আরবী শিক্ষা

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী 1024 বার পঠিত

বিদ্যা ও সাহিত্যিকতার প্রাচীনতম যুগের সহিত আরবী ভাষার সম্পর্ক বিজড়িত, বরং একথাও দাবী করা যাইতে পারে যে, ধরাপৃষ্ঠে এপর্যন্ত যতগুলি জীবন্ত অথবা মৃত ভাষার সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, তন্মধ্যে কাব্যসাহিত্যের প্রাচীনতম সম্পদ আরবী ভাষাই পৃথিবীকে দান করিয়াছে।

আরবীকে সমগ্র ভাষার জননী (ام الالسنة) এবং মক্কানগরীকে সমুদয় জনপদের আদি কেন্দ্রভূমি (ام القرى) রূপে অভিহিত ককরা হইতেছে। একথার প্রকৃত তাৎপর্য ব্যাপক অনুসন্ধান ও গভীর গবেষণা সাপেক্ষ! এইরূপ আল কোরআনকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় (عربي مبين) অবতীর্ণ করার হেতুবাদ কি, তাহাও ভাষাতত্ত্ববিদগণের গবেষণার মুখাপেক্ষী হইয়া রহিয়াছে। কিন্তু ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই যে, আরবী ভাষা ও আরবী সাহিত্যের ইতিহাস যে যুগ হইতে শুরু হইয়াছে বলিয়া সচরাচর অনুমান করা হইয়া থাকে, তদপেক্ষা উহার বহু পূর্ববর্তী যুগের সম্পদ।

তওরাত বিশারদগণের অধিকাংশের মতে তওরাতের সর্বপ্রাচীন পুস্তক হইতেছে ‘ইয়োবের বিবরণ’ আরবী আইয়ুবকে বাইবেলের প্রচলিত বাংলা অনুবাদে ‘ইয়োব’ লেখা হইয়াছে। হযরত আইয়ুব, হযরত ইব্রাহীমের যদি পূর্ববর্তী নাও হন, তথাপি তিনি যে তাঁহার সমসাময়িক, ইহা অনস্বীকার্য আর হযরত আইয়ুব যে আরব ছিলেন, ইহাও তাওরাত বিশারদগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। আইয়ুবের বিবরণে উল্লিখিত আছে যে, তিনি উষ (উষ) দেশের অধিবাসী ছিলেন এবং যে শেবা ও কলেদীয়ার লোকেরা তাঁহার পশুপাল চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছিল বলিয়া উক্ত বিবরণে কথিত আছে, সেগুলি উহার পার্শ্ববর্তী দুইটি দেশ। আদি পুস্তকে উষকে অ’রামের পুত্র এবং তাঁহাকে শেমের পুত্র বলা হইয়াছে এবং হযরত নুহের যে তিন পুত্র জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া ছিলেন শেম তাঁহাদের অন্যতম। অ’রামীগণ সর্বসম্মতভাবে খাঁটি আরবদের বংশধর। ভৌগলিক হিসাবে দেখিলেও শেবাও কলদীয়ার নিকটতম দেশ একমাত্র আরবই হইতে পারে।

তাওরাত বিশারদগণ আরও বলিয়াছেন যে, হযরত আইয়ুবের পুস্তক প্রথমতঃ প্রাচীন আরবী ভাষাতেই লিখা হইয়াছিল, হযরত মুছা কর্তৃক উহা আরবী হইতে ইব্রীয় ভাষায় অনুদিত হয়। অলংকার, কবিত্ব ও শব্দবিন্যাসের গৌরবে গীতসংহিতা (যবুর) ও হিতোপদেশ ব্যতীত পুরাতন নিয়মের (old testament) কোন পুস্তকই আইয়ুবের পুস্তকের সমকক্ষতা বরিতে সমর্থ নয়। সুতরাং হযরত মুছারও পূর্বে আইয়ুবের পুস্তকের মত আরবী ভাষার লিখিত কাব্যের বিদ্যমানতা ইহাই প্রতিপন্ন করিতেছে যে, ইব্রীয় সাহিত্যের বিকাশ লাভের কয়েক শতাব্দী পূর্বেই আরাব সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল। আইয়ুবের পুস্তকের আরবী উপকরণ যোগাইয়াছিল, তাহাতে দ্বিমত নাই।

ইহাও প্রনিধান যোগ্য যে, যে ভাষা কোরআনের তাৎপর্য ও ইংগিতের বাহক ও ধারক হইয়াছে যে, আরবীতে ইমরাউলকয়েছ কবিতা রচনা করিয়াছেন উহাকে অনুন্নত যাযাবরদের ভাষা বলিয়া কিরূপে স্বীকার করা সম্ভবপর? বস্ত্ততঃ আরবী ভাষা তমদ্দুনী ক্রমাবর্তনের এতগুলি স্তর অতিক্রম করিয়াছে যে, পৃথিবীর অপর কোন ভাষাই এবিষয়ে তাহার সমকক্ষতা করিতে সমর্থ নয়। সুমেরীয় (sumerian) আক্কাদী (Accadian) ও নিনেভিয় (Ninever) তমদ্দুন বাবিলোনিয়ার শিক্ষাসম্ভার ও মিসরের শব্দকোষের ভান্ডার, এরমিয় (Aramaia) ভাষার সম্পদ এবং কলেদীয় ও সিরিক সাহিত্য একই ভাষার শাব্দিক রূপায়ণের ক্রমবিকাশ মাত্র। ইহাই উত্তরকালে খৃষ্টপূর্ব চারি শতাব্দীতে আরবী ভাষার পোশাক পরিধান করিয়াছিল। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দের নবাবিষ্কার সমূহের মধ্যে আহীরাম (Ahiram) সমাধিসিন্দুক অংকিত লিপি আবিষ্কার আরবী ছাত্রদের জন্য অনুসন্ধানের একট নুতন পথ মুক্ত করিয়া দিয়াছে।  বর্ণমালার সুসংবদ্ধ লিখন প্রণালীর ইতিহাস এযাবত খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দি পর্যন্ত পৌঁছিয়া থামিয়া গিয়াছিল, কিন্তু এই সমাধিবাক্সের আবিষ্কার মানুষের হস্তলিপির ইতিহাসকে খৃষ্টপূর্ব ১২৫০ অব্দ পর্যন্ত পিছাইয়া লইয়া গিয়াছে অর্থাৎ খৃষ্টের ১২৫০ বৎসর পূর্বে উহা লিখিত এবং আরবী ফিনিক (Phoerecian) অক্ষরে অংকিত হইয়াছিল। এই আবিষ্কারের সাহায্যে  ইহাও প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, তওরাতের ও বাবিলোনিয়ার লাইব্রেরীতে রক্ষিত লিখিত ফলকসমূহের পূর্বে আরবী ভাষা এরূপ একটি লেখ্য ভাষার রূপ গ্রহণ করিয়াছিল যাহাতে বিজ্ঞপ্তি ও রাজসিক ফর্মান লিখিত হইত।

প্রাচীনতার দিক দিয়া ঋগ্বেদ কাব্যসাহিত্যের প্রাচীনতম সম্পদরূপে গণ্য হইয়া থাকে কিন্তু ম্যাক্সমূলক ঋগ্বেদের প্রাচীনতম কবিতাগুলিকে খৃষ্টপূর্ব ১২০০ বৎসরের রচিত বলিয়াছেন এবং আধুনিক Orientalist (প্রাচ্যবাদী) গণ কর্তৃকও উহা সমর্থিত হইয়াছে। স্মার্ণার মহাকবি হোমরের Iliad ও কাব্য সাহিত্যের প্রাচীনতম স্মৃতি বলিয়া কথিত হইয়া থাকে কিন্তু হেরোডোটাসের (Herodotus) অভিমত অনুসারে Homer খৃষ্টের ৮৫০ হইতে ৯ শত বৎসর কালের অধিক পূর্ববর্তী ছিলেন না।

ভাষাতত্ত্ববিশারদগণের যে সমস্ত উদ্ধৃতির আমি ইংগিত দিয়াছি, সেগুলির সাহায্যে আরবী কাব্যেরই সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতা প্রতিপন্ন হয়, অথচ গবেষণার দ্বার এখনও মুক্ত এবং কথা বলার অবসরও বাকী রহিয়াছে।

মহিমামন্ডিত কোরআনকে সাধারণতঃ অনাদি বাণী (كلام قديم) বলা হয়। প্রথমতঃ যেহেতু অনাদিত্ব আল্লাহর অন্যতম বিশেষণ, তাই তদীয় বাণী কোরআনকে অনাদি বা পুরাকাব্য বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। কিন্তু এই শাশ্বত বাণী যে প্রাঞ্জল আরবীর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, উহার প্রাচীনতা লক্ষ্য করিয়াও উহাকে পুরাবাক্য নামে অভিহিত করা আশ্চর্য নয়।

নবীগণের সমাপ্তকারীরূপে ধরণীর বুকে আরবী নবীর শুভপদার্পণ এবং শেষ ঐশীগ্রন্থ কোরআনের আরবী ভাষার অবতরণ একটা সাধারণ ও আকস্মিক ব্যাপার নয়, ইতিহাস-দর্শন ও জীবতত্ত্বের বহু রহস্যমূলক তথ্য ইহার সহিত জড়িত রহিয়াছে।

আরবী একটি জীবন্ত ভাষা :

আরবী পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা হওয়া সত্বেও আজ পর্যন্ত জীবন্ত ও প্রাণবন্ত রহিয়াছে। মরক্কো হইতে পাকিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত উহা কথা ও লেখ্য ভাষা রুপে ব্যবহৃত হয়। অথচ আরবী ভাষা অপেক্ষা বহু কালের পরবর্তী ভাষাগুলির অধিকাংশ আজ ধরাপৃষ্ট হইতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে আর যেগুলি অবশিষ্ট রহিয়াছে, সেগুলোরও শুধু সাংস্কৃতিক (Classical) রূপই বিদ্যমান আছে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বাহন হওয়া দূরের কথা পৃথিবীর কোন অংশেই সেই ভাষাগুলি ব্যবহৃত হয়না, কেহ বুঝিতেও পারেনা। পক্ষান্তরে আরবী ভাষার এই সজীবতা ইছলামের সজীবতার পক্ষে অপরিহার্য ছিল বলিয়া স্বয়ং প্রকৃতি ইহার স্থায়িত্বের উদ্দেশ্যকে সম্পন্ন করিয়াছে।

আরবী বিদ্যা ধর্মীয় বিদ্যার নামান্তর কেন?

ইতিপূর্বে আরবী বিদ্যাকে দ্বীনীবিদ্যা বলিয়া আখ্যাত করা হইয়াছিল, ইহার তাৎপর্য এই যে, প্রকৃতপক্ষে ধর্মের সত্যস্বরূপ প্রতিপন্ন করার জন্য মহাগ্রন্থ কোরআন আল্লাহর জ্বলন্ত নিদর্শন। কোরআন বোধগম্য না হওযা পর্যন্ত ইছলামের স্থায়িত্ব কল্পনা করা যাইতে পারেনা। আর কোরআনের ভাষা আরবী, সুতরাং কোরআনের অভিজ্ঞতা আরবী ভাষার সজীবতার উপরেই নির্ভর করিতেছে। তাই আরব ও আরব বহির্ভূত দেশের উলামা সমাজ আরবী ভাষার হিফাযত ও প্রচারের আবশ্যকতা সম্পর্কে একমত হইয়াছেন। আরবীবিদ্যার জীবন ও বিস্তৃতি ইছলাম ও মিল্লাতের সমৃদ্ধি ও শক্তিরই নামান্তর।

দুনিয়ার বুকে যত মানুষ ইছলামে দীক্ষিত হইয়াছে তাহারা সকলেই পরস্পরের ভাই। ইহারা আরবী উম্মত বা ফার্সী উম্মত, পাকিস্তানী উম্মত বা তুর্কী উম্মত নহে, ইহারা সকলেই ইছলামী উম্মতের অন্তর্ভূক্ত। এই কথারই ইংগিত রহিয়াছে আল্লাহর এই নির্দেশের ভিতর : وان هذه امتكم امة واحدة وانا ربكم فاعبدون ‘এবং বস্ত্ততঃ  তোমাদের এই উমতত একই অদ্বিতীয় উম্মত আর একমাত্র আমি তোমাদের প্রভু। অতএব তোমরা শুধু আমারই দাসত্ব কর’। আর একথা সুস্পষ্ট যে উম্মতের এই অদ্বিতীয়তার পরিকল্পনা ভাষার অদ্বিতীয়তা ব্যতীত সার্থক হইতে পারেনা। একথার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি মানবের পক্ষেই উহাতে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করা ওয়জিব, কিন্তু উম্মতের প্রত্যেকের পক্ষেই আরবী ভাষার আংশিক অভিজ্ঞতা যে ওয়াজিব, তাহা অনস্বীকার্য। আল্হামদুলিল্লাহ! জাতির বৃহত্ত্বর অংশ আজ পর্যন্ত এই ওজুবকে অস্বীকার করে নাই।

এবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই যে, জাতীয় সংহতি ও সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের যে মহাগৌরব মুছলিম জাতি বিভূষিত হইয়াছে, সে গৌরব আরবীর মাধ্যমেই অর্জিত হইয়াছে। এই জাতীয়তা আরবী গোত্র ও স্বাদেশীকতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, উহা আরবী ভাষার সাহায্যেই সম্ভবপর হইয়াছে। তাই আমরা দেখিতে পাই যে, আরব বহির্ভূত দেশের মুছলমানগণ আরবী ভাষার সেবায় কোনদিন আরবগণের পশ্চদাবর্ত্তী হন নাই। আরবী কেবল আরবগণের ভাষা নয়, উহা  কোরআনের ভাষা এবং কোরআনের ধারক (দঃ) আরবী ভাষার মাধ্যমেই উহার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করিয়াছেন। বিশ্ববাসীকে আল্লাহ কোরআন বুঝিবার, উহার গবেষণায় প্রবৃত্ত হইবার, উহার যিক্র ও উহার সাহায্যে হিদায়ত আহরণ করিবার আদেশ দিয়াছেন। আমাদের নমায ও যপ-তপকে আরবী ভাষাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হইয়াছে, ইবাদত, যিক্র ও তিলাওয়াতের অর্থ যাহাতে আমরা হৃদয়গম করিয়া উহার তাৎপর্য অনুধাবন করিতে পারি, আল্লাহ তাহার নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।

ইছলামী সংবিধানের যতগুলি দফা আছে, সংক্ষেপে অথবা সবিস্তারে কোরআন সমস্তই উল্লিখিত রহিয়াছে। আরবী ভাষার অভিজ্ঞতা লাভ না করা পর্যন্ত উল্লিখিত আইনসমূহকে বুঝা ও অনুসরণ করিয়া চলা সুদূর পরাহত এবং ইহা সর্বজনবিদিত যে, ما لا يتم الوجب الا به فهو واجب ‘যাহা না করিলে ওয়াজেব সমাধা হয় না তাহাও ওয়াজিব’। আবার কোরআনকে ‘অতিপ্রাকৃতিক’ বা অলৌকিক (Miracles) বলা হইয়াছে এবং উহার শ্লোকগুলি নিদর্শনরূপে অভিহিত হইয়াছে। সুতরাং কোরআন কেমন করিয়া মুজিযা, তাহা কোরআনের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমাকে হৃদয়ঙ্গম করার উপরেই নির্ভর করিতেছে।

কোরআনের অনুবাদ প্রকৃত কোরআন নয় এবং উহার অনুকল্প ও স্থলাভিষিক্তও নয় :

স্ব স্ব কল্পনাবিলাসের অভিমানের যে অরাজকতা বর্তমানে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তাহার ফলে কতিপয় অনুবাদসর্বস্ব ব্যক্তি কোরআনী বিদ্যার বিশেষজ্ঞ হওয়ার দাবীদার হইয়া বসিয়াছেন। ইহা অপেক্ষাও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, অনুবাদকে মূল অপেক্ষা গুরুত্ব প্রদান করার ধ্বনিও নিনাদিত হইতেছে কিন্তু বিচার-বুদ্ধির ক্ষুদ্রতম অংশও যাহারা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা কোনক্রমেই এই বাস্তবকে অস্বীকার করিতে পারিবেন না যে, অনুবাদ যদি সঠিক ও বিশুদ্ধও হয় তথাপি কোরআনের অলংকারিক গৌরব ও মর্ম্মস্পর্শীতার বাতাসও অনুবাদগুলির গায়ে লাগা সম্ভবপর নয়। তারপর এই অর্বাচীন ব্যাখ্যাকারীরা একথা কেমন করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে, আল্লাহ যে কোরআনকে আরবী রাছুলের (দঃ) প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছেন, সে কোরাআন আরবী কোরআনই ছিল।

স্বয়ং আল্লাহ এ সম্পর্কে বলিয়াছেন :الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ- إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ-  আলিফ-লাম-মীম-রা ইহা প্রত্যক্ষ গ্রন্থের আয়াত সমূহ। আমরা উহাকে আরবী কোরআনরূপে অবতীর্ণ করিয়াছি, যাহাতে তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি উন্মেষিত হয়। আরও বলিয়াছেনঃ وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ এবং উহাকে আরবী কোরআন রুপে অবতীর্ণ করিয়াছি। যাহাতে তাহারা সমীহ করিতে শিখে তজ্জন্য আমরা উহাতে ভয়-প্রদর্শনের রীতিও অবলম্বন করিয়াছি। আরও আদেশ করিয়াছেনঃحم- تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ- كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ- হা-মীম পরম দয়াময় কৃপানিধান আল্লাহ নিকট হইতে অবতীর্ণ, ইহা এরূপ একটি গ্রন্থ যাহার শ্লোকগুলি পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষিত হইয়াছে, যাহারা বিদ্যান তাহাদের জন্য আরবী কোরআন।

উল্লিখিত অকাট্য উদ্ধৃতিসমূহ প্রতিপন্ন করিতেছে যে,  অনুবাদ ও তাফছীর কোনক্রমেই কোরআন নয়। যে কোরআন আমাদের জন্য অবতীর্ণ করা হইয়াছে এবং যে কোরআনের পঠনও আবৃতি, যিকর ও আনুসরণ আমাদের জন্য ওয়াজিব, তাহার আরবী কোরআন। উহার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অবগত হওয়া আরবী ভাষার অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের উপর নির্ভর করে। তর্জমার শব্দগুলি ওহী ও প্রত্যাদেশ নয় এবং কোনক্রমেই অকাট্য নয়, উহার ভ্রম ও প্রমাদের অবকাশ সব সময়েই বিদ্যমান রহিয়াছে। কোন তর্জমাকেই অবিসম্বাদিত ও সুনিশ্চিত বলার উপায় নাই বরং সত্য কথা এই য, শুধু আরবী সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করিয়াও কোরআনের কতক শব্দ আদেশের অনুবাদ করা সম্ভব নয়। কারণ এই মহিমান্বিত গ্রন্থ কেবল আরবী সাহিত্যেরই এক অমূল্য অনুপম সম্পদ নয়, ইহার শব্দগুলি বিভিন্ন অর্থের ধারক। আল্লামা আবুল ফযাইল আহমদ বিনে মুহাম্মাদ বিনুল মুযাফফর রাযী স্বীয় হুজাজুল কোরআন নামক চমৎকার গ্রন্থে সমুদয় পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত মুছলিম দলের মতবাদ ও উক্তিগুলির সন্ধান কোরআনই প্রদান করিয়াছেন আর এই জন্যই গোমরাহ ও বিদআতির দল সকল ক্ষেতেই কোরআনকে আড়াল করিয়া ধরায় অভ্যস্ত আর এই জন্যই হযরত উমর ফারুক এই শ্রেণীর লোকদের সম্বন্ধে আদেশ করিয়াছেন : رموهم بالسنة অর্থাৎ ছুন্নতের তীর বর্ষণ করিয়া উহাদের মুখ ফিরাইয়া দাও।

যাহারা মূল আরবী ভাষার যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি রাখিতেন, তাঁহারাদের অবস্থা যদি এইরূপ হয়, তাহা হইলে যেসকল স্বয়ং সিদ্ধ মুজতাহিদ এবং অভিযানসর্বস্ব মূর্খের দল আরবী ভাষার সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও ইছলামের সংশোধন ও ব্যবচ্ছেদের কার্যে রত এবং মহামাননীয় মোহাম্মাদী শরীআতকে স্ব-স্ব প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার উপকরণে পরিণত করিতে সমুৎসুক, তাহাদের অবস্থা যে তাহা সহজেই কল্পনা করা যাইতে পারে।

অনুবাদ ও পরিবর্তিত বর্ণমালা দ্বারা শরীআতের পরিবর্তন ঘটিয়াছে :

ভাষা ও বর্ণমালার (Script) প্রভাবে ও প্রতাপে জাতি ও রাষ্ট্রের ভাগ্য গঠিত এবং বিপর্যয় সংঘটিত হয়। এই বিষয়টির গুরুত্ব আপনারা কোনক্রমেই এড়াইয়া যাইতে পারেন না। প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে যাহাদের ভাষা ও বর্ণমালা অবলুপ্ত হইয়াছে, তাহাদের অস্তিত্বও ধরাপৃষ্ট হইত মুছিয়া গিয়াছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইয়াহুদী জাতীয়তার (Judaism) কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। বাবেলোনিয়ার যুদ্ধে ইয়াহুদীরা তাওরাত হারাইয়া ফেলে এবং ইহার কয়েক শতাব্দীর পর কতিপয় ইছরাইলী বিদ্বান কর্তৃক তওরাত নামীয় একখানা গ্রন্থ সংকলিত এবং উহার মুছা, হারুন এবং অন্যান্য নবীগণের কাহিনীগুলি সন্নিবেশিত হয়। শাব্দিক ও আর্থিক নানাবিধ ভ্রম ও পরিবর্তন সহকারে উহার সহিত মূল তাওরাতের কতিপয় সাংবিধানিক ধারাও সংযোজিত করা হয়। উত্তরকালে ইয়াহুদিরা শুধু এই অনুবাদরে উপর নির্ভর করিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়ে। খৃস্টানিটির অবস্থা এই যে, যেমস্ত শিক্ষা, উপদেশ এবং সুসংবাদ পরিবেশন করার উদ্দেশ্যে লইয়া হযরত ঈছা (যীশুখৃষ্ট) আবিভূত হইয়াছিলেন, প্রথম শতকেই উহা সত্তরখানা বিভিন্নরূপী বাইবেলের আকারে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিমাপূজক (Pagan) রাজা কনস্ট্যান্টাইন (২৭২-৩৩৭) নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য হযরত ঈছার তিন শতাব্দী পর খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং শুধু খামখেয়ালীর বশবর্তী হইয়া সমুদয় বাইবেল প্রত্যাখান করিয়া তন্মধ্য হইতে শুধু চারিটি বাইবেল গ্রহণ করেন। এই রাজাই হযরত মরইয়ম ইত্যাদির পূজা খৃষ্টধর্মে প্রচলিত করেন এবং গীর্জ্জাগুলি নানারূপ প্রতিমূর্তি ও ছবিতে পূর্ণ হইয়া উঠে। ভাষা ও বর্ণমালার পরিবর্তনের ফলে পরিশেষে উক্ত ইঞ্জিল চতুষ্টয়ও পরিবর্তিত হইয়া যায় আর এই কারণে মোহাম্মাদ রছুলুল্লাহর (দঃ) গৌরবান্বিত নাম বিকৃত ও সন্দেহযুক্ত হইয়া উঠে।

আরবীকে উপেক্ষা করার কুফল :

বর্তমানে নাস্তিক ও নিরীশ্বরবাদীদের সংখ্যা বাড়িয়া চলিয়াছে    এবং তাহাদের সংখ্যা বহুল দলগুলি স্বয়ং ধর্মের বিরুদ্ধে প্রাচীনকালের সন্দেহগুলিকে পুনর্জীবিত করিয়া  তুলিয়াছে এবং আধুনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কতগুলি মতবাদের উপর সেই সকল সন্দেহের ভিতি স্থাপন করিয়াছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতবাদ সম্পর্কে কল্পনা ও অনুমানের পর্বত রচনা করা হইয়াছে। এগুলির মধ্যে কতকগুলি উত্তম আর কতক বর্জনীয়, কতিপয় মতবাদ কল্যাণময় আর কতক অতিশয় ক্ষতিকারক। এগুলির মধ্যে এরূপ মতবাদেরও অভাব নাই, যাহা বিশ্বজনীন বিধ্বস্তির কারণ হইয়াছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারঘাত করিয়াছে। বস্ত্ততান্ত্রিক বিদ্যার প্রাচুর্য, নীতিনৈতিকতার উশৃংখলা, শ্চছরিত্রতা, হীনমন্যতা, অশান্তি, উপদ্রব ও অরাজকতা প্রভৃতিকে চারিত্রিক মর্যাদা এবং সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর আসন প্রদান করার মনোবৃত্তি ইহার ভয়াবহ পরিণতি।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে অশান্তি ও উপদ্রবের এই প্রলয়ংকারী দাবানল জলে স্থলে জ্বলিয়া উঠিয়াছে। পুঁজিবাদ ও সমূহবাদের অগ্নিশিখায় ভূমন্ডলের আকাশ ধুম্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। কম্যুনিস্ট প্রচারক দলের প্রচারণা ধরিত্রীর প্রতি প্রান্তে বিস্তার লাভ করিতেছে এবং নিরীশ্বরবাদী অশ্লীল তমদ্দুন দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতেছে।

মুছলমানগণের মধ্যে হীনমন্যতার প্রাদুর্ভাব :

বাগদাদের পতনের হৃদয়বিদারক ঘটনা ইছলামের প্রকাশ্য অবয়বকে আংশিকরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার আত্মাকে বিকৃত করিতে সক্ষম হয় নাই কিন্তু তাতারী অভিযানকে যদি ইয়াজুজ মাজুজের ফিতনা বলা চলে, তাহা হইলে ইহা বিশ্বাস করা উচিত যে, বর্তমান ফিতনা দাজ্জালের ফিতনা অপেক্ষা কোনক্রমেই কম নয়। এই ভীষণ ফিতনার কবল হইতে ইছলাম ও মিল্লাতে ইছলামের সম্ভ্রমকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হইতেছে দ্বীনী বিদ্যা অর্থাৎ আরবীকে পুনরুজ্জীবিত করা। ইমাম শাফেয়ীর মূল্যবান উক্তি কোনক্রমেই আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়, যাহা তিনি অছুলে ফিক্বহের সর্বপ্রথম গ্রন্থ কিতাবুর রিছালায় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। অতি সংক্ষিপ্তভাবে তাঁহার উক্তির মর্মানুবাদ আমি নিম্নে উধৃত করিয়া দিতেছি। তিনি বলিয়াছেন, রছুলুল্লাহ (দঃ) পূর্বে নবীগণ স্ব স্ব গোত্রের জন্যই প্রেরিত হইতেন কিন্তু মোহাম্মাদ মুছতফার (দঃ) আবির্ভাব নিখিল বিশ্ব মানবের জন্যই ঘটিয়াছে। যেহেতু প্রাচীন জাতিসমূহের ভাষা বিভিন্ন এবং এক জাতি অপর জাতির ভাষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সুতরাং এক ভাষার পক্ষে অপর ভাষার অনুসারী হওয়া যরূরী এবং অনুসৃত ভাষার পক্ষে অনুসারী ভাষা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হওয়া ওয়াজেব। আর এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই যে, রছুলুল্লাহর (দঃ) ভাষা সমগ্র ভাষা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং তাঁহার ভাষার পক্ষে অপর কোন ভাষার একটি অক্ষরেও অনুসারী হওয়া বৈধ নয় বরং সমগ্র ভাষার পক্ষে তদীয় ভাষার অনুসারী হওয়া অপরিহার্য। সমুদয় অতিক্রান্ত ধর্মের জন্য রছুলূল্লাহ (দঃ) ধর্মের অনুসরণ ওয়াজেব করা হইয়াছে ( ১৪ ও ১৫ পৃষ্ঠা)।

একথার এরূপ উদ্দেশ্য নয় যে, আমাদের ছাত্র মন্ডলী আরবী ব্যতীত অন্যান্য ভাষা এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আদৌ চর্চা করিবেন না অথবা তর্জমা, তফছীর এবং ভাষ্যগ্রন্থসমূহ দ্বারা উপকৃত হইবেন না। আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য শুধু এইটুকু যে, আরবী ভাষা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুছলিম ছাত্রের জন্য ফরয। আমাদের বর্ত্তমানে ও ভাবী বংশধরগণ জীবন সংগ্রামের যে কোন ক্ষেত্রেই অভিযান করুণ, তাঁহারা কোরআনের ধারকের ভাষায় যেন অপরিচিত না থাকেন। কিন্তু অশেষ লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমানে আরবী শিক্ষার এই গুরু কর্তব্যকে বড়ই অবহেলা করা হইতেছে। বস্ত্ততান্ত্রিক বিদ্যা, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান এবং অন্যান্য ভাষার প্রতি যে রূপ গুরুত্ব প্রদান করা হইয়া থাকে, পাকিস্তান ইছলামী গণতন্ত্রের সরকার এবং উহার নাগরিকগণ আরবী শিক্ষার প্রতি উহার শতাংশ গুরুত্বও প্রদান করিতে প্রস্ত্তন হন না।

পূর্ব পাকিস্তানের আরবী শিক্ষার অবস্থা এবং এসম্পর্কে কতিপয় প্রস্তাব :

ওয়ারেণ হেস্টিংসের সময় হইতে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ হইতে এই দেশে একটি বিশেষ ধরণের আরবী শিক্ষা প্রচলিত রহিয়াছে এবং দর্ছে নিযামিয়া নামেও আরেক প্রকার শিক্ষা পদ্ধতি যাহা নিশ্চিহৃ প্রায় হইয়া গিয়াছিল পুনঃ প্রবর্তিত হইয়াছে। এই উভয়বিদ শিক্ষার প্রণালী স্বস্ব স্থানে নিজ নিজ উদ্দেশ্য সাধন কল্পে চমৎকার ছিল, কিন্তু আমার বাচালতাকে যদি আপনারা ক্ষমা করেন, তাহা হইলে আমি বলিব যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিক দিয়া এই উভয়বিধ শিক্ষা এবং উহার পাঠন প্রণালী, বিশষভাবে বর্তমান সময়ে, সম্পূর্ণ ত্রুটিবিমুক্ত নয়। আমি শিক্ষা বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ নই, আমি একজন ক্ষুদ্র ছাত্র মাত্র, প্রচলিত পঠন ও পাঠন প্রণালীতে যে জ্ঞানতৃষ্ণা আমি স্বয়ং অনুভব করিয়াছি, কেবল সেই সকল বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।

যাকে বলে জ্ঞান তৃষ্ণার নিবৃত্তি, প্রচলিত শিক্ষা প্রণালীতে তাহার অস্তিত্ব নাই। শুধু অনুবাদ আর নোট মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হয় বটে, কিন্তু ইহার সাহায্যে জ্ঞানের গভীরতা ও পান্ডিত্য অর্জন করা সুদূর পরাহত। যাহা পঠিত ও পাঠিত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত উহা মস্তিষ্কে অংকিত হইয়া না যায় শুধু শব্দগুলি এবং সেগুলির সরল অর্থ মুখস্থ করিয়া কোন লাভ হইবে না। সাহিত্যের পঠন ও পাঠনে শব্দতত্ত্ব অর্থ তুলনা ও সৌসাদৃশ্যমূলক উদাহরণ এবং অলংকার ও প্রকাশ ভংগীর অনুধাবন, দৃষ্ঠান্ত ও উদাহরণের যাচাই একান্তভাবে প্রয়োজনীয়, আরবী সাহিত্যের ইতিহাস ও সাহিত্য-দর্শনের প্রতি মনঃসংযোগ করাও আবশ্যক। কোরআন এবং তফছীরের শিক্ষাদানে অছুলে তফছীর, উলুমে কোরআন ও কোরআনের ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক উল্লেখগুলির নিরুপণ ও অনুসন্ধান বিশেষভাবে যরূরী। নির্দিষ্ট মযহব উদ্দেশ্যের প্রচার ও প্রসারের পরিবর্তে যাহাতে ছাত্রগণ প্রসারিত দৃষ্টিভংগী, প্রবণতা, ইজতিহাদ এবং স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হইতে পারেন, তজ্জন্য সচেষ্ঠ হওয়া আবশ্যক। কোরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সীমাহীন গভীর মহাসমূদ্র। সাহিত্য, নীতিনৈতিকতা, আধ্যাতিকতা, ইতিহাস ও জীবনী, অর্থবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি, তমদ্দুন ও সমাজদর্শন, তর্কশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র, গণিত ও রসায়ণ, ভূগোল ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের মহামূল্য মুক্তারাজি কোরআনে বিক্ষিপ্ত অথবা স্ত্তপীকৃতভাবে বিদ্যমান রহিয়াছে এবং যেসমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য এই গ্রন্থ ‘খাতেমুল কুতুব’ অর্থাৎ সমুদয় ঐশীগ্রন্থের সমাপ্তকারী আখ্যা লাভ করিয়াছে তাহার তত্ত্ব উদঘাটিত করাও শিক্ষক মহোদয়গণের জন্য ওয়াজিব। শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে এই গ্রন্থ মানুষের কর্মজীবনের সত্যকার দিক দিশারী এবং পথের আলো। কিন্তু শুধু শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটির জন্যই এই মহা গ্রন্থ আজ মছজিদ ও গোরস্তানেই সীমাবদ্ধ রহিয়া গিয়াছে।

আরবী শিক্ষার বরকত ও কল্যাণেই আমাদের পূর্বপুরুষগণ দ্বীনী ও দুনিয়াবী গৌরবের গগণস্পর্শী মিনারায় অধিরোহন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহাদেরই উত্তরাধিকারীরা আরবী শিক্ষার গঠন ও পাঠন এবং কার্যকারিতার ক্রুটির জন্য কর্মজীবনের প্রত্যক স্থান হইতে বিতাড়িত হইতেছেন। ইহা বিশ্বস্ত হওয়া আদৌ উচিৎ নয় যে, প্রাচীন ধর্মসমূহের মধ্যে যে ধর্ম যুগের দাবী পূর্ণ করিতে সক্ষম হই নাই, তাহারা হয় ধরাপৃষ্ঠ হইতে নিশ্চিহৃ হইয়া গিয়াছে অথবা স্ব স্ব উপাসনালয়ের চতুঃসীমার ভিতর কয়েদ হইয়া রহিয়াছে। আর এই আটক থাকার সুযোগও যে, তাহারা লাভ করিয়াছিল, তাহার কারণ এই যে, তখন পর্যন্ত ধর্মের প্রতি অনাস্থা ভাব সভাবসিদ্ধ হইয়া উঠে নাই। এই জন্য প্রাচীন ধর্মগুলি নির্বাসিত জীবনযাপন করার সুযোগ পাইয়াছিল।  কিন্তু ইদানীং ধর্ম ও মযহব সমন্ধে অসন্তোষ ব্যাপকভাবে সংক্রামক আকার ধারণ করিয়াছে। সুতরাং আরবী শিক্ষা যদি যুগের দাবী আর মানুষের প্রয়োজন মিটাইতে সমর্থ না হয় তাহা হইলে উহার ধারকদের জন্য ধরা পৃষ্ঠ কোন স্থান থাকিবেনা। হাদীছ শাস্ত্রের শিক্ষা লাভ কোরআনের মতই সমান্তরাল ভাবে গবেষণামূলক পদ্ধতিতে প্রদত্ত হওয়া আবশ্যক। শব্দতত্ত্ব ও আভিধানিক অনুসন্ধানের সাথে সাথে হাদীছের তাৎপর্য যাহার হাদীছ সেই রছুলের (দঃ) অভিপ্রায় মত ছাত্রদের সম্মুখে বিশ্লেষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাদীছের সমর্থন ও বলিষ্ঠতার জন্য আনুসঙ্গিক প্রমাণাদির প্রতিও ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া আবশ্যক। যে সমস্ত মছআলা হাদীছ হইতে প্রতিপাদিত হয়, পূর্ববর্তীগণের গ্রন্থে তাহার উল্লেখ থাকুক কি না থাকুক, সেগুলি প্রতিপন্ন করিয়া দেখান উচিত। ছনদ, রিওয়ারত ও দিরায়ত সম্পর্কে অনুসন্ধান করার অভ্যাস ছাত্রবৃন্দের মধ্যে সৃষ্টি করা অপরিহার্য। সকল অবস্থায় রসূলুল্লাহর (দঃ) হাদীছকে মূল কেন্দ্রের মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে। হাদীছে বিরোধীদের প্রশ্নগুলির সমুচিত উত্তর প্রদানের জন্য ছাত্রদের মধ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতা সৃষ্টি করিতে হইবে।

ফিকহ ও আছারের শিক্ষাও অবশ্যপাঠ্য, কিন্তু শুধু অনুসন্ধান এবং জ্ঞানের প্রবণতা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ সাধনের জন্য উদার মনোবৃত্তি এবং  প্রশস্ত দৃষ্টি লইয়া ইহার পঠন ও পাঠনে ব্রতী হইতে হইবে। ময্হবী সংকীর্ণতাও দৃষ্টিভংগী অতীতেও মুছলমানগণের জন্য ফলপ্রসু হয় নাই আর বর্তমানে এরূপ রুচি শুধু ক্ষতিকারকই নয় বরং উহা মিল্লত ও দ্বীনের পক্ষে ধ্বংসাত্মক। আপনারা কি দেখিতেছেননা যে, বিদ্বানগণের মতভেদ যাহা প্রকৃতপক্ষে চিন্তাচর্চা এবং অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ কল্পে বহুমূল্য সম্পদ ছিল, সেগুলির দৃষ্টান্ত উধৃত করিয়া আজ ইছলাম ও ইছলামী বিদ্যার ধারকদিগকে কিভাবে উপহসিত ও বিড়ম্বিত করা হইতেছে এবং জনগণের কাছে তাহাদিগকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এই জীবন-যন্ত্র কিভাবে মারণযন্ত্ররূপে ব্যবহৃত হইতেছে? ইহাও জানিয়া রাখা আবশ্যক যে, ফিকহশাস্ত্র (Islamic Jurisprdence) সীমাহীন বস্ত্ত এবং কোরআন ও ছুন্নাহর মত উহা চরম ও অকাট্য নয়। পৃথিবীর আয়ুর দীর্ঘতা ও বিবর্তনের সংগে সংগে ফিকহশাস্ত্রের বিকাশ ও পরিবর্ধন অনস্বীকার্য। হাতুড়ে চিকিংসকদের মত শুধু পুরাতন ব্যবস্থাপত্রের তনুকরণ করা যথেষ্ট নয়। অভিজ্ঞ বহুদর্শী চিকিৎসাবিদের ন্যায় যাহারা পুরাতন ব্যবস্থাপত্রের সংশোধন করিতে এবং উহাকে নুতনত্ব প্রদান করিতে সমর্থ, ইছলামী বিদ্যার ধারকদিগকে তাঁহাদেরই মত হইতে হইবে। জীবন সমস্যার প্রত্যেক দুরূহপ্রান্তে ও স্তরে ইজতিহাদ ও সুদৃঢ় প্রজ্ঞা সহকারে তাঁহাদিগকে নিত্যনতুন ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন কল্পে কঠোর সাধনায় ব্রতী হইতে হইবে, অথচ কোন অবস্থাতেই কোরআন ও ছুন্নাহর মর্ম কেন্দ্র হইতে তাঁহাদের পদস্খলন ঘটিবে না। ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের অধ্যাপনাতেও এইভাবে প্রমাণাদি, গ্রহণ-বর্জন ও আলোচনাপদ্ধতি ও বিচার সম্বন্ধেও ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করিয়া তোলা আবশ্যক। ফলকথা, যে বিষয়ের শিক্ষাই প্রদত্ত হউক না কেন, উহার প্রকৃত আস্বাদ ছাত্রদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত করাই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনাতেও আরবী ছাত্র সমাজের মতঃসংযোগ করা কর্তব্য। যেহেতু এই সকল শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থগুলি আরবী ভাষায় নাই, তাই যে যে ভাষায় ওগুলি সংকলিত হইয়াছে বা হইতেছে সে সমস্ত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। অনুসরণ ও তক্বলীদের জন্য নয় বরং জ্ঞানের সম্প্রসারণ ও পরীক্ষামূলক তুলনা ও সমালোচনার উদ্দেশ্যে, যুক্তিবাদকে শরীআতের সহিত সুসমঞ্জস করার অভিপ্রায়ে।

দৃষ্টিভংগীর পরিপক্কতা এবং জ্ঞানের গভীরতা লাভের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় (Research) প্রবৃত্ত হওয়াও আবশ্যক। কিন্তু আমাদের শাসকগোষ্ঠি এবং শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের একদেশ দর্শিতা, গোঁড়ামি এবং তাঁহাদের দৃষ্টিভংগীর সংকীর্ণতার জন্য আরবী ইউনিভার্সিটির স্বপ্ন যেরূপ বাস্তবাকারে রুপায়িত হইতে পারে নাই, তেমনি আরবী শিক্ষার্থীদের জন্য কোন প্রেক্ষাগৃহ ও গবেষণাগার (Research institute) প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভবপর হয় নাই। ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকলকেই আরবী ছাত্র সমাজের অযোগ্যতার বুলি আওড়াইতে শুণা যায়, কিন্তু আরবী শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ ও সুবিধা প্রদান করার সদিচ্ছা কাহারও মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজ এবং বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণ সামান্য মনোযোগ দিলে আরবী শিক্ষা সমাপ্তকারী ছাত্রদের জন্য অন্ততঃ ‘দারুল মুছান্নেফীন’ আকারের প্রতিষ্ঠান গঠন করা কিছুই কষ্টসাধ্য নয়।

একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব

আরবী ছাত্র ও ইংরেজী ছাত্রদের মধ্যে যে রেষারিষি বর্তমানে সংঘর্ষের পর্যায়ে উপনীত হইতে চলিয়াছে, দেশ ও সমাজের কল্যাণ এবং ধর্মীয় স্বার্থের খাতিরে তাহার নিরসন কল্পে অগ্রসর হওয়া অপরিহার্য। বিদ্যা ও পান্ডিত্যের আপোষ, নৈকট্য ও মিলনের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে কোন বৈপ্লবিক পরিকল্পনা অবলম্বন করা অবশ্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে আর ইহার প্রথম সোপান হইতেছে পাঠ্যতালিকা ও শিক্ষার মাধ্যমের আশু পরিবর্তন এবং চরিত্রগঠনের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা।

আমার বিবেচনার মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত মাদরাছা ও স্কুলের পাঠ্যবৈষম্য বিদূরিত করা উচিত। মাধ্যমিক শিক্ষায় কোরআন মোটামুটি আরবী শিক্ষা, দ্বীনিয়াত, রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা, জাতীয় ইতিহাস, অঙ্ক, ভূগোল, প্রাথমিক আধুনিক ন্যায় শাস্ত্র, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলা, উর্দু, ইংরেজী ও আরবীর লিখন এবং অনুবাদের অনুশীলন প্রত্যেক মুছলিম ছাত্রের জন্য শিক্ষণীয় হওয়া উচিত আর শিক্ষার মান পুঁথিগত পরীক্ষায় সীমাবদ্ধ না রাখিয়া ইছলামী নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের উপর প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক। মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী ছাত্রগণ বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হইয়া পড়িবে এবং বিজ্ঞানের ছাত্রদের ন্যায় আরবী ছাত্রগণ বিজ্ঞান কলেজের পরিবর্তে আরবী কলেজে ভর্তি হইবে এবং তথায় উন্নত জ্ঞানের অধিকার লাভ করিবে। এইভাবে আরবী ও ইংরেজী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ ও বিদ্বেষের স্থলে প্রীতি ও সৌহার্দের ভাব সৃষ্টি হইবে এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছাত্রদের অন্তঃকরণও কোরআন ও ইছলামের নূরে আলোকিত হইয়া উঠিবে।

আরবীর প্রয়োজনীয় শিক্ষা যদিও অলংঘনীয় ফরয (فرض عين) কিন্তু ধর্মবিদ্যার বিশেষজ্ঞ হওয়া ফরযে কিফায়া আর এই আসনের অধিকারী হওয়া সকলের সাধ্যায়ত্তও নয়।

আল কোরআনে বলা হইয়াছে, فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ ‘তাহাদের সমুদয় দল হইতে কিছু সংখ্যক লোক কেন বহির্গত হয়না? যাহারা দ্বীনের বিশেষজ্ঞ হইবে এবং দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়া জাতিকে সাবধান করিবে, যাহাতে তাহারা অন্যায় হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হয়’ (আত-তওবা, ১২২ আয়াত)।

নবুওতের উত্তরাধিকারের আসন কেবল কাল-যাপন এবং পার্থিব সুখ-সন্তোগের উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত নয়। এই কার্যের দায়িত্ব প্রাণান্তকর, আর এপথের সংকট ও বিপদ অতিশয় ভয়াবহ।

در  منزل  ليلي  كه  خطر  هاست   بجان

شرط  اول  قدم  آن ست    كه  مجمون باشى!

ইদানীং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবী শিক্ষার পথ কেবল কাল যাপন ও আর্থিক অনটনের কারণেই অবলম্বন করা হয়। কোন উন্নত লক্ষ্য এবং মহৎ আকাংখা ইহার পশ্চাতে প্রেরণা যোগায় না। সুতরাং কোরআনের ধারক হওয়ার দায়িত্ব অবহেলিত হয় আর সুযোগ পাইলেই মওলবীগিরীর শিষ্ঠাচারকে মিষ্টারীর চাকচিক্যে বিভূষিত করার চেষ্টা করা হইয়া থাকে। এই সকল কারণেই প্রতি বৎসর শত সহস্র আরবী বিদ্যার্থী মাদরাছা হইতে বহির্গত হন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাঁহাদের সন্ধান করা দুরূহ হইয়া উঠে।

পার্টি লিডারদের যিন্দাবাদী ঘোষণা এবং তাঁহাদের আসনকে গগনস্পর্শী করিয়া তোলার জন্য কাঁধ আগাইয়া দেওয়ার উদ্দেশ্য রাজনীতির চ্চর্চা করা ছাত্রদের পক্ষে অবৈধ ও নিন্দনীয়। অবশ্য পবিত্র দ্বীনের তবলীগ ও প্রচার এবং নাস্তিকতা ও লাদ্বীনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা আবশ্য কর্ত্তব্য। তাঁহাদের মনে রাখা উচিত যে, তাঁহারা জাতির অপরিহার্য্য অঙ্গ। আজ যাহারা ছাত্র এবং মিল্লাতের সন্তান, আগামী কল্য তাঁহারাই জাতির চালক ও নেতৃস্থানীয় হইবেন। অতএব পরিবেশের সহিত ঔদাসীন্য তাঁহাদের ভাবী জীবনকে বিকল ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ করিয়া তুলিবে। সুখের বিষয়, আরবী ছাত্রবৃন্দের দৃষ্টি এদিকে কতকটা আকৃষ্ট হইয়াছে, কিন্তু ইহাকে আরও ব্যাপক ও প্রশস্ততর করিতে হইবে। আরবী ছাত্রদের জন্য পাঠাগার এবং ডিবেটিং ক্লাব সমূহের একান্তই অভাব। ইহাদের জন্য একই হল ত দূরের কথা একটি বোর্ডিং হাউসের সু ব্যবস্থা করাও আজ পর্যন্ত পূর্বপাক সরকারের পক্ষে সম্ভবপর হইলনা।

فالى الله المشتكى

উপসংহারে আরবী ছাত্রদের সম্বন্ধে সমাজের ঔদাসীন্যের জন্য আমি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া ক্ষান্ত হইতেছি।

مبين  حقير  گدايان عشق    را كيس قوم،

شهان  بے كمر  و خسروان  بے  كله  اند!

মূল অভিভাষণ উর্দুতে লিখিত ও পঠিত হওয়ার জন্য স্থানীয় এক দৈনিকপত্রে পূর্বপাকিস্তানের জনৈক শিক্ষাবিদ অপরাধ ধরিয়াছেন। তাঁহার সমালোচনার ভংগীতে যে শ্লেষের সুর অনুরণিত হইয়াছে, কোন দিক দিয়াই তাহা প্রশংসনীয় নয়। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের পটভূমিকা ও উহার বিবর্তনের ইতিহাস তাঁহার যদি অপরিজ্ঞাতও থাকে, তথাপি এ কথা তাঁহার ভুলিয়া যাওয়া উচিত ছিলনা যে, উর্দু পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। যতদিন হইতে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিল্প, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞগণ প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে ইংরাজীর মাধ্যমে তাঁহাদের বক্তব্য প্রকাশ করিয়া আসিতেছেন, তাহার বহুকাল পূর্ব হইতে ভারত উপমহাদেশের আরবী শিক্ষায়তন গুলিতে উর্দুর মাধ্যমেই পঠন ও পাঠনের ব্যবস্থা প্রচলিত রহিয়াছে।

কোরআন, হাদীছ, ফিকহ, অছুল, অলংকার, ন্যায়, ইতিহাস, ব্যাকরণ প্রভৃতির গ্রন্থগুলি উর্দুর মাধ্যমেই আজ পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। উর্দুর এই যোগ্যতা লাভের কারণ দুইটি, প্রথমতঃ উর্দু প্রধানতঃ আরবী ও ফার্ছীর শব্দ সম্পদে গৌরবান্বিত, এ গৌরব এক আরবী ব্যতীত অন্য কোন সাহিত্যের নাই। ইছলামী ভাব সম্পদের দিক দিয়াও পৃথিবীর সমুদয় ভাষায় উর্দুর সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কেহই নাই। দ্বিতীয়, ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরাই উহার জনক ও প্রতিপালক। ইংরেজও ইংরেজী বুলির মহিমায় উক্ত ভাষায় যে সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়,সেগুলি আমাদের শিক্ষাবিদ পরমানন্দে উপভোগ এমন কি এরূপ কোন কোন প্রতিষ্ঠান অধ্যক্ষতা করিলেও পাকিস্তানের আরবী শিক্ষানুষ্ঠানে উর্দু শুনিলেই হয় তিনি তন্দ্রাবিভূত হইয়া পড়েন, নয় ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া সভাস্থল পরিত্যাগ করেন। উহাকে তাঁহার উর্দু আতংক ছাড়া আর কি বলিব? তাঁহার জানিয়া রাখা উচিত যে, উর্দুর সৃষ্টি ও শ্রীবুদ্ধি সাধনে বাংলার মুছলমানের সাধনা ও দান পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান বা সিমান্তের মুছলমানদের অপেক্ষা চুল পরিমাণও কম ছিলনা। এ গৌরব ও দাবী হইতে যদি বাঙলার মুছলমান ইদানীং বঞ্চিত হইয়া থাকে, তার জন্য তাহাদের অর্বাচীন সাহিত্যিকদের হঠকারিতাই দায়ী। মুছলিম যুগের স্মৃতি আর ইছলামী শব্দ ও ভাব সম্পদে গৌরবান্বিত বলিয়া আজ ভারতের সিকিউলর রাষ্ট্র হইতে উর্দু নির্বাসিত হইয়াছে, উড়িষ্যা ও তামিলের মত উহাকে আঞ্চলিক ভাষার আসনও প্রদান করা হয় নাই, কিন্তু তজ্জন্য বিস্ময়ের কারণ নাই। পরমাশ্চর্য এই যে, পাকিস্তান ইছলামী গণতন্ত্রের একজন নামকরা শিক্ষাবিদ ভারতের মতই উর্দু বিদ্বেষে আক্রান্ত হইয়াছেন? সম্পূর্ণ বিদেশী ও বিজাতীয় ইংরাজী ভাষার প্রভাব বর্ধিত করার জন্য নিত্যনূতন ব্যবস্থা আমদানী করা হইতেছে, অনুবাদ পদ্ধতির পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা ‘ডাইরেক মেথডে’ শিখিবার ও শিখাইবার মশক শুরু হইয়া গিয়াছে, ইহার জন্য আমাদের শিক্ষাবিদের ভ্রুকুঞ্চিত হয়না, কিন্তু কালে ভদ্রে আরবী ছাত্রদের মহফিলে যদি কেহ উর্দু উচ্চারণ করে, তাহা হইলে তাঁহার গাত্রদাহ উপস্থিত হয়। এরূপ ছাত্রের আদৌ অভাব নাই, যাহারা কলেজে অধ্যাপকের ইংরেজী লেকচার বুঝিতে সক্ষম অথবা সচেষ্ট হয়না। কিন্তু তার জন্য ইংরেজীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বিত হইয়াছে কি? কোন কোন প্রতিভাবান আরবী ছাত্র, তাঁহাদের শিক্ষার মাধ্যম যদি বুঝিতে ইচ্ছুক না হন, তাহা হইলে তাঁহাদের পক্ষ সমর্থন করিয়া মাদরাছা হইতে উর্দু নির্বাসন আন্দোলনে ইন্ধন যোগান কোন শিক্ষাবিদের পক্ষেই গৌরবজনক নয়।

আমরা এরূপ আশংকাও অনুভব করিতেছি যে, মরহুম কামালের অন্ধ অনুকরণে এক শ্রেণীর শিক্ষাবিদ নমায, জুমআ, খুতবা ও আযান প্রভৃতি হইতে আরবী বহিষ্কারেরও স্বপ্ন দেখিতেছেন, কিন্তু আমাদের মনে হয়, এবিষয়ে তাঁহাদের বড়ই বিলম্ব ঘটিয়া গিয়াছে। আজ তুর্কীর মছজিদসমূহে আবার নূতনভাবে যে ‘আরবী বিলালের’ আযান শুরু হইয়া গিয়াছে, সে সংবাদ কাহারও অবিদিত নাই। সাময়িক হৈ চৈ ও গন্ডগোল প্রকৃত বাস্তবকে কখনও বিকৃত করিতে পারেনা, ভবিষ্যতে পারিবে না। ‘শাশ্বত বঙ্গের’ পূজা আর ইছলামের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভংগীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। একপথে দাঁড়ান আবশ্যক। হয় পাকিস্তান খতম করার চেষ্টায় প্রকাশ্যভাবে লাগিয়া যাওয়া উচিত, নয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীকে প্রসারিত করিয়া এই ইছলামী রাষ্ট্রে যাহাতে উর্দু ও বাংলা পাশাপাশি গলাগলি করিয়া গৌরবের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত হইতে পারে, তজ্জন্য সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য।

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী



আরও