সমসাময়িক যুবসমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণে করণীয়

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 1040 বার পঠিত

ভূমিকা : যৌবন বা তারুণ্য এমন অজেয় শক্তি যা ঝঞ্চার মত উদ্যম, ঝর্ণার মত চঞ্চল আর প্রকৃতির মত স্বচ্ছ। যুবক মানে না নিষেধ, মানে না বাঁধা। যৌবনের উদ্যমতা ডিঙি যোগে সাগর পাড়ি দেওয়ার মতই দুঃসাহসিক চেতনার নাম।

‘আমি ঝঞ্চা, আমি ঘূর্ণি আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ’।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যুব সমাজের চিত্র এভাবেই ফুটে উঠেছে। আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভায়, উদ্যমে, কর্মযজ্ঞে যারা সমাজ বদলে দেয় তারাই যুবক। তাদের ধর্মে বিদ্বেষ নেই, আভিজাত্যের অভিমান নেই। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কিন্তু বর্তমান সমস্যা জর্জরিত এই সমাজে যুবকদের যুবশক্তি বরফের মত ক্ষয়ে ক্ষয়ে জাতির মেরুদন্ড ভঙ্গুর করে দিয়ে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। যুবশক্তি সঠিক উপায়ে ব্যবহৃত না হলে একটি দেশ ও জাতি স্বমর্যাদায় টিকে থাকতে পারেনা। আলোচ্য নিবন্ধে সমসাময়িক যুবসমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।

যুবক কারা : আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় সময় হচ্ছে যৌবনকাল। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার ১৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৫ বছরে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের তারুণ্য বা যৌবনকাল শুরু হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের খসড়া জাতীয় যুবনীতি : ২০০২ অনুযায়ী ১৫-৩৫ বছর বয়সী সবাই তরুণ। তবে কবি নজরুলের ভাষ্যমতে ‘তারুণ্যকে বয়সের ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না। তরুণ তারাই যাহার শক্তি অপরিসীম, গতিবেগ ঝঞ্চার ন্যায়, তেজ নির্মোঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তন্ড প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।’ যাদের তেজদীপ্ত কন্ঠে ধ্বনিত হয়-

‘নব নবীনের গাহিয়া গান

সজীব করিব মহাশ্মশান,

আমরা দানিব নতুন প্রাণ,

বাহুতে নবীন বল’

সামাজিক সমস্যা বলতে কী বুঝায় : কোন সমাজই সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ নয়। সমাজ এবং সমস্যা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সমাজ বিজ্ঞানী David Dreser Zvui ‘The study of Human Interaction’ গ্রন্থে সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে বলেছেন, ‘সামাজিক সমস্যা মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট এমন একটি অবস্থা, যাকে সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক অস্বাভাবিক বা অবাঞ্ছিত বলে বিবেচনা করে এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তা দূরীকরণে বিশ্বাসী হয়’। বিচ্ছিন্ন কোন অবস্থাকে সামাজিক সমস্যা বলা যায় না। বরং কোনো একটি অবস্থা যদি সমাজের বৃহৎ মানুষের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তবে তা সামাজিক সমস্যা হিসাবে গণ্য হয়। আবার যখন কোন অস্বাভাবিক অবস্থা প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে তখন তাকে সামাজিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর আলোকে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

দুর্নীতি : দুর্নীতি বাঙালির শিরা-উপশিরায় মিশে আছে। শরীরে কোনটি রক্ত আর কোনটি দুর্নীতি তা পার্থক্য করা কঠিন। দুর্নীতিতে বিশ্বদরবারে ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল রেকর্ড বাংলাদেশের রয়েছে। ফলশ্রুতিতে দুর্নীতি বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। দুর্নীতির কুপ্রভাবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও ক্ষমতাবলের বাইরের জনগোষ্ঠী। এটি দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে এবং মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে। বার্লিন ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকায় নীচের দিক থেকে বাংলাদেশ ১২তম অবস্থানে আছে। ২০১৯ সালে নিন্মক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। এর পেছনে করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।[1]

মাদক ও জুয়া : মাদক একটি জাতির জন্য অভিশাপ। তরুণ প্রজন্মের বহু মেধাবী ও সম্ভাবনাময় প্রতিভা মাদকের নেশার কবলে পড়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের পথ বেছে নিয়েছে। মাদকাসক্তদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তাই অপরাধ জগতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। এর ভয়াবহ করাল গ্রাস থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলামে নেশা জাতীয় যেকোন দ্রব্যই মাদক হিসাবে গণ্য। আর যাবতীয় মাদকই হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ، وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ وَمَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ فِي الدُّنْيَا فَمَاتَ وَهُوَ يُدْمِنُهَا لَمْ يَتُبْ لَمْ يَشْرَبْهَا فِي الْآخِرَةِ. ‘নেশা উদ্রেককারী প্রত্যেক জিনিসই ‘মদ’ আর প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসই হারাম। আর যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করেছে এবং অবিরত পান করতে থাকে এবং তা থেকে তওবা না করেই মৃত্যুবরণ করেছে, তাহলে সে পরকালে তা (জান্নাতী সুপেয় মদ) পান করতে পারবে না’।[2]

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে পরিকল্পিতভাবে ফেনসিডিল ও ইয়াবা কারখানা তৈরী করে রেখেছে। প্রাণঘাতি নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বি.এস.এফ-এর গুলিতে প্রায়শ গরু বেপারী মারা গেলেও আজ পর্যন্ত কোন মাদক কারবারীর নিহতের খবর পাওয়া যায়নি। অপরদিকে আইপিএল সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে চলছে জুয়াড়িদের উপদ্রব। বহুল আলোচিত ক্যাসিনো কান্ড, জুয়ার রমরমা ব্যবসা এবং হাযার হাযার মদের বোতল আটকের দৃশ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নৈতিকভাবে আমরা কতটা অধঃপতিত হয়েছি!

ধর্ষণ : ধর্ষণের নখরে ছিন্ন ভিন্ন নারীদের রক্তরেখায় বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত। মাঝখানে লাল-সবুজের পতাকা পেলেও চেতনাধারী ধর্ষকেরা আদৌ থেমে যায়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও ধর্ষণের সংবাদহীন কোন সূর্য উদয় দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা ধর্ষণের যে খবর পাই তা শুধু ডুবোপাহাড়ের ভাসমান চূড়া সদৃশ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে সারাদেশে ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন আরও ১২ জন নারী। ২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিলো ১১১৫টি। সেজন্য বলতে হয়-

‘কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী

রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’

বিজাতীয় সংস্কৃতি : বিজাতীয় সংস্কৃতির বিষবাষ্পে তরুণ প্রজন্ম আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অদ্ভূত মানসিক বিকারগ্রস্ত একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে। বিভিন্ন দিবস পূঁজা এবং তাতে হিন্দি-বাংলা গানের আসর এক নতুন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অবসর সময়ে ভারতীয় সিরিয়ালে পরকীয়া, কুটিলতা, বউ-শাশুড়ী দ্বন্দ্বের মনোমুগ্ধকর পার্ফরমেন্স প্রদর্শিত হচ্ছে। অপরাধ দমনের নামে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডি অনুষ্ঠানে হাতে-কলমে অপরাধ শেখানো হচ্ছে।

পর্ণোগ্রাফি : কিছু অন্ধকার আতঙ্কিত করে, কিছু অন্ধকার মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষের ধারণা পর্ণোগ্রাফির অন্ধকারে ডুব দেওয়া দোষের কিছু নয়। ছোটখাটো কোন নৈতিক বিচ্যুতি মাত্র। পর্ণোগ্রাফি এমন এক ব্যাধি, যা সবার অগোচরে ছড়িয়ে পড়েছে মেট্রোপলিটন থেকে মফস্বলে। কোন শ্রেণী, বর্ণ, ভাষা কিংবা জাতীয়তাবাদী সীমারেখা এ ব্যাধি মেনে চলেনা। নিজ বিষাক্ত কলুষতায় সে চরম সাম্যবাদী। বেডরুম, ক্লাস, কিংবা পাবলিক প্লেসেও এর ভয়ানক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস-এর তথ্যানুযায়ী, পশ্চিমারা প্রতিবছর অশ্লীল ছবি ব্যবসার মাধ্যমে কমপক্ষে ৫৭ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। যা বিশ্বের ১৩৮টি দেশের জিডিপির সমান। বর্তমান পৃথিবীতে পর্ণসাইটের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। Google-এর সমীক্ষা অনুযায়ী পর্ণ সার্চে গোটা বিশ্বে শীর্ষ যে ৮টি দেশ তার প্রথম ৬টি মুসলিম রাষ্ট্র। বাংলাদেশও এ ব্যাধির স্বীকার। ফলে ব্যভিচার, পরকীয়া, পতিতাবৃত্তি, শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এখন নিত্য-নৈমেক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেকারত্ব : বেকারত্ব সমাজের জন্য বোঝাস্বরূপ। মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজের সুযোগ না পেলে তার মেধা ও সামর্থ্যের অপচয় ঘটে। বেকারত্ব তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা তৈরী করে। বেকারত্বের সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। তবে বলা যায় যে, যার কর্ম নেই সে বেকার। করোনার আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। বিবিএসের তথ্য মতে, করোনায় বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়েছে। আইএলও‘র রিপোর্ট অনুযায়ী তরুণদের মধ্যে ২৫% বেকার। ফলে হরহামেশা আত্মহত্যা এবং অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আত্মহত্যা : আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে করোনাকালে গেল এক বছরে দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী ও পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, প্রেমে ব্যর্থতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, চাকরি না পাওয়া, আর্থিক সংকট এই সব আত্মহত্যার মূল কারণ।[3]

সন্ত্রাস ও চরমপন্থা : সরকারী প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দেশের প্রতিটি স্থানে সন্ত্রাস একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। আবরার হত্যকান্ড এ শিল্পের করুণ বলি। অন্যদিকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, বোমা হামলা চালিয়ে ইসলামকে কলুষিত করছে একটি চক্র। উভয় দলই সামাজিক শান্তি বিনষ্টের অন্যতম কারণ।

নাস্তিক্যবাদ : সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর আসমানের নীচে বসবাস করে, তাঁরই নে‘মত ভোগ করে তাঁর অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করা নিতান্তই বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। ৯০% মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদের চর্চা চরম ধৃষ্টতা। ইদানিংকালে ইন্টারনেটে সেক্যুলারিজমকে উপজীব্য করে মুক্তচিন্তা ও বাক স্বাধীনতার দোহাই পেড়ে যুবসমাজের মাঝে নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে একটি চক্র। কৌশলে ধর্ম বিদ্বেষকে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে ভুয়া ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। এই চক্রের ফাঁদে পড়ে মনুষ্যত্ব বিকিয়ে ধ্বংস হচ্ছে হাযারও যুবক।

উপরিউক্ত সামাজিক সমস্যা সমূহের জালে আবদ্ধ হয়ে তরুণ সমাজ স্বীয় তারুণ্য শক্তি হারাচ্ছে। ফলে একদিকে দেশে যেমন মেধা ও যোগ্য নেতৃত্ব শূন্য প্রজন্ম গড়ে উঠছে, অপরদিকে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে অস্থিতিশীলতার দিকে দেশ ধাবিত হচ্ছে।

এহেন পরিস্থিতিতে এসকল সমস্যার উত্তরণে নিম্নল্লেখিত বিষয়সমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে-

১. তাওহীদকে উপলব্ধি : তাওহীদ ইসলাম নামক অট্টালিকার প্রধান সোপান। প্রত্যেকটি আদম সন্তান ইসলামী ফিৎরাত তথা তাওহীদের উপর জন্মগ্রহণ করে। তাওহীদ বিমুখ প্রজন্ম গন্তব্যহীন অভিযাত্রীদলের মত। সেজন্য তাওহীদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে আল্লাহর রঙে রঙ্গিন করতে হবে।

২. জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে অনুশীলন : যুবসমাজকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। কারণ ধর্ম মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। যাবতীয় অপরাধের উৎস চারিত্রিক অবক্ষয়। তাই যুব সমাজ চারিত্রিক আদর্শের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারলেই আদর্শ সুশীল সমাজ গঠন সম্ভব।

৩. আদর্শ শিক্ষা গ্রহণ : শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। আমরা মানুষ, কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারছি না। কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার হার বাড়ালেও প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ। তাই যুবকদের মনুষ্যত্বের ধারক-বাহক হতে হলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

৪. পরকালীন ভীতি : যুবকদের মধ্যে পরকালীন জীবনের স্থায়িত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে চেতনা জাগ্রত করতে হবে।

আল্লাহ বলেন, وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ‘এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বৈ কিছুই নয়। আর পরকালীন জীবন হ’ল চিরস্থায়ী জীবন (যেখানে কোন মৃত্যু নেই)। যদি তারা জানত! (অর্থাৎ সেটা বুঝলে মানুষ নশ্বর জীবনকে অবিনশ্বর জীবনের উপর প্রাধান্য দিত না)’ (আনকাবূত ২৯/৬৪)। কেননা পার্থিব জীবনের পরই রয়েছে অনন্তকাল স্থায়ী জীবন। পরকালের জীবনই প্রকৃত জীবন। হাদীছে দুনিয়াকে মৃত কানকাটা বকরীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহর নিকট যার কোন দামই নাই। হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِجَدْيٍ أَسَكَّ مَيِّتٍ قَالَ: أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنَّ هَذَا لَهُ بِدِرْهَمٍ؟ فَقَالُوا: مَا نُحِبُّ أَنَّهُ لَنَا بِشَيْءٍ! قَالَ: فَوَاللَّهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللَّهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْ. জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি কানকাটা মৃত বকরীর বাচ্চার নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পসন্দ করবে যে, এক দিরহামের বিনিময়ে এটা তার মালিকানাভুক্ত হোক। তাঁরা বললেন, কোন কিছুর বিনিময়ে এটা আমাদের মালিকানাভুক্ত হোক তা আমরা পসন্দ করব না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট, আল্লাহর কাছে দুনিয়া (এবং তার সম্পদ) এর চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট।[4]

এভাবে ইসলাম মানুষকে পরকালীন চেতনায় উজ্জীবিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে।

৫. জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপন : শয়তান একার সাথী এবং দুইজন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَالْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামাআতবদ্ধ জীবনযাপন হল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন আযাব’।[5] সুতরাং আদর্শ সমাজ বিনির্মানে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী দ্বীনদার, দূরদর্শী ও অভিজ্ঞ আলেমদের নেতৃত্বে দ্বীনী জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যকীয়।

পরিশেষে বলব, যুবশক্তি লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার ন্যায়। সকলেই এই শক্তিকে লাগাম পরিয়ে বাগে এনে নিজের সুবিধামত পথে পরিচালিত করতে চায়। সেজন্য যুবকদেরকে খুব সতর্কভাবে থাকতে হবে এবং জীবন ও যৌবনকে কেবলমাত্র আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর রাহে বিলিয়ে দেওয়ার শপথ নিতে হবে। তাহলেই জাতির সকল জঞ্জাল মুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ। হে যুবক! তোমার প্রতি ফোঁটা রক্ত আল্লাহর দেওয়া পবিত্র আমানত। এসো তা ব্যয় করি নির্ভেজাল সত্যের পথে।

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দেক

সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[1]. বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৮শে জানুয়ারী, ২০২১।

[2]. মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৬৩৮।

[3]. ১৩ই মার্চ ২০২১, দৈনিক প্রথম আলো।

[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৭।

[5]. আহমাদ হা/১৮৪৭২; সিলসিলাতুছ ছহীহাহ হা/৬৬৭।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও