দুশ্চিন্তা

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 261 বার পঠিত

আল-কুরআনুল কারীম :

১- وَلَا تَهِنُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَنتُمُ ٱلْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ-

(১) ‘আর তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)

২- أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ- الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ- لَهُمُ الْبُشْرٰى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِيْ الْآخِرَةِ لَا تَبْدِيْلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ-

(২) ‘মনে রেখ (আখেরাতে) আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না। যারা ঈমান আনে ও সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে। তাদের জন্যই সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর বাণীসমূহের কোন পরিবর্তন নেই। আর (মুমিনের জন্য) এটাই হ’ল বড় সফলতা’ (ইউনুস ১০/৬২-৬৪)

৩- إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ-

(৩) ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর তার উপর দৃঢ় থাকে, তাদের উপর ফেরেশতামন্ডলী নাযিল হয় এবং বলে যে, তোমরা ভয় পেয়ো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)

৪- الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُوْنَ مَا أَنْفَقُوْا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ-

(৪) ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর সেজন্য পরে কোন খোটা দেয় না বা কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে অঢেল পুরস্কার। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬২)

৫- فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ-

(৫) ‘অতঃপর যখন আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে কোন হেদায়াত পৌঁছবে, তখন যারা আমার হেদায়াতের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৩৮)

৬- الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ-

(৬) ‘যারা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে রাত্রে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৪)

৭- إِلَّا تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِيْ الْغَارِ إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَمْ تَرَوْهَا-

(৭) ‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন তাকে কাফেররা (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছিল এবং সে ছিল (ছওর) গিরিগুহার মধ্যে দু’জনের একজন। যখন সে তার সাথীকে বলল, চিন্তিত হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন ও তাকে এমন সেনাদল দিয়ে সাহায্য করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখোনি’ (তওবা ৯/৪০)

৮- وَذَا النُّوْنِ إِذْ ذَهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ- فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِيْ الْمُؤْمِنِيْنَ-

(৮) ‘আর (স্মরণ কর) মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা। যখন সে ক্রুদ্ধ অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তাকে কোন কষ্টে ফেলব না। অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আর নিশ্চয়ই আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর আমরা তার দো‘আ কবুল করলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৮৭-৮৮)

হাদীছের বাণী :

১০- عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ وَ عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ - صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا يُصِيْبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلاَّ كَفَّرَ اللهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ-

(১০) আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল যাতনা, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন’।[1]

(১১) আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, নবী করীম (ছাঃ) আবু ত্বালহাকে বলেন, তোমাদের ছেলেদের মধ্য থেকে একটি ছেলে খুঁজে আন, যে আমার খেদমত করতে পারে। এমনকি তাকে আমি খায়বারেও নিয়ে যেতে পারি। অতঃপর আবু ত্বালহা (রাঃ) আমাকে তার সাওয়ারীর পেছনে বসিয়ে নিয়ে চললেন। আমি তখন প্রায় সাবালক। আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর খেদমত করতে লাগলাম। তিনি যখন অবতরণ করতেন, তখন প্রায়ই তাকে এই দো‘আ পড়তে শুনতাম, اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ، ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণভার ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার নিকট পানাহ চাচ্ছি’।[2]

(১২) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে বান্দা যখন দুশ্চিন্তা ও পেরেশানীতে পতিত হয়ে বলে,اَللَّهُمَّ إِنِّى عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ نَاصِيَتِى بِيَدِكَ مَاضٍ فِىَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِىَّ قَضَاؤُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِىْ كِتَابِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِىْ عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيْعَ قَلْبِىْ وَنُوْرَ صَدْرِى وَجَلاَءَ حُزْنِىْ وَذَهَابَ هَمِّىْ- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার এক বান্দা ও এক বান্দীর পুত্র। আমার কপাল তোমার হাতে। আমার ব্যাপারে তোমার হুকুম কার্যকর। আমার ব্যাপারে তোমার ফয়ছালা ইনছাফপূর্ণ। আমি তোমার সেই প্রত্যেক নামের অসীলা দিয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যে নামের মাধ্যমে তুমি নিজের নামকরণ করেছ বা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছ বা তোমার কোন বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছ অথবা যে নামগুলোকে তুমি নিজের জ্ঞান ভান্ডারে সংরক্ষিত করে রেখেছ, কুরআনকে আমার অন্তরের প্রশান্তি, বক্ষের নূর, দুশ্চিন্তা এবং পেরেশানী বিদূরিত হওয়ার মাধ্যমে পরিণত করে দাও’। যে ব্যক্তি এই দো‘আ পাঠ করবে, আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে আনন্দ ও খুশীর দ্বারা সেই স্থানকে পরিপূর্ণ করে দিবেন’।[3]

১৩- عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها أَنَّهَا كَانَتْ تَأْمُرُ بِالتَّلْبِيْنِ لِلْمَرِيْضِ وَلِلْمَحْزُوْنِ عَلَى الْهَالِكِ، وَكَانَتْ تَقُوْلُ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ- صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ إِنَّ التَّلْبِيْنَةَ تُجِمُّ فُؤَادَ الْمَرِيْضِ، وَتَذْهَبُ بِبَعْضِ الْحُزْن-

(১৩) আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রোগীকে এবং কারো মৃত্যুজনিত শোকাহত ব্যক্তিকে তরল জাতীয় খাদ্য খাওয়ানোর আদেশ করতেন। তিনি বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তালবীনা’ রোগীর কলিজা মযবূত করে এবং নানাবিধ দুশ্চিন্তা দূর করে’।[4]

মনীষীদের বক্তব্য :

১. মালেক ইবনু দীনার (রহঃ) বলেন, ‘আখেরাতের ব্যাপারে তুমি যতটুকু চিন্তা-ভাবনা করবে, সে পরিমাণ পার্থিব দুশ্চিন্তা তোমার হৃদয় থেকে বের হয়ে যাবে’।[5]

২. আবুল লায়েছ সমরকান্দী (রহঃ) বলেন, তিনটি বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না। (১) দরিদ্রতা সম্পর্কে চিন্তা করবে না, তাহ’লে তোমার দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা বেড়ে যাবে এবং লোভ-লালসা বৃদ্ধি পাবে। (২) যালেমের যুলুম সম্পর্কে তুমি চিন্তা করবে না, তাহ’লে তোমার অন্তর শক্ত হয়ে যাবে, হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে এবং তোমার রাগ স্থায়ী রূপ নিবে। (৩) দুনিয়াতে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকা নিয়ে চিন্তা করবে না, তাহ’লে তুমি সম্পদ সঞ্চয়ে উদ্গ্রীব হয়ে পড়বে, সময় নষ্ট করবে এবং আমল সম্পাদনে বিলম্ব করবে’।[6]

৩. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, প্রত্যেক জাতির সাধারণ মানুষ ও জ্ঞানীজন এ কথায় একমত যে, পাপ-পঙ্কিলতা ও ফিৎনা-ফাসাদে জড়িয়ে পড়ার ফলে মানুষের মনে দুশ্চিন্তা, পেরেশানি, ভয়-ভীতি, দুঃখ-বেদনা, মানসিক সংকীর্ণতা, অন্তরের রোগ ইত্যাদির জন্ম হয়’।[7]

সারবস্ত্ত :

১. নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা তাক্বদীরকে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং তাক্বদীরে বিশ্বাসই দুশ্চিন্তা দূর করতে পারে।

২. কারণে-অকারণে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, উৎকণ্ঠা, দুঃখ, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতির কারণে নানাবিধ রোগ-ব্যধি শরীরে ও অন্তরে বাসা বাঁধে।

৩. দুশ্চিন্তা ছওয়াবকে বিনষ্ট করে এবং এর দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা সকল মুমিনকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক দান করুন।-আমীন!


[1]. বুখারী হা/৫৬৪১; মিশকাত হা/১৫৩৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮১৮।

[2]. বুখারী হা/২৮৯৩ ‘জিহাদ ও যুদ্ধকালীন আচার ব্যবহার’ অধ্যায়-৫৬।

[3]. আহমাদ হা/৩৭৮৪; ছহীহাহ হা/১৯৯; ছহীহুত তারগীব হা/১৮২২।

[4]. বুখারী হা/৫৬৮৯ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, ‘রোগীর জন্য তালবীনা’ অনুচ্ছেদ।

[5]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহ্দ ২৫৯ পৃ.।

[6]. আবুল লায়েছ সমরকান্দী, তাম্বীহুল গাফেলীন ৫৭২ পৃ.।

[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আত্ব-ত্বীববুন্নাবী ১/১৫৫ পৃ.।



আরও