চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 794 বার পঠিত

আকাংখা, প্রত্যাশা, উচ্চাভিলাষ মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। মানুষ স্বপ্ন দেখে বলেই স্বপ্নের পিছনে ছোটে। উচ্চাকাংখা আছে বলেই প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশা তাকে ক্লান্তিহীন ছুটে চলার রসদ জোগায়। আকাশছোঁয়া স্বপ্নের বুননই শত কষ্টের মাঝে দৃঢ় রাখে। বড় কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা ছোট কিছু ত্যাগ করার মানসিক পরিপক্কতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে আসে। আমাদের এই চাওয়া বা প্রত্যাশার সীমানা কখনও দুনিয়ার এই সংক্ষিপ্ত জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে; আবার কখনও আসমান-যমীনের গন্ডি পেরিয়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবন অবধি পরিব্যপ্ত হয়।

তবে সত্যিকার অর্থে অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রাই মূলতঃ দুনিয়ামুখী। দুনিয়াকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় তাদের যাপিত জীবনের প্রায় সবটুকু। মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশ্বাস রাখলেও সে ব্যাপারে তারা বেখবর কিংবা গুরুত্বহীন। আখেরাত তাদের কাছে প্রাধান্য না পাওয়ায় দুনিয়া থেকে যতটুকু নেয়ার, সবটুকু কড়ায়-গন্ডায় তারা বুঝে নিতে চায়। এতে অধিকাংশ সময়ই হয়ত তারা সফল হয় না। ফলে জীবনটা তাদের কাছে যুদ্ধের অপর নাম কিংবা এক সততঃ বিষাদময় উপাখ্যান। আবার এতকিছুর পর প্রত্যাশামাফিক কিছু পেলে হয়ত সন্তুষ্ট হয়- কিন্তু সেটাও যেন তারা উপভোগ করতে পারে না। কারণ ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’ বাণীগুচ্ছের মত দোলাচলে থেকে তারা আরো পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকে। আরো চাই, আরো চাই- তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে। এভাবে জীবনে সবকিছু পাওয়ার পরও তাদের চাহিদার শেষ হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, সামর্থবান, আত্মনির্ভর ব্যক্তির জন্যও একথা চিরন্তন সত্য। এভাবেই চাওয়া ও পাওয়ার সীমাহীন দ্বন্দ্বে ভরপুর মানবজীবন। মৃত্যু অবধি এর অবসান হয় না। আল্লাহর ভাষায়- ‘অধিক পাওয়ার আশা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১-২)

সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন আসে- আমাদের জীবনে এমন সময় কি আসবে, যখন আমাদের সব চাওয়াগুলো পূর্ণ হয়ে যাবে? আমাদের না পাওয়ার বেদনাগুলো সব চিরতরে ঘুচে যাবে? হ্যাঁ, সেই সময় একদিন অবশ্যই আসবে। যেদিন বিশ্বাসী মানুষ তার রবের সন্তুষ্টি লাভ করে চিরন্তন জান্নাতের মহাপুরষ্কারে ভূষিত হবে। যেদিনের পর চাওয়া-পাওয়ার এই দ্বন্দ্ব চিরতরে ঘুচে যাবে। সেটাই হবে আমাদের পূর্ণতার জীবন। সর্বময় প্রাপ্তির জীবন। সেই সর্বাঙ্গীন সফল জীবনই পরম আরাধ্য- যার অধীর অপেক্ষায় অপেক্ষমান প্রতিটি ঈমানদার হৃদয়।

প্রিয় পাঠক, দুনিয়াবী জীবনে চাওয়া-পাওয়ার এই দ্বন্দ্বের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। মৃত্যু অবধি প্রবৃত্তি আমাদেরকে এ পথে অবিরাম তাড়িয়ে ফিরবে। সুতরাং এই অর্থহীন পথ থেকে যথাসাধ্য আত্মরক্ষা করা এবং নিজেকে পূর্ণতার পথে পরিচালিত করাই ঈমানদার হিসাবে আমাদের কর্তব্য। এজন্য আমাদের করণীয় হ’ল। 

(ক) অল্পে তুষ্টি : অল্পে তুষ্ট জীবন মানেই পরিতৃপ্ত জীবন। যতটুকু নে‘মত আল্লাহ তাকে দিয়েছেন, তা নিয়েই সে ভীষণ সন্তুষ্ট থাকে। বিপদ-আপদে সকাতর কিংবা সহিংস না হয়ে নিরবে-নিভৃতে প্রভুর প্রতি ভরসা রেখে ধৈর্য ধারণ করে। সে তার যাবতীয় কামনা-বাসনাকে রবের সাথে সংযুক্ত রাখে। ফলে তার প্রাপ্তির আকাংখা কখনও আকাশছোঁয়া হয় না, আবার অপ্রাপ্তির বেদনা তাকে নৈরাশ্যের আঁধারে ডোবায় না। কারণ সে জানে আল্লাহ তার জন্য যা বন্দোবস্ত রেখেছেন, সেটাই তার জন্য সর্বোত্তম। তেমনিভাবে আমাদের চাওয়া চুড়ান্ত নয়; বরং আল্লাহর চাওয়াই চুড়ান্ত। তিনিই তো সবকিছু অবগত এবং সর্বময় প্রজ্ঞার অধিকারী (দাহর ৩০)

(খ) মধ্যপন্থা : Life is short, keep enjoying কিংবা ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক’-এর মত আগ্রাসী চিন্তাধারা নয়; বরং সৎ, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধারণই তার কাছে কাম্য। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের কল্যাণচিন্তা তাকে ভারসাম্যতা দান করে। আল্লাহর ভাষায়- ‘আর আল্লাহ তোমাকে যা (নে‘মত, ধন-সম্পদ) দিয়েছেন, তা দিয়ে (উত্তম পন্থায় ব্যবহারের মাধ্যমে) পরকালের কল্যাণ কামনা কর। তবে দুনিয়ার (জন্য করণীয়, তথা অন্যের হক আদায় করা বা নিজের বৈধ চাহিদা পূরণের) অংশ ভুলে যেও না। তোমার প্রতি আল্লাহ যেভাবে অনুগ্রহ করেছেন, তেমনভাবে তুমিও (অন্যের প্রতি) অনুগ্রহ কর। আর পৃথিবীতে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে চেয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না’ (ক্বাছাছ ৭৭)

এই মধ্যপন্থী অবস্থানের কারণে এমনকি শত্রুর শত্রুতা ও বিদ্বেষ; কারো প্রতি ক্ষোভ ও অভিযোগও তাকে আড়ষ্ট করে না। প্রতিশোধপরায়ণ করে না। বরং সর্বদা ছাড় দিতে শেখায়। ক্ষমা করার সুযোগ করে দেয়। কেননা জীবনের অর্থ তার কাছে সুগভীর। জীবনের পরমার্থ তাকে সর্বদা সত্যনিষ্ঠ, বিবেকবান, সহানুভূতিশীল রাখে। কাজী নজরুল ইসলাম কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন, ‘তুমি কারো অবিচারের বিচার করো না। কারোর ভুলের প্রতিশোধ ভুল দিয়ে করো না। কে তোমায় অপমান করতে পারে, যদি নিজেকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পার। যার কল্যাণ কামনা করা, সে যদি কোনদিন তোমায় দূর্ভাগ্যবশতঃ বিষদৃষ্টিতেই দেখে- তাকেই বরণ করে নিও। তাকে ত্যাগ করো না’ (নজরুল রচনা সমগ্র ৪/৪০৫)

(গ) আখেরাতমুখী জীবন : দুনিয়ামুখী বস্ত্তবাদী জীবনের পিছনে ছুটে চলা মানুষ শত প্রাপ্তিতেও সন্তুষ্ট হতে পারে না। দিনশেষে হতাশা, অপ্রাপ্তির বেদনা তাকে দিশাহারা করে তোলে। জীবনের বিশেষ লক্ষ্য না থাকায় অস্থিরতা; বেপরোয়া চিন্তা; অন্যের সাথে অসুস্থ দুনিয়াবী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া; মাল-মর্যাদা, সম্মান- প্রতিপত্তি অর্জন করা; অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করা কিংবা অর্থের নেশাই তার কাছে জীবনের মোক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে আখেরাতমুখী জীবন হয় এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস তাকে এমন আত্মবিশ্বাসী ও প্রশান্ত হৃদয় করে যে, কোন অবস্থাতেই সে নিয়ন্ত্রণহীন হয় না, জীবনের সর্বাধিক কঠিন মূহূর্তেও সে আদর্শহীনতার পরিচয় দেয় না, অনৈতিকতার পথ বেছে নেয় না। আখেরাতে মুক্তির চুড়ান্ত উদ্দেশ্যে তাকে সর্বদা সত্য, ন্যয় ও সুন্দরের পথে অবিচল রাখে। চাওয়া-পাওয়ার বস্ত্তবাদী হিসাব-নিকাশ থেকে তাকে দূরে রাখে। তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস তাকে এমনই নির্ভার রাখে যে, সে সহসাই বলতে পারে - نصيبك يصيبك ولو كان بين جبلين و ما ليس نصيبك لن يصيبك ولو كان بين شفتين ‘যা তোমার ভাগ্যে আছে, তা যদি দুই পাহাড়ের মাঝেও থাকে, তবুও তোমার কাছে পৌঁছে যাবে; আর যা তোমার ভাগ্যে নেই তা যদি তোমার দুই ঠোঁটের মাঝে থাকে, তবুও তা তোমার কাছে পৌঁছাবে না’। রবের প্রতি এই অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা তাকে সর্বদা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে, অন্যায় কাজে বাধা দেয়। আর এভাবেই সে হয়ে ওঠে পূর্ণতা ও নাজাতের পথে ছুটে চলা এক জান্নাতী মানুষ। আল্লাহ আমাদের দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে থেকে অল্পে তুষ্ট, মধ্যমপন্থী ও আখেরাতমুখী জীবন যাপনের তাওফীক দান করুন। আমীন!



আরও