অস্থির পাকিস্তান : কালো মেঘের ঘনঘটা

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক 8813 বার পঠিত

প্রসঙ্গ কথা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র দুনিয়ায় স্বাধীনতার উত্তাল তরঙ্গ উপচে পড়ে। এই তরঙ্গে ভেসে যায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। বৃটিশদের পতনের পর বিশ্বের দুই পরাশক্তির মাঝে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদী আশা আফগানিস্তানের পাহাড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লে সমগ্র বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় আমেরিকা। সমগ্র বিশ্বকে করতলগত করার জন্য তারা প্রণয়ন করে এক সর্বগ্রাসী নতুন ধারার সম্রাজ্যবাদী নীতি। আমেরিকা কেন্দ্রিক এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বায়নের নামে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে সারাবিশ্বকে একক কেন্দ্রের অধীনে এনে শাসন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। তাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা আদর্শিক শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে ইসলাম তথা মুসলিম বিশ্বকে। এরই অংশ হিসাবে তারা বর্তমান বিশ্বে ‘সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিরক্ষী যোদ্ধা’র তকমা লাগিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের অজ্ঞাবহ দাস বানানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের ভয়াল থাবা আজ আফগান ও ইরাককে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাদের এই থাবার পরবর্তী টার্গেট পাকিস্তান। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

অতীত ও বর্তমানের আলোকে পাকিস্তান : আজ থেকে বহু বছর পুর্বে ৭১১ খৃষ্টাব্দে অসীম সাহসী বীর শার্দুল মুহাম্মাদ বিন কাসিম পাকিস্তানের সিন্ধুতে সফল অভিযান পরিচালনা করে পাকিস্তানের বুকে ইসলামের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে দেন। তারপর প্রায় হাযার বছর ধরে মুসলমানরা স্বগৌরবে এ উপমহাদেশ শাসন করে আসছিল। কিন্তু যেদিন বৃটিশ বণিকদের জাহাজ বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে বাংলার পদপ্রান্তে নোঙ্গর ফেলে সেদিন এই সোনালী যুগের বিদায় ঘন্টা বেজে উঠে। তারপর পলাশীর মর্মান্তিক ঘটনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের পতন ঘটে এবং্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বুনিয়াদ  গড়ে উঠে। এরপর থেকে শুরু হয় ব্রিটিশদের নির্যাতনের স্টীম রোলার। এ হায়েনাদের অসহ্য নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ আরেকবার জিহাদের নব উদ্দীপনায় জেগে উঠে। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৯৪৭ সালে খন্ডিত আকারে হলেও পাকিস্তান নামের একটি মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানী নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা, হঠকারিতা এবং ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা পাকিস্তানের ভিত্তিকে টলমল করে তোলে। ফলশ্রুতিতে  মাত্র ২৪ বছরের মাথায় দেশের একটা অংশকে হারিয়ে আভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ের শিকার হয় পাকিস্তান। অন্যদিকে ভারতীয়দের নিদারুণ শত্রুতা ও কাশ্মীর নিয়ে স্থায়ী টানাপোড়েনে কখনোই দেশটি নিজের পায়ে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এভাবে নেতৃত্বের অদক্ষতা  আর প্রতিবেশীর হুমকি থেকে নিজেকে রক্ষার দুশ্চিন্তা শুরু থেকেই পাকিস্তানকে সদাশংকিত ও আত্মবিশ্বাসহীন অবস্থায় রেখেছে। পাকিস্তানের অবস্থা সেই মাঝির মত যে শত চেষ্টা করেও তার তরীকে আর উজানে নিতে পারছে না। ফলে তাকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হয়েছে।  বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকেই সে আশ্রয় নেয় মার্কিন পক্ষপুটে। অন্যদিকে ভারত মৈত্রীবন্ধন রচনা করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। পরিহাসের বিষয় এই যে, ভারত কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের তাঁবেদার না হলেও পাকিস্তান আমেরিকার তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হতে সময় নেয়নি। আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বর্তমান রাশিয়া ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের প্রতিটি বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমেরিকা তার স্বার্থ পূরণ হয়ে গেলেই পাকিস্তান থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। দুনিয়া কাঁপানো ৯/১১-এর পর দিশেহারা পাকিস্তান যখন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দিয়ে নাকে দড়ি পরেছে।  সে পরিস্থিতিতেও ভারত দিব্যি স্বীয় মর্যাদা রক্ষা করে মার্কিন, রুশ  উভয়ের বিশ্বাস ও মৈত্রী লাভে সক্ষম হয়েছে।

পাকিস্তান ধ্বংসের মহাপরিকল্পনা : সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের শ্যেন দৃষ্টি এখন মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র এই পাকিস্তানের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে পাকিস্তানের শক্তিমত্তাকে দুর্বল করার জন্য সেখানকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পরিচালিত ষড়যন্ত্রের কিছু নমুনা নিম্নে তুলে ধরা হল। -

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রই নওয়াজ শরীফ সরকারের পতন ঘটিয়ে পারভেজ  মোশাররফকে ক্ষমতায় আনে। পাকিস্তানের বর্তমান দুরবস্থার জন্য অনেকটাই দায়ী সাবেক এই সেনাপ্রধান। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মোশাররফ আমেরিকার ঘনিষ্ট সহযোগী ও হাতের ছড়ি হয়ে উঠায় পাকিস্তানের আজ এই অচলবস্থা। এটা ওপেন সিক্রেট যে, এই আমেরিকাই গত শতকে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করে পাকিস্তানকে মেরুদন্ডহীন করার অপপ্রয়াস চালায়। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল নিজের অনুগত তল্পীবাহক শাসককে ক্ষমতায় নিয়ে আসা এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে চরম বিভক্তি সৃষ্টি করা। যার ধারাবাহিকতায় তাদের এককালের তল্পীবাহক বেনজির ভুট্টোকে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে হত্যা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এ হত্যাকান্ডটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা ও জাতি হিসাবে পাকিস্তানকে একটি ভঙ্গুর অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া মার্কিন পরিকল্পনারই অংশ ছিল। Anglo-American ambition behind the assassination of Benozir bhotto and disstabilization of pakistan' শীর্ষক এক নিবন্ধে ল্যারি  চিন বলেন ‘বুশ-চেনি প্রশাসন ও তার মিত্ররা পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জোরদার করেছে এবং এর অংশ হিসাবে বেনজিরের মৃত্যু ও মোশাররফের পতন অবধারিত ছিল।[1] সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, পাকিস্তানকে রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্যই তারা একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা উস্কে দিয়ে যাচ্ছে। গত শতকে নিকারাগুয়ায় বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য যে আমেরিকান কনসালট্যান্ট নেগ্রোপন্টেকে মার্কিন সরকার পাঠিয়েছিল বর্তমানে তাকে একই এ্যাসাইনমেন্টে পাকিস্তানে পাঠিয়ে নিয়মিত দাবার গুঁটি চালছে। তাদের সহযোগিতায় এককালের ‘টেন পা©র্সন্ট’ বলে খ্যাত দুর্নীতিবাজ আসিফ আলী জারদারী ক্ষমতায় আসেন। যাকে ইমরান খান ২য় মোশাররফের আগমন বলে আখ্যায়িত করেছেন। যাইহোক আমেরিকা সবসময় এমন লোককেই ক্ষমতায় দেখতে চায় যারা তাদের স্বার্থ হাছিলে তৎপর থাকবে এবং জাতীয় স্বার্থ অগ্রাহ্য করায় কোন ত্রুটি করবে না। জারদারীই হলেন তাদের চাহিদামত সেই যোগ্য (!) প্রার্থী।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় : যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান দুই সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মারাত্মক অর্থনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টি করে আসছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, বিশ্বের সকল দেশ এমনকি মুসলিম দেশগুলোও আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে রিযিকদাতা মনে করে। তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে পাকিস্তানও। এই দুই অর্থনৈতিক হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানকে ভয়াবহ ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলেছে আমেরিকা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শ অনুযায়ী তথাকথিত অর্থনৈতিক সংস্কার করতে যেয়ে দেশটি মারাত্মক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পাকিস্তান তার চিরদিনের বন্ধু সৌদি আরব ও চীনের প্রতি দ্রুত সহযোগিতার হাত বাড়ায় কিন্তু কোন প্রকার সাড়া না পেয়ে পাক সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইএমএফ-এর কাছ থেকে পুনরায় মোটা অংকের ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এভাবে মুসলিম বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশের মত পাকিস্তানকে আইএমএফ ঋণের বেড়াজালে আটকিয়ে অনুগত দাসে পরিণত করে ক্রুর হাসি হাসছে।

অভ্যন্তরীণ সমস্যা : পাকিস্তান আজ তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে, বিশেষ করে বালুচদের ভয়াবহ বিদ্রোহ পাকিস্তানের জন্য এক অশনি সংকেত। বর্তমানে ভারত ও মার্কিনের গোয়েন্দাদের অপতৎপরতায় তা নতুন গতি পেয়েছে। সিআইএ ও তার দোসররা যেমন পূর্ব তিমুরের গেরিলাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ঠিক একই প্রক্রিয়ায় ‘বালুচ লিবারেশন আর্মি’ (বিএলএ)-কে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। ২০০৫ সালে এনআইসি ও সিআইএ কর্তৃক প্রণীত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানকে যুগোশ্লাভিয়ার পরিণতিই বরণ করতে হবে’। তথা যুগোশ্লাভিয়া যেমন নানা সংকটে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গিয়েছিল তেমনিভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলা, দুর্নীতি, জঙ্গি তৎপরতা, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতা, আমেরিকার ড্রোন বিমান হামলা, তালেবানদের উত্থান, সেনা-তালেবান সংঘাত এবং মুম্বাই হামলার চাপানো দায় মাথায় নিয়ে পাকিস্তান আজ সে পথেই এগুচ্ছে। মূলত আমেরিকা চায় পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও ইরানের বালুচ এলাকা নিয়ে গ্রেটার বেলুচিস্তান গঠিত করতে এবং এভাবে মুসলিম বিশ্বের দুই শক্তিধর রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে খান খান (বলকানাইজেশন) করতে । যেমন সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা লে.কর্নেল র‌্যালিফ পিটার্স ‘দ্য আর্মড ফোর্সেস জার্নালে’ ২০০৬ সালের জুন সংখ্যায় পাকিস্তানকে ভেঙ্গে বর্তমান ভূখন্ডের অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।[2] শত কোটি মুসলিমের আবাসস্থল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, রাশিয়া ও চীনকে ঘিরে ন্যাটো শক্তিবলয় গড়ে তোলা ও ভারত মহাসাগরের নিরংকুশ আধিপত্য গ্রহণ করাই বর্তমানে আমেরিকার টার্গেট। ‘ফরেন এ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকা বলছে, ভারত মহাসাগর হল একবিংশ শতাব্দীর কেন্দ্রীয় মঞ্চ। ‘বৃহত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল জড়িয়ে আছে সাহারা মরুভূমি থেকে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত ইসলামের সমগ্র খিলানটিতে... এর সীমার মধ্যে রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরান ও পাকিস্তান। এই সাগর ঘিরেই চলছে গতিশীল বাণিজ্য, দানা বেঁধেছে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, জলদস্যুতা ও মাদক চোরাচালান। এর পূর্ব প্রান্তে বাস করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার শত কোটি মুসলিম।’[3] এ কাজে মার্কিনরা পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিচ্ছে যার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে একজন নেতৃস্থানীয় মার্কিন বিশেষজ্ঞ র‌্যান্ড ক্রিস্টাইন আমেরিকার ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নাল’ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘বেলুচিস্তানে অস্থিরতা বাড়াতে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগ যুক্তিসঙ্গত’।[4] বেলুচিস্তানের হাতে গোনা কয়েকজন গোত্রপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ভারত ও মার্কিন যোগশাজশে বেলুচিস্তানে সঙ্কট সৃষ্টি করছেন। মরহুম আকবর বুগতির পৌত্র ব্রাহামদাগ বুগতির মন্তব্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তিনি বলেছেন, ইসলামাবাদের হাত থেকে বেলুচিস্তানের সম্পদ রক্ষার জন্য ভারতের যে কোন নৈতিক সমর্থন ও বস্ত্তগত সাহায্য তিনি গ্রহণ করবেন।[5] এই সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সকল প্রকার পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রস্ত্ততিতে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। জানা গেছে যে, আফগানিস্তানে ‘পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন’ কার্যক্রমের মুখোশে বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন (বিআরও) আফগানিস্তানে বিস্ফোরক এনে বালুচদের সন্ত্রাসী কাজে সহযোগিতা করছে। মূলতঃ ভারত কয়েকটি কারণে বেলুচিস্তানের অস্থিরতার আগুনে বাতাস দিচ্ছে। যথা-

১. বেলুচিস্তানের উপকূলে গোয়াদর বন্দর চালু হওয়ায় পারস্য উপসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানী সরবরাহ লাইন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাকিস্তান অর্জন করেছে।

২. ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক করাচীর নৌঘাঁটি অবরোধ করা সহজ। কিন্তু গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাকিস্তান করাচি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে কৌশলগত অবস্থানের অধিকারী হতে পেরেছে। যা ভারতের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে।

৩.  বেলুচিস্তান অঞ্চলে দিন দিন চীনের উপস্থিতি জোরদার হচ্ছে। যা ভারতের জন্য বিপদজনক।

এককথায় পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্য ভারত বালুচ জনগণের মাঝে বিভেদ-বিভাজন এবং ক্ষোভ অসন্তোষ সৃষ্টির মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন পরিচালনা করছে। যেমন সম্প্রতি বালুচ যুবক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জড়িত আছে বলে প্রচারণা চালানো। কিন্তু আসল ঘটনা ছিল ভিন্ন। ইউসুফ রাজা গিলানির স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা রেহমান মালিক বলেন, গত কয়েক দিন আগে যে ২০০ বালুচ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তাদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরা সবাই সীমান্ত পার হয়ে চলে গেছে আফগানিস্তানে এবং সেখানে গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদেরকে বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকান্ডের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। অতএব এটা এখন সুস্পষ্ট যে ভারত আফগান সীমান্তে উন্নয়ন কাজের নাম করে, কনস্যুলেট বসিয়ে বালুচ স্বাধীনতা আন্দোলনকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাতিয়ে তুলছে।

জঙ্গী সংকটের অথৈ সাগরে পাকিস্তান :  বর্তমানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হল জঙ্গীবাদ। বলা হচ্ছে, এই জঙ্গীদের জন্য আগামী ছয় মাসের মধ্যে বা এক বছরে পাকিস্তান ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যাবে। পশ্চিমা বিশ্বের আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু হল পাকিস্তানের অস্ত্র ভান্ডারে মজুদকৃত ১০০টি পারমাণবিক বোমা। তাদের মতে নিকট ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে যায় তাহলে এসব পরমাণু অস্ত্র তালেবানদের হাতে গিয়ে পড়বে। মার্কিনীদের মতে, বিশ্বের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা আর হতে পারে না। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে তালেবানদের নবউত্থান লক্ষ্য করা গেছে। তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনা লক্ষ্য করে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ম্যারিয়েট হোটেলে হামলা, পুলিশ স্টেশনে হামলা, শ্রীলংকান ক্রিকেটারদের উপর হামলা ইত্যাদি। এছাড়াও নৃশংসভাবে তারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে মসজিদ-মাদরাসা ও পাবলিক প্লেসে। তালেবান নেতাদের মধ্যে মাওলানা ফযলুল্লাহ গত বছর সোয়াতে শরী‘আহ আইন জারির মাধ্যমে সরকারের সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় সফলতা অর্জন করেন। পাকিস্তানের জনগণও একে স্বাগত জানায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের এই সহনশীল আচরণকে আমেরিকান সরকার ও গণমাধ্যমগুলো জঙ্গী দমনে পাকিস্তানের পরাজয় ও জঙ্গীদের বিজয় বলে প্রচার করা শুরু করে এবং সোয়াতে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে বলে তার স্বরে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অথচ যারা নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করছেন তারা বলেছিলেন, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এই চুক্তি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। পরবর্তীতে তালেবানরা সোয়াতের সফলতায় অতি উৎসাহী হয়ে সোয়াত পার্শ্ববর্তী বুনার প্রদেশ দখল করে নিয়ে সারা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেয়। এই সুযোগে আমেরিকার গণমাধ্যমগুলো আরও ফলাও করে প্রচার করে যে, জঙ্গীরা পাকিস্তান দখল করার জন্য ইসলামাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে, তারা এখন ইসলামাবাদ থেকে এত কি.মি. দূরে অবস্থান করছে। এই অতি প্রচার পাক সরকারকে বিপাকে ফেলে দেয়। সত্যি বলতে কি, এই পরিবেশে সোয়াতের যোদ্ধাদের অভিযানটি ছিল একটা আত্মঘাতি অভিযান। মূলত শান্তি চুক্তিতে সফলতা লাভের পর তাদের উচিৎ ছিল পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের আসল শত্রু আমেরিকার দিকে লক্ষ্য করা এবং সোয়াতে শরীআ আইন যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করে একটি দৃষ্টান্তমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যা দেখে অন্ততপক্ষে মুসলিম বিশ্বের শাসকগণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু তারা নিতান্ত অবিবেচকের মত নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে লিপ্ত হল। ফলে আমেরিকার চাপে নড়বড়ে সরকার বাধ্য হয়ে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে এবং জঙ্গীদেরকে বুনার অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর শান্তিচুক্তির আওতাভুক্ত সোয়াত অঞ্চলেও জঙ্গী বিরোধী অভিযান শুরু করে। অতঃপর বর্তমানে ওয়াজিরিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানী সেনা ও তালেবানসহ সেখানে নিহত হয়েছে কয়েক সহস্রাধিক। লক্ষ লক্ষ লোক যুদ্ধাঞ্চল ছেড়ে নিরাপদ অশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। এই ভ্রাতৃঘাতি যু্দ্ধ পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। পাক সেনাবাহিনী এখন নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে এবং নিজেদের অস্ত্রভান্ডার নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধেই শেষ করে দিচ্ছে। ইমরান খান বলেন, ‘পাকিস্তান শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলাই অনুমোদন করেনি বরং নিজ সেনাবাহিনীকে তাদের নিজ জনগণের বিরুদ্ধে লড়তে পাঠান  হচ্ছে। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় কৌতুক। এটি অশ্রুতপূর্ব ও নযীরবিহীন যে, নিজের সেনাবাহিনী নিজের জনগণকে হত্যা করছে।[6] এত বড় ধরনের অভিযান চালানোর পরও পাকিস্তান তার প্রভু আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই অভিযানের ফল হবে অত্যন্ত নগণ্য ও ব্যর্থ। তারা পাকিস্তানের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে, খোলাখুলি প্রস্তাব করে যে, যেহেতু পাকিস্তান এককভাবে জঙ্গীদের সামাল দিতে পারছেনা তাই পাক ও আমেরিকার সৈনিকরা পাক সীমান্তে একসাথে যৌথ অভিযান পরিচালনা করলে জঙ্গীদের দমন করা যাবে। অবশ্য পাকিস্তান তাদের এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে জঙ্গীদের দমন নিয়ে এই লেজে-গোবরে অবস্থার মধ্যে জঙ্গী দমনের নামে আমেরিকা চালকবিহীন ড্রোন গোয়েন্দা বিমান হামলা করছে। পাকিস্তান সরকারের সকল অনুনয়-বিনয় উপেক্ষা করে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ পর্যন্ত মার্কিনীরা পাক সরকারের বিনা অনুমতিতে  ২২ বারেরও বেশী বিমান হামলা করে এবং  প্রায় ৩০০ জন পাকিস্তানী নাগরিককে হত্যা করে, যাদেরকে জঙ্গী বলে চালিয়ে দেয়া হয়। তাই এ মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে দিগন্তব্যাপী কালো মেঘের ঘনঘটা বিরাজ করছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, জঙ্গী সমস্যার সাথে একদিকে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে আগামীদিনের বিশ্বমোড়ল চিরবৈরী ভারত অন্যদিকে আঠার মত লেগে থাকা শত্রু আমেরিকা পাকিস্তানের দোরগোড়ায়। আরো রয়েছে ইরান, যার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক তেমন একটা ভাল নয়; বরং আফগানিস্তানে নিজেদের আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে গিয়ে বাহ্যত তারা শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এখন শুধু বাকী রইল আরেক প্রতিবেশী চীন। এই দেশটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বকে বজায় রেখে চলছে। সব মিলিয়ে যেন পাকিস্তানের অবস্থা আজ করুণ। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে পাকিস্তানের জনগণের মাঝে যে ধরনের অটুট ঐক্য দরকার তা যে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। বালুচ গেরিলা এবং সীমান্তবর্তী মুজাহিদদের সাথে সরকারের বিরোধ পাকিস্তানকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বহুমুখী সংকটের এবড়ো থেবড়ো পথে হোঁচট খেতে খেতে পাকিস্তানের অবস্থা ত্রাহিত্রাহি। যার জন্য ভারত ও আমেরিকা বহুদিন যাবৎ অপেক্ষা করছে।

সস্ত্রাসবিরোধী লড়াই ও প্রকৃত রহস্য :  রুশ শাসনের কবল থেকে মুক্ত জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা নিয়ে মুজাহিদ দলগুলো ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সকলেই যখন একটি তৃতীয় পক্ষের অপেক্ষা করছিল, সেই মুহূর্তে ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানের মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় ‘তালেবান’ নামক সংগঠন। ছাত্রদের এই সংগঠন অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে আফগানিস্তানে একক নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ইসলামী আইনের ভিত্তিতে দেশটি পরিচালনায় জন্য নেতৃত্ব দেন। এ সময় পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত তালেবান সরকারকে সমর্থন দেয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এই ইসলামী বিপ্লবকে নিজেদের জন্য পথের কাটা মনে করে বসে। শুরু হল এ বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে তাদের নতুন ষড়যন্ত্র।

উল্লেখ্য যে, আফগানিস্তানের মুজাহিদ গ্রুপগুলো আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিলযাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আল-কায়েদা। ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ ওসামা বিন লাদেনকে সরাসরি সহযোগিতা দেয়। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠে আল-কায়েদা। পরে সিআইএ’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে বিন লাদেন প্রশিক্ষণ নেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউসে আল-কায়েদা কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেন।[7] আল-কায়েদাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য হাছিলের পর আমেরিকার কাছে আল-কায়েদার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। অতঃপর তালেবানদের ইসলামী বিপ্লব সফল হলে আল-কায়েদাও তাদের মিত্র হিসাবে কাজ করতে থাকে। এদিকে তালেবানদের উত্থানে শংকিত আমেরিকা যে কোন মূল্যে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং মধ্যপ্রাচ্যের পর মধ্য-এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা অাঁটতে থাকে। ২০০১ সালে ৯/১১ এই মোক্ষম সুযোগ এনে দেয় তাদের হাতে। এমতবস্থায় তারা আল-কায়েদাকে নতুন ভূমিকায় দৃশ্যপটে এনে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অপরিহার্য সঙ্গীতে পরিণত করে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে হারিয়ে নতুন প্রতিপক্ষ হিসাবে মুসলিম বিশ্বকে যখন তারা টার্গেট করে, তখনই আল-কায়েদার মত একটা প্রতীক প্রয়োজন পড়ে। তাই মিডিয়ার মাধ্যমে সুচারুরূপে আল-কায়েদাকে তারা এক যোগ্য প্রতিপক্ষে পরিণত করে। শুধুমাত্র আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ এই সংগঠনটি পশ্চিমা মিডিয়ার নিষ্ঠাবান মিথ্যাচারিতায় আজ এক বিশাল আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। অথচ এর অস্তিত্ব কেবল একটা জুজুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ জন্যই কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাইকেল চসুদোভস্কি আল-কায়দাকে রহস্যময় বলে উল্লেখ করেন।[8] সাবেক বৃটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবিন কুক বলেন, ‘আল-কায়েদা টায়েদা সিআইএ’র একটা ফাইলের নাম’। আল-কায়েদা তাই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তথা সন্ত্রাসবাদের বিনিয়োগে আমেরিকার জন্য এক মূল্যবান পুঁজি। এখন বিশ্বের কোনখানে যে ধরনের বোমা হামলাই ঘটুক না কেন কিংবা যেই করুক না কেন সে হামলার সাথে আঞ্চলিক কোন ইসলামী সংগঠনের নাম দিয়ে তাকে কাল্পনিক নেটওয়ার্ক আল-কায়েদার সাথে জড়িত করার জন্য অপপ্রচার চালানোই পাশ্চাত্য মিডিয়া ও তার পোষ্যদের গুরু দায়িত্ব। এটা লক্ষ্য করে সিআইএ-এর সাবেক গোয়েন্দা বেয়ার্ডম্যান বলেন, সন্ত্রাসবাদ যুক্তরাষ্ট্রের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। এর মাধ্যমে সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে বৈধ ও অব্যাহত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রই গোপনে কথিত সন্ত্রাসীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।[9] ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামের এই বুদ্ধিবৃত্তিক মরণাস্ত্র দিয়েই তারা তালেবানকে ঘায়েল করতে সমর্থ হয়। বলতে দ্বিধা নেই, শুধু তালেবান নয় মুসলিম বিশ্বের যেকোন অগ্রগামী বিপ্লববাদী ইসলামী দলকে ধ্বংস করার জন্য ‘আল-কায়েদা’কে সৃষ্টি আমেরিকার জন্য পয়মন্ত হয়েছে। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইহুদী-খৃষ্টান ইউনিয়নের এক অধিবেশনে ২০০২ সালের জানুয়ারীতে বক্তৃতাকালে বলেন, যে সকল আন্তর্জাতিক সংগঠন মার্কিন ও ইসরাঈলী স্বার্থের বিরোধিতা করবে আমরা তাদের উপর হামলা চালাতে কারোরই পরওয়া করব না। চাই তা জাতিসংঘ হোক, আফ্রিকান ইউনিয়ন হোক, আরব লীগ হোক কিংবা ওআইসি হোক বা কোন ইসলামী সংগঠন হোক না কেন।[10] একথা এখন নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জর্জ বুশের এই কথার বাস্তব প্রমাণ ইরাক ও আফগানিস্তান। তারা ৯/১১-এর ঘটনার জন্য তাদের বানানো আল-কায়েদাকে দায়ী করে এবং আল-কায়েদা প্রধান ওসামাকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ করে আফগানের ইসলামী বিপ্লবের নায়ক তালেবান সংগঠন ও তাদের গঠিত সরকারকে ধ্বংস করে। আগেই বলা হয়েছে, আল-কায়েদার সাথে তালেবানের বিস্তর ফারাক রয়েছে। আল-কায়েদা ছিল নিছক একটি মুজাহিদ সংগঠন। কিন্তু তালেবান আফগানিস্তানের একটি বৈধ ও প্রতিষ্ঠিত সরকার ছিল, যাদের জনসমর্থনও ছিল তুঙ্গে। বর্তমানেও তালেবানরা আফগান মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত বলে পরিগণিত হচ্ছে। সুতরাং তালেবান ও আল-কায়েদা এক নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয়  হল, আমেরিকা যে কথিত সন্ত্রাসী ওসামার নামে পুরো একটি রাষ্ট্র দখল করল এবং অদ্যাবধি সেখানে আধিপত্য বজায় রেখেছে সেই ওসামাকে তারা ৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও ধরতে পারেনি। কেননা ওসামাকে গ্রেফতার করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং তাকে দাবার ঘুটি হিসাবে ব্যবহারই তাদের উদ্দেশ্য। অথবা তিনি হয়ত নিহতই হয়েছেন কিন্তু তারা মিডিয়ার মাধ্যমে ওসামাকে বাঁচিয়ে রেখেছে একটা জুজু হিসাবে। যে জুজুর কারসাজিতে দীর্ঘকাল যাবৎ বিশ্বের যে কোন স্থানে তারা ইচ্ছামত অস্ত্রের মহড়া দিতে পারছে এবং সুবিধা মত স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে।

পাকিস্তানে তালেবানদের উত্থান ও অসন্তোষের কারণ :  প্রথমতঃ পাকিস্তানের পাঠান ও পশতুনদের সাথে আফগান পশতুনদের মাঝে নৃতাত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় মিল রয়েছে। তাই আফগানিস্তানে তালেবানরা আমেরিকা কর্তৃক আক্রান্ত হলে তাদের প্রতি স্বভাবজাতভাবেই পাকিস্তানীদের সহমর্মিতা জাগে। এই সহমর্মিতাবোধ থেকে সৃষ্টি হয় প্রতিরোধের। তাই যখন তালেবানরা স্বজাতি পাক-পশতুনদের নিকট আশ্রয় নেয় তখন পশতুনরা তাদের শুধু আশ্রয় দেয়া নয় বরং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে সহযোগিতা করতে থাকে। সোয়াতে মাওলানা ফযলুল্লাহ ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে বায়তুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে পাক-পশতুনরা সমাবেত হয় এবং মার্কিনীদের সহযোগী হওয়ায় পাকিস্তান সরকারেরও বিরোধিতা করে। মূলতঃ পাকিস্তান সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণই এ অঞ্চলে তালেবানের সশস্ত্র উত্থান ঘটিয়েছে। ইমরান খান তেহরান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেছেন, ‘বর্তমান জঙ্গিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সরাসরি প্রতিক্রিয়া। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানে সন্ত্রাস ও জঙ্গি বাড়ছে। একে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে সন্ত্রাসের যুদ্ধ। তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে বোমা বর্ষণ এখানকার পশতুনদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তাদের এই প্রতিক্রিয়াকে দমনের জন্য উপজাতীয় এলাকায় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। ফলে উপজাতীয় এলাকাগুলোতে জঙ্গিবাদের সূচনা হয়’।[11]

দ্বিতীয়তঃ আমেরিকা চাইছে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানকে তালেবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে লাগিয়ে দিতে। রক্তের সংযোগ এবং রুশবিরোধী লড়াইয়ের সূত্র ধরে পাকিস্তানের সরকার, সেনাবাহিনী, সাধারণ জনগণ প্রত্যেকেই তালেবানদের প্রতি দুর্বল। পাকিস্তানের সাথে তালেবানদের সুসম্পর্ক ভাবিয়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্রকে। তাই তালেবানদের বিষয়ে তাদের মনোভাব দুর্বল করার জন্য তারা বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলায় মদদ যুগিয়ে পাকিস্তানের সাথে তালেবানদের সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তালেবানকে দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ দেখিয়ে আমেরিকা জঙ্গী দমনের নামে বহু অর্থ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তথা তালেবানদের বিরুদ্ধে নামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। উদ্দেশ্য হল একদিকে চলমান আফগান-তালেবান বা আমেরিকা-তালেবান সংকটটি পাক-তালেবান সংঘাতে রূপ নেবে এবং এ সুযোগে আফগানিস্তান তালেবানের হাত থেকে নিরাপদ হবে। অন্যদিকে তালেবানদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়বে তখন আমেরিকা ও ভারত মিলে ফাঁক বুঝে পাকিস্তান দখল করবে অথবা নিরাপত্তার আশংকা দেখিয়ে পারমাণবিক বোমাগুলো কার্যত ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে। তাদের সেই পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে পাকিস্তান। ইতিমধ্যে বুনার, সোয়াতের পর ওয়াজিরিস্তানে পাক-তালেবান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর এরই মাঝে পাক-তালেবান সংঘাত যদি স্থায়ী রূপ লাভ করে তাহলে পাকিস্তানকে ভাঙ্গার পরিকল্পনা বাস্তব রূপ লাভ করতে মোটেও দেরী হবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পাক-আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছেন এবং পাক-আফগান সমস্যাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে অভিহিত করেছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি নতুন করে কৌশল নির্ধারণ করেছেন যাতে পাক-আফগানকে একসাথে নিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। এই কৌশলে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য পকিস্তানের স্থিতিশীলতাকে শর্ত করা হয়েছে এবং পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার পথ হিসাবে জঙ্গী দমনকে উল্লেখ করা হয়েছে। তার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইমরান খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার উপর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে বলে ওবামা যে মন্তব্য করেছেন তা মোটেই ঠিক নয়। পাকিস্তানে তো স্থিতিশীলতা ছিলই। জর্জ বুশের কান্ডজ্ঞানহীন নীতির কারণে ও অন্যায়ভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যার ফলে আফগান অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং তার এই অন্যায় কর্মকান্ডের প্রতি মোশাররফের নগ্ন সমর্থনের প্রভাব পাকিস্তানের উপর পড়ে। কাজেই পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার উপর। আর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে আফগান থেকে বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের উপর। আফগান থেকে বিদেশী সৈন্য যত দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে তত দ্রুত পাক-আফগান স্থিতিশীল হবে এবং জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস দমন হবে’। তিনি অন্যত্র বলেন, পাকিস্তানের মানুষ অন্যায়ের বিচার পায় না। তাই তারা শরী‘আহ আইনের দিকে ঝুঁকছে। ফাতিমা ভুট্টো বলেছেন, ‘পাকিস্তানের সমস্যা কোন মতেই তালেবান নয়, বরং দুর্নীতি’। আসলে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন সরকারের বড় কোন দায় পড়ে যায়নি। তাদের মূল উদ্দেশ্য আফগানিস্তানকে পুরোপুরি আপন কব্জায় রাখা এবং ভারত, চীন, রাশিয়া, ইরানকে একযোগে পাহারা দেয়া। সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য পার্শববর্তী পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তান বিভক্ত ও অস্থিতিশীল হলেই তাদের লাভ। তাই তারা পাকিস্তানকে তালেবানদের সাথে সমঝোতায় যেতে সবসময় নিরুৎসাহিত করে আসছে এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাপ দিচ্ছে। এমনকি গত ৯ মে ওয়াশিংটনে শেষ হওয়া ত্রিদেশীয় বৈঠকে আমেরিকা পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারতকে বন্ধু হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে এবং তালেবানদেরকে সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে উল্লেখ করে। সাথে সাথে ভারত সীমান্ত থেকে পাকিস্তানী সৈন্য সরিয়ে নিতে চাপ দেয়। যে ভারত বিশ্ববাসীর চোখের সামনে কাশ্মীর নিয়ে আজ অর্ধশতাব্দীকাল ধরে টালবাহানা করছে, হাযার হাযার কাশ্মীরীকে পাখীর মত হত্যা করে সেখানে স্থায়ী মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে রেখেছে। যে ভারত তার দেশের যে কোন দুর্ঘটনায় সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং পাকিস্তানের বিপদ মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক বরং ক্ষতি সাধনের সম্ভাবনায় আমোদিত হয়, সেই ভারত কি কখনো পাকিস্তানের বন্ধু হতে পারে? তাহলে ওবামার এই ধরনের প্রস্তাবের উদ্দেশ্যে কি? আসলে ওবামারা চান যে, পাকিস্তান ইসলামপন্থী তালেবানদের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক এবং এই যুদ্ধ পাকিস্তানে গৃহ যুদ্ধে রূপ নিক এবং পাকিস্তানকে ভঙ্গুর অবস্থার দিকে ঠেলে দিক। আর সেই মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সময় বুঝে তারা ভারতকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ‘পরিবর্তনে’র শ্লোগান নিয়ে ওবামারা বার বার নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনবেন ঠিকই। কিন্তু তাদের এসব ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্র ইতিহাসের ‘পরিবর্তন’ সোনার হরিণই থেকে যায়। হয়তবা সাম্রাজ্যবাদী ধারাবাহিকতাকে আরো জোরদার করার সক্ষমতাই ওবামাদের কাঙ্খিত সেই ‘পরিবর্তনে’র সূচক !!

সমাধান কোন পথে :  মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতিই পাকিস্তানের জন্য বার বার দুর্দশা বয়ে এনেছে। মিঃ গান্ধি ভারতবর্ষের ঐক্য রক্ষার জন্য বলেছিলেন, We are first Indian then we are Hindu or Muslim ‘আমরা প্রথমে ভারতীয় তারপর হিন্দু অথবা মুসলিম’। তার উত্তরে মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলেছিলেন, we are first Muslim then we are Indian ‘আমরা প্রথমে মুসলিম তারপর ইন্ডিয়ান’। তাঁর সেদিনের এই বক্তব্য কোন আকস্মিক প্রকাশ ছিলো না বরং তা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ের ভাষা। এই ভাষাই অনূদিত হয়েছিল সুপ্রসিদ্ধ দ্বি-জাতি তত্ত্বে। আর এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই সেদিন স্বাধীন পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টি হয়। এই জন্যই তো পাকিস্তানের নামকরণ করা হয়েছিল The Islamic Republic of Pakistan। ১৮০০ মাইল দূরত্বে অবস্থান করা সত্ত্বেও কেবলমাত্র ইসলামের সূত্রেই দুই পাকিস্তান সেদিন একতাবদ্ধ হতে পেরেছিল। সুতরাং একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপলক্ষ ছিল ইসলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যে ইসলামের উপর ভিত্তি করে স্বাধীন পাকিস্তানের উদ্ভব ঘটেছিল পাকিস্তানী শাসনযন্ত্র রাষ্ট্রপরিচালনায় কখনো সেই ইসলামী শরী‘আহকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। সেই সাথে ঘন ঘন শাসক পরিবর্তন, নেতাদের উন্নাসিকতা, নেতৃত্বের লোভ, অপরিণামদর্শিতা এবং ইহুদী-খৃষ্টানদের লেজুড়বৃত্তির দরুণ ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের আর ইসলামী রাষ্ট্র হওয়া হয়নি। তাইতো ২৪ বছরের মাথায় পাকিস্তান দুর্ঘটনায় নিপতিত হল। যদি পাকিস্তান ইসলামী আইন যথাযথ অনুসরণ করত, ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সত্যিকার খেলাফতী কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করত তাহলে বাঙ্গালি জাতিকে বঞ্চনার শিকার হতে হত না এবং তাদের অস্ত্র হাতে নেওয়ার প্রয়োজন হত না। আল্লামা ইকবালের নাতি যথার্থই বলেন, ‘যেই বাঙ্গালি জাতি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন করেছিল সেই বাঙ্গালী জাতি কম ব্যথায় ব্যথিত হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেনি’। এতেও শাসকদের সম্বিত ফেরেনি। অদ্যাবধি তারা একের পর এক বিপর্যয়ের প্রতিকূল স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছেন কিন্তু তাদের আদর্শের কথা ভুলেও মাথায় আনছেন না। তালেবানরা তো কোন অযৌক্তিক, অশ্রুতপূর্ব দাবী তোলেনি। তাদের দাবী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মৌলিক লক্ষ্যের সাথেই সংগতিপূর্ণ। তারা তো তাদের সরকারের বিদেশী শক্তির পদলেহী আচরণের অবসান চেয়েছেন। সরকার ইচ্ছা করলেই তালেবান বিদ্রোহীদের সাথে এ নিয়ে আলোচনায় বসতে পারত। কেননা তারা বহির্দেশীয় কোন বর্গী নয়। তারা তো দেশেরই নাগরিক। দেশের বিপদে এরাই তো আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ভারত, আমেরিকার মত সুস্পষ্ট শত্রুর সাথে যদি আলোচনা করতে অসুবিধা না হয়, তবে স্বদেশী তালেবানদের সাথে আলোচনা, সমঝোতায় বাধা কোথায়? এ কথা অতি সত্য যে, পাকিস্তান যদি তার প্রতিষ্ঠাকালীন কক্ষপথে ফিরে যায় এবং ইসলামী শরীআহ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় তাহলে বালুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তান থেকে শুরু করে সোয়াত, কাশ্মীর সহ পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ সরকার ও সেনাবাহিনীর সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একাত্মতা ঘোষণা করবে। পাক জনগণ, সরকার ও সেনাদের এই ঈমানী ঐক্য ও সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণের আকুণ্ঠ সমর্থন ও ঐকান্তিক ভালবাসায় যে মহাবিপ্লব শুরু হবে সেই বিপ্লবে নিমিষে শুধু সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ভেসে যাবে না, ভেসে যাবে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ভারত ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সকল হুমকি ও ষড়যন্ত্র ইনশাআল্লাহ। পাকিস্তানের একতা, সংহতি, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাই মূল আদর্শের দিকে ফিরে যাওয়াই একমাত্র পথ। সকল বাধা-বিপত্তি ও অর্থনৈতিক অবরোধকে উপেক্ষা করে আজও যদি ইরান টিকে থাকতে পারে তাহলে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান পারবে না কেন? আসল সমস্যা হচ্ছে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহভীরু, সৎসাহসী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী একজন শাসকের অভাব, যিনি পকিস্তানকে স্বীয় লক্ষ্যপানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং জনতাকে সাথে নিয়ে দুর্জয় সাহসের সাথে শত্রুদের ষড়যন্ত্র মুকাবিলা করবেন। পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে সেইরূপ কোন সূর্য উদিত হওয়ার দূরূহ প্রত্যাশা নিয়ে এখনো অপেক্ষা করছে পাকিস্তানীরাসহ মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণ।

উপসংহার : পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি মুসলিম বিশ্বে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন। উম্মাহর বিভিন্ন সংকটে পাকিস্তানের ভূমিকা সমুজ্জ্বল। তাছাড়া একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় পাকিস্তান বিশ্বের মুসলমানদের আশা-ভরসারও প্রতীক। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটামুটি অগ্রসর এ দেশটি এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়েও খুব গুরুত্বূপূর্ণ। এরূপ একটি মুসলিম রাষ্ট্র আজ সাম্রাজ্যবাদীদের ভয়াল থাবায় ক্ষত-বিক্ষত। একদিকে অর্থনৈতিক সাঁড়াশী বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পাকিস্তানের গলায় শক্ত ঋনের ফাঁস পরিয়ে দিয়ে ক্রুর হাসি হাসছে, অন্যদিকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামক ভয়ানক সংহারী তোপ তার দিকে নিশানা করে রয়েছে। পাকিস্তানের এহেন সংকট মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব কি কোনরূপ পদক্ষেপ নিচ্ছে? তারা কি বিগত দিনের মত আজও বেহুঁশ হয়েই পড়ে থাকবে? নখদন্তহীন ওআইসির কি কোন দিনই উম্মাহর প্রয়োজনে সামান্য ভূমিকাও রাখার সুযোগ হবে না? আর কতকাল আমাদের পশ্চিমা বিশ্বের কদমবুচি করে চলতে হবে? কতকাল তাদের করুণার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? কবে হবে ন্যাটোর মত একটি আর্ন্তজাতিক ইসলামী সেনাবাহিনী, যেই সেনাবাহিনী প্রতিটি মুসলিম দেশসহ মযলূম জনতার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে হবে বদ্ধপরিকর? কতকাল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর কাছে ভিক্ষা করে যেতে হবে? কবে আসবে পূর্ণাঙ্গ সূদমূক্ত ইসলামী অর্থনীতি, যার হাতে জনসাধারণের জান-মাল, সহায়-সম্পদ থাকবে নিরাপদ? আল্লাহ আমাদের শাসকদের সুমতি দিন এবং তাদের হেদায়তর পথ সুপ্রশস্ত করুন। আমীন!!


[1]. পাকিস্তান ভাঙ্গার মার্কিন মহাপরিকল্পনা, মোতালেব জামালি, নয়া দিগন্ত, ৩ ডিসেম্বর ২০০৮, পৃ.৭।

[2]. পাকিস্তান ভাঙ্গার মার্কিন মহাপরিকল্পনা, মোতালেব জামালী, নয়াদিগন্ত, ডিসেম্বর, ২০০৮, পৃ.৭।

[3]. বিপন্ন মানুষ আর রক্তমাখা আতরের কথা, ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম আলো, পৃ: ১২, ১৯.০৫.২০০৯ (গৃহীত ফরেন এ্যাফেয়ার্স মার্চ/এপ্রিল’০৯)  

[4]. বেলুচিস্তান পরিস্থিতি : ফায়দা তুলছে ভারত, খালিদ খোকা, বঙ্গানুবাদ-মীযানুল করীম, নয়া দিগন্ত, ৩ মে ২০০৯, পৃ. ৬।

[5]. ঐ।

[6].  বর্তমান জঙ্গিবাদ, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ : সরাসরি প্রতিক্রিয়া, ইমরান খান, বিশেষ সাক্ষাৎকার, তেহরান টাইমস, নয়াদিগন্ত, ২৯ এপ্রিল ২০০৯, পৃ. ৯।

[7]. পাকিস্তান ভাঙার মার্কিন মহা পরিকল্পনা, মোতালেব জামালী, নয়া দিগন্ত, ৩ ডিসেম্বর ২০০৮, পৃ.৭।

[8]. ভারতের ৯/১১ : পেছনে কারা? গোলবাল রির্সাচ, মাইকেল চসুদোভস্কি, বঙ্গানুবাদ : ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর, ২০০৮, পৃ.১২।

[9]. পাকিস্তান ভাঙার মার্কিন মহা পরিকল্পনা, মোতালেব জামালী, নয়া দিগন্ত, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮, পৃ.৭।

[10]. গ্লোবালাইজেশন আওর ইসলাম, ইয়াসীর নাদীম, দারুল কিতাব দেওবন্দ, ভারত। বঙ্গানুবাদ : ‘বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্রাটেজী’, শহীদুল ইসলাম ফারুকী, প্রফেসরস পাবলিকেশন্স, মগবাজার ঢাকা, পৃ. ৯২।

[11].  বর্তমান জঙ্গিবাদ, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ : সরাসরি প্রতিক্রিয়া, ইমরান খান, বিশেষ সাক্ষাৎকার, তেহরান টাইমস, নয়াদিগন্ত, ২৯ এপ্রিল ২০০৯, পৃ. ৯।



আরও