মীমাংসা : শারঈ দৃষ্টিকোন

আসাদ বিন আব্দুল আযীয 947 বার পঠিত

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ পরিক্রমায় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে নিজেদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হয়। কখনওবা একারণে সম্পর্কচ্ছেদ পর্যন্ত হয়। এই বিচ্ছিন্ন জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উৎকৃষ্ট মাধ্যম হ’ল মীমাংসা। এতে উভয়ের ভিতরে লালন করা শত্রুতা, রাগ-অভিমান দূর হয়। ফলে পুনরায় নিজেদের মাঝে সৌহার্দপূর্ণ আচারণ ও পারস্পরিক ভালোবাসা জাগ্রত হয়। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা মীমাংসা সম্পর্কে বলেন,فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে আপোষ মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)

মীমাংসার শর্ত :

নিশ্চয় ঈমানের পরিচায়ক হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ছাড়া কোন ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না। এজন্য প্রত্যেকটি মুমিন ব্যক্তি শারঈ নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। অতএব মহান আল্লাহর নির্দেশনা وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ ‘তোমরা পরস্পরে আপোষ মীমাংসা করে নাও’ এটাও মানতে হবে। নচেৎ ঈমান ভেঙ্গে যাবে। নিম্নে বাদী-বিবাদীর মাঝে মীমাংসার শর্তগুলো উপস্থাপন করা করা হ’ল।

১. ইসলামী শরী‘আ অনুযায়ী হওয়া :

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, বারীরা (রাঃ) আমার কাছে এসে বলল, আমি আমার মালিক পক্ষের সাথে ৯ (নয়) উকিয়া দেওয়ার শর্তে ‘মুকাতাবা’ করেছি। প্রতি বছর এক উকিয়া করে দেওয়া হবে। আপনি (এ ব্যাপারে) আমাকে সাহায্য করুন। আমি বললাম, যদি তোমার মালিক পক্ষ পছন্দ করে যে, আমি তাদের একবারেই তা পরিশোধ করব এবং তোমার ওয়ালা (আযাদ সূত্রে উত্তরাধিকার)-এর অধিকার আমার হবে, তবে আমি তা করব। তখন বারীরা (রাঃ) তার মালিকদের নিকট গেল এবং তাদের তা বলল। তারা তা অস্বীকার করল। বারীরা (রাঃ) তাদের নিকট থেকে (আমার কাছে) এলো। আর তখন রাসূলূল্লাহ্ (ছাঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সে বলল আপনার কথা তাদের কাছে পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা নিজেদের জন্য ওয়ালার অধিকার সংরক্ষণ ছাড়তে রাযী হয়নি। রাসূলূল্লাহ্ (ছাঃ) তা শুনলেন, হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলূল্লাহ্ (ছাঃ)-কে তা সবিস্তারে জানালেন। তিনি বললেন, তুমি তাকে নিয়ে নাও এবং তাদের জন্য ওয়ালার শর্ত মেনে নাও। কেননা, ওয়ালার হক তারই, যে আযাদ করে। আয়েশা (রাঃ) তাই করলেন। এরপর রাসূলূল্লাহ্ (ছাঃ) জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলার হামদ ও ছানা বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন, مَا بَالُ رِجَالٍ يَشْتَرِطُونَ شُرُوطًا لَيْسَتْ فِى كِتَابِ اللَّهِ، مَا كَانَ مِنْ شَرْطٍ لَيْسَ فِى كِتَابِ اللَّهِ فَهُوَ بَاطِلٌ وَإِنْ كَانَ مِائَةَ شَرْطٍ، قَضَاءُ اللَّهِ أَحَقُّ، وَشَرْطُ اللَّهِ أَوْثَقُ، وَإِنَّمَا الْوَلاَءُ لِمَنْ أَعْتَقَ- ‘লোকদের কী হ’ল যে, তারা এমন শর্ত আরোপ করে, যা মহান আল্লাহ তা‘আলার বিধানে নেই। মহান আল্লাহ তা‘আলার বিধানে যে শর্তের উল্লেখ নেই, তা বাতিল বলে গণ্য হবে, শত শর্ত হলেও। মহান আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালাই সঠিক, মহান আল্লাহ তা‘আলার শর্তই সুদৃঢ়। ওয়ালার হক তো তারই, যে আযাদ করে’।[1]

২. বাদী-বিবাদী উভয় সন্তুষ্টি থাকা :

ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كُنْتُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَأَتَاهُ رَجُلاَنِ يَخْتَصِمَانِ فِى أَرْضٍ فَقَالَ أَحَدُهُمَا إِنَّ هَذَا انْتَزَى عَلَى أَرْضِى يَا رَسُولَ اللَّهِ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَهُوَ امْرُؤُ الْقَيْسِ بْنُ عَابِسٍ الْكِنْدِىُّ وَخَصْمُهُ رَبِيعَةُ بْنُ عِبْدَانَ قَالَ بَيِّنَتُكَ قَالَ لَيْسَ لِى بَيِّنَةٌ. قَالَ يَمِينُهُ قَالَ إِذًا يَذْهَبُ بِهَا قَالَ لَيْسَ لَكَ إِلاَّ ذَاكَ قَالَ فَلَمَّا قَامَ لِيَحْلِفَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنِ اقْتَطَعَ أَرْضًا ظَالِمًا لَقِىَ اللَّهَ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ  আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে দু’ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে একটি ভূমি সম্পর্কে বিচার প্রার্থনা করে। তন্মধ্যে একজন বলল, হে আল্লাহর রাসুল! জাহিলিয়্যাত যুগে এ ব্যক্তি আমার ভূমি জবরদখল করে নিয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, বিচার প্রার্থনাকারী ছিল ইমরাউল কায়স ইবনু আবিস আল কিনদী আর তার বিবাদী ছিল রাবী‘আ ইবনু আবদান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমার সাক্ষী পেশ কর। লোকটি বলল, আমার কোন সাক্ষী নাই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহলে বিবাদী থেকে কসম নেয়া হবে। লোকটি বলল, তবে তো সে মিথ্যা কসম করে সম্পত্তি গ্রাস করে ফেলবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার কাছ থেকে তোমার এতটুকু প্রাপ্য। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর বাদী যখন শপথ করার জন্য প্রস্তুত হ’ল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে সম্পত্তি গ্রাস করবে, সে আল্লাহর কাছে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তিনি তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকবেন’।[2] 

৩. বিবাদীর উপর শারঈ নির্দেশনা দেওয়া :

বর্তমান সময়ে বিচার ব্যবস্থা একদম ভঙ্গুর। শারঈ মানদন্ডে বিচারকার্য না চলার কারণে বিনা দোষে আজ হাযারো মানুষ কারাভোগ করছে। কখনও বা দন্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু ব্যক্তি তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে। এতে কারো সুফারিশে শাস্তি কম-বেশী হবে না। হাদীছে এসেছে, عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّ قُرَيْشًا أَهَمَّهُمْ شَأْنُ الْمَرْأَةِ الْمَخْزُومِيَّةِ الَّتِى سَرَقَتْ، فَقَالَ وَمَنْ يُكَلِّمُ فِيهَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا وَمَنْ يَجْتَرِئُ عَلَيْهِ إِلاَّ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ حِبُّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَكَلَّمَهُ أُسَامَةُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَتَشْفَعُ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ ثُمَّ قَامَ فَاخْتَطَبَ ثُمَّ قَالَ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللَّهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ ابْنَةَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا-  আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, মাখযূম গোত্রের জনৈক চোর মহিলার ঘটনা কুরাইশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুললো। এ অবস্থায় তারা (পরস্পর) বলাবলি করতে লাগল এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে কে আলাপ আলোচনা (সুফারিশ) করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসূলে করীম (ছাঃ)-এর প্রিয়তম ব্যক্তি ওসামা ইবনু যায়িদ (রাঃ) এ জটিল ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। (নবীজীর খেদমতে তাঁকে পাঠানো হ’লে তিনি এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে) ক্ষমা করে দেয়ার সুফারিশ করলেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘনকারিণীর সাজা (হাত কাটা) মওকুফের সুফারিশ করছ? তারপর নবী (ছাঃ) দাঁড়িয়ে খুত্ববায় বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি সমূহকে এ কাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অপরদিকে যখন কোন সহায়হীন দরিদ্র সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার উপর হদ (হাতকাটা দন্ডবিধি) প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর কন্যা ফাতিমা চুরি করত তবে আমি তার হাত অবশ্যই কেটে ফেলতাম’।[3] 

৪. বাদী-বিবাদীর উপর যুলুম না হওয়া :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ وَإِنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ وَأَقْضِىَ لَهُ عَلَى نَحْوِ مَا أَسْمَعُ فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ شَيْئًا فَلاَ يَأْخُذْ فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّارِ-  উম্মে সালামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তো একজন মানুষ। আর তোমরা আমার কাছে বিবাদী মীমাংসার জন্য এসে থাক। তোমাদের এক পক্ষ অপর পক্ষ হ’তে দলীল প্রমাণ পেশ করার ব্যাপারে অধিকতর পারদর্শী হ’তে পারে। ফলে আমি আমার শোনা মতে যদি কাউকে তা অন্য ভাইয়ের হক দিয়ে দেই, তাহলে যেন সে তা গ্রহণ না করে। কেননা আমি তার জন্য জাহান্নামের একটা অংশই পৃথক করে দিচ্ছি’।[4]

অপর এক হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنْصُرُهُ إِذَا كَانَ مَظْلُومًا أَفَرَأَيْتَ إِذَا كَانَ ظَالِمًا كَيْفَ أَنْصُرُهُ قَالَ تَحْجُزُهُ أَوْ تَمْنَعُهُ مِنَ الظُّلْمِ فَإِنَّ ذَلِكَ نَصْرُهُ- আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর। সে জালিম হোক অথবা মজলুম হোক। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! মজলুম হ’লে তাকে সাহায্য করব, তা তো বোধ্যগম্য ব্যাপার। কিন্তু জালিম হ’লে তাকে সাহায্য করব, তা কিভাবে? তিনি বললেন, তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখবে। আর এটাই হচ্ছে তার সাহায্য’।[5]

মীমাংসার প্রকারভেদ :

১. মুসলমান ও কাফের ব্যক্তির মাঝে মীমাংসা :

মিছওয়ার ইবনু মাখরামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, আমর ইবনু আউফ আনসারী (রাঃ) যিনি আমির ইবনু লুয়াইয়ের মিত্র ছিলেন এবং বদর যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন, তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু উবাইদা ইবনু জাররাহ (রাঃ)-কে বাহরাইনে জিযিয়া আদায় করার জন্য পাঠালেন। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাহরাইনবাসীদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন এবং ‘আলা ইবনু হাযরামী (রাঃ)-কে তাদের আমির নিযুক্ত করেছিলেন’।[6]

২. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা :

আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও সহানুভূতি তৈরী হয় (রূম /২১)। অপর দিকে শয়তানের নিকট অধিক প্রিয় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো (মুসলিম ২৮১৩)। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা হওয়া খুবই যরূরী। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا  ‘আর যদি তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা চায়, তাহ’লে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে (সম্প্রীতির) তাওফীক দান করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও ভিতর-বাহির সবকিছু অবহিত’ (নিসা ৪/৩৫)

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا যদি কোন স্ত্রী তার স্বামী থেকে দূরত্ব ও উপেক্ষার আশংকা করে, তাহ’লে তারা পরস্পরে কোন সমঝোতায় উপনীত হলে, তাতে কোন দোষ নেই। আর মীমাংসাই উত্তম। (কেননা) অন্তর সমূহে লোভ বিদ্যমান থাকে (যা পরস্পরকে সন্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে)। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং সংযমী হও, তবে তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত’ (নিসা ৪/১২৮)

হাদীছে এসেছে, সাহল ইবনু সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আলী (রাঃ)-এর কাছে ‘আবু তুরাব’-এর চাইতে প্রিয়তর কোন নাম ছিল না। এ নামে ডাকা হলে তিনি অত্যন্ত খুশী হ’তেন। কারণ একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফাতিমা (রাঃ)-এর ঘরে আসলেন। তখন আলী (রাঃ)-কে ঘরে পেলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চাচাতো ভাই কোথায়? তিনি বললেন, আমার ও তাঁর মধ্যে কিছু ঘটায় তিনি আমার সঙ্গে রাগারাগি করে বের হয়ে গেছেন। আমার কাছে কায়লুলা করেন নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে বললেনঃ দেখতো সে কোথায়? সে লোকটি এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি তো মসজিদে ঘুমিয়ে আছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসে দেখতে পেলেন যে, তিনি কাত হয়ে শুয়ে আছেন, আর তাঁর চাদরখানা পাশ থেকে পড়ে গেছে। ফলে তাঁর সাথে মাটি লেগে আছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর গায়ের মাটি ঝাড়তে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, উঠো, আবু তুরাব (মাটির বাবা) উঠো, আবু তুরাব! একথাটা তিনি দু’বার বললেন।[7]

৩. সীমালংঘনকারী ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির মাঝে মীমাংসা :

মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ যদি মুমিনদের দুই দল পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহ’লে তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর সীমালংঘন করে, তাহ’লে তোমরা ঐ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে দল সীমালংঘন করে। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের (সন্ধির) দিকে ফিরে আসে। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহ’লে তোমরা উভয় দলের মধ্যে ন্যায়ানুগভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালবাসেন’ (হুজুরাত ৪৯/৯)

হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ ابْنُ نُمَيْرٍ وَأَبُو بَكْرٍ يَبْلُغُ بِهِ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَفِى حَدِيثِ زُهَيْرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ الْمُقْسِطِينَ عِنْدَ اللَّهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ عَزَّ وَجَلَّ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِينٌ الَّذِينَ يَعْدِلُونَ فِى حُكْمِهِمْ وَأَهْلِيهِمْ وَمَا وَلُوا  আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ন্যায়পরায়ণ শাসক মহান আল্লাহর নিকট নূরের উচ্চ মিনারায় অবস্থান করবে, যা থাকবে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ডান পাশে। তবে আল্লাহর (কুদরতের) উভয় হাতেই ডান দিক। যেসব শাসক ন্যায়-ইনসাফ ও সততার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করবে, নিজেদের পরিজনদের সাথে ইনসাফ করবে এবং তাদের উপর ন্যস্ত প্রতিটি দায়িত্বের ক্ষেত্রে ন্যায়ের পরিচয় দেবে- কেবল তারাই এই মার্যাদার অধিকারী হবে’।[8]

অপর হাদীছে এসেছে, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক যুদ্ধে আমরা উপস্থিত ছিলাম। জনৈক মুহাজির এক আনছারের পশ্চাদদেশে লাথি মারেন। তখন আনছারী ছাহাবী ‘হে আনছারী ভাইয়েরা! এবং মুহাজির ছাহাবী ‘হে মুহাজির ভাইয়েরা! বলে ডাক দিলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) শুনে বললেন, এ কি ধরণের ডাকাডাকি? তখন উপস্থিত লোকেরা বললেন, এক মুহাজির এক আনছারীর পাছায় লাথি মেরেছে। আনছারী হে আনছারী ভাইয়েরা! এবং মুহাজির ছাহাবী হে মুহাজির ভাইয়েরা! বলে নিজ নিজ গোত্রকে ডাক দিলেন। এ কথা শুনে নবী (ছাঃ) বললেন, বাদ দাও, এটি খুবই বাজে কথা। নবী (ছাঃ) যখন মদিনায় হিজরত করে আসেন তখন আনছাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। অবশ্য পরে মুহাজিররা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যান। এরপর ঘটনাটি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর কানে পৌঁছল। সে বলল, সত্যিই তারা কি এ কাজ করেছে? আল্লাহর কসম! আমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে সেখান থেকে সবল লোকেরা দুর্বলদের বহিষ্কার করবেই। তখন উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আমি এখনই এ মুনাফিকের শিরচ্ছেদ করি। নবী (ছাঃ) বললেন, উমার! তাকে ছেড়ে দাও, যেন কেউ এ কথা বলতে না পারে যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর সাথীদের হত্যা করছেন’।[9]

৪. দু’জন দেনা-পাওনাদারের মাঝে মীমাংসা :

হাদীছে এসেছে, কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় একবার তিনি ইবনু আবু হাদরাদের কাছে মসজিদে পাওনা আদায়ে তাগাদা করলেন, এতে উভয়ের আওয়াজ চড়ে গেল। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ঘর থেকেই আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘরের পর্দা সরিয়ে তাদের কাছে এলেন আর কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ)-কে ডাকলেন এবং বললেন, হে কা‘ব! কা‘ব (রাঃ) বললেন, আমি হাযির হে আল্লাহর রাসূল! রাবী বলেন, তিনি হাতে ইশারা করলেন, অর্ধৈক মওকুফ করে দাও। কা‘ব (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাই করলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইবনে আবু হাদরাদকে) বললেন, ‘যাও, তার ঋণ পরিশোধ করে দাও’।[10]

মীমাংসার ফযীলত :

১. মীমাংসা উত্তম কাজ :

পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে চলতে গিয়ে কখনও যদি নিজেদের মাঝে মনমালিন্য হয় সে ক্ষেত্রে আপোষে মীমাংসা করে নেওয়া খুবই যরূরী। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, وَالصُّلْحُ خَيْرٌ ‘আর মীমাংসাই উত্তম’ (নিসা ৪/১২৮)

২. আল্লাহর নিকট মীমাংসাকারীর উত্তম প্রতিদান :

মহান আল্লাহ বলেন, لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, عَنْ أَبِى مُوسَى قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَتَاهُ طَالِبُ حَاجَةٍ أَقْبَلَ عَلَى جُلَسَائِهِ فَقَالَ اشْفَعُوا فَلْتُؤْجَرُوا وَلْيَقْضِ اللَّهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا أَحَبَّ আবু মুসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে কোন ব্যক্তি প্রয়োজন নিয়ে এলে তিনি তাঁর সঙ্গীদের বলতেন, তোমরা এর জন্য সুফারিশ কর, তাহ’লে ছওয়াব পাবে। আর আল্লাহ তার নবীর মুখে এমন সমাধান দেন যা তিনি পছন্দ করেন’।[11]

৩. মীমাংসা করা ছাদাক্বা :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ سُلاَمَى مِنَ النَّاسِ عَلَيْهِ صَدَقَةٌ كُلَّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيهِ الشَّمْسُ قَالَ تَعْدِلُ بَيْنَ الاِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ وَتُعِينُ الرَّجُلَ فِى دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا أَوْ تَرْفَعُ لَهُ عَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ قَالَ وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ وَكُلُّ خَطْوَةٍ تَمْشِيهَا إِلَى الصَّلاَةِ صَدَقَةٌ وَتُمِيطُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ صَدَقَةٌ- ‘প্রত্যেক দিন যখন সূর্য উদিত হয়, তখন মানুষের প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্কর জন্য ছাদাক্বা ওয়াজিব। তিনি বলেন, দু-ব্যক্তির মাঝে ন্যায়বিচার করা ছাদাক্বা, কোন ব্যক্তিকে তার সাওয়ারীর ব্যাপারে সাহায্য করা। অথবা তার মাল সামগ্রী তুলে দেয়া ছাদাক্বা। তিনি আরও বলেছেন, ভাল কথা বলা ছাদাক্বা, ছালাতের উদ্দেশ্যে গমনের পথে প্রতিটি পদক্ষেপ ছাদাক্বা। চলার পথ হ’তে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া ছাদাক্বা’।[12]

৪. মীমাংসা করা দেওয়া মহৎ ইবাদত :

আবূ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ قَالُوا بَلَى قَالَ إِصْلاَحُ ذَاتِ الْبَيْنِ وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الْحَالِقَةُ- আমি কি তোমাদের ছালাত, ছিয়াম এবং যাকাত হ’তে উত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করবো না? ছাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, তা হ’ল পরস্পরের মাঝে আপোষ-মীমাংসা করে দেয়া। কেননা, পরস্পরের মধ্যেকার ঝগড়া-বিবাদ লোকদের ধ্বংস করে দেয়’।[13]

অপর হাদীছে এসেছে, আবুদ দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, (নফল) ছিয়াম, ছালাত ও ছাদাক্বা অপেক্ষাও উত্তম আমলের কথা তোমাদের বলব কি? ছাহাবীগণ বললেন অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, পরস্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কেননা পরস্পর সম্পর্ক বিনষ্ট করা হ’ল দ্বীন বিধ্বংসী বিষয়’।[14] 

মীমাংসার বৈশিষ্ট্য :

১. পরামর্শ ভিত্তিক :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا إِلاَّ رَجُلاً كَانَتْ بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا أَنْظِرُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَصْطَلِحَا প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়। এরপর এমন সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে শরীক স্থাপন করে না। তবে সে ব্যক্তিকে নয়, যার ভাই ও তার মধ্যে শক্রতা বিদ্যমান। এরপর বলা হবে, এই দু’জনকে আপোষ রফা করার জন্য অবকাশ দাও, এই দু’জনকে আপোষ রফা করার জন্য অবকাশ দাও, এই দু’জনকে আপোষ রফার জন্য অবকাশ দাও’।[15]

২. ঈমানী ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা :

মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ‘মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ব্যতীত নয়। অতএব তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর। তাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে থাকে। কারণ অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ অনুসন্ধান করো না, গোয়েন্দাগিরী করো না, একে অন্যকে ধোকা দিও না, আর পরস্পর হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করো না এবং পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করো না। বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে থেকো’।[16]

৩. মীমাংসার নিমিত্তে কিছু মিথ্যা কথা বলা :

হাদীছে এসেছে, عَنْ أُمِّ كُلْثُومٍ بِنْتَ عُقْبَةَ بْنِ أَبِى مُعَيْطٍ وَكَانَتْ مِنَ الْمُهَاجِرَاتِ الأُوَلِ اللاَّتِى بَايَعْنَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم أَخْبَرَتْهُ أَنَّهَا سَمِعَتْ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَقُولُ لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِى يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ وَيَقُولُ خَيْرًا وَيَنْمِى خَيْرًا قَالَ ابْنُ شِهَابٍ وَلَمْ أَسْمَعْ يُرَخَّصُ فِى شَىْءٍ مِمَّا يَقُولُ النَّاسُ كَذِبٌ إِلاَّ فِى ثَلاَثٍ الْحَرْبُ وَالإِصْلاَحُ بَيْنَ النَّاسِ وَحَدِيثُ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ وَحَدِيثُ الْمَرْأَةِ زَوْجَهَا-

উম্মু কুলসূম বিনত উকবা ইবনু মূঈত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, তিনি বলেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে মানুষের মাঝে আপোষ মীমাংসা করে দেয়। সে কল্যাণের জন্যই বলে এবং কল্যাণের জন্যই চোগলখুরী করে। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছেন বলে আমি শুনিনি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে, লোকদের মাঝে আপোষ-মীমাংসার জন্য, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর কথার ও স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর কথা প্রসঙ্গে’।[17]

৪. বিতর্ক এড়িয়ে চলা :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, عَنْ جَابِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ أَنْ يَعْبُدَهُ الْمُصَلُّونَ فِى جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِى التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ  জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, আরব ভূখন্ডে মুসল্লীগণ শয়তানের উপাসনা করবে, এ বিষয়ে শয়তান নিরাশ হয়ে পড়েছে। তবে তাদের এক জনকে অন্যের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়নি’।[18]

অপর হাদীছে এসেছে জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِىءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُولُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِىءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ قَالَ فَيُدْنِيهِ مِنْهُ وَيَقُولُ نِعْمَ أَنْتَ قَالَ الأَعْمَشُ أُرَاهُ قَالَ فَيَلْتَزِمُهُ ইবলীস পানির উপর তার আরশ স্থাপন করতঃ তার বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে তার সর্বাধিক নৈকট্য প্রাপ্ত সেই যে সর্বাধিক ফিতনা সৃষ্টিকারী। তাদের একজন এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করেছি। সে বলে, তুমি কিছুই করনি। অতঃপর অন্যজন এসে বলে, অমুকের সাথে আমি সকল প্রকার ধোঁকার আচরণই করেছি। এমনকি তার থেকে তার স্ত্রীকে তালাক করে দিয়েছি। অতঃপর শয়তান তাকে তার নিকটবর্তী করে নেয় এবং বলে হ্যঁা, তুমি একটি বড় কাজ করেছ। বর্ণনাকারী আমাশ বলেন, আমার মনে হয়, তিনি বলেছেনঃ অতঃপর শয়তান তাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়’।[19]

উপসংহার : দ্বন্দ্ব মুখর দুনিয়ায় নানামুখী সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। ইসলাম সমস্যা ও সমাধানের অনুপম মীমাংসা ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হওয়ায় মানবতা খুঁজে পায় তার যাবতীয় মীমাংসার কাংঙ্খিত মনযিল-মাক্বছাদ। ফলে ইনছাফভিত্তিক ইসলামই হতে পারে যুলুম থেকে মানবতার মুক্তির একমাত্র প্লাটফর্ম।


[1]. বুখারী হা/২১৬৮।

[2]. মুসলিম হা/১৩৯।

[3]. বুখারী হা/৩৪৭৫ ।

[4]. বুখারী হা/৬৯৬৭ ।

[5]. বুখারী হা/৬৯৫২।

[6]. বুখারী হা/৬৪২৫।

[7]. বুখারী হা/৪৪১; মুসলিম হা/২৪০৯।

[8]. মুসলিম হা/১৮২৭ ।

[9]. বুখারী হা/৪৯০৭।

[10]. বুখারী হা/২৭১০।

[11]. বুখারী হা/৬০২৬; মুসলিম হা/২৬২৭।

[12]. মুসলিম হা/১০০৯।

[13]. আবু দাঊদ হা/৪৯১৯।

[14]. তিরমিযী হা/২৫০৯।

[15]. মুসলিম হা/২৫৬৫।

[16]. বুখারী হা/৬০৬৪।

[17]. মুসলিম হা/২৬০৫।

[18]. মুসলিম হা/২৮১২।

[19]. মুসলিম হা/২৮১৩।



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও