ঈমানের জোর!

প্রলয় হাসান 184 বার পঠিত

আমার এক স্কুল জীবনের বন্ধুর বড় ভাইয়ের দুইটা দোকান ছিল বঙ্গবাজারে। দুইটাতে কাপড় ছিল প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকার মত। দুইটাই পুড়ে ছাই। ভাই বেশ কয়েক বছর হ’ল কাপড়ের ব্যবসা করে বেশ ধনী হয়েছেন। ইসলামপুরেও তার দুইটা দোকান আছে। এখন সেগুলোই তার ভরসা! ভাগ্যিস সে এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখে নি!

আমি পরশুদিন তাকে কল দিলাম মূলত সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ও আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের ধারণা কী তা জানার জন্য। ভাবী কল ধরে বলল, ভাই কুরআন তেলাওয়াত করছেন। মনে পড়ল বন্ধু জানিয়েছিল, করোনার আগ দিয়ে তিনি খুবই দ্বীনদার হয়ে গেছেন। করোনার ভেতর দাড়ি রেখে ৫ ওয়াক্ত ছালাত ও কুরআন পড়া শুরু করেছেন, এখনও ছাড়েননি। রামাযান মাসে কুরআন পড়া আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বললাম, ভাইয়া ফ্রী হ’লে আমাকে কল ব্যাক করতে বলবেন।

ঘণ্টাখানেক পর ভাই কল ব্যাক করলেন। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার ও আমার সদ্যজাত কন্যার খোঁজ-খবর নিলেন। জানতে চাইলেন, আমার মেয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ আছে কিনা। এরপর বাসায় একদিন সস্ত্রীক বেড়াতে আসতে বললেন। আমার কেমন যেন খটকা লাগল! বললাম, ভাইয়া, বঙ্গবাজারে আপনার কত টাকার মাল ছিল? ভাইয়া বললেন, দুই দোকানে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকার উপরে। সব পুড়ে গেছে, কিছুই উদ্ধার করা যায় নি! তা তো গেছেই, যা উদ্ধার করা গেছে সেগুলা তো কাউরে দানও করা যাবে না, পোড়া গন্ধই তো যাবে না অনেকদিন! তার এক চিলতে হাসি আমাকে আশ্চর্য করল! এই লোক হাসছে কি করে? নাকি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেল? নিশ্চিৎ হওয়ার জন্য উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে এতগুলা টাকার মাল নষ্ট হ’ল, আপনার কষ্ট হচ্ছে না? নাহ! কোন কষ্ট হচ্ছে না! কারণ মাল যিনি দিয়েছেন তিনিই নিয়ে গেছেন। তাই আমার ড্যামেজ কভারের কোন ইচ্ছাও নাই! কি বলেন ভাই! বুঝলাম না!!

ভাইয়া আমি খুব অল্প বয়সে ব্যবসা শুরু করি এবং অল্প বয়সেই অনেক উন্নতি করি। এই কয়েক বছরে আমি চারটা কাপড়ের দোকান রেখেছি ঢাকায়। এগুলো থেকে কামাই রোজগার যা হয় মাশাআল্লাহ তা আমার বউ বাচ্চা, আববা-আম্মা, ভাই-বোন সবার জন্য যথেষ্ট!

ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার ১ বছরে যা ব্যবসা বৃদ্ধি হয়, অন্যদের তা হ’তে কয়েক বছর লাগে! আমি বিয়েও করেছি অল্প বয়সে! ২ বাচ্চার বাপও হয়েছি অল্প বয়সে। তাই আমার কেন যেন মনে হয়, আল্লাহ আমাকে খুব অল্প হায়াত দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। কারণ আমি সবকিছু খুব দ্রুত অর্জন করছি। আমার আয়-উন্নতি সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে। এগুলো যত তাড়াতাড়ি হয়, আমার টেনশন তত বাড়ে! আমার মনে হয় আমার মরণ খুব বেশী দেরী নেই। কিন্তু আমি মরতে চাই না, কারণ মরণের কোন প্রস্ত্ততি আমি এখনো নিতে পারি নি! ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কি জবাব দিব? আমি এইসব নিয়েই সারাদিন টেনশনে থাকি, এর ভেতর দোকান পোড়ার টেনশন কখন করব ভাই বল?

ভাইয়ের এই উত্তরে অনেকটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এমন উত্তর আশা করি নি। যা হোক, এরপর বন্ধুকে কল দিয়ে বললাম যে, ওর বড় ভাই কী কী বলেছে আমাকে! ও সব শুনে বলল, ‘হুম, বঙ্গবাজারে আমাদের কাপড়ের আড়ত পোড়ার খবর শোনার পরেও ভাইয়ের কোন কিছু হয় নি। সে জোরে জোরে আলহামদুলিল্লাহ পড়েছে’। আববাও অবাক। আমরা জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘তার বা তার পরিবারের যদি বড় ধরনের কোন ক্ষতি হ’ত? সেইটা এখন মালের উপর দিয়ে গেছে। কিংবা এই মালের মধ্যে কোন বরকত ছিল না, বরং খারাপই ছিল, এই জন্য সব পুড়ে গেছে’।

এই কথা শুনে আমি প্রচন্ড বিস্মিত হ’লাম। বন্ধু এরপর বলল, গত বছর থেকে ভাইয়ের ব্যবসায়ে কোন মন নেই! সে সারাদিন ছালাত পড়ে, আর মরণের চিন্তা করে! দোকানেও ঠিকমত বসে না, প্রচুর দান-খয়রাত করে। পারলে মানুষকে সব কিছু বিলিয়ে দেয়। এইজন্য আববার সাথে তার অনেকবার রাগারাগি হয়েছে। আমরা ভাবছিলাম দোকানে হয়ত অনেক লস হবে। কিন্তু লস তো দূরের কথা, গত কয়েক মাসে প্রচুর লাভ হয়েছে।

এরপর আবারও ভাইয়াকে কল দিলাম। উদ্দেশ্য তার কাছে আরও কিছু কথা শোনা। তিনি দু’এক কথার পর বললেন, ‘আল্লাহপাক আমাকে একটা উত্তম সুযোগ দিয়েছেন। আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাই। একটু থেমে আবার বললেন, আল্লাহ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভাই, আজ বাদশাহ তো কাল ফকির। তাহ’লে এই দু’দিনের দুনিয়ায় কেন মানুষ অহংকার করে? দোকান পোড়ার খবর পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে আল্লাহ হয়ত আমার হায়াত কিনে নিলেন কিছু মালের বিনিময়ে এবং তিনি দেখলেন যে, আমি তার উপরে রাযী-খুশী আছি কিনা। আমি অবশ্যই আমার মালিকের ফয়ছালায় খুশী আছি।

আমি বললাম, যদি ইসলামপুরের দোকানগুলো আগুনে পুড়ে যায়? ভাইয়া হাসতে হাসতে জবাব দিল, ‘তাহ’লে তো আমি আরো খুশী, তাহ’লে আর আমাকে প্রতিদিন সকালে দোকানে যেতে হবে না। আমি আরও আল্লাহর ইবাদতে সময় দিতে পারব! আমি বললাম, ইসলামে কিন্তু বৈরাগ্য নেই ভাইয়া...! আমি তো বৈরাগী হব না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য আমার ভাল লাগে না। মনে হয় দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ আর টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের প্রতি মোহ আমাকে জাপটে ধরছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য একটু কম হ’লে আমার শান্তি লাগে! ভাই তোমার সাথে পরে আরও কথা বলব, এখন আমি তারাবীহর ছালাতে যাই। তুমিও যাও। আমি আসলে এরপর আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না। আমার জন্য দো‘আর দরখাস্ত করে ফোন রেখে দিলাম। আমি ভাবলাম, ইসলাম কতই না সুন্দর ধর্ম...! কত মহৎ মানুষেরই না জন্ম হয় ইসলামের পরশে এসে!

প্রলয় হাসান

লেখক : প্রলয় হাসান, ঢাকা



বিষয়সমূহ: ঈমান
আরও