সামাজিক অবক্ষয় ও ইসলাম

আব্দুর রাযযাক বিন তমিযুদ্দীন 1198 বার পঠিত

মানুষকে আল্লাহ অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। অথচ এক সময় মানুষ উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের উপর যুগের এমন একটি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন বস্ত্ত ছিল না। আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি (পিতা-মাতার) মিশ্রিত শুক্রবিন্দু হ’তে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমরা তাকে করেছি শ্রবণশক্তিসম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন । আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ হৌক কিংবা অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/১-৩)

মানুষকে আল্লাহ স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন; তার জীবনের অতিক্রান্তের তিনটি সময় তথা শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্যকাল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তাশীল মানুষ মহান আল্লাহকে ভুলে নিজেকে চরম বিপদে পতিত করে কিংবা আল্লাহর শোকরগোযার বান্দাতে পরিণত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে সামাজিক অবক্ষয় রোধে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব।

সামাজিক অবক্ষয়

মানুষের ছোট কালের শিক্ষা পাথরে খোদাই করার মত স্থায়ী, যা হৃদয় থেকে কখনো মুছে যায় না। আরবী প্রবাদে আছে, التعليم في الصغر كالنقش علي الحجر، و التعليم في الكبر كالنقش علي الماء ‘ছোটকালের শিক্ষা পাথরে খোদাই করার মত এবং বয়স্ক বয়সের শিক্ষা পানিতে অংকনের মত’। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। যে শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের শিরদাড়াকে সোজা রাখতে পারে, সেটিই প্রকৃত শিক্ষা। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)

ইসলাম নৈতিক শিক্ষার আধার। এই শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টিজীব মানুষ তার স্রষ্টা এবং পালনকর্তাকে চিনতে পারে। কেননা তাক্বওয়াশীল সুনাগরিক হ’তে হ’লে মহান আল্লাহ তথা মা‘বূদের সাথে আবেদের মধ্যে সুদৃঢ় সম্পর্ক থাকতে হবে। নইলে জগৎ সংসার ফিৎনা-ফাসাদ আর অশান্তিতে ভরে যাবে। দুনিয়া বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

আজকে আমাদের সমাজের চিত্র ভিন্ন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটি শিশু ছোটকাল থেকেই সমাজিক অবক্ষয়ে পতিত হচ্ছে। পিতামাতা শিশু সন্তানকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের পূর্বেই মোবাইল, কম্পিউটারের মত বিষাক্ত ডিভাইস তুলে দিচ্ছে। ফলে একটা ছোট্ট বাচ্চা অসহ্য মানসিক চাপে দিনাতিপাত করছে। অন্যদিকে শিক্ষার নামে বাচ্চার খেলার বয়সে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। পিতামাতা বাচ্চার হাতে ছোট বয়সে শিক্ষাসামগ্রী তুলে দিলেও কুরআন শিক্ষার মত বরকতময় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে বস্ত্তবাদী শিক্ষার সবক দিচ্ছে। এভাবে সামাজিকভাবে একটা শিশুকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর স্বাধীন সৃষ্টি একদিন সমাজ ও শয়তানের দাসে পরিণত হচ্ছে।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হ’ল তার যৌবনকাল। এই যৌবনে নিষিদ্ধ কাজের প্রতি যুবসমাজ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। প্রবাদে আছে, الإنسان حريص في ما منع- ‘মানুষ নিষিদ্ধ বস্ত্তর প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়’। বর্তমান যুবসমাজের অন্যতম ব্যাধি হচ্ছে মাদকতা। মাদক একটি জাতি ধ্বংসকারী নিরব সংক্রামক ব্যাধি। আমাদের দেশে এ সমস্যা অতি প্রকট। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জীবন বিনাশী নীলনেশা মাদকদ্রব্য। লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর জীবনে ড্রাগস এখন সহজলভ্য। অথচ ইসলামে এটা স্পষ্ট হারাম। আল্ল­াহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, বেদী ও শুভাশুভ নির্ণয়ের তীর সমূহ নাপাক ও শয়তানী কাজ। অতএব তোমরা এসব থেকে বিরত থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০)

মাদকাসক্তির কারণে বর্তমানে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা এবং এ সংক্রান্ত অন্যায়-অপরাধের প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, প্রত্যেক সচেতন নাগরিক জীবন নিয়ে চরমভাবে উৎকন্ঠিত কখন কি হয়!। সম্প্রতি বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন চরম রূপ নিয়েছে। এমনকি কন্যা শিশুরাও এই বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে। এ কারণে কন্যা শিশু থাকা পরিবারে বাবা মা সহ স্বজনরা এখন চরম আতঙ্কে সময় পার করছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও একাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া যুবতী তরুণীরাও প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাদ পড়ছে না মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধরাও। এমনকি ধর্ষণের পর ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে নিষ্পাপ শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ মহিলাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।

অথচ আল্ল­াহ তা‘আলা এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী বাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে কেউ জীবনের বদলে জীবন অথবা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করা ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করে’ (মায়েদাহ ৬/৩২)। এই মর্মে হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رضى الله عنهما عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ হযরত আব্দুল্ল­াহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, পবিত্র মুসলিম সে যার মুখ ও হাত থেকে ওপর মুসলিমরা শান্তি ও নিরাপদে থাকে’।[1]

মাদকাসক্তির প্রকৃত কারণ :

এর জন্য ৫টি কারণ বেশী দায়ী। যথা-

(১) পাশ্চত্যের অনুকরণ (২) ব্যক্তি জীবনে হতাশা (৩) বেকারত্ব (৪) নৈতিক অবক্ষয় (৫) সামাজিক মূল্যবোধের অবলুপ্তি।

আমাদের যুবসমাজ তাদের চলার পথ তথা জীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সন্দিহান। তারা জীবনের সঠিক ইসলামী আদর্শ এবং নীতিবোধ হ’তে বঞ্চিত। তাদের জানা নেই, কোন পথ ধরে এগুবে, কী তাদের লক্ষ্য। এই মানসিক অস্থিরতা ও ঔদাসীন্যের কারণেই তারা মাদকের দংশনে দংশিত হচ্ছে। যার প্রভাবে জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, ধর্ষণ, হত্যা প্রভৃতি নোংরা ও জঘন্য কর্মে তারা লিপ্ত হচ্ছে।

নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলাম :

ইসলাম নৈতিক উপদেশের সাথে নিবর্তনমূলক আইনও রেখেছে, যাতে অপরাধ নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যেমন (১) হুদুদ তথা আল্ল­াহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি। (৩) তাজির তথা ভীতি প্রদর্শন মূলক শাস্তি।

এমন শাস্তির মূল উদ্দেশ্য হলো তিনটি। (ক) অপরাধীকে শোধরানো বা ক্ষমার পথ তৈরী করা (খ) ক্ষতিগ্রস্থদের স্বান্তনা দেওয়া। (গ) অন্যদেরকে অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে নিরুৎসাহিত করা। এ মর্মে আল্ল­াহ তা‘আলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিহতদের রক্তের বদলা গ্রহণের বিষয়টি তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস ও নারীর বদলে নারী। এক্ষণে তার ভাইয়ের পক্ষ হ’তে যদি তাকে কিছু মাফ করে দেওয়া হয়, তবে সেটা যেন সুন্দরভাবে তাগাদা করা হয় এবং তাকে ভালোভাবে তা পরিশোধ করা হয়। এটা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে লঘু বিধান ও বিশেষ অনুগ্রহ। অতঃপর যদি কেউ এর পরে বাড়াবাড়ি করে, তবে তার জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি আর হে জ্ঞানীগণ! হত্যার বদলে হত্যার মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে। যাতে তোমরা সাবধান হ’তে পার (বাক্বারাহ ২/১৭৮-১৭৯)

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। যেমন- (১) ইসলামে ন্যায় বিচার সবার জন্য (২) ক্ষতিগ্রস্থদের অধিকার আছে বৈধ উপায়ে প্রতিশোধ নেওয়ার (৩) ন্যায় বিচারটা হ’তে হবে আল্লাহর দেওয়া বিধান মোতাবেক। (৪) আল্লাহর দেওয়া বিধান উপেক্ষাকারীদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি (৫) কিছাছের মাধ্যমে অন্যদের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে।

নিশ্চয় শেষের বাক্যে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, হত্যাকারীকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে কীভাবে জীবন বাঁচানো যায়? এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর হ’ল, যখন কোন অপরাধী ঠিক তার অপরাধের সমপরিমাণ শাস্তি পাবে, তখন সমাজে অন্য কেউ ঐ অপরাধে জড়াতে পারবে না, এটাই মানব প্রকৃতি। সুতরাং একজনের মৃত্যুদন্ডের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে অন্যদের জীবনকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব। ইসলামী বিধান সমাজে ন্যায়বিচারের একটি জীবন্ত শিক্ষা হিসাবে কাজ করবে। সুতরাং হুদুদ অর্থাৎ আল্ল­াহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি অনুযায়ী একজন যেনাকারী বা ধর্ষককে যদি রজম করে হত্যা করা হয়, একজন চোরকে যদি তার হাত কেটে দেওয়া হয় এবং একজন অন্যায়ভাবে হত্যাকারীর যদি ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তখন অন্যরা সেই ভয়াবহতা সরাসরি অনুভব করবে এবং এই ধরণের কোন অন্যায়ের সঙ্গে কখনও নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাইবে না।

অতএব মাদকাসক্তিসহ যাবতীয় সামাজিক অন্যায়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও সামাজিক পর্যায়ে আরো বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি করা যরূরী। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করতে হবে। নৈতিক আদর্শ শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

আমরা চাই না এমন দুর্বৃত্ত সন্তান কারো ঘরে জন্ম গ্রহণ করুক। এমন অসভ্য বর্বর ছাত্র কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকুক। যারা এসব কুসন্তানের জনক জননী তাদের ধিক্কার জানাই যারা তাদের সন্তান জন্ম দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন। মানুষ করার দায়িত্ব নেননি। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক। আর প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা একজন রক্ষক, সে তার অধীনস্থদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের রক্ষক, তাকে তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[2]

পরিশেষে বলা যায় যে, সত্যিকার অর্থে যদি কোন অপরাধীকে তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়, তাহ’লে বিশ্বজিৎ কিংবা রিফাতের মত আর কাউকে দুর্ঘটনার শিকার হ’তে হবে না। আর ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে না। হে আল্ল­াহ! আপনি আমাদের সমাজকে যাবতীয় অবক্ষয় থেকে নিরাপদ রাখুন এবং আমাদের জীবনকে আপনার পথে কবুল করুন-আমীন!

আব্দুর রাযযাক বিন তমিযুদ্দীন

[লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ও ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম, বড়পাথার বালিয়াদিঘী মাদরাসাতুল হাদীছ ও ইয়াতিম খানা, শাহজাহানপুর, বগুড়া]


[1]. বুখারী হা/১০; মিশকাত/৬

[2]. মিশকাত হা/৩; বুখারী হা/৩৫৮৮।



আরও