যেতে হবে বহুদূর!

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 9494 বার পঠিত

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানায় একধরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দীর্ঘকাল সামাজিক পরিমণ্ডলে আপাত পিছিয়ে পড়ে থাকা ধর্মীয় অঙ্গনের মানুষগুলো নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। সমাজ থেকে সযত্নে গাঁ বাঁচিয়ে চলাকে যে সকল ওলামায়ে কেরাম একসময় মুক্তির পথ মনে করতেন, তারা এখন দেদার সমাজ স¤পৃক্ত কাজে যুক্ত হচ্ছেন। মিডিয়ায়, বইমেলায় কিংবা সামাজিক ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে তাদের সরব উপস্থিতি এক নতুন জাগরণের আভাস দিচ্ছে। ফলে যারা একসময় ধর্মচর্চায় যুক্ত মানুষগুলোর প্রতি নাক সিটকানোর ভাব দেখাতেন, কুপমণ্ডুকতার দায়ে তাদেরকে কথায় কথায় হেয় করতে চাইতেন, তাদের মাঝে হঠাৎ ধর্মীয় ঘরানার প্রতি কিছুটা হ’লেও সুনজর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই জাগরণের ভবিষ্যৎ এখনই অনুমান করা কঠিন, তবে নিঃসন্দেহে তা আশাব্যঞ্জকই বলতে হবে। আর তা এই কারণে যে, এই ধর্মীয় গণজাগরণে যে জিনিসটি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে, তা হ’ল সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম স¤পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া। তাদের মধ্যে সত্য জানার আগ্রহটা আগের তুলনায় এখন অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদেশে ধর্মের নামে হাযারো কুসংস্কার যে শত শত বছর ধরে চেপে বসে আছে এবং কুরআন-হাদীছের ইসলাম আর প্রচলিত রেওয়াজী ইসলাম যে এক নয়, তা বহু মানুষের উপলব্ধিতে আসতে শুরু করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিগত মাসগুলোতে পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া সফরেও প্রায় একই দৃশ্য দেখেছি। মানুষ এখন উন্মুখ হয়ে আছে সত্যিকার ইসলামের পতাকাবাহকদের জন্য। এক মরুভূমিসম তৃষ্ণা নিয়ে তাদের হৃদয় অপেক্ষা করছে নতুন দিনের অশ্বারোহীদের জন্য, যারা মানুষকে ইসলামের সরল ও সঠিক পথের দিকে ডাকবে, জাহেলিয়াতের যুলুমাতকে ছিন্ন করে হক্বের প্রদীপ জ্বালাবে।

এই প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার কাজে যারা স¤পৃক্ত রয়েছেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, এই জাগরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং এদেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় অঙ্গন, সমাজ ও রাজনীতিতে অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসা। আর এজন্য প্রয়োজন ময়দানে একদল সত্যসেবী মানুষের সক্রিয় পদচারণা এবং ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও অবিচলতার সাথে পরিস্থিতির মুকাবিলা করা। তাদের দায়িত্বশীলতা এবং দৃঢ়পদ ভূমিকার উপরই নির্ভর করছে এই জাগরণের ভবিষ্যৎ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হ’ল, এই জাগরণে সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি যেমন আলেম সমাজ, তেমনি সবচেয়ে বড় বাধাও হ’ল আলেম সমাজ। তাদের সঠিক ভূমিকার কারণে সমাজ যেমন ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে, তেমনি তাদের অনৈতিক ভূমিকার কারণে এই জাগরণ আবার অচিরেই বিপর্যস্তভাবে নিভে যেতে পারে। এজন্য একদিকে আলেম সমাজকে যেমন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, তেমনি সাধারণ জনগণকেও বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে, যেন কিছু আলেমের পদস্খলনের কারণে সমগ্র সমাজ পদস্খলিত না হয়। ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি জিনিস : (১) আলেমদের পদস্খলন, (২) কুরআন নিয়ে মুনাফিকদের বিতর্ক, (৩) নেতাদের পথভ্রষ্ট হওয়া (জামে‘উ বায়ানিল ইলম হা/১৮৬৭)। এর ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষের করণীয় স¤পর্কে মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, আলেমদের ব্যাপারে দু’টি পন্থা অবলম্বন করবে। যদি তারা সঠিক পথে থাকেন, তবে তাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না। আর যদি তারা ফিৎনায় নিপতিত হন, তবে তাদের থেকে ধৈর্যহারা হয়ে ছিটকে যাবে না। কেননা মুমিন ফিৎনায় পতিত হলে তওবা করে (অর্থাৎ তাদের প্রতি সুধারণা রেখে তাদের তওবার অপেক্ষায় থাকবে) (জামে‘উ বায়ানিল ইলম হা/১৮৭২)। এভাবে পার¯পরিক দায়িত্বশীল ও সহমর্মী ভূমিকার মাধ্যমেই দ্বীনের এই পবিত্র জাগরণ সঠিক গন্তব্যপানে এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এই নেক আশাবাদ আমরা আন্তরিকভাবে পোষণ করি।        

আলহামদুলিল্লাহ এই দ্বীনী গণজাগরণেরই প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহর অশেষ রহমতে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত ৩০তম বার্ষিকী তাবলীগী ইজতেমা ২০২০ অনুষ্ঠিত হ’তে যাচ্ছে। এই ইজতেমা এদেশের বুকে হকের আওয়াজ বুলন্দ করার জন্য সর্ববৃহৎ প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে এদেশের গণমানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদা ও আমলের বার্তা, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তনের বার্তা, ন্যায় ও ইনছাফের বার্তা, সর্বোপরি ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত জীবনের সবগুলো ক্ষেত্রকে অহীর আলোয় ঢেলে সাজানোর বার্তা। এদেশের ধর্মীয় অঙ্গন থেকে শিরক-বিদ‘আতকে উৎখাত করে তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহ্র কার্যকর চাষাবাদ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে সকল প্রকার বিজাতীয় মতবাদকে উৎখাত করে ইসলামের সাম্য ও ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠাদানের সু¯পষ্ট ও বলিষ্ঠ লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে দেশব্যাপী। সুতরাং যুবসমাজের প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন! আমরা সম্মিলিতভাবে এই আন্দোলনের বার্তাকে দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বাÍক প্রচেষ্টা গ্রহণ করি এবং সেই সাথে ধৈর্য, সাহস ও আÍবিশ্বাসের সাথে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হই। আমাদের মধ্যে হাযারো ত্র“টি-বিচ্যুতি থাকবে, মতভেদ থাকবে, চলার পথে থাকবে অসংখ্য বাধা ও বিপদ। কিন্তু তাই বলে যে ঈমান, যে আক্বীদা, যে রাসূলের আনুগত্য আমাদেরকে উজ্জল ভবিষ্যতের হাতছানি দেখিয়েছে, তা আমরা কখনও হাতছাড়া করতে পারি না। ঐ শোন আল্লাহ্র বাণী- ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই তো বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ১৩৯)। যত বাধাই আসুক, সকল বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সত্য সূর্যের আলো আমরা সর্বত্র ছড়িয়ে দেবই। জান্নাতের পথে ছুটে চলার এই মিছিলকে আমরা বেগবান করবই। জাহেলিয়াতের তিমিরে ডুবে থাকা মানুষকে আলোর পথ দেখাবই। উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় না তার ক্ষয় নাই। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন!         


আরও