ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 571 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

১-إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ-

(১) ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)।

২- وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا-

(২) ‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নে‘মতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিলেন। তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।

৩- وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ-

(৩) তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর না’ (মায়েদাহ ৫/২)।

৪- وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَى سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ-

(৪) (দুনিয়াতে) তাদের পরস্পরের অন্তরে যে বিদ্বেষ ছিল তা আমরা দূর করে দেব। ফলে তারা ভাই ভাই হয়ে পরস্পরে মুখোমুখি আসনে বসবে’ (হিজর ১৫/৪৭)

হাদীছের বাণী :

৫- عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَظْلِمُهُ، وَلَا يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-

(৫) ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন’।[1]

৬- عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَبَسُّمُكَ فِى وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ-

(৬) আবু যর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য ছাদাক্বা স্বরূপ’।[2]

৭- عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَجُلاً جَاءَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ؟ وَأَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعَهُمْ لِلنَّاسِ، وَأَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ سُرُورٍ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ، أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً، أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دِينًا، أَوْ تُطْرَدُ عَنْهُ جُوعًا، وَلِأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخٍ لِي فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ، يَعْنِي مَسْجِدَ الْمَدِينَةِ، شَهْرًا، وَمَنْ كَفَّ غَضَبَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ، وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ، مَلَأَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ قَلْبَهُ أَمْنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ مَشَى مَعَ أَخِيهِ فِي حَاجَةٍ حَتَّى أَثْبَتَهَا لَهُ أَثْبَتَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ قَدَمَهُ عَلَى الصِّرَاطِ يَوْمَ تَزِلُّ فِيهِ الْأَقْدَامُ-

(৭) আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এ নিকটে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হ’ল সে যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশী উপকারী। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হ’ল, একজন মুসলিমের হৃদয়কে খুশীতে পরিপূর্ণ করা অথবা তার কোন কষ্ট দূর করে দেওয়া অথবা তার পক্ষ থেকে তার ঋণ আদায় করে দেওয়া অথবা তার ক্ষুধা দূর করে দেওয়া। এই মসজিদে (নববীতে) একমাস ই’তিকাফ করার চাইতে মুসলিম ভাইয়ের কোন প্রয়োজন মিটাতে যাওয়া আমার নিকট অধিক পসন্দনীয়। যে ব্যক্তি নিজ ক্রোধ সংবরণ করে নিবে, আল্লাহ তার দোষ গোপন করে নিবেন। যে ব্যক্তি নিজ রাগ সামলে নিবে; অথচ সে ইচ্ছা করলে তা প্রয়োগ করতে পারত, সে ব্যক্তির হৃদয়কে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন সন্তুষ্ট করবেন। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যাবে এবং তা পূরণ করে দিবে, আল্লাহ সেদিন তার পদযুগলকে সুদৃঢ় রাখবেন, যেদিন পদযুগল পিছলে যাবে’।[3]

৮- عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قَالَ لِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ-

(৮) আবু যর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, ভাল কাজের কোনটাকেই তুচ্ছ মনে করবে না। যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎও হয়’।[4]

৯- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّ رَجُلًا زَارَ أَخًا لَهُ فِي قَرْيَةٍ أُخْرَى، فَأَرْصَدَ اللهُ لَهُ، عَلَى مَدْرَجَتِهِ، مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ، قَالَ: أَيْنَ تُرِيدُ؟ قَالَ: أُرِيدُ أَخًا لِي فِي هَذِهِ الْقَرْيَةِ، قَالَ: هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا؟ قَالَ: لَا، غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، قَالَ: فَإِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكَ، بِأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ-

(৯) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’ল। সে আরেক গ্রামে থাকে। আল্লাহ রাস্তায় তার অপেক্ষায় একজন ফেরেশতা বসিয়ে দিলেন। সে যখন সেখানে পৌঁছল, ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে ইচ্ছা করেছ? সে বলল, ঐ গ্রামে আমার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে। ফেরেশতা বলল, তার কাছে তোমার কোন পাওনা আছে যে, তুমি তা আনবে? সে বলল, না, আমি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাকে ভালবাসি। তখন ফেরেশতা বলল, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ তোমাকে এ সুসংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহর তোমাকে অনুরূপ ভালবাসেন, যেরূপ তুমি তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবেসেছ’।[5]

১০- عَنْ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَرَى المُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ، كَمَثَلِ الجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالحُمَّى-

(১০) নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তুমি ঈমানদারদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন সমস্ত

শরীর তজ্জন্য বিনিদ্র ও জ্বরে আক্রান্ত হয়’।[6]

১১- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلاَلِى الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِى ظِلِّى يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلِّى-

(১১) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন সকলকে ডেকে বলবেন, আমার সম্মানে পরস্পরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ কোথায়? আজ আমি তাদেরকে ছায়া দেব আমার ছায়াতলে। যেদিন কোন ছায়া নেই আমার ছায়া ব্যতীত’।[7]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. ইয়াহইয়া ইবনু মু‘আয বলেন, তোমার ভাই তো সে যে তোমার ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেয়। আর তোমার বন্ধু তো সে যে তোমাকে পাপ থেকে সতর্ক করে’।[8]

২. ওমর (রাঃ) বলেন, তুমি বিশ্বস্ত ভ্রাতৃত্ব তৈরী কর। আর তাদের সাথে জীবন-যাপন কর। কেননা সুখের সময় তারা তোমাকে আনন্দিত করবে এবং কষ্টের সময় তোমার পাশে দাঁড়াবে’।[9]

৩. আবু কিলাবা (রহঃ) বলেন, যখন তোমার কাছে তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু সংবাদ আসে যা তুমি অপছন্দ করে তখন এর কারণ অনুসন্ধান কর। যদি তুমি কোন কারণ না পাও তাহ’লে বল হয়তো আমি তার সেই কারণ সম্পর্কে জানিনা যার জন্য এমনটি হয়েছে’।[10]

৪. হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, আমি দ্বীনী ভ্রাতৃত্বকে আমার পরিবার ও সন্তানের চেয়ে বেশি ভালবাসি। কেননা আমার পরিবার আমার সাথে দুনিয়াবী বিষয়ে আলোচনা করে। আর দ্বীনী ভাইয়েরা আমার সাথে পরকালীন জীবন নিয়ে আলোচনা করে’।[11] 

সারবস্ত্ত :

১. ইসলামী ভ্রাতৃত্ব হ’তে হবে, এক দেহ এক প্রাণের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ ব্যথিত হ’লে সমস্ত অঙ্গ ব্যথিত হয়।

২. ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষার্থে নিজেদের মাঝে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে।

৩. নিজের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাতে ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হবে।

৪. পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য হ’তে হবে, যাতে ক্বিয়ামতের মাঠে আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ করা যায়। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে সুদৃঢ় ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন নাজাত দান করুন।-আমীন!


[1]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।

[2]. তিরমিযী হা/১৯৫৬; ছহীহাহ হা/৫৭২; মিশকাত হা/১৯১১।

[3]. ত্বাবারানী, আল-আওসাত্ব; ছহীহুত তারগীব হা/২৬২৩; ছহীহাহ হা/৯০৬

[4]. মুসলিম হা/২৬২৬; মিশকাত হা/১৮৯৪

[5]. মুসলিম হা/২৫৬৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫৭২; আহমাদ হা/৯২৯১।

[6]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৩।

[7]. মুসলিম হা/২৫৬৬; মিশকাত হা/৫০০৬।

[8]. আল-ফাওয়ায়ে ওয়ালা আখবার ওয়ার হেকায়াহ ১৪৮ পৃ.।

[9]. ইখওয়ান, ইবনু আবীদ দুনইয়া ৩৫ পৃ.।

[10]. রওযাতুল উক্বালা ২৪৮ পৃ.।

[11]. আর-রাক্বায়েক্ব পৃ.৮০।



বিষয়সমূহ: ইসলামের সৌন্দর্য
আরও