রাহবারে উম্মাহ

সারোয়ার মেছবাহ 190 বার পঠিত

উপস্থাপনা : রাহবার শব্দটি ফারসী। অর্থ পথপ্রদর্শক। সুতরাং রাহবারে উম্মাহ এমন সকল ব্যক্তিদের বলা হয় যারা পথভোলা উম্মাহকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। এই মহান দায়িত্বটি পৃথিবীর শুরু থেকেই নবী-রাসূলগণ আঞ্জাম দিয়েছেন। মানবজাতিকে সরল পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসূল দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন (নাহল ১৬/৩৬)। তঁাদের সর্বশেষ হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) শুষ্ক মরুর বুকে প্রেরিত হয়েছিলেন (বুখারী হা/৩৫৯৫)। সেখান থেকে সারা দুনিয়ায় হেদায়াতের আলো বিচ্ছুরিত করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই সমগ্র মানবজাতি মিথ্যার কলুষতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। 

রাসূল (ছাঃ) দুনিয়া ছেড়ে রবের সান্নিধ্য গ্রহণের প্রায় দেড় হাযার বছর হ’তে চলল। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই উম্মাহর ওলামায়ে কেরাম। তঁারাই এখন উম্মাহর রাহবার। শুধু পথভোলা মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করার মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ নয় বরং তাগুতের কফিনে পেরেক বিদ্ধ করার দায়িত্বও তঁাদেরই। কারণ, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (ছাঃ) নিজে একটি লাঠি হাতে কাবা গৃহে প্রবেশ করে পাঠ করলেন,وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا ‘আর বল সত্য এসে গেছে এবং মিথ্যা বিদূরিত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েই থাকে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮১)। অতঃপর কা‘বা গৃহে রক্ষিত মূর্তিসমূহের গায়ে হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করেন (বুখারী হা/৪৭২৯)। সেদিন তাঁর সাথে দশ হাযার ছাহাবী উপস্থিত ছিলেন।[1] রাসূল (ছাঃ) চাইলেই তাঁদেরকে বায়তুল্লাহর মূর্তিগুলি সরিয়ে ফেলার আদেশ দিতে পারতেন। তবে তিনি এমনটা করেননি। বরং সেদিন তিনি নিজ হাতেই বায়তুল্লাহ পবিত্র করেছেন। তাঁর এ কাজ থেকে আমরা এই বার্তাই পেয়েছি যে, যদি আবার আল্লাহর ঘর মূর্তিতে কলুষিত হয়, তবে তা ভেঙ্গে ফেলার গুরুদায়িত্ব নবীর ওয়ারিছ ওলামায়ে কেরামের।

আলেম কে?

যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম, যিনি যতবড় আলেম তিনি তত লম্বা পাঞ্জাবি পরেন। যেমন বিভিন্ন সেক্টরে নিচের পদের তুলনায় ওপরের পদের ইউনিফর্মে বেশী লেভেল দেখা যায়, তেমনই যিনি শুধু টুপি পরেন, তিনি একটু ছোট আলেম, যিনি পাগড়ি পরেন, তিনি তুলনামূলক বড় আলেম। যিনি পাগড়ির ওপরে রুমালও পরেন তিনি আরো বড় আলেম। আর যিনি এগুলোর পাশাপাশি জুববার ওপরে আলখেল্লা পরেন তিনি তো আল্লামাতুদ দাহর! এ ধারণা আমার অনেক দিন বিদ্যমান ছিল। এরপরে যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হলাম তখন দেখলাম, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় আলেমগণের পোশাক সাদাসিধে হয়। বুঝলাম, যখন মানুষের দেখানোর মত, গর্ব করার মত, সম্মান অর্জনের মত আর কিছুই থাকেনা তখন মানুষ পোশাক দেখায় এবং পোশাকের মাধ্যমে সম্মান অর্জনের চেষ্টা করে। তবে আশ্চর্যজনক হ’ল, তারা এক্ষেত্রে বারো আনাই সফল!

পরবর্তীতে জানলাম, আলেম তিনিই যার কুরআন ও হাদীছের ইলম রয়েছে। এরপর থেকে সন্ধানী চোখে খঁুজে বেড়াতাম, কুরআন-হাদীছ কে বেশী জানে? তঁাদের কাছে যেতাম, তঁাদের সাহচর্য গ্রহণে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। কিন্তু কিছু আলেমকে খুব কাছে থেকে দেখার পরে এ ধারণাও পাল্টে গেল। কারণ, তঁারা দিনের আলোতে দ্বীনের ধারক-বাহক। তবে রাতের অন্ধকারে দ্বীন বিক্রেতা! বুঝলাম, ইলম থাকলেই আলেম হয় না। কারণ একই কুরআন-হাদীছের ইলম কাউকে বানায় আলেম আর কাউকে বানায় দুনিদার!

ইলমের স্বরূপ : ইলমের মতই দেখতে হুবহু একটি জিনিস রয়েছে যার নাম মা‘লূমাত। দু’টির গুণাগুণ একদম বিপরীত। যেমন, চিনির মতই দেখতে লবণ। তবে লবণ চিনির প্রকার নয়। কেউ কুরআন-হাদীছ অধ্যয়ন করে কয়েক ছটাক চিনি প্রাপ্ত হয়। যা দ্বারা সুপেয় শরবত তৈরি হয়। আবার কেউ কয়েক মণ লবণ প্রাপ্ত হয়। সেটা দিয়েও শরবত হয় তবে সেটাকে সুপেয় বলা যায় না। সে সময় উস্তাদগণের মুখে শুনতাম, তুমি পড়া মুখস্থ করতে পার না তার মানেই তুমি গোপন কোন গুনাহে জড়িত। কোন ছাত্র দারস ঠিকমত না বুঝলেও তাকে বলা হ’ত, গুনাহ ছেড়ে দাও। আল্লাহ মেধা বাড়িয়ে দিবেন। প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হ’ত ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর কবিতা,

شَكَوْتُ إِلى وَكيْعٍ سُوْءَ حِفْظِيْ * فَأَرْشَدَنِيْ إِلى تَرْكِ المَعَاصِيْ

وَأَخْبَرَنِيْ بِأَنَّ الْعِلْمَ نُوْرٌ * وَنُوْرُ اللهِ لَا يُهْدَى لِعَاصِي

‘আমি (আমার উস্তাদ) ওয়াকী‘র নিকট আমার মুখস্থের দুর্বলতা সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে পাপ পরিত্যাগের উপদেশ দিলেন। আর বললেন, নিশ্চয় ইলম আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোন অবাধ্য পাপীকে দেওয়া হয় না’।

কেউ যদি অনেক হাদীছ মুখস্থ শোনাতে পারত, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেত, কিতাব ভাল বুঝত তাকেই আমরা বড় ইলমের অধিকারী মনে করতাম। পক্ষান্তরে যে ভাল কিতাব বুঝত না তাকে আলেম বলতে দ্বিধা হ’ত। সে যত ভাল আমলই করুক আর তার চরিত্র যত সুন্দরই হোক সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করত না। এভাবেই দিন যেতে থাকল। মাথায় সর্বদা ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর উক্তিটি উঁকি দিত। তবে বাস্তবতার সাথে তা কখনই মিলত না। দেখতাম, যারা আমল-আখলাকে ভালো তাদের অনেকেই কিতাব বোঝে না। আবার অনেক নোংরা চরিত্রের ছাত্র পড়ালেখায় ভালো। এর মাঝে তৃতীয় শ্রেণী অর্থাৎ কিতাবও বোঝে আবার তাক্বওয়াও রয়েছে এমন ছাত্র যে ছিল না এমনটা নয়। তবে তঁারা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।

এ বিষয়ে খেঁাজাখুঁজি করতে গিয়ে আরেকটি হাদীছ নযর কাড়ল। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের পূর্বে ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং মূর্খতা বৃদ্ধি পাবে’।[2] অথচ বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখা যায়, যত দিন যাচ্ছে তত হাফেয, আলেম ঘরে ঘরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিষয়টাও কেমন যেন বোধগম্য হ’ল না। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একদিন মনে হ’ল, আলেম ঘরে ঘরে বাড়ছে ঠিকই কিন্তু নবীদের ওয়ারিছ প্রকৃত আলেম পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সমাজে যারা নিজেদের আলেম বলে দাবী করে বসে আছেন তারা নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনের কাজ কেউই করছেন না। দ্বীনের জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ ও কুরবানী কেউ করছেন না। এত-শত আলেম, কত-শত সম্মান-ইয্যত-শোহরত! কিন্তু এতকিছুর মাঝে কুরবানী কোথায়? উম্মাহর দরদী কোথায়? তাহ’লে কি কুরআন-হাদীছ আর সালাফদের বাণীতে বর্ণিত ‘ইলম’ আর বর্তমান ‘ইলম’ এক নয়? যদি একই হবে তাহ’লে কুরআন-হাদীছ শিক্ষা করার পরেও কেন মানুষ আল্লাহ্কে ভয় করে না? অথচ কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্কে সর্বাধিক ভয় করে আলেমগণ’ (ফাতির ৩৫/২৮)। উম্মাহর আক্বীদা ও আমল সংশোধনের চিন্তা তো বহুদূরে, নিজেদেরই আক্বীদা শিরক মিশ্রিত, আমল বিদ‘আতে জর্জরিত এবং রুচিবোধ পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত।

সবকিছু মিলিয়ে যেটা পেলাম, প্রকৃত ইলম সেটাই যেটা দিয়ে আল্লাহকে চেনা যায়। হক গ্রহণ করতে শেখায়। তাক্বওয়া বর্জন করে অনেক কিছু জানাকে ‘ইলম’ বলা যায় না। সেটাকে মা‘লূমাত বলা যেতে পারে। অনেক কিছু জানা তখনই ইলম হবে যখন, এই জ্ঞান তাকে দুনিয়ালোভী নয় বরং দুনিয়াবিমুখ করবে। আল্লাহকে চিনতে শিখাবে, হক গ্রহণ করতে শিখাবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ হাযার হাযার হাদীছ মুখস্থ শোনানোর পরেও আল্লাহর বিধান মাফিক চলতে না পারে তবে বুঝতে হবে, তার কিছু মা‘লূমাত অর্জিত হয়েছে। কিন্তু সে কুরআন-হাদীছের ইলম প্রাপ্ত হয়নি।

বর্তমান প্রেক্ষাপট : ওলামায়ে কেরাম রাসূল (ছাঃ)-এর ইলমের ওয়ারিছ।[3] তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে আফসোসের বিষয়, রাসূল (ছাঃ)-এর ইলম তাঁর জীবনকে যে ধারায় পরিচালিত করেছিলেন, আমাদের ইলম আমাদের জীবন ধারায় সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে বাতিল সর্বদাই পরাশক্তি ছিল। কিন্তু রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফদের ইলম তঁাদেরকে বাতিলের সাথে আপোষ করতে দেয়নি। বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে গেলে, ‘হঁাকে বীর শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’। সেটাই হয়ত প্রকৃত ইলম ছিল। মোটা মোটা যে কাল দাগগুলো আমাদের ইলমকে কলুষিত করেছে সেটাই এখন ধারাবাহিক আলোচনা করছি।

বাতিলের সাথে আপোষকামিতা : আজ আমাদের অর্জিত ইলম আমাদেরকে বাতিলের সাথে আপোষ করতে বাধ্য করে। কঁাচা পয়সা-কড়ি দেখলেই ইলমের ধার চকচক করে ওঠে। যে ইলমের মাধ্যমে কুরআন-হাদীছ নিংড়ে হুকুম-আহকাম বের করা হয়, সেই ইলমের মাধ্যমেই আমরা হুকুম- আহকাম উল্টিয়ে দেই। অনেকটা প্রকৌশলীর বিদ্যা চুরিতে কাজে লাগানোর মত। যে ইলম হক গ্রহণ না করে উল্টো হকের বিপক্ষে দলীল তৈরি করার কাজে ব্যবহৃত হয় সেটা আর যাই হোক ইলম হতে পারে না। এমন ব্যক্তিকে কখনো আলেম বলা যায় না। কুরআন-হাদীছের জ্ঞান অর্জনের পরে আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমনই। আমরা রাস্তা খরচ দিয়ে বাতিলের কাছে যাই আপোষের জন্য। আমাদের মনে হয়, অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছি কর্মজীবনে কিছুটা সুখে থাকব বলে। কী দরকার ‘হক’ বলে ঝামেলায় জড়ানোর! অথচ ইমাম মালেক (রহঃ)-কে স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বা নিয়ে হাদীছ শোনার জন্য খলীফা হারূনুর-রশীদ ডেকে পাঠালে তিনি বলেছিলেন, ‘ইলম কারো কাছে যায় না। ইলমের কাছে যেতে হয়’।[4] সেটা বাতিলের সাথে আপোষের জন্য ছিল না। তবুও তাঁর এই উচ্চারণ এবং আত্মমর্যাদাবোধের দৃষ্টান্ত আমাদেরকে লজ্জিত করে। আজকের দিনে যদি কোনো দুনিয়াদার ধনী বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আমাদেরকে ফৎওয়া নেয়ার জন্য ডাকেন তবে আমরা খুশিতে কাপড়ও ঠিকঠাক পরতে পারি না। অথচ আমরা জানি, তারা আলেমগণকে ফৎওয়া নেয়ার জন্য তলব করেন না, বরং ফৎওয়া উল্টানোর জন্য তলব করেন। হায় আফসোস!

সাহসের অভাব : জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) কা‘ব বিন উজরাহ (রাঃ)-কে একদা বলেন, আল্লাহ নির্বোধদের শাসনকাল থেকে রক্ষা করুন। কা‘ব (রাঃ) বললেন, নির্বোধদের শাসনকাল কী? রাসূল (ছাঃ) বললেন, এক শ্রেণীর শাসক, যারা আমার পরে আসবে, তারা আমার আদর্শে আদর্শিত হবে না এবং আমার পথও অবলম্বন করবে না। মিথ্যাবাদী হওয়া সত্ত্বেও যারা তাদেরকে সত্যায়ন করবে এবং তাদের যুলুমে সাহায্য করবে; তারা আমার দলভুক্ত নয় এবং আমিও তাদের দলভুক্ত নই। ক্বিয়ামতের দিন তারা আমার হাউযের কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। আর যারা তাদের মিথ্যাকে সত্য বলবে না, তাদের যুলুমে সাহায্যও করবে না; তারা আমার দলভুক্ত এবং আমিও তাদের দলভুক্ত। তারা ক্বিয়ামতের দিন আমার হাউয থেকে পান করবে’।[5]

কারারক্ষীর পক্ষ থেকে এই হাদীছের ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, এর সনদ কি ছহীহ? তিনি বললেন, হ্যঁা। তখন তিনি সেই কারাগারেই রুদ্ধ ছিলেন। কারারক্ষী জিজ্ঞেস করল, এই হাদীছের ভাষ্যমতে তিনি কি যালেমের সাহায্যকারী হবেন? তিনি উত্তর দিলেন, যালেমের সাহায্যকারী তো তারা, যারা তোমার চুল অঁাচড়িয়ে দেয়। কাপড় পরিষ্কার করে দেয়। খাবার তৈরি করে দেয়। কিন্তু হে কারারক্ষী! তুমি যালেমের সাহায্যকারী নও, বরং নিজেই যালেমদের একজন! [6]

তাঁর বুকের এই সাহসের পেছনে রয়েছে তাঁর ইলম। কিন্তু আমাদের ইলমে বুকে ভয় ছাড়া কোনদিন সাহস যোগায় না। চোখের সামনে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতে কাদা মেশাতে দেখেও কখনো মুখে ‘ওয়া বিহী ক্বালা হাদ্দাছানা’ উচ্চারিত হয় না। বরং আমরা সেখানে স্বার্থ খুঁজি। আর এ বিষয়ে অনেক ইমামগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সেদিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার বলে এড়িয়ে যাই। আমরা আজকে সুকুমার রায়ের ‘বাপুরাম সাপুড়ে’ ছড়ার ঐ সাপের মত হয়ে গেছি,

‘যে সাপের চোখ নেই

শিং নেই, নখ নেই,

ছোটে না কো হাঁটে না

কাউকে যে কাটে না,

করে নাকো ফেঁাস-ফঁাস

মারে না কো ঢঁুস-ঢঁাস,

নেই কোন উৎপাত

খায় শুধু দুধভাত’।

প্রকৃতার্থে আলেমগণের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আমার উম্মাহর আলেমগণ মূল্যের বিনিময়ে ইলমকে বিক্রি করবে’[7] তা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য হচ্ছে।

দাসত্বের মানসিকতা : বনু ইস্রাঈল মূসা (আঃ)-এর জন্মের আগে থেকেই ফারাওদের দাস ছিল। দীর্ঘ দিন দাস থাকার ফলে দাসত্ব তাদের রক্তে মিশে গিয়েছিল। এজন্যই মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে হেদায়াত লাভের পর তাঁর কয়েক দিনের অনুপস্থিতিতে তারা বাছুরকে তাদের প্রভু বানিয়ে নিয়েছিল (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)। গোলামী না করে তারা যেন সুখে থাকতে পারছিল না। বর্তমান ‘ওলামায়ে কেরামের যেন বনু ইস্রাঈলের মতই অবস্থা। দাসত্ব ছাড়া তারাও সুখে থাকতে পারছেন না। তবে সেটা আল্লাহর দাসত্ব নয়, ত্বাগুতের দাসত্ব। যেখানে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আলী! সব উচু কবরকে ভেঙ্গে সমান করে দাও। সব ছবি-মূর্তি ভেঙ্গে চূর্ণ করে দাও’।[8] সেখানে এই হাদীছকে বুকে দাবিয়ে রেখে সামান্য কিছু অর্থের কাছে বিক্রি হওয়া এবং কুরআন-হাদীছের ভাষাগত ফঁাক-ফোকর তালাশ করে মূর্তির বৈধতার পক্ষে দলীল উপস্থাপনের চেষ্টা করা সত্যিই লজ্জাকর!

সম্মান প্রদর্শনের নামে চাটুকারিতা : রাসূল (ছাঃ) সম্মানীদেরকে সম্মান দিতেন। সাধারণ মানুষকেও সম্মানিত করতেন। এটা তাঁর আদর্শ ছিল। যেমন জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ)-কে তিনি মজলিসে নিজের চাদরে বসতে দিয়েছিলেন। জারীর (রাঃ) চাদরটিতে না বসে সেটা চোখে-মুখে লাগিয়ে বলেছিলেন, আপনি যেভাবে আমাকে সম্মানিত করেছেন আল্লাহও সেভাবে আপনাকে সম্মানিত করুন’।[9] তবে এই সম্মান প্রদর্শন নিজের আদর্শ থেকে বের হয়ে নয়। সম্মান প্রদান করা আর নিজের আদর্শকে ছোট করার মধ্যে বিস্তর ফারাক্ব রয়েছে। অথচ আমরা তাঁর থেকে সম্মান দেয়ার শিক্ষার জায়গায় নিজের আদর্শকে ছোট করতে শিখেছি। তাইতো পনের টাকার টুপি দিয়ে পনের হাযার টাকার জুতা মুছে দিতে আমাদের একটুও জাত যায় না। বরং ইনছাফ মনে হয়।

শুধু আলেম হওয়ার কারণে হীনমন্যতায় ভোগা : আমরা দেখেছি, মসজিদের ইমাম ছাহেবের ছালাত আদায় করানো আর খাবারের বাটি বহন করা ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না। সমাজের মানুষের ঈমান-আমল দেখার দায়িত্ব ইমাম ছাহেবের নয়। সামাজিক কুসংস্কারে বাধা প্রদানের দায়িত্ব ইমাম ছাহেবের নয়। আমরা জেনেছি, এক টাকাও সরকারী অনুদান ছাড়া সম্পূর্ণ নিজের খরচে ১৫ বছর লেখাপড়া করে আলেম হওয়াকে বলে ‘ফকীরী বিদ্যা’। আমরা জেনেছি, ওলামায়ে কেরাম, ইমাম, মুওয়াযযিন, মাদ্রাসার শিক্ষকরাই সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ। এজন্যই আমরা কথা বলতে ভয় পাই। সত্য প্রকাশ করতে আমরা হীনমন্যতায় ভুগি। পশ্চিমা পঁচা, বিকৃত পোশাকের ভিড়ে ঢিলাঢালা পাঞ্জাবি-টুপিকে মধ্যযুগীয় অসভ্য পোশাক মনে করি। আচ্ছা! বলুন তো, আপনাকে কেউ যখন ইমাম ছাহেব, হাফেয ছাহেব বলে ডাকে আপনি জবাব নেন কেন? আপনি জানেন, ইমাম অর্থ কী? আপনি জানেন, ইমাম, হাফেয ইত্যাদির শেষে ‘ছাহেব’ কেন যুক্ত করা হয়? সেটার অর্থ কী? ‘ওলামা’ শব্দের পরে ‘কেরাম’ কেন যুক্ত করা হয়? সবসময় মনে রাখবেন, আমাদের পরিচয়, আমরা উম্মাহর কর্ণধার। আমরা দুনিয়ার বুকে দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী। আমরা বানের পানিতে ভেসে দুনিয়াদারদের চরণসেবা করতে আসিনি। আমরা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পেঁŠছে দিতে এসেছি। এই মহান কাজের জন্য আমরা তাঁর পক্ষ থেকেই নির্বাচিত। এজন্যই আমাদেরকে ‘ছাহেব’ বলা হয়। 

শেষ কথা : আজ আমাদেরকে পেছনের সকল গ্লানি মুছে ফেলে আবার নতুনভাবে জাগতে হবে। মনে রাখতে হবে, কুরআন-হাদীছের ধারক-বাহকগণ অধিকাংশই দুনিয়ার ধন-যশে ধনী ছিলেন না। তঁাদের কাড়ি কাড়ি পয়সা ছিল না। তঁাদের ক্ষমতা, পদমর্যাদা ছিল না। তবে তঁাদের পাহাড় সমান আত্মমর্যাদাবোধ ছিল। হক প্রকাশে তঁারা ছিলেন অকুতোভয়। হক প্রতিষ্ঠায় তঁারা ছিলেন জানবায মুজাহিদ। এযুগেও কুরআন-হাদীছের ধারক-বাহকদের জীবন-যাপন গরীবানা ধঁাচের হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, আর্থিক প্রাচুর্যে কোন ফযীলত থাকলে আল্লাহ তা‘আলা সবচেয়ে বেশি প্রাচুর্যের অধিকারী করতেন রাসূল (ছাঃ)-কে। যেহেতু তঁাকে সেটা দেয়া হয়নি। সুতরাং গরীবানা জীবনের জন্য হীনমন্যতায় ভোগা একজন আলেমের জন্য নিতান্তই বেমানান, অশোভন। রাসূল (ছাঃ) যা গ্রহণ করেননি, তা কোনদিনও আমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণের বিষয় হ’তে পারে না।

এই গরীবানা জীবনেও আত্মমর্যাদাবোধ সর্বদা পাহাড়ের মত উঁচু রাখতে হবে। কারণ এটা একজন আলেমকে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করে। জীবন যতই ঘোর অমানিশার মাঝে হারিয়ে যেতে থাকুক বা শক্তিশালী ঢেউয়ের আঘাত জীবন চরের পাড়গুলো ভেঙ্গে ফেলুক; সদা সর্বদা হক প্রকাশে আমাদের তৎপর থাকতে হবে। আমাদের সালাফদের জীবনে যেমন বৈরি পরিবেশ এসেছে, তেমন আমাদের জীবনেও আসবে। হক প্রতিষ্ঠায় সর্বস্ব ভূলুন্ঠিত হতে হতে পারে, সবকিছু হারাতে হতে পারে। কিন্তু সেটাকে কুরবানী ভেবেই গ্রহণ করতে হবে। তবেই ইলমের যথাযথ ব্যবহার হবে। নে‘মতের শুকরিয়া আদায় হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!


[1]. আর-রাহীকুল মাখতুম ৪০১ পৃ.।

[2]. বুখারী হা/৮০ ‘ইলমের বিলুপ্তি ও মুর্খতার প্রসার অনুচ্ছেদ-২৫।

[3]. আবু দাউদ হা/৩৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/২২৩ মিশকাত হা/২১২।

[4]. আবুল হাসান ইবনে ফিহর, কিতাবু ফাযায়েলে ইমাম মালেক।

[5]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৪৮১, ছহীহুত তারগীব হা/২২৪২।

[6]. সিয়ারুস সালাফিছ ছালেহীন ১০৫৯ পৃ.।

[7]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৫১১।

[8]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/১৩৬৬, মুসলিম হা/৯৬৯।

[9]. মুসতাদরাকে হাকেম হা/৭৭৯১ সনদ ছহীহ।



আরও