নিঃস্ব পদ্মার অব্যক্ত হাহাকার ও আমার মতিভ্রম

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 296 বার পঠিত

আমার দুই সন্তানের মধ্যে ৮ বৎসরের আহমাদ সাজিদ ওশানই ছোট। জানার আগ্রহ খুব বেশী। চুপচাপ একা একা যে কোন কাজ করা তার খুব পছন্দ। কিন্তু এবারের কাজটি সে আর একা একা করতে পারলনা। সুদূর রাজশাহীতে নানাবাড়ি বেড়ানোর সুযোগ এলো। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বহতা তিন নদী পদ্মা, মেঘনা আর যমুনা- সেই কবেই না বইতে পড়েছে। ও আরও জানে গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে প্রমত্তা পদ্মা নদীর উৎপত্তি। তাই রাজশাহীতে নানাবাড়ি এসেই সে ধরল পদ্মানদী দেখবে। মামাতো ভাই আর ওকে নিয়ে গত ২১ মে’১১ তারিখে রাজশাহীর অহংকার সেই পদ্মা দেখতে গিয়েছিলাম। পদ্মার সেই ঐতিহ্যবাহী টি-বাঁধ, সেই উপচে পড়া ভীড়, সেই স্নিগ্ধ ফুরফুরে উদাস হাওয়া, সূর্যাস্তের সময় সেই মোহনীয় কল্পলোক সবকিছুই আগের মত। কিন্তু আমার ছোট বেলার উত্তাল পদ্মা? সেই শো শো শব্দ, তীব্র ঘূর্ণিস্রোত, রং-বেরংয়ের পালতোলা নৌকার আনাগোনা-কই সেসব? না সবকিছু হারিয়ে প্রমত্তা পদ্মা আজ রিক্ত, নিঃস্ব। গভীরতা আগের মতই, বাঁধের ধার দিয়ে রাখা বন্যানিরোধের জন্য কংক্রিট বোল্ডারের সারি। কিন্তু পদ্মার মূল পরিচয়, মূল সম্পদ সেই জলধারার খোঁজ নেই। বাঁধ থেকে অন্ততঃ ৩০ গজ নীচে সুগভীর পদ্মার অভ্যন্তরে পানির পরিবর্তে কেবলই উসর ধূসর বালুকাসমুদ্র, অনায়াসে মহিষের দল তার বুক চিরে অতিক্রম করে যাচ্ছে। যেন প্রতিবেশী দেশের ফারাক্কা বাঁধের নির্মম ছোবলে গড়ে ওঠা বিশাল বাথান। আমার স্মৃতির এ্যালবামের সাথে গোধূলীলগ্নে দেখা এই দৃশ্য মেলাতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। বহু দূরে পানির যে ক্ষীণধারা পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তাতে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে-মেয়ে হাঁটু পানিতে গোসল করছে। যেন এক ছোট্ট ডোবা বা মজা পুকুর। দশ বছর আগেও যেখানে অপর পাড়ের গ্রামগুলো প্রায় অস্পষ্ট রেখার মত মনে হত, আজ সেখানে মাত্র ৫০ গজ দূরেই উঁচু টিলার মত চরের উপর সবুজ গাছের সারি। আশ্চর্য! অস্তাচলে ঢলে পড়া সূর্যটা সাক্ষী দিচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি কিছুই অনিয়মের নয়, তাই সে সকালে উঠে এখন আবার পাটে যাচ্ছে। পরবর্তী সকালে সে আবার হাজিরা দেবে। কোন শক্তি তাকে আটকে রাখার নেই। কিন্তু পদ্মার পানি ফারাক্কা বাঁধ আটকে আছে, সে চাইলেও আসতে পারছেনা। হায়রে ফারাক্কা! যাকে একসময় আমরা সর্বনাশা পদ্মা বলতাম, যার উত্তাল তরঙ্গ দু’কূল ছাপিয়ে যেত, সেই পদ্মাকে তুমি আজ পানির পরিবর্তে ধু ধু বালুর নদীতে পরিণত করেছ। যদিও তুমি এ দেশের মানুষকে বন্যায় ডোবাতে আবারও পানি ছেড়ে দিতে পারো- এ আশংকায় আমাদের সরকার বাঁধের উপর অনেক বড় বড় পাথর মজুদ করে রেখেছে। হায়রে মানুষ, কেন তোমাদের এই বিচিত্র খেয়াল? কাউকে উপকার না কর, অপকার করোনা বন্ধু! আজ আমার সন্তানের কাছে আমি লজ্জিত, হয়ত বইয়ের কালো অক্ষরগুলো আজ ওর কাছে কেবল মিথ্যা গালগল্পমাত্র। রাজনীতির প্যাঁচ বোঝার বয়স ওর এখনও হয়নি, তবে এদেশের নাগরিক হয়ে ও যত বড় হবে ততই বুঝতে পারবে- বই মিথ্যা নয়, মিথ্যার শিকার শুধু হয়েছে বর্তমান সময়।

ওহীদা বেগম

সহকারী শিক্ষিকা, নবজীবন ইনস্টিটিউট, সাতক্ষীরা।



আরও