মুসলিম সমাজে প্রচলিত হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 2098 বার পঠিত

ভূমিকা : মানুষের জীবনধারার উপর নির্ভর করে একটি সমাজের সংস্কৃতি গড়ে উঠে। জাতিগত ভিন্নতার কারণে সংস্কৃতির ভিন্নতা দেখা যায়। আবার ভূ-রাজনৈতিক কোন্দলে এক জাতি অন্য জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করলে সাহিত্য-সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আরবী, হিন্দী, আফগানী ও সর্বশেষ ইংরেজরা এ বিশাল ভূখন্ড শাসন করার কারণে বাঙ্গালীর ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে এ সমস্ত জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির উপাদান অনুপ্রবেশ করেছে। যেমন- আফগানীদের মাধ্যমে ধর্মে হানাফী ও শিয়া মাযহাব এবং তাদের ভাষা ফার্সী হওয়ায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাপক ফার্সী শব্দ ঢুকে পড়েছে। অপরদিকে হিন্দু ও ইংরেজদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে। যে কোন ভাষার প্রবাদ-প্রবচন সে অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। শুধু লোকসংস্কৃতি নয় বরং মূল সাহিত্য ও সংস্কৃতিরও অংশ। দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হ’ল, বাংলাদেশের জনসমষ্টি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ওপার বাংলার হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির ছোঁয়ায় এদেশের ভাষা-সাহিত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দু ধর্মীয় আক্বীদা মিশে গেমে, যা কিনা মুসলমানদের ঈমান ও আক্বীদার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আলোচ্য প্রবন্ধে হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত অনুরূপ কিছু প্রবাদ-প্রবচন সম্পর্কে আমরা আলোচনা করবো, যা আমাদের ইসলামী চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হ’লেও অবচেতন মনে তা হরহামেশা ব্যবহার করে থাকি।

প্রবাদের সংঙ্গা : ‘প্রবাদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরম্পরাগত বাক্য, লোককথা, জনশ্রুতি। যে সব প্রাজ্ঞ উক্তি লোক পরম্পরায় জনশ্রুতিমূলকভাবে চলে আসছে, তা-ই প্রবাদ। প্রবাদ সম্পর্কে বলা হচ্ছে ‘A proverb is a saying, usually short, that expresses a general truth about life.’ অর্থাৎ প্রবাদ হ’ল সংক্ষিপ্ত একটি উক্তি, যা জীবন সম্পর্কে সাধারণ কোন সত্যকে ব্যক্ত করে। পন্ডিত আর্চার টেলর বলেন, ‘A proverb is a terse didactic statement that is current in tradition or, as an epigram says, the wisdom of many and the wit of one.’ অর্থাৎ প্রবাদ হ’ল প্রচলিত ঐতিহ্যগত নীতিশিক্ষামূলক সংক্ষিপ্ত উক্তি অথবা যেমনটি একটি সরস ক্ষুদ্র কবিতায় বলা হয়েছে, এটা হ’ল বহুজনের প্রজ্ঞা ও একজনের বুদ্ধিদীপ্ততার প্রকাশ’।[1]

সুতরাং প্রবাদ বলতে এমন কতক বাক্যাংশকে বোঝায়, যা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বহু বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ সংক্ষিপ্ত কথন, যে কথনের আড়ালে শিক্ষামূলক নিগূঢ় অর্থ বিদ্যমান এবং তা দ্বারা মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রবচন প্রবাদের সমার্থক শব্দ। শব্দগত দিক থেকে প্রবাদ ও প্রবচনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু বাক্যে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্রবাদ রূপক অর্থবোধক কিন্তু প্রবচনের শাব্দিক অর্থ রয়েছে। এ উভয় প্রকারই বাংলার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত।

হিন্দুদের পূরাণ, মহাভারত ও রামায়ণের নানা ঘটনা থেকে অনেক প্রবাদের জন্ম। এ পর্বে মহাভারতের চরিত্র ও ঘটনা প্রবাহকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত প্রবাদের জন্ম হয়েছে সেগুলো উপস্থাপন করা হ’ল-

(১) মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? : ‘মহাভারত’ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রসিদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। হিন্দুরা গ্রন্থটিকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিশ্বাস করলেও মূলত এটি ইতিহাস বিষয়ক প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ। মূল গ্রন্থটি ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গুপ্ত যুগে ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস বা ব্যাসদেব কর্তৃক লিখিত বলে দাবী করা হয়। সংস্কৃত ভাষায় রচিত আঠারো পর্বের লক্ষাধিক শ্লোক ও গদ্যাংশ সমৃদ্ধ ‘ভরত’ নামক রাজার রাজবংশের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে বলে একে মহাভারত বলা হয়। এ গ্রন্থের মূল উপজীব্য বিষয় কৌরব ও পান্ডব বংশের মর্মান্তিক গৃহযুদ্ধ।[2] উক্ত ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক সম্পূরক বহু কাল্পনিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেজন্য গ্রন্থটি আদৌ ধর্মগ্রন্থ নাকি রূপকথাভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। আমরা কথা প্রসঙ্গে রাগ কিংবা অভিমানে প্রায়শ বলি ‘তুমি আসলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’ অর্থাৎ তোমার আসার কারণে মহাভারতের মত পবিত্র কিতাব অশুদ্ধ হয়ে তো ধর্ম নষ্ট হবে না। অর্থাৎ বিরাট ক্ষতি হয়ে যাওয়া বোঝাতে আমরা প্রবাদটি ব্যবহার করি। এই প্রবাদটি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমরা যেন মহাভারতকেই শুদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবেই সমর্থন দিচ্ছি। অথচ খোদ হিন্দু পন্ডিতরাই গ্রন্থটির শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা বা এর ধর্মীয় মর্যাদা নিয়ে সন্দিহান। সেখানে মুসলিমদের মহাভারতের উপমা ব্যবহার করা অবশ্যই চরম অজ্ঞতা পরিচায়ক। আর ইসলামী আক্বীদার সাথে সাংঘর্ষিক তো বটেই।

(২) ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা : দেবব্রত ভীষ্ম মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুরু বংশের পঞ্চম পুরুষ ভীষ্মের পিতা হস্তিনাপুর (হিন্দুদের মতে, বর্তমান দিল্লি) রাজা শান্তনু এবং মাতা দেবী গঙ্গা (ভারতের গঙ্গা নদীর দেবী)। ভীষ্ম তাদের একমাত্র জীবিত অষ্টম সন্তান। ভীষ্ম শিক্ষা-দীক্ষা ও অস্ত্র বিদ্যায় তৎকালীন সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। রাজা শান্তনু ভীষ্মকে যুবরাজ পদে বহাল করেন। তার চার বছর পরে একদিন শান্তনু বনে ঘুরতে গিয়ে যমুনার তীরে রাজা উপরিচরের কন্যা সত্যবতীকে পেয়ে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সত্যবতীর পিতা শর্ত দেন যে, যদি তার কন্যার গর্ভজাত পুত্র সন্তানকে পরবর্তীতে রাজা করার প্রতিশ্রুতি দেন, তবেই তিনি বিবাহ দিবেন। শান্তনু এ প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রাজ্যে ফিরে আসেন। কারণ নিয়মানুযায়ী যুবরাজ দেবব্রতের বংশধররাই পরবর্তীতে রাজা হওয়ার অধিকার রাখে। দেবব্রত বিষয়টি জানতে পেরে সত্যবতীর পালিত পিতা দাসরাজের কাছে যান। পিতার প্রতি পরম ভক্তির কারণে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, সে মৃত্যু অবধি কখনো রাজ্য দাবি করবে না এবং বিবাহ করবে না। এই আত্মত্যাগের জন্য শান্তনু ভীষ্মকে ইচ্ছা মৃত্যুর বর প্রদান করেন’।[3] পরবর্তীতে শান্তনুর সাথে সত্যবতীর বিয়ে হয় এবং চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্র জন্ম লাভ করে’।[4] ভীষ্মের এই প্রতিশ্রুতি ইতিহাসে ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ হিসাবে প্রসিদ্ধি পায়। এই ঘটনার কারণে কঠিন পণ বা প্রতিজ্ঞা বোঝাতে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা প্রবাদটি চালু হয়।

(৩) শিখন্ডী খাড়া করা : এ প্রবাদটির অর্থ যার আড়াল থেকে মন্দ কাজ করা যায়। এ প্রবাদের পেছনেও মহাভারতে বর্ণিত লম্বা কাহিনী রয়েছে। সেটা হ’ল- ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তার সৎ ভাই চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসায়। কিন্তু কিছুকাল পরেই এক যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। এরপর চিত্রাঙ্গদের ছোট ভাই বিচিত্রবীর্য রাজা হয়। একবার কাশী রাজ্যের রাজা তাঁর তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকাকে পাত্রস্থ করার জন্য স্বয়ংবর[5] সভার আয়োজন করেছিলেন। ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য সে সভায় গেলে তাকে অপমান করা হয়। এতে সে রাগান্বিত হয়ে কাশী রাজের তিন কন্যাকে জোর পূর্বক অপহরণ করে। অতঃপর অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হয়। কিন্তু বড় কন্যা অম্বা পিতাকে না জানিয়ে স্বয়ংবরের পূর্বেই শাল্ব দেশের রাজাকে বিবাহ করে। অম্বা ভীষ্মকে বিষয়টি জানালে তাকে শাল্বরাজের কাছে পাঠিয়ে দেয়’।[6]

কিন্তু শাল্ব আর তাকে গ্রহণ করে না। অপরদিকে ভীষ্ম চিরকুমার থাকবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন বিধায় অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করে। অপমানিত অম্বা ভীষ্মকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে দেবতা শীবের তপস্যা করে। শীব জানায় যেদিন ভীষ্মের মনে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে, সেদিন অম্বা তার মৃত্যুর কারণ হবে। এই বর পাবার পর অম্বা আগুনে ঝাপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। পরজন্মে (হিন্দুরা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আবার জন্মগ্রহণ করা যায়। একেই পরজন্ম বলা হয়।) সে পাঞ্চাল দেশের (মনে করা হয় ভারতের উত্তরাখন্ড ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ জুড়ে পাঞ্চাল দেশ ছিল) রাজা দ্রুপদের ঘরে শিখন্ডিণী নামে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে পুরুষ লিঙ্গ গ্রহণ করে শিখন্ডী নাম ধারণ করে। সে গল্পও অল্প বিস্তর নয়! যাইহোক মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুন (ভীষ্মের নাতি) বৃদ্ধ ভীষ্মের বীরত্বে পেরে উঠতে না পেরে দেবতা কৃষ্ণের পরামর্শে শিখন্ডীকে ভীষ্মের সামনে দাঁড় করায়। যৌবনে ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কোন নারীর উপর অস্ত্র উঠাবে না। সে প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে শিখন্ডীকে পূর্বজন্মের অম্বা ভেবে অস্ত্র ত্যাগ করে। ঠিক সে মুহূর্তে অর্জুনের ছুড়া তীরের আঘাতে ভীষ্ম ধরাশায়ী হয়’।[7]

এ ঘটনার আলোকে ‘শিখন্ডী খাড়া করা’ বলতে অন্যায় কাজ করার জন্য কাউকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা বোঝানো হয়।

(৪) অকাল কুষ্মান্ড : বাংলা অভিধান অনুযায়ী সংস্কৃত শব্দ কুষ্মান্ড অর্থ কুমড়া। অকাল কুষ্মান্ড অর্থ অসময়ে জন্ম নেওয়া কুমড়া অর্থাৎ অকেজো, অপদার্থ বা অযোগ্য ব্যক্তি। এ প্রবাদটির পেছনের গল্প মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র দুর্জধনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দুর্জধন ধৃতরাষ্ট্রের বড় সন্তান। ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র’।[8] গান্ধার দেশের রাজা সুবলের কন্যা গান্ধারীর সাথে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ হয় এবং কুন্তিভোজের রাজকন্যা কুন্তির সাথে পান্ডুর বিবাহ হয়। যৌবনে গান্ধারী দেবতা শিবের কাছ থেকে শত পুত্রের বর পেয়েছিলেন। কিন্তু বিবাহের পরে দুই বছর অতিক্রম হলেও গর্ভবতী গান্ধারীর কোন সন্তান হয় না। অপরদিকে কুন্তির প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠিরের জন্ম হলে হিংসায় গান্ধারী নিজ পেটে আঘাত করে গর্ভপাত ঘটায়। গর্ভপাতে লোহার মত শক্ত একটি মাংসপিন্ড বেরিয়ে আসে। গান্ধারী রাগে সে মাংসপিন্ড ফেলে দিতে উদ্যত হয়। এমন সময় ঋষি ব্যাস আবিভূর্ত হয়ে সে মাংসপিন্ডটি একশত খন্ড করে ঘিয়ে পরিপূর্ণ (সম্ভবত কুমড়া সদৃশ) পাত্রে রেখে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তার এক বছর পরে গান্ধারীর প্রথম সন্তান দুর্জধন, দুঃশলা নামে এক কন্যা এবং নিরানববই পুত্র পরপর জন্মগ্রহণ করে। ধৃতরাষ্ট্রের এ শত পুত্রের বংশকে কৌরব বলা হয়। মহাভারতের যুদ্ধে দুর্জধন পান্ডু পুত্রদের সাথে লড়াই করে নিজের বংশকে ধ্বংস করে। এ কারণে দুর্জধনকে অকালকুষ্মান্ড বা অপদার্থ বলা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অযোগ্য ব্যক্তিকে নির্দেশ করতে ‘অকালকুষ্মান্ড’ প্রবাদটি সমাজে প্রচলিত হয়’।[9]

(৫) সূর্যসন্তান : কুন্তিভোজের কন্যা কুন্তি যৌবনে ঋষি দূর্বাসার পরিচর্যা করায় দূর্বাসা মুনি খুশি হয়ে একটি মন্ত্র শিক্ষা দেন। যে মন্ত্রের মাধ্যমে কোন দেবতাকে আহবান করলে সে দেবতার দ্বারা সন্তান লাভ হবে। কুন্তি একদিন কৌতুহলবশত মন্ত্র পাঠ করে সূর্য দেবতাকে আহবান করে। এতে সূর্যদেবতার ঔরসে কর্ণ নামে এক সন্তানের জন্ম হয়। কুন্তি সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে নবজাতক সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই সন্তান হস্তিনাপুরের রাজ সারথী অধিরথের তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হয়। অতঃপর বিষ্ণুর ৬ষ্ঠ অবতার[10] পরশুরামের কাছে নিজের পরিচয় গোপন করে অস্ত্র বিদ্যা লাভ করে। কর্ণ স্বীয় প্রতিভাবলে বীরত্বে মহাভারতে খ্যাতি অর্জন করেছিল’।[11] সে সময়ে রথচালকদের তথা ক্ষত্রিয় ব্যতীত অন্যান্য নিচু জাতের মানুষদের অস্ত্র শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল এবং সামাজিকভাবে তাদের হেয় করা হত। কর্ণ সে সমাজে বড় হয়েছিল বিধায় সামাজিক জাত বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সারাজীবন সংগ্রাম করেছে। সেখান থেকেই মহাভারতের এই প্রবাদ পুরুষের বীরত্বকে উপজীব্য করে বর্তমান সময়ে সম্মানীত ব্যক্তিদের প্রশংসায় ‘সূর্য সন্তান’ প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।

(৬) ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির : রাজা পান্ডু তার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীকে নিয়ে বনে হরিণ শিকারে যায়। সেখানে কিমিন্দম মুনির অভিশাপে রাজা পান্ডু সন্তান জন্মদানে বাধাপ্রাপ্ত হয়’।[12] সে সময় পান্ডু কুন্তিকে মন্ত্র দ্বারা দেবতাকে আহবান করে সন্তান উৎপাদনের অনুমতি দেয়। কুন্তি দেবতা ধর্মকে আহবান করে। দেবতা ধর্মের ঔরসে যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়। এ কারণে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মপুত্র বলা হয়। যুধিষ্ঠির তাদের ধর্ম দেবতার মতই অত্যন্ত ধার্মিক ন্যায়পরায়ণ ও পরম সত্যবাদী ছিল। সেজন্য আমাদের সমাজে অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি বোঝাতে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির উপমাটি প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও কপট ব্যক্তি ধার্মিক লেবাস পরে ধার্মিকতা জাহির করলে তাকেও ব্যঙ্গ করে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির বা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলা হয়।

(৭) শকুনি মামা : শকুনি গান্ধার রাজ। সুবলের পুত্র এবং দুর্জধনের মামা। দুর্জধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিল বলে তার মাতা গান্ধারীও চোখে কাপড় বেঁধে মৃত্যু অবধি স্বামীর সাথে অন্ধ থাকার পণ করে। এতে শকুনি প্রতিশোধ নিতে গান্ধার ছেড়ে হস্তিনাপুরে বোন-ভগ্নিপতির রাজ্যে পড়ে থাকতো। শকুনি অত্যন্ত ধূর্ত, অসৎ ও কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ছিল। তার প্ররোচনাতেই কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্রের বংশ সমূলে নিঃশেষ হয়ে যায়। এজন্য কূটবুদ্ধি দিয়ে নিজ আত্মীয়ের মধ্যে গৃহবিবাদ বাধানো ব্যক্তিকে ‘শকুনি মামা’ বা নির্মম আত্মীয় বলা হয়।

(৮) কুরুক্ষেত্র কান্ড : ধারণা করা হয় কুরু ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যে অবস্থিত। কৌরব ও পান্ডবদের পূর্বপুরুষ রাজা কুরু উক্ত জায়গায় লাঙ্গল চাষ করতেন। তিনি বর পেয়েছিলেন যে, এ স্থানে মৃত্যুবরণকারী কিংবা তপস্যাকারী ব্যক্তি অবশ্যই স্বর্গে যাবে। সেই থেকে জায়গাটি কুরুক্ষেত্র নামে পরিচিত। এখানেই কুরু-পান্ডবদের মধ্যে মহাভারতের তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেজন্য মহাকলহ, ভীষণ যুদ্ধ বা ঝগড়াঝাটি বোঝাতে ‘কুরুক্ষেত্র কান্ড’ প্রবাদটি ব্যবহার হয়।[13]

(ক্রমশঃ)

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়


[1]. বাংলার প্রবাদ, ড. সুশীলকুমার দে (পত্র ভারতী প্রকাশনী, কলকাতা- ৭০০০০৯, ১ম সংস্করণ) ১-২ পৃ.।

[2]. https://bn.wikipedia.org/wiki/mahabharat.

[3]. বাংলা অভিধান অনুযায়ী বর অর্থ অলৌকিক উৎস থেকে ক্ষমতা লাভ। বরদান অর্থ অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা। ইচ্ছা মৃত্যুর বর দান বলতে ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী মারা যাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা বোঝায়। হিন্দু ধর্মে ঋষি, দেবতা ও পুণ্যবান ব্যক্তি বরদান প্রদান করেন।

[4]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, এম. সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ (কলকাতা- ৭০০০৭৩, ১৩তম মুদ্রণ : ১৪১৮ বাংলা), আদিপর্ব, ৪০-৪২ পৃ.।

[5]. যে অনুষ্ঠানে রাজকন্যা বিভিন্ন দেশের রাজা অথবা রাজকুমারদের মধ্য থেকে একজনকে পছন্দ করে বর মালা পরিয়ে বিবাহ করে তাকে স্বয়ংবর বলে।

[6]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, আদিপর্ব, ৪২-৪৩ পৃ.।

[7]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, ভীষ্ম পর্ব, ৪০৩-৪০৬ পৃ.।

[8]. এরা বিচিত্রবীর্যের ঔরসজাত নয়। সন্তান জন্মের আগেই বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মা রোগে মারা যায়। বংশ রক্ষার্থে তার মাতা সত্যবতীর বিবাহ বর্হিভূত সন্তান মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেবের ঔরসে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর জন্ম হত (মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, আদিপর্ব, ৪২-৪৩, ৪৮ পৃ.)।

[9]. প্রবাদ সংগ্রহ, শ্রীকানাই লাল ঘোষাল, ১৪ যুগল কিশোর দাস লেন, কলকাতা- ১৮৯০ খ্রীঃ, ৫ পৃ।

[10]. হিন্দু ধর্মে কোন দেবতা মানুষ রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে জন্ম নিলে তাকে অবতার বলা হয়।

[11]. মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, আদিপর্ব, ৪৭ পৃ.।

[12]. পান্ডু বনে মিলনরত একটি পুরুষ হরিণকে হত্যা করে। ঐ হরিণ দম্পতি ঋষি কিমিন্দম এবং তার স্ত্রী ছিল। সন্তান লাভের আশায় তারা হরিণ রূপ ধারণ করেছিল। ঋষি মৃত্যুর পূর্বে পান্ডুকে অভিশাপ দেয় যে, তুমিও যখন স্ত্রীর কাছে মিলনের আশায় যাবে তখনি তোমার মৃত্যু হবে। পরবর্তীতে কাম ভাব নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর কাছে যাওয়ায় পান্ডুর মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে দেবতা দ্বারা যুধিষ্ঠিরের জন্মের পরে পবনদেব ও দেবরাজ ইন্দ্রের মাধ্যমে যথাক্রমে ভীম ও অর্জুনের জন্ম হয়। পান্ডুর অপর স্ত্রী মাদ্রী একই পদ্ধতিতে নকুল ও সহদেব নামে দুই পুত্রের জন্ম দেয়। এদেরকেই পঞ্চ পান্ডব বলা হয়। এদের বংশই পান্ডব বংশ। মহাভারত, বঙ্গানুবাদ : রাজশেখর বসু, আদিপর্ব, ৫০-৫১ পৃ.।

[13]. প্রবাদের উৎস সন্ধান, সমর পাল (৩য় প্রকাশ : ২০১৬), ৪৯-৫০ পৃ.।



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও