দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন

প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব 241 বার পঠিত

(অবক্ষয় যুগ)

উত্তর ও পূর্ব ভারতে আহলেহাদীছ আন্দোলন (৬০২-১১১৪ হিঃ/১২০৬-১৭০৩ খৃঃ) :

সিন্ধু ও মালাবার উপকূলের ন্যায় দিল্লীতে ইসলাম আরব বণিক ও মুহাদ্দিছগণের মাধ্যমে আসেনি। বরং এখানে ইসলাম এসেছিল সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে। গযনীর শাসনকর্তা মুইয্যুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন সাম ওরফে সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরী (মৃঃ ৬০২/১২০৬ খৃঃ) ও তাঁর দুই সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবক ও ইখ্তিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিল্জী-এর মাধ্যমে দিল্লী হতে বাংলাদেশ পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ও পূর্বভারত বিজয় ও দিল্লীতে রাজধানী স্থাপনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। মুহাম্মাদ ঘোরীর তুর্কী গোলাম ও সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবক (৬০২-৬০৪/১২০৬-৮ খৃঃ)-এর হাতে প্রতিষ্ঠিত মামলূক সালতানাত-এর শাসকগণ নওমুসলিম তুর্কী হানাফী ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মধ্য এশিয়া হ’তে হানাফী আলিমগণ দিল্লীতে জমা হতে থাকেন। এমতাবস্থায় রাজধানী দিল্লী হতে যে ইসলাম উত্তর ও পূর্বে ভারতে প্রচারিত হয়, তা আলিমদের রায়নির্ভর ফেক্হী মাযহাবভিত্তিক ইসলাম ছিল বলা চলে। যাতে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তুর্কী, ইরানী, আফগান, মোগল ও ভারতীয় বহু কিছু সংস্কার। ছাহাবা, তাবেঈন ও মুহাদ্দিছগণের প্রচারিত বিশুদ্ধ ইসলামের সাথে তার বিস্তর প্রভেদ ছিল। এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে আবদুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১২৬৪-১৩০৪/১৮৪৮-১৮৮৬ খৃঃ) বলেন,.....‘ফিক্হ ব্যতীত লোকেরা কুরআন ও হাদীছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ...আহলেহাদীছদেরকেও তারা জানত না। কেউ কেউ ‘মিশকাত’ পড়লেও তা পড়ত ‘বরকত’ হাছিলের জন্য আমল করার জন্য নয়, বুঝবার জন্যও নয়। তাহকীকী তরীকায় নয় বরং তাকলীদী তরীকায় ফিক্হের জ্ঞান হাছিল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।...এই অবস্থা চলতে থাকে যতদিন না আল্লাহ পাক তাঁর খাছ মেহেরবাণীতে দশম শতাব্দী হিজরীতে কয়েকজন আলিমের মাধ্যমে ইলমে হাদীছকে পুনরুজ্জীবিত করেন।[1]

সুলায়মান নাদভী (১৩০২-১৩৭২/১৮৮৪-১৯৫৩) বলেন, ‘‘তুর্কী বিজয়ী যারা ভারতে এসেছিলেন, দু’চারজন সেনা অফিসার ও কর্মকর্তা বাদে তাদের কেউই না ইসলামের প্রতিনিধি ছিলেন, না তাদের শাসন ইসলামী নীতির উপরে পরিচালিত ছিল। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন নওমুসলিম তুর্কী ক্রীতদাস। ঘূরীগণ চতুর্থ শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত এবং মুগলগণ সপ্তম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি।.....এরা ছিলেন আরব বিজয়ীদের থেকে অনেক পৃথক যাদের মধ্যে ইসলাম জীবিত ছিল। যাদের মধ্যে অনেকেই ছাহাবী ছিলেন।[2]

ডঃ মুহাম্মাদ ইসহাক বলেন-‘এই সময় ভারতবর্ষের আলিমদের অধিকাংশ হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। যাদের সার্বিক মনোযোগ ফিক্হের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল, যা সরকারী চাকুরী লাভের জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত ছিল। তাদের মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কোন ফায়ছালা দেওয়ারও যোগ্যতা ছিলনা। হানাফী ফিক্হের আলোকেই তারা ইসলামী শরীয়তকে বিচার করতেন। এর প্রতিকূলে হাদীছ থাকলেও তারা ভীষণভাবে তার বিরোধিতা করতেন। এ ব্যাপারে দিল্লীর হানাফী আলেমদের সঙ্গে খ্যাতনামা ছূফী মুহাদ্দিছ নিযামুদ্দীন আউলিয়ার (৬৩৪-৭২৫/১২৩৬-১৩২৫ খৃঃ) যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়, তা খুবই প্রসিদ্ধ।[3] প্রাসংগিকভাবে উল্লেখ্য যে, শিক্ষার পাঠ্যসূচী হতে ইলমে হাদীছকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। খ্যাতনামা মিসরী মুহাদ্দিছ আলামা শামসুদ্দীন তুর্ক দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দীন খিল্জীর শাসনামলে (৬৯৬-৭১৬/১২৯৬-১৩১৬ খৃঃ) ৭০০/১৩০০ খৃষ্টাব্দে হাদীছ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ভারতে পদার্পন করেন। কিন্তু মুলতানে এসে তিনি জানতে পারেন যে, আলাউদ্দীন জুম‘আ-জামা‘আতে যোগদান করেন না। তিনি ছালাতে অভ্যস্ত নন। তিনি দুঃখিত মনে ফিরে যাওয়ার সময় আলাউদ্দীনকে একটি ছোট্ট হাদীছ-পুস্তিকা ও চিঠি লিখে যান। তাতে তিনি বলেন যে, ‘আলাউদ্দীনের যামানায় আলিমগণ ফিক্হে তা‘লীম দিয়ে থাকেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন।[4] এই সময়ে ভারতের ৪৬ জন শ্রেষ্ঠ আলিমের মধ্যে শামসুদ্দীন ইয়াহইয়ার (মৃঃ ৭৪৭/১৩৪৬ খৃঃ) মধ্যেই কেবল ইল্মে হাদীছের প্রতি কিছুটা আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।[5] সম্ভবতঃ আলিমগণ এ সময় হাদীছের অধ্যয়নের চেয়ে ফিক্হের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন।

উপরোক্ত রাজনৈতিক অনুদারতার সাথে সাথে হাদীছ গ্রন্থের দুষ্প্রাপ্যতা ও অপ্রতুলতা ইলমের প্রসারে ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রগতির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল। বিভিন্ন হাদীছগ্রন্থের ভারতবর্ষে প্রবেশের সময়কাল হতে বিষয়টি আঁচ করা চলে। যেমন-

(১) মাশারেকুল আন্ওয়ার : হিন্দুস্থানী মুহাদ্দিছ ইমাম রাযিউদ্দীন হাসান বিন মুহাম্মাদ ছাগানী লাহোরী (৫৭৭-৬৫০/১১৮২-১২৫২ খৃঃ) সংকলিত এই হাদীছগ্রন্থ সপ্তম শতাব্দী হিজরীর মধ্যভাগে দিল্লীতে আসে। মুহাম্মাদ তুগলকের সময়ে (৭২৫-৫২/১৩২৫-৫১ খৃঃ) দিল্লীতে এর একটি মাত্র কপি মওজুদ ছিল। সুলতান তার রাজকর্মচারীদেরকে পবিত্র কুরআন ও ‘মাশারেকুল আনওয়ার’ স্পর্শ করে আনুগত্যের শপথ নিতেন।

(২) সুনানে আবুদাঊদ : সুলতান নাছীরুদ্দীন মাহমূদ (৬৪৪-৬৪/১২৪৬-৬৬ খৃঃ)-এর সময়ে প্রণীত ‘ত্ববাক্বাতে নাছীরী’-তেই সর্বপ্রথম সুনানে আবু দাঊদ হ’তে উদ্ধৃতি দেখতে পাওয়া যায়। এতে আন্দাজ করা যায় যে, সপ্তম শতাব্দী হিজরীর মধ্যভাগে উক্ত হাদীছগ্রন্থ দিল্লীতে মওজুদ ছিল। কিন্তু পরে আর সন্ধান মেলেনি।

(৩) ছহীহায়েন : সপ্তম শতাব্দী হিজরীর শেষভাগে আল্লামা শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বুখারীর (মৃঃ ৭০০/১৩০০ খৃঃ) মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে ছহীহায়েনের দরস শুরু হয়। তাঁর নিকট থেকে খ্যাতনামা ছাত্র ও জামাতা বিহারের শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুনীরী (৬৬১-৭৮২/১২৬৩-১৩৮০ খৃঃ) উহা প্রাপ্ত হন।

(৪) মাছাবীহ : জালালুদ্দীন বুখারী (মৃঃ ৭৮৫/১৩৮২) দিল্ল­ীতে উক্ত কিতাব থেকে হাদীছের দরস দিতেন। বিহারের মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুনীরীর (৬৬১-৭৮২/১২৬৩-১৩৮০) গ্রন্থসমূহে উক্ত কিতাবের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এতে বুঝা যায় যে, অষ্টম শতাব্দী হিজরীর মাঝামাঝি নাগাদ ইমাম মুহিউস্ সুন্নাহ বাগাভী (৪৩৬-৫১৬/১০৫৩-১১১৫ খৃঃ) সংকলিত এই হাদীছগ্রন্থ অষ্টম শতাব্দী হিজরীতে মুহাদ্দিছ আমীর কাবীর আলী বিন শিহাব হামাদানীর (৭১৪-৮৬/১৩১৪-৮৪ খৃঃ) মাধ্যমে কাশ্মীরে আনীত হয়।

(৬) শারহু মা‘আনিল আছার : আবু জা‘ফর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ মিসরী ত্বাহাভী (২৩৯-৩২/৮৫৩-৯৩৩ খৃঃ) সংকলিত এই হাদীছগ্রন্থ সর্বপ্রথম ফীরোয শাহ তুগলকের সময়ে (৭৫২-৭৯০/১৩৫০-১৩৮৮ খৃঃ) অষ্টম শতাব্দী হিজরীর শেষভাগে ভারতে পরিদৃষ্ট হয়।

(৭) মিশকাতুল মাছাবীহ : অলিউদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ তাবরেযী (মৃঃ ৭৩৭ হিজরীর পরে) সম্পাদিত ভারতবর্ষে বহুল প্রচলিত এই হাদীছ সংকলন নবম শতাব্দী হিজরীতে সর্বপ্রথম জৌনপুরের লাইব্রেরীতে দেখতে পাওয়া যায়।

(৮) সুনানে আরবা‘আহ, বায়হাক্বী ও হাকেম : বিহারের হুসাইন বিন মুইয ‘নওশাহে তাওহীদ’ (মৃঃ ৮৪৪/১৪৪১ খৃঃ) স্বীয় লাইব্রেরীর জন্য হেজায হ’তে উক্ত কিতাবসমূহ আনিয়ে নেন। ফলে এইসব কিতাব ভারতবর্ষে নবম শতাব্দী হিজরীতে আগমন করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।[6]


[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ, পৃঃ ২২৯-২৩২]


১. ‘জুহুদ মুখ্লিছাহ’ পৃঃ ৩৭।

২. ‘আরব ও হিন্দ কে তা‘আল্লুকাত’ (সংক্ষেপায়িত) পৃঃ ১৮৭-৯০।

৩. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৭৯। আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষৌভী (১৮৪৮-১৮৮৬ খৃঃ ) বর্ণিত ঘটনাটি সংক্ষেপে নিম্নরূপ- নিযামুদ্দীন আউলিয়া ‘সামা’ (এক প্রকার মারফতী গান) শুনতেন ও তা মুবাহ মনে করতেন। এ ব্যাপারে তিনি ইমাম গায্যালীর (১০৫৮-১১১১ খৃঃ) ‘এহইয়াউল উলূমে’ বর্ণিত হাদীছ থেকে দলীল নিয়েছিলেন। তবে ওটা যে মূলতঃ হাদীছ নয়, সেটা তিনি পরে বুঝতে পারেন ও মত পরিবর্তন করেন। যাই হোক হাদীছ ভেবেই তিনি দিল্লীর সুলতান গিয়াছুদ্দীন তুঘলক (১৩৮৮-৮৯)এর দরবারে অনুষ্ঠিত বিতর্কসভায় প্রতিপক্ষ আলিমদের জওয়াবে সেটা পেশ করেন। এতে আলেমগণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন-‘হিন্দুস্তানে হাদীছের চেয়ে ফিকহের আইনগত গুরুত্ব বেশী। তাদের কেউ কেউ বললেন, ‘ঐ সব হাদীছ আমরা শুনতে চাই না, যা আমাদের মাযহাবের শত্রু ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ খ্রিঃ) গ্রহণ করেছেন। তারা এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফার (৮০-১৫০ খ্রিঃ) রায় তলব করেন। তখন শায়খ ব্যথিত হয়ে বলেন, ‘সেই দেশে মুসলিম কতদিন টিকে থাকবে, যেদেশে একজন ব্যক্তির রায়কে হাদীছের উপরে প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে? তিনি বলেন, ‘সুবহানাল্লাহ! আমি তোমাদের কাছে রাসূলের (ছাঃ) হাদীছ বর্ণনা করছি, আর তোমরা আমার কাছে আবু হানিফার উক্তি দাবী করছ? (ইলমে হাদীছ পৃঃ ৭৯, জুহুদ মুখলিছাহ (আরবী) পৃঃ ৩৮)

৪. ‘ইল্মে হাদীছ’ পৃঃ ৭৩-৭৫।

৫. প্রাগুক্ত পৃঃ ৭৫।

৬. প্রাগুক্ত পৃঃ ৯৫-৯৮।



বিষয়সমূহ: সংগঠন
আরও