বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কবে হবে প্রকৃত বিদ্যার আলয়?

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 10529 বার পঠিত

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে গত কিছুদিনে একটার পর একটা ঘটনা আমাদের ভাবনার জগতে নতুন করে নাড়া দিয়ে গেল। ৭ই অক্টোবর ২০১৯ আবরার ফাহাদ নামে বুয়েটের এক মেধাবী ছাত্র ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সহপাঠীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হ’ল। ১৯শে অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান জানালেন যে, আওয়ামী যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পেলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদও ছেড়ে দেবেন। ২রা নভেম্বর রাজশাহী পলিটেকনিক ইনিস্টিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দীন আহমেদকে নিজ কলেজেরই পুকুরে নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা করল ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটি। ৪ঠা নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করায় উক্ত ছাত্রসংগঠনটি প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, এই দিনটি তার জন্য আনন্দের এবং এই ‘গণঅভ্যুত্থানে’র জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ।

প্রিয় পাঠক, উপরের এই সর্বসাম্প্রতিক চিত্রগুলো আপাতদৃষ্টিতে অভাবনীয় মনে হ’লেও বিগত ৮০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব দৃষ্টান্ত অতি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কর্মকান্ড নিয়মিত দেখতে দেখতে এ জাতির বিস্মিত হওয়ার শক্তিও বোধহয় এখন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে দেশের কর্ণধার হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলো যারা দেখভাল করছেন, তারা বছরের পর বছর জাতিগত অধঃপতনের এই নিকৃষ্টতম দৃশ্য কিভাবে সহ্য করছেন! সর্বোচ্চ মেধার লালনকেন্দ্র এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে প্রধান নিয়ামক শক্তি যে বিশ্ববিদ্যালয়, তা হওয়ার কথা ছিল জাতীয় গুরুত্বের শীর্ষ কেন্দ্র। শিক্ষা ও গবেষণার প্রাচুর্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানের একেকটি খনি। অথচ তথাকথিত রাজনীতির বিষবাষ্প ঢুকে গোটা ব্যবস্থাপনা এমনভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন যাবতীয় অন্যায়, দূর্নীতি, কুশিক্ষা আর অনৈতিকতার অবাধ অনুশীলনকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হয় না।

ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর অধ্যয়নকেন্দ্র নয়, বরং নিছক সার্টিফিকেট বিতরণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যে ছাত্রটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দিয়েছিল, সে এখন আর জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত নয়। বরং সে ব্যস্ত ছাত্ররাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তার আর টেন্ডারবাজির প্রতিযোগিতায়। দূর্নীতির বাস্তবদীক্ষা তারা গ্রহণ করা শুরু করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ভাই নামক দানবদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। গণরুম কালচার, টর্চার সেল, র‌্যাগিং ইত্যাদি ভয়ংকর ও অবিশ্বাস্য অপরাধকর্মের সাথে তাদের পরিচয় ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই। এর সাথে রয়েছে কথায় কথায় আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, ভাঙচুর আর শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবির সংস্কৃতি। আর এভাবেই অধঃপতনের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ কারিগররা।

অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত অংশ হওয়া সত্ত্বেও প্রচলিত ক্ষমতা ও স্বার্থবাদিতার রাজনীতিতে জড়িয়ে তাদের একটা বড় অংশই হারিয়ে ফেলেছেন নীতি-নৈতিকতা। যারা সমাজ ও জাতির আদর্শ হওয়ার কথা ছিল, তারা নিজেরাই যখন আদর্শহীনতার স্রোতে গা ভাসান, তখন কার কাছে ছাত্ররা নৈতিক মুল্যবোধ ও আদর্শ শিখবে?

এর শুরুটা এখন হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগদান পর্ব থেকেই। যেভাবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ কোন যোগ্যতা ছাড়াই স্রেফ লবিং-গ্রুপিং-দূর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের মত দেশেও এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। শিক্ষকতার প্রধান শর্ত মেধা ও গবেষণার সাথে সম্পৃক্ততার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাই এখানে  একচ্ছত্র  প্রাধান্য  পাচ্ছে।  ফলে ছাত্রদেরকে সুনাগরিক হওয়া এবং জ্ঞানার্জন ও গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য ন্যূনতম যে নৈতিক বল ও যোগ্যতা প্রয়োজন, সেটুকু আজ শিক্ষকদের কাছে পাওয়াটা দুষ্কর। বরং মেধাহীনতা, দূর্নীতির দৌরাত্মে শিক্ষকতা পেশাই হারিয়ে ফেলেছে তার চিরন্তন মর্যাদা।

আমরা জানি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হ’ল, পাঠদান ও জ্ঞানচর্চার সাথে সাথে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা। আরও খোলাসা করে বললে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উৎপাদন, বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে সেই জ্ঞান সংরক্ষণ এবং পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণভাবে নতুন কোন জ্ঞান উৎপাদনের পদক্ষেপ দেখা যায়? অভিজ্ঞমহল জানেন যে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ফলে মাধ্যমিক শ্রেণীর মত উচ্চতর শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও পুরনো জ্ঞানই অন্ধভাবে গলধঃকরণ করে আসছে। পরীক্ষার খাতায় মুখস্তনির্ভর জ্ঞান উপস্থাপন করা এবং দিনশেষে ভাল মার্কস পাওয়াতেই তারা স্বার্থকতা খোঁজে। শিক্ষকরা ছাত্রদের নতুন জ্ঞান আহরণ বা সৃষ্টিতে উৎসাহিত করেন না। তাদেরকে জ্ঞানের প্রয়োগক্ষেত্র দেখিয়ে দেন না। বিভাগগুলোতে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের কোন আয়োজন দেখা যায় না। এমনকি শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরীতে পর্যন্ত যেতে আগ্রহী হয় না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) জীবনে এমন অনেক ছাত্র দেখেছি, যারা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে কখনো একটি বইও ছুঁয়ে দেখেনি। অর্থাৎ সৃষ্টিশীল জ্ঞানার্জনের জন্য যে পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা প্রয়োজন, তার ছিঁটেফোটাও নেই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। এক অজানা গৎবাঁধা সিস্টেমের জালে সকলেই যেন বন্দী।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে বড় যে সংকট তা হ’ল গবেষণার সংস্কৃতি না থাকা। গবেষণা কি জিনিস তা মাস্টার্সে গিয়েও অধিকাংশ ছাত্র জানে না। অথচ মেধার সঠিক পরিচর্যা, দক্ষ মানুষ তৈরী করা, সর্বোপরি জাতীয় উন্নতির জন্য গবেষণার কোন বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাখাতে সবচেয়ে বেশী খরচ করছে। সরকারী-বেসরকারী বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা দিন দিন উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে ছাত্ররা অনার্স পর্যায়ে গবেষণার চিন্তাই করতে পারে না। আর মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে তারা যে গবেষণা করেন, তা উন্নত বিশ্বের গবেষণার তুলনায় পদ্ধতিগতভাবে শিশুতুল্য। গবেষণার সার্বজনীন মান রক্ষায় যত্নবান না থাকায় এসব গবেষণায় মৌলিকত্ব প্রায়ই থাকে না। ফলে গবেষণার মূল বিষয়টি তাদের নিকটে অনাস্বাদিতই থেকে যাচ্ছে। কেউ যখন দেশের বাইরে গিয়ে উন্নত বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় যুক্ত হয়, তখনই কেবল নিজ দেশের গবেষণা সংস্কৃতির দৈন্যতা অনুভব করতে পারে। কিন্ত তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কেবলই মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মূল্যবান সময়টা কিভাবেই না নষ্ট হয়ে গেছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার হ’ল বাংলাদেশে গবেষণা সংস্কৃতি এতই দূর্বল যে, গবেষণার জন্য সরকারী যে যৎসামান্য বরাদ্দ রয়েছে তা-ও অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে প্রকৃত গবেষকের অভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭-২০১৮ সনে গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ১৪ কোটি টাকা। কিন্তু বছরান্তে দেখা গেছে তা থেকে মাত্র ৮ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। ইউজিসিতে ২০১৭ সালে ১০০টি পিএইচ.ডি ফেলোশীপ থাকলেও মাত্র ৫৮ জন শিক্ষক তা গ্রহণ করেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ফলে গবেষণা সংস্কৃতি না গড়ে ওঠায় বিপুল সংখ্যক মেধার অপচয় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অতএব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন শিক্ষক-ছাত্র সবার মাঝে জ্ঞান আহরণ ও গবেষণার  সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরী হয়, এ ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত ভুমিকা পালন এখন সময়ের দাবী। 

অন্যদিকে ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। যতটুকু রয়েছে তা-ও কেবল বইয়ের মলাটে সীমাবদ্ধ। ফলে বাস্তবতার ময়দানে শিক্ষকসমাজ হোক কিংবা ছাত্রসমাজ, সকলেরই নৈতিকতার বন্ধন অত্যন্ত শিথিল ও নড়বড়ে। সামান্য স্বার্থের টানে মুহূর্তেই তারা মাকড়সার জালের মত এই নৈতিকতার বন্ধন ছিন্ন করতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। আর এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যার আলয় না হয়ে দূর্নীতি, অপশিক্ষা, মেধার অপচয়, স্বার্থদুষ্টতা আর সীমাহীন নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতনের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।

এই নাভিশ্বাস অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গেলে সবার আগে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির করালগ্রাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। একশ্রেণীর সুশীল ব্যক্তি ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর উদাহরণ টেনে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে বুলি কপচান। তারা কি জানেন না সেই আন্দোলনগুলো মূলতঃ ছাত্ররাজনীতির অবদান নয়, বরং সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলন? প্রয়োজনে আবারও ছাত্রসমাজ জেগে উঠবে যেভাবে সাম্প্রতিক কালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এজন্য লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি? যে রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্ররাজনীতির বলি হয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছে, সেই রাজনীতির হাতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ তো দূরের কথা, কারও প্রাণটাও তো নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর এমন একটি রাষ্ট্র পাওয়া যাবে না, যেখানে এই তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নিকৃষ্ট চর্চা রয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ ইতিমধ্যে আবরার হত্যার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে এবং সর্বমহলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে এক প্রকার ঐক্যমত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতএব সরকারের কাছে আমাদের জোর দাবী থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান না হয়ে বিদ্যার প্রকৃত আলয় হোক। ক্ষমতা আর সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্র না হয়ে সুস্থ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিকাশকেন্দ্র হোক। অবৈধ প্রেমকানন না হয়ে সুরোভিত জ্ঞানকানন হোক। এটাই আজ দেশের প্রতিটি সচেতন, জ্ঞানপিপাসু ছাত্রের হৃদয়ের গভীরতম প্রত্যাশা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: সম্পাদকীয়
আরও