কর্মী সম্মেলন ২০১৮

ড. নূরুল ইসলাম 771 বার পঠিত

কর্মী সম্মেলন ২০১৮

নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী এ দেশের একক যুবসংগঠন বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর বার্ষিক কেন্দ্রীয় কর্মী সম্মেলন ২০১৮ সমাগত। প্রতিবছর সংগঠনের সকল স্তরের কর্মী ভাইদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি, বিগত দিনের কর্মসূচীসমূহ মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের বৃহত্তর উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। যে কোন সংগঠনের মূল প্রাণশক্তি হল এর কর্মীবাহিনী। কর্মীদের পক্ষেই সম্ভব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সুশৃংখল কর্মনীতি নিয়ে জীবন ও সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে একটি ইতিবাচক ও অর্থবহ ভূমিকা পালন করা। এজন্য কর্মীদের এই বিশেষ সম্মেলন নিঃসন্দেহে একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অতীব গুরুত্বের দাবীদার। 

মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হল সংঘবদ্ধতা। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, জ্ঞাতে হোক বা অজ্ঞাতে হোক, কেউ কখনও বিচ্ছিন্ন ও একাকী জীবন যাপন করতে পারে না। তার কারণ মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং পরনির্ভর। অপরের সহযোগিতা ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষে এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। সুতরাং তাদেরকে স্রষ্টার বেঁধে দেয়া এক অমোঘ নিয়মে সংঘবদ্ধ হতেই হয়। এই নিয়ম দেশ-কাল-পাত্র ভেদে নানা রূপে নানা মাত্রায় প্রতিভাত হয়। ভৌগলিক অবস্থান, আচার, ভাষা, বর্ণ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য ও মিল-অমিলের দিক থেকে মানুষের পারস্পরিক এই সম্পর্ক ও সংঘবদ্ধতা আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং কখনও তা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মোহনা উপনীত হয়। যেমন একই বর্ণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষের মধ্যেও যারা সৎজীবন যাপনের প্রত্যাশী, তারা সর্বদা সৎসঙ্গ খোঁজেন; আবার যারা অসৎজীবন যাপনকারী তারা অনুরূপ সহযোগীর অনুসন্ধানে থাকেন। অর্থাৎ যে যেভাবে জীবনটাকে সাজাতে চান, যে যেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন তেমনিভাবে জীবনসাথী নির্বাচন করে থাকেন। এভাবে সংঘবদ্ধতা ছোট-বড় বিভিন্ন পরিসরে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এটিই জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। এর বিশেষ কোন ব্যত্যয় নেই। আধুনিককালে সংগঠন হল এই নিয়মেরই অধীন একটি বৃহত্তর কাঠামো যা সমমনা মানুষের মাঝে যুথবদ্ধতা তৈরী করে এবং ঐক্যের সূত্র ধরে রাখে।

জগতের অমোঘ নিয়ম হওয়ার পাশাপাশি সংঘবদ্ধতা এমন এক কার্যকরী দুনিয়াবী শক্তি, যা মানুষকে জীবন পরিচালনার পথ সুগম করে, শত্রুর বাঁধা মোকাবিলা শক্তি যোগায় এবং যাবতীয় বিপদাপদে সুদৃঢ় রাখে। এজন্য ইসলামী জীবনাদর্শে মুমিনসমাজকে বার বার ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ না থাকার নেতিবাচক ফলশ্রুতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। সুতরাং যারা হকের ওপর দৃঢ়চিত্ত থাকতে চান এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে চান, তাদের জন্য সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের কোন বিকল্প নেই। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ বিগত কয়েক দশক যাবৎ বাংলাদেশের বুকে সাংগঠনিকভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। এই দাওয়াতের বরকতপূর্ণ ফলস্বরূপ কর্মীদের ঘামঝরা প্রচেষ্টা এবং বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে অহির বিধানের প্রতি আত্মসমার্পণের আহবান- ‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’, ‘সকল বিধান বাতিল কর, অহির বিধান কামনা কর’। আহলেহাদীছ আন্দোলন আজ যে মজবুত শিকড় বিস্তার করেছে এ দেশের আনাচে-কানাচে, তার পেছনে এক অমূল্য অবদান রেখেছে এই সংঘবদ্ধ দাওয়াতের বরকতময় বারিসিঞ্চন। ফালিল্লাহিল হামদ সুতরাং আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে এই সাংগঠনিক ও জামা‘আতবদ্ধ দাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। 

অধূনা যারা সংঘবদ্ধ দাওয়াতের সাথে আত্মবিরোধ অনুভব করেন এবং তাতে সবকিছু ছাপিয়ে দলীয় সংকীর্ণতার আভাস আবিষ্কার করেন, তারা হয় বাস্তব জগত সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন না অথবা স্বার্থদুষ্টতার প্রভাবে তা স্বীকার করতে প্রস্ত্তত নন। নতুবা কোন সচেতন ও সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে এমন স্থূল ধারণা পোষণ করা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। ততোধিক বিস্ময়কর হল, জগতের অন্য কোন সংঘবদ্ধতার ধারণাকে নাকচ না করে কেবল নাকচ করেন আহলেহাদীছ জামা‘আতের সংঘবদ্ধতাকে। পৃথিবীর সকল সমাজে নেতৃত্বের প্রয়োজন, সুশৃংখল কর্মনীতির প্রয়োজন, একনিষ্ঠ কর্মীর প্রয়োজন; কেবল প্রয়োজন নেই আহলেহাদীছ জামাআতের! তাহলে সমাজ গড়ার কাজে নেতৃত্ব কিভাবে তৈরী হবে? কোন পদ্ধতিতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে? বৃহত্তর কর্মসূচী কিভাবে বাস্তবায়িত হবে? জাতীয় জীবন সুদূরীপ্রসারী লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে?

আমরা মনে করি এই নেতিবাদি চিন্তাধারার জন্ম একধরণের পরাজিত অথবা জাগতিক ভোগসর্বস্ব মানসিকতা থেকে। শুধু তা-ই নয়, এই মানসিকতা যেন পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরই ভিন্নতর রূপ, যেখানে ব্যক্তি অপরের প্রতি দায়-দায়িত্বহীনভাবে কেবল নিজের স্বার্থে এবং আপনার মর্জি মাফিক চলতে পারার স্বাধীনতাকেই জীবনের পরমার্থ মনে করা হয়। অথচ এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী জীবনব্যবস্থার মৌলিক রূপরেখার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম যেখানে সর্বদা ঐক্যের ধারণাকে প্রণোদনা দেয়, সেখানে এরূপ আত্মকেন্দ্রিকতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কোন ধারণাই স্থান পেতে পারে না।

অতএব সচেতন যুবক ভাইদের প্রতি আমাদের আহবান থাকবে, যেখানেই থাকুন জামাআতবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ থাকার চেষ্টা করুন। নতুবা বাতিলের সর্বপ্লাবী ও সাড়াশী আক্রমণে আমাদের ঈমান ও আমল যে কোন মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে। সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব বাতিলের বিরুদ্ধে হককে বিজয়ী করা। এজন্য আল্লাহ ঈমানদারদের সীসাঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন (ছফ ৪)। সাংগঠনিক জীবন আমাদেরকে এমন একটি দ্বীনী বন্ধুত্বের সার্কেল প্রদান করে, যার মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরকে হক্বের প্রতি আহবান করা যায় এবং বিপদাপদে পাশাপাশি থাকার প্রতিজ্ঞা গড়ে তোলা যায়। সাংগঠনিক জীবন এমন একটি শক্তি যা আমাদেরকে সহজে বাতিলের স্রোতে হারিয়ে যেতে দেয় না, বরং ব্যক্তির মধ্যে এমন ইস্তিকামাত ও দৃঢ়তা তৈরী করে যা তাকে দ্বীনের পথ থেকে সাধারণত বিচ্যুত হতে দেয় না। সাংগঠনিক জীবন আমাদের শৃংখলা শেখায়, স্বেচ্ছাচারিতার পথ রুদ্ধ করে দেয়, অপরের কল্যাণে ভাবতে শেখায়, আত্মকেন্দ্রিক না করে বহুকেন্দ্রিক করে, সমগ্র জাতি ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরী করে। সর্বোপরি সংগঠন সেই দুনিয়াবী শক্তি যা আল্লাহ রাববুল আলামীন বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রস্ত্তত রাখতে বলেছেন (আনফাল ৬০)। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকল ভাইকে তাঁর দ্বীনের পথে যোগ্য খাদেম হিসাবে কবুল করে নিন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ছহীহ দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: সম্পাদকীয়
আরও