত হয়ে যায়।

মুক্তিকামী তালিবানের উত্থান ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পতন :

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের পর মুজাহিদরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার জন্য কাবুলের দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে। ১৯৯২ সালে মুজাহিদদের হাতে নাজিবুল্লাহ সরকারের (তথা সমাজতন্ত্রের) পতন হয়। কিন্তু এবার আফগানিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন মুজাহিদ দলগুলোর মধ্যে বিরোধ বেঁধে যায়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পুনরায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। এসময় আবির্ভূত হন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর ও তার অখ্যাত ছাত্র সংগঠন ‘তালেবান’ বা ছাত্রগণ। মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়েই মূলতঃ সংগঠনটি গঠিত হবার কারণে এই নাম দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখল করে এবং পরবর্তীতে মাজার-ই-শরীফ দখলের মাধ্যমে আফগানিস্তানের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কাবুল দখলের পর বিভিন্ন মুজাহিদ গ্রুপগুলোর মধ্যে বিবাদ মীমাংসা করে মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নেতৃত্বে সঊদী আরব, আরব আমিরাত এবং পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে আফগানিস্তান একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনের পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় তাতে বাঁধ সাধে আরেক ঘটনা, যা আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে ফের উল্টো দিকে প্রবাহিত করে।

১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১, সকাল ৯টা। মঞ্চস্থ হয় বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দেওয়া বিস্ময়কর ৯/১১-এর হামলা। বিশ্ববাসীকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জোড়া টাওয়ার (Twin Tower) ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনে ছিনতাই করা যাত্রীবাহী বিমান দ্বারা অচিন্তনীয়ভাবে আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়। টুইন টাওয়ার বিমানে রক্ষিত ৬০,০০০ গ্যালন জ্বালানি তেলের বিস্ফোরণের কারণে বিকট আওয়াজে মুহূর্তেই ভূপাতিত হয়। দন্ডায়মান থাকে স্রেফ লোহার ফ্রেমটুকু। অপ্রত্যাশিত হলেও 'America Under Attack' শিরোনামে BBC হামলার সংবাদ প্রচার করে। আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, খোদ মার্কিন মুলুক থেকে এতো বড় হামলা করা হলেও এর কোন পূর্বাভাস বা তথ্য পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল না। মার্কিন প্রশাসন এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই এ হামলার সাথে ওসামা বিন লাদেনের সম্পৃক্ততার দাবী করেন এবং প্রতিশোধ নেবার ঘোষণা দেন। এদিকে ১১-২৪ সেপ্টেম্বর- এই ১৩ দিনের মধ্যে বিন লাদেনের ওয়েবসাইট থেকে চার বার ঘোষণা আসে যে, তিনি ও তার সংগঠন এই হামলার সাথে জড়িত নন’।[1] 

কিন্তু এ কথায় কোন কর্ণপাত করা হয়নি, বরং জর্জ বুশ বলেন, শত্রুদের তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে নিঃশেষ করবেন। এরপর মাত্র ২৮ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট বুশ ‘ক্রুসেড’ বা ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা করেন এবং বিন লাদেনকে আশ্রয় ও সন্ত্রাসবাদে মদদ দেবার অভিযোগ তুলে ন্যাটো জোটকে সাথে নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করেন। প্রচন্ড আক্রমণে তালেবান প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং বিভিন্ন গোত্রীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। দুই মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন হয় এবং মার্কিন সমর্থিত পুতুল সরকার ক্ষমতায় আসে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া পাকিস্তান বনে যায় আমেরিকার বিশ্বস্ত মিত্র। ওয়াশিংটনের নির্দেশে পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে তালেবানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। এভাবে War on Terror তথা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আমেরিকা আফগানে একতরফাভাবে শুরু করেছিল এক অসম রক্তক্ষয়ী লড়াই এবং এর আড়ালে সমগ্র মুসলিম জাতিকে বানিয়েছিল সন্ত্রাসী।

১৯৯৩ সালে Foreign Affairs জার্নালে 'The Clash of Civilizations' শীর্ষক প্রবন্ধে একটি তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। যার তাত্ত্বিক ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর Samuel P. Huntington। উক্ত প্রবন্ধে তিনি দাবী করেন, আগামী দিনে পৃথিবীতে যুদ্ধ বা সংঘাতগুলো হবে সভ্যতা কেন্দ্রিক। তিনি পৃথিবীকে মোট ৭টি মৌলিক সভ্যতায় বিভক্ত করেন এবং আমেরিকাকে এই বার্তা দেন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি আসবে ইসলামী সভ্যতার দিক থেকে। তিনি ইসলামকে একটি ‘সভ্যতা’ হিসাবে বিবেচনা করেন। প্রবন্ধটি প্রকাশের পরই গোটা বিশ্ব জুড়ে আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশে এই তত্ত্বের একজন কট্টর সমালোচক হলেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি হান্টিংটনের এই গবেষণা প্রবন্ধকে ডাস্টবিনে ফেলারও অযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর পরের বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে কাকতালীয়ভাবে হান্টিংটনের তত্ত্বের সাথে ঘটনা প্রবাহের ব্যাপক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় এবং একুশ শতকে এই সংঘাতের সূচনা হয়েছিল আমেরিকার আফগান আক্রমণের মধ্য দিয়ে। যা সংঘটিত হয়েছিল শুধুমাত্র নিছক ধারণা প্রসূত একটি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে।

দিনে দিনে বিশ্ব রাজনীতি ও আফগান পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবশেষে ২০০৫ সালে বিচ্ছিন্ন তালেবান যোদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত হ’তে শুরু করে। তারা প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে এবং একই সাল হ’তে তারা মার্কিন ও তাদের মিত্র বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালাতে শুরু করে। দৈনিক নয়াদিগন্ত জানায়, ‘বর্তমানে (২০০৫) আফগানিস্তানে মার্কিন ক্ষয়ক্ষতি ইরাককেও ছাড়িয়ে গেছে। তালেবান মুখপাত্র বলেন, বিদেশী সৈন্য আফগানিস্তান ত্যাগ না করা পর্যন্ত হামলা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো জানান, তালেবান যোদ্ধারা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং মোল্লা ওমর তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন। গত তিন মাসে দু’টি মার্কিন কপ্টার ভূপাতিত হয়েছে। যোদ্ধাদের রণকৌশলে মার্কিন বাহিনী অবাক। তাদের দক্ষতা ইরাকীদের চাইতেও সুনিপুণ’।[2] পাকিস্তানি সাংবাদিক সাইয়েদ সেলিম শেহজাদের মতে, তালেবান বড় মাপের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে পরের বছর ২০০৬ সাল থেকে। সময় এগোনোর সাথে সাথে তালেবানরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে দখল নিতে থাকে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত এ যুদ্ধের এক দশকের মাথায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সূচনাকালে আমেরিকা বুঝতে পারে যুদ্ধের মোড় তার অনুকূলে যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও আমেরিকা বিশ্বের সামনে নিজের সুপার পাওয়ার ইমেজ ধরে রাখার জন্য একের পর এক হামলা চালিয়ে যায়। টনের পর টন বোমা ফেলে পুরো দেশকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। এসব হামলার শিকার হয় হাযার হাযার নারী, শিশু ও বেসামরিক নাগরিক। কিন্তু তবুও আমেরিকার শেষ রক্ষা হয়নি। রাশিয়ার অনুরূপ ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সামরিক ব্যর্থতা আমেরিকাকে থামতে বাধ্য করে। খোদ মার্কিন সরকারের হিসাব বলছে, ‘আফগান যুদ্ধে সব মিলিয়ে ২০০১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। কিন্তু এতে পাকিস্তানে যে ব্যয় হয়েছে তার হিসাব ধরা হয়নি’।[3] প্রকৃত হিসাবে যদিও আরো বেশী। এতো ব্যাপক ক্ষতির মুখে আমেরিকা আফগান ত্যাগ করার পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু তালেবানের সাথে আপোষ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ তাদের সামনে ছিল না। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই আমেরিকা সে পথে হাঁটে।

২০২০ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী কাতারের রাজধানী দোহায় স্বাক্ষরিত হয় ‘মার্কিন-তালেবান’ ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আমেরিকা ১৪ মাসের মধ্যে মার্কিন ও ন্যাটো জোটের সব সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকবে। পরবর্তীতে আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন’।[4] বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার সাথে সাথে ঝড়ের গতিতে তালেবানরা আফগানিস্তানে একের পর এক অঞ্চল দখল করতে থাকে। মার্কিন প্রশিক্ষিত আফগান সরকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করে ও দেশ ত্যাগ করে পালাতে থাকে। অবশেষে প্রায় ২০ বছর পর গত ১৫ই আগস্ট তালেবান পুনরায় কাবুল দখল করে এবং প্রেসিডেন্ট প্যালেসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

কথিত সন্ত্রাস দমনের নামে এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ে যুদ্ধে নামা ছিল আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। আফগান থেকে এই লজ্জাজনক প্রত্যাবর্তনের পর সোভিয়েত রাশিয়ার মতো মার্কিন সাম্রাজ্যকেও ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে বাঁচানো আমেরিকার জন্য আরেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আফগানিস্তানে তাদের পরাজয় জানিয়ে দিচ্ছে যে, ক্ষয়িষ্ণু হ’তে শুরু করেছে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের জাল। আমেরিকার পতন একথা আমাদের জানান দেয় যে, ‘আপনি যদি আফগানে প্রবেশ চান তাহ’লে সেটা বেশ সহজ। কিন্তু যখন বেরিয়ে আসতে চাইবেন তখন সেটা খুব কঠিন হয়ে যাবে’। যে কথাটি মূলত বিশ্ববিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট-এর। এটা তিনি বলেছিলেন দখলদারদের উদ্দেশ্য। মঙ্গল, ব্রিটিশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পর আফগানের মাটিতে আমেরিকার পরাজয় যেন সেই কথারই সাক্ষ্য দেয়।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ :

তালেবানের কাবুল দখলের পর সেখানকার জনগণের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। বিমানে গাদাগাদি করে দেশ ত্যাগ করার তোড়জোড় শুরু করেন অনেকে। কিন্তু কাবুল দখলের পর তালেবান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কাবুল দখলের পর তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে তালেবান মুখপাত্র যবীহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘২০ বছর সংগ্রাম করে আমরা দেশকে মুক্ত করেছি এবং বিদেশীদের বহিষ্কার করেছি। গোটা জাতির জন্য এটা গর্বের মুহূর্ত’।[5]

তালেবানের কাবুল দখলের পর চীনা পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, ‘আফগানিস্তানের জনগণের ইচ্ছা ও পসন্দকে চীন সম্মান করে’। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘আফগানরা দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গেছে’ বলে মন্তব্য করেন।

ভবিষ্যতে আফগানিস্তানকে কিভাবে পরিচালনা করা হবে, এ প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদুল্লাহ হাশিমী বলেন, ‘এখানে কোন রকম গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকবে না। কারণ আমাদের দেশে এর কোনো ভিত্তি নেই। আফগানরা যেহেতু শতভাগ মুসলিম তাই এখানে ইসলামী শারঈ আইন বলবৎ থাকবে। সেটাই শেষ কথা’।[6] আফগানের ভূমি ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশের উপর কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না বলেও তারা বিশ্বকে আশ্বস্ত করে। মিডিয়ার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হ’ল, ইসলামী মূল্যবোধ পরিপন্থী কিছুই তারা মিডিয়ায় প্রচার করতে দেবে না’।[7] আফগান নারীদের ব্যাপারে তাদের নীতি কি হবে? এ ব্যাপারে যবীহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা নারীদের বাইরে কাজ করার ও পড়াশোনার অনুমতি দেব। তবে সেটা হবে আমাদের কাঠামোর মধ্যে। শারঈ আইনের অধীনে নারীর অধিকার রক্ষায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।[8]

উপসংহার : আফগানিস্তানের এই পরিবর্তন নিয়ে পুরো বিশ্ব উদ্বিগ্ন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতাগণ। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন করে নীতি নির্ধারণ করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এখনো পূর্ণ স্থিতিশীল নয়। কাজেই আফগানিস্তান নতুন কোন গন্তব্যে যাত্রা শুরু করবে, তা এখনি নিশ্চিতভাবে বলার সময় আসে নি। সে জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আফগানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান করি। তাদের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করি। আশাকরি যে ইসলামী ইমারত প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে তারা আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়েছে, তা তারা বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। ইসলামে সাম্য ও ন্যায়বিচারের বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেবে। তবেই তাদের এই দীর্ঘ আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম স্বার্থক হবে। 

মুহাম্মাদ আবু হুরায়রা ছিফাত

লেখক : বড়পই, প্রসাদপুর, মান্দা, নওগাঁ


[1]. মাসিক আত তাহরীক, জুন ২০১১

[2]. নয়া দিগন্ত, ৬ জুন ২০০৫

[3]. বিবিসি, ১ মার্চ ২০২০

[4]. বিবিসি, ২ জুলাই ২০২১

[5]. বিবিসি, ১৭ আগস্ট ২০২১

[6]. বিবিসি, ১৮ আগস্ট ২০২১

[7]. বিবিসি, ১৭ আগস্ট ২০২১

[8]. বিবিসি, ১৭ আগস্ট ২০২১



বিষয়সমূহ: দেশ পরিচিতি
আরও