সুন্নাতের দুর্ভিক্ষ ও দৃপ্ততেজী তারুণ্য

ইলিয়াস বিন আলী আশরাফ 289 বার পঠিত

দেশ এবং জাতি এক ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় অবস্থায় নিপতিত। শান্তি-শৃঙ্খলা, নীতিবোধ এবং জীবনের নিরাপত্তা বলতে আজ আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। গ্রামের পর্ণকুটির থেকে শুরু করে রাজধানীর প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলোতে পর্যন্ত কেউ এখন আর নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেনা। একটা ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও অস্বস্তির বোঝা যেন আজকাল সবার বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। কি হবে এ দেশের? এ জিজ্ঞাসাই সচেতন, বিবেকবান মানুষকে তাড়িত করছে। মহানবী (ছাঃ) এর কণ্ঠনিঃসৃত হাদীছে যেসব ভয়াবহ ফেতনার আগাম খবর দেওয়া হয়েছে, সেসব ফেতনারই যেন কোন একটার আবর্তে আমরা পতিত হয়েছি। কূল-কিনারাহীন এই ফিতনার ঘূর্ণিপাকে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি চীৎকার ছাড়া আমাদের যেন করার কিছুই নেই। এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে এক ভয়ংকর হায়েনার চক্র এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইসলাম ও মুসলমানদের আদর্শ, ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, যা কিছু অর্জন ও গৌরবের, সে সব কিছুই গুড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ইসলাম, মুসলমান, দাঁড়ি, টুপি ও ফৎওয়া নিয়ে এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষের যে গাত্রদাহ, তা সত্যিই অবাক করার মত বিষয়। যে দানবীয় শক্তিটাকে আমাদের পূর্বপুরুষগণ সাময়িকভাবে হলেও উচিত শিক্ষা দিয়ে এই উপমহাদেশে আমাদের জাতিসত্তাকে অন্ততঃ এক শতাব্দী কালের জন্য কিছুটা নিরাপদ করেছিলেন, বালাকোটের জিহাদের ময়দানে যে দানবদের হাতে আল্লাহর রাহে প্রাণ দিয়ে আমাদের জন্য আগামী দিনের পথ দেখিয়েছিলেন আমীরুল মুজাহিদীন সৈয়দ আহমাদ শহীদ (রঃ), শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ) প্রমুখ সেই দানবের অপশক্তির প্রেতচ্ছায়া আজ বাংলাদেশের বুকে নতুন বেশে, নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। এদের বিষাক্ত দন্ত, নখর শুধু আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জাতীয় মর্যাদাবোধকেই ধূলিসাৎ করে দিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছে না, আমাদের দ্বীন, ঈমান, তাহযীব-তমুদ্দুন, শিক্ষা ও বোধ বিশ্বাসকে একের পর এক আক্রমণ করে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে উদ্যত হয়েছে।

ইসলাম ও মুসলমানদের আক্বীদার বিরুদ্ধে মুসলিম নামধারীদের কলবাজি, চাপাবাজি সীমা অতিক্রম করেছে। রাজনীতির ময়দানে মুসলিম জাতিসত্তার স্বতন্ত্র পরিচিতি নিয়ে অগ্রসর হ’তে চাইলেই নানা অপবাদের আড়ালে সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। গন্ডায় গন্ডায় সংবাদপত্র এবং ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়াকে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামী বোধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। মুসলিম উম্মাহর চিহ্নিত দুশমন ইহুদীদের মুখ থেকেও যে সব মিথ্যা ও অপবাদের কথা কল্পনা করা যায় না, তার চাইতেও জঘন্য বক্তব্য উদগীরণ করানো হচ্ছে নামে মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত এদেশের এক শ্রেণীর পক্ষ থেকে।

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও আজ চরম হতাশা। যুবসমাজের নিকট সঠিকভাবে আদর্শ উপস্থাপনের ব্যর্থতার কারণে ধর্মবিরাগী ও নাস্তিক্যবাদীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মের খোলস ঝেড়ে ফেলতেও অনেকে উন্মুখ। ইসলামপন্থীগণ নানা দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে লিপ্ত। একদল বৈরাগ্যবাদের পূজারী, অন্যদল সমাজ সংস্কারে নিয়োজিত থেকে নিজেদের দায়িত্ব  সম্বন্ধে উদাসীন। একদল ইসলামের কাটছাট চান, অপর দল কোন রূপ ঝুঁকি নিতে নারাজ। যারা সত্যিকার ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি, তাদের মধ্যেও রয়েছে অনৈক্যের আবহ। স্ব স্ব কার্যক্রমে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ চেষ্টা, কার্যপ্রণালীর বিভিন্নতাকে প্রাধান্য দিয়েই নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্টার জন্য চলছে আন্দোলন।

শিরক-বিদ‘আত ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ দিন দিন বাড়ছে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সমাজে অনুপস্থিত। আর যদি কেউ শিরক বিদ‘আত সম্পর্কে বলতে যায়, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য মানুষের আর অভাব হয় না।

কিন্তু এই ফিতনার সমুদ্রকে তো চিরদিন অবাধ গতিতে সয়লাব হতে দেয়া যায় না। সময়ের ব্যবধানে স্রোতের বিপরীতে কোন না কোন প্রতিরোধশক্তিকে দাঁড়িয়েই যেতে হয় এবং তার মাধ্যমেই রচিত হয় নবযুগের ইতিহাস। আমি আমাদের জগতপুর গ্রামের এমনই একটি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরতে চাই।

সময়টি ছিল ১৯৭৭ সাল। আমাদের গ্রামের মধ্যে জামে মসজিদ ছিল একটি, যা জগতপুরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নামে পরিচিত। ১৯৭৭ সালের শা‘বান মাসে শবেবরাতের আগের জুম‘আ। এই দিন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কুমিল্লা যেলার সভাপতি মাওলানা ছফিউল্লাহ সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তখনো ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। মাওলানা ছফিউল্লাহ সাহেব তখন ২০/২২ বয়সের তরুণ। ফাযেল পরীক্ষা শেষ করেছেন সবেমাত্র। মুখে সামান্য দাঁড়ি গজিয়েছে। তিনি বড় মসজিদে উপস্থিত হলেন। এই সময়ে মসজিদের ইমাম ছিলেন মাওলানা সাইদুর রহমান সাহেব। তিনি মাওলানা ছফিউল্লাহকে বললেন খুৎবা দেওয়ার জন্য। মাওলানা ছফিউল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কোন বিষয়ে আমি খুৎবা দিব। তিনি বললেন, শবেবরাতের বিদ‘আত সম্পর্কে আলোচনা কর। খুৎবা হল। খুৎবার অন্যান্য আরো বিষয়বস্ত্ত ছিল, সমাজে ধর্মের নামে প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ। যেমন শবেবরাত, মানুষের বাড়ী বাড়ী পয়সা নিয়ে কুরআন খতম, দলবেধে পয়সা নিয়ে কবর যিয়ারত, মৃত মানুষকে কেন্দ্র করে কুলখানী, চেহলাম, মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠান, এই সমস্ত বিষয়ে তিনি জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করলেন এবং এগুলো যে শরী‘আত সম্মত না বরং বিদ‘আত তা প্রমাণ করলেন। তবে তিনি বিশেষ করে শবেবরাত নিয়ে আলোচনা করলেন। কেননা তখন বিদ‘আতীদের মত আহলেহাদীছদের মধ্যেও ঘটা করে শবেবরাতের প্রচলন ছিল। এমনকি শা‘বান মাসের প্রথম থেকেই পিঠা বানানো, হালুয়া-রুটি, কুরআন খতম ইত্যাদির ধূমধাম চলত। আর শবেবরাতের রাত্রে অর্ধ রাত পর্যন্ত মানুষ ছালাত আদায় করত। এই সবগুলো যে শরী‘আত সম্মত না, তা ছফিউল্লাহ সাহেব তুলে ধরলেন। তবে এর আগে তিনি আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের শবেবরাত সম্পর্কে ‘আরাফাত’ পত্রিকায় একটি লেখা অধ্যয়ন করেছিলেন। আর আমীরে জামা‘আত শায়খ বিন বাযের ফৎওয়া অনুবাদ করে ‘আরাফাত’ পত্রিকায় লিখেছিলেন। মাওলানা ছফিউল্লাহর মূল প্রেরণা ছিল মূলতঃ এগুলো থেকেই। তারপর জুম‘আর ছালাত শেষ হল, মসজিদভরা মুছল্লী, ছালাত শেষে সমস্ত মুছল্লির গায়ে যেন জাহান্নামের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। তখন তো সবাই চোখ রাঙ্গিয়ে গম গম করে উঠল, মাওলানা ছফিউল্লাহর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। ছফিউল্লাহ সাহেব এগুলি কিছুই মনে করেননি। বরং তিনি ধৈর্যের সাথে মসজিদের ভিতর বসে ছিলেন। আমাদের গ্রামের একজন সরদার ছিলেন খুবই ভাল মানুষ। তার কথা এখনো সবার মুখে মুখে আছে। কিন্তু তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তার নাম ছিল সুলতান সরদার। তখন সুলতান সরদার সাহেব দাঁড়ালেন। কিন্তু মাওলানা সাইদুর রহমান চুপ করে আছেন। সরদার সাহেব দাঁড়িয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনারা মসজিদের ভিতর কোন কথা বলবেন না। মাদরাসার পুকুরপাড়ে সবাই আসেন এবং মাওলানা ছফিউল্লাহকেও বললেন বসার জন্য। ছফিউল্লাহ সাহেব ঐখানে গিয়ে বসলেন। মাদরাসার উত্তর দিকে একটি আমগাছ আছে, এক ব্যক্তি ঐ আমগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তিনি মাঝে মাঝে বিদ‘আতী দাওয়াতও খায়। মাওলানা ছফিউল্লাহকে লক্ষ্য করে এই ব্যক্তি বলে উঠল, ‘ঐ মিয়া, আপনি যে এই গুলি বিদ‘আত বললেন, বলেন তো দেখি বিদ‘আতের ওযন কতটুকু? এখানে সব মানুষ বসা, সরদার সাবও বসে আছেন’। তখন ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, ‘বিদ‘আতের এত ওযন, তা এত ভারি যে, যে ব্যক্তি বিদ‘আত করবে তাকে বিদ‘আত টেনে জাহান্নামে নিয়ে যাবে’। তিনি এই কথাটি বলার পরে সবাই চুপ হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বলল না। তখন সুলতান সরদার মাওলানা ছফিউল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, ছফিউল্লাহ মিয়া, আপনি যে কথাগুলো বললেন শবেবরাত সম্পর্কে এবং অন্যান্য আরো বিষয়ে, আপনি কি এগুলোর দলীল দিতে পারবেন? তখন মাওলানা ছফিউল্লাহ বললেন, জ্বী, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই দলীল দিতে পারব। আমি জেনেশুনেই এই কথাগুলি বলেছি। একথা বলার পর, সরদার সাহেব সভা ঐখানে সমাপ্ত করে দিলেন। এই সভাতে সরদার সাহেব কোন সমাধান দিলেন না। সবাই সবার মত বাড়ীতে চলে গেল। তারপর এলাকায় মানুষ খুব তোলপাড় করা শুরু করল। হাটে, ঘাটে, দোকান-পাটে, মসজিদে-মাদরাসায়,স্কুলে সব জায়গায় মাওলানা ছফিউল্লাহ সাহেবরের বিরুদ্ধে গালি গালাজ, বিষোদগার। এই অবস্থা চলতেছে। পরের দিন মাওলানা ছফিউল্লাহ মাদরাসা গেলেন ক্লাস করার জন্য। তখন তিনি মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। যখন তিনি মাদরাসায় গেলেন, তখনকার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আলী আছগর ছাড়া অন্যান্য যত শিক্ষক আছেন, তারা লাইব্রেরী থেকে কিতাব খুলে ছফিউল্লাহ সাহেবের সাথে তর্ক করার জন্য প্রস্ত্তত। তারা তাফসীরগুলো খুলল। খুলে তারা কুরআনের একটি আয়াত দেখালো। আয়াতটি হল-

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ (3) فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

এছাড়াও আরো বিভিন্ন আয়াতগুলো পর্যালোচনা করে যখন ছফিউল্লাহ সাহেব তাদের যুক্তি খন্ডন করে দিলেন, তখন তারা কিতাবগুলো রেখে দেয়। পরের জুমআ‘ আর একজন অল্প শিক্ষিত মুন্সি দিয়ে পড়ানো হল। বিদ‘আতপন্থীরা মিশকাতের শবেবরাত সংক্রান্ত যঈফ হাদীছগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ঐ মুন্সির কাছে দিয়েছে। মুন্সি ছালাতের পরে উঠে দাঁড়িয়ে সব যঈফ হাদীছগুলো পড়ে শুনালেন। মাওলানা ছফিউল্লাহ এর প্রতিবাদে আর কিছু বলেননি। এদিকে মসজিদের ইমাম মাওলানা সাইদুর রহমান মাওলানা ছফিউল্লাহকে কিতাবাদি দিয়ে সাহায্য করতে থাকেন। তিনি তাঁকে ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ কিতাবটি পড়ার জন্য দিলেন। যাহোক কিতাবটি পাঠ করে মাওলানা ছফিউল্লাহ শবেবরাত সম্পর্কে খুব শক্ত দলীল পেলেন। ওদিকে মুন্সির বক্তব্যের পর সমাজে মাওলানা ছফিউল্লাহর বিরুদ্ধে নারী-পুরুষদের গালি গালাজ তো সীমা অতিক্রম করছে। এমনকি মাওলানা ছফিউল্লাহর বংশের এক মহিলা বলল, ‘আরে সে তো দজ্জাল হয়ে এসেছে এবং বলতেছে শবেবরাত উঠাইছে, কয়দিন পরে ছালাত ছিয়াম সব উঠিয়ে দিবে’। এর মাঝেই ছফিউল্লাহ সাহেবের সাথে এলাকার মোল্লা-মুন্সিদের তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে সুলতান সরদার সাহেব আবার উদ্যোগ নিলেন বাহাছ করার জন্য। বাহাছ হবে মাদরাসায়। নির্ধারিত সময়ে সবাই মাদরাসায় উপস্থিত হল। সুলতান সরদার মাওলানা ছফিউল্লাহকে কানে কানে বললেন, ভাতিজা! তুমি যে এগুলো বলছ তার প্রমাণ দিতে পারবা? এই ফৎওয়ার উপর অটল থাকতে পারবা? মানুষ যে তোমাকে গালাগালি করে, আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, আমি যা বলেছি সব দলীল ভিত্তিকই বলেছি। আপনি চিন্তা করবেন না। তখন সরদার সাহেব মনে একটি বল পেলেন কিন্তু প্রকাশ্যে কিছুই বললেন না। তবে মানুষ একাধারে সব ছফিউল্লাহ সাহেবের বিরুদ্ধে। বাহাছের সময় হলো। মানুষ দল বেঁধে আসছে বাহাছ শোনার জন্য। অন্যান্য হুজুররাও বসেছে। আমাদের গ্রামের সর্দাররা সবাই আছেন। মাওলানা ছফিউল্লাহ সাহেব তার ছাত্রদেরকে সিরিয়াল ধরে দাঁড় করে দিলেন তাদের হাতে কিতাব দিয়ে। মাদরাসার মাঠে জমজমাট অবস্থা। বাহাছ শুরু হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাওলানা ছফিউল্লাহ সাহেব অনুভব করলেন যুবকশ্রেণীর শ্রোতারা সব তার পক্ষে। অবশেষে ছফিউল্লাহ সাহেবই বাহাসে বিজয়ী হলেন। তারপর মসজিদের ইমাম মাওলানা আলী আছগর তার বক্তব্য শুরু করলেন এবং বললেন, শবেবরাত নিয়ে ছফিউল্লাহর সাথে ১৫-২০ দিন তর্ক বির্তক হয়েছে আমাদের সাথে। শেষ পর্যন্ত আমি ছফিউল্লাহকে বলি যে, তুমিও কিতাব দেখ, আমরাও কিতাব দেখি। দেখার পর বুঝতে পারলাম ছফিউল্লাহ যা বলেছে সব ঠিকই বলেছে। এই কথা বলার পর বিরোধীদের চেহারা সব মলিন হয়ে গেল। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ হাত তালি দেয়া শুরু করল। পরিস্থিতি দেখে মনে হল অধিকাংশই গোপনে মাওলানা ছফিউল্লাহকে সমর্থন করত। তারপর সরদার সাহেব বিপক্ষের আলেমদেরকে খুব কোণঠাসা করলেন। প্রোগ্রাম শেষ হল। সবাই বাড়িতে চলে গেল। সেদিনের পর আমাদের গ্রাম থেকে শবেবরাত উঠে গেল আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর আরো অনেক শরী‘আত বিরোধী কাজে ছফিউল্লাহ সাহেব বাধা দিয়ে ছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। যেমন একদিন দুপুর বেলায় তিনি ভূঁইয়া বাড়ীতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন, এক ব্যক্তি এসেছে যে মানুষকে তাদের পীরের মুরীদ বানায়। ছফিউল্লাহ সাহেব তাদের কাছে গিয়ে বসলেন। মুরীদকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এইখানে কেন আসছ? সে বলল সিরাজ মাস্টারের কাছে। ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, সিরাজ মাস্টার তোমার কি হয়? সে বলল, আমার পীর ভাই। ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, পীর ভাই আবার কেমন ভাই, সহোদর ভাই, মামাত ভাই, ফুফাত ভাই, খালাত ভাই ইত্যাদি হয়, তবে কি তোমরা দু’জন এক পীরের ঘরে জন্ম নিয়েছ? তোমরা দু’জন কি এক পীরের সন্তান? তখন মুরীদ বলল, না আমরা দু’জন এক পীরের মুরীদ। এরপর ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, তোমরা মানুষকে কি শিখাও? সে ঘর থেকে একটা বই আনল। ছফিউল্লাহ সাহেব বইটি খুললেন, এরপর কিছুদূর পড়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পীর লিখেছে, ‘ফিল কোরআনে ক্বালাল্লাহ ক্বলবুন মু’মিনীন আরশুল্লাহ’ (অর্থাৎ কোরআনে বলছে মু’মিনের ক্বলবই আল্লাহর আরশ (নাউযুবিল্লাহ)। এই কথাটা কুরআনের কোন জায়গায় আছে বল। আমি একটু জানতে চাই। সে বলল, আমি তো কুরআন শরীফ পড়তে জানিনা। এই কথা বলার পরে ছফিউল্লাহ সাহেব রেগে বললেন, ঐ বেটা তুই পীরের মুরীদ হয়েছিস, কুরআন পড়তে জানিস না মানে? না পড়ে মানুষকে এইসব আবোল-তাবোল শিখাচ্ছিস? সে বলল, আমার পীর এইগুলো বলছে। ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, তোকে বলতে হবেই কারণ সব তুই জানিস। সে বলে, আমি জানি না, আমি কুরআন পড়তে জানি না। ছফিউল্লাহ সাহেব আবার বললেন, ‘তুই যখন মুরীদ, তখন তো তোর কাশফ থাকার কথা, তুই কাশফের মাধ্যমে চোখ বন্ধ করে তোর পীরকে বল। পীর যখন বলবে এই কথাগুলি কুরআনের কোন জায়াগায়, কত নাম্বার আয়াতে আছে, তখন তুই আমাকে বলবি। তোকে আজকে দেখাইতেই হবে, না দেখালে তোর অবস্থা খারাপ হবে’। তখন সে ভয়ে কাপা শুরু করল। ছফিউল্লাহ সাহেব বললেন, ‘কাপাকাপি চলবে না, আজকে তোর কলবে আরশ কোথায় আছে বাহির কর, না হলে আমি নিজেই তোর ক্বলবটা ফেড়ে বের করব। আল্লাহর আরশটা কোথায় আছে, তোর কলবে আল্লাহর আরশ আছে না?’ সে বলল, ‘আছে’। তখন ছফিউল্লাহ সাহেব আবার বললেন, ‘এখনই ক্বলবটা ফেড়ে বাহির কর নইলে আমি ফেড়ে বাহির করব’। এরই মধ্যে সে জায়গায় লোকজন ভীড় করেছে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত তাকে নাস্তানাবুদ করে ছফিউল্লাহ সাহেব তার বইটা নিয়ে গেলেন। পরে একজন তাকে বলল, এই ফকির এইখানে আর থাকবে না, আপনি তার বইটি দিয়ে দেন। ছফিউল্লাহ সাহেব বইটা দিয়ে দিলেন। ফকির চলে গেল। কিছু দিন পর সে আবার এসেছিল। জহির মাস্টার সাহেব তাকে কিছু প্রশ্ন করল। এই ফকির কোন উত্তর দিতে পারে নি। তারপর জহির মাস্টার সাহেব তাকে চড়-থাপ্পর মেরে বিদায় করে দিলেন।

উপরিউক্ত দুটি ঘটনায় মাওলানা ছফিউল্লাহ যে ধরণের সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, অনুরূপ ভূমিকা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে নেয়া অতীব প্রয়োজন। প্রতিটি গ্রামে যদি একজন যুবকও শিরক ও বিদ‘আতকে প্রতিরোধ করার জন্য সোচ্চার হন, তাওহীদ ও সুন্নাতের প্রচার ও প্রসারে যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে তাই নিয়ে আত্মনিয়োগ করেন, ইনশাআল্লাহ তাদের এই সাহসী প্রচেষ্টাতেই সমাজে একদিন পরিবর্তন সাধিত হবে। আমরা যে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সর্বক্ষেত্রে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার মাধ্যমেই জাতীয় জীবনে তাওহীদ ও সুন্নাতের যে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে, তা মোকাবেলা ও প্রতিহত করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। তাই তরুণ ও যুবক ভাইদের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন যৌবনের এই টগবগে রক্তকে আমরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্ত্তত করি। আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয়িত হোক রাসূল (ছাঃ) এর সুন্নাতের বিপ্লব সাধনে। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর মত নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী যুবসংগঠন সর্বদা আপনাদের জন্য প্রেরণাশক্তি হিসাবে থাকবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে এ দেশের বুকে আক্বীদা ও আমলের বিপ্লব এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের বিপ্লব সাধিত হবে, জাহান্নামের হাত থেকে মানুষ রেহাই পাবে-এটাই আমাদের একান্ত স্বপ্নসাধ। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: সুন্নাত
আরও