যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক : গুরুত্ব ও ফযীলত

আসাদুল্লাহ আল-গালিব 8822 বার পঠিত

উপস্থাপনা :


আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিজীবকে একে অন্যের উপর প্রাধান্য ও মর্যাদা দিয়েছেন। অনুরূপভাবে একটি দিনকে অপর দিনের চেয়ে, একটি মাসকে অপর একটি মাসের চেয়ে ফযীলতপূর্ণ করেছেন। যেমন সপ্তাহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন জুম‘আর দিন। আর রাত্রিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম রামাযানের শেষ দশক, যা লায়লাতুল ক্বদর দ্বারা মর্যাদাবান হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০দিন বছরের সকল দিনের চেয়ে ফযীলতপূর্ণ, যা মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার নিমিত্তে উৎসর্গকৃত কুরবানীর মাধ্যমে।

এই দশকের ছালাতের মর্যাদা বছরের বাকী দিনগুলির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। অনুরূপভাবে ছিয়াম, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির-আযকার, আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার, পিতামাতার প্রতি সদাচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ়করণ, মানুষের প্রয়োজন পূরণ, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাযায় অংশগ্রহণ, প্রতিবেশীর সাথে উত্তমাচরণ, অভাবীকে খাওয়ানোসহ অন্যান্য ফযীলতপূর্ণ আমলগুলো এ দশককে মর্যাদার উচ্চ শিখরে পৌঁছায়। নিম্নে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের কিছু ফযীলতপূর্ণ আমলসমূহ নিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ!

যিলহজ্জের প্রথম দশকের ফযীলত :

ইসলাম পঞ্চস্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত’।[1] এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে একমাত্র হজ্জই আর্থিক ও দৈহিক শক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে। সেকারণ যিলহজ্জের প্রথম দশকের ফরয ইবাদতের মর্যাদা অন্যান্য ফরয ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই দশকের নেকী অনেক বেশী। আর এর নফল ইবাদতসমূহ অন্যান্য দিনের নফল ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ’।[2] 

ফযীলতের কারণ :

এই দশক ফযীলত ও আমলের দিক দিয়ে বছরের অন্যান্য দিনগুলির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর এই দশকের দিনগুলো শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণ হ’ল এর মধ্যে রয়েছে হজ্জ, কুরবানী, আরাফা ও ইয়াওমুত তারবিয়া’।[3]

হজ্জের মাস :

মহান আল্লাহ বলেন, الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ ‘হজ্জের মাসগুলি নির্ধারিত’ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)। আর এগুলো হ’ল শাওয়াল, যিলক্বদ, যিলহজ্জের প্রথম দশদিন। অধিকাংশ ছাহাবী বিশেষ করে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব, তার ছেলে আব্দুল্লাহ, আলী, ইবনু মাসঊদ, ইবনু আববাস, ইবনু যুবায়ের, আনাস (রাঃ) সহ অধিকাংশ তাবেঈগণ এই মত দিয়েছেন’।[4] 

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের শ্রেষ্ঠত্ব :

হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ يَعْنِى أَيَّامَ الْعَشْرِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَىْءٍ- ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় কোন আমল নেই। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, জিহাদও নয়। তবে ঔ ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) বেরিয়েছে এবং আর সে কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি’।[5]

অর্থাৎ এই দশকে মহিমান্বিত কয়েকটি ইবাদত রয়েছে যা অন্য কোন সময় আদায় করা সম্ভব নয়। যেমন হজ্জ, কুরবানী। এর সাথে সাথে ছালাত আদায়, ছিয়াম (যবেহকৃত পশুর কলিজা বা গোশত দিয়ে ইফতার করা পর্যন্ত) ও ছাদাক্বার মিলন ঘটে’।[6] 

১ম দশকের রাত্রির মর্যাদা :

এই দশকের রাত্রির মর্যাদায় পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এর কসম করে বলেছেন, وَالْفَجْرِ- وَلَيَالٍ عَشْرٍ ‘শপথ ফজরের’। ‘শপথ দশ রাত্রির’ (ফজর ৮৯/১-২)। জমহুর মুহাদ্দিছগণের নিকট এই দশ রাত্রি হ’ল যিলহজ্জের প্রথম দশক’।[7]

১ম দশকের দিনের মর্যাদা :

নিশ্চয়ই এই দশকের দিনগুলো অত্যাধিক মর্যাদাপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেছেন,لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ‘যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হ’তে পারে এবং রিযিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুসমূহ যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলিতে তাদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে’ (হজ্জ ২২/২৮)।أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ দ্বারা অধিকাংশ জমহুর উলামাগণ যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনকে বুঝিয়েছেন’।

এই দশকে ইসলামের পূর্ণতা :

এই দশকে আরাফার দিন মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এই দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। কুরআনের ভাষায়- الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)

এই মাসে করণীয় আমলসমূহ :

১. অধিক পরিমাণে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمَ عِنْدَ اللَّهِ وَلاَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الْعَمَلِ فِيهِنَّ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ الْعَشْرِ فَأَكْثِرُوا فِيهِنَّ مِنَ التَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ وَالتَّحْمِيدِ ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও আমলের দিকে দিয়ে প্রিয় এই দশদিন ব্যতীত আর কোন দিন নেই। অতঃপর তোমরা অধিক পরিমাণে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) পেশ কর’।[8]

তাকবীর ধ্বনি মুমিনের অন্তর উজ্জীবিত করে। শত্রুদের ভীত-সন্তুস্ত করে। আর এগুলো হ’ল আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় কালাম। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَحَبُّ الْكَلاَمِ إِلَى اللَّهِ أَرْبَعٌ سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ. আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় কালাম চারটি। ‘সুবহানাআল্লাহ’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’।[9]

ইয়ামুত তাশরীকের দিনগুলোতে ইবনু ওমর ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বাজারে গেলে উচ্চস্বরে ঈদের তাকবীর ধ্বনি দিতেন। তাদের সাথে সাথে মানুষরাও তাকবীর ধ্বনি দিত’।[10]

২. মাসের প্রথম ৯দিন ছিয়াম ছিয়াম :

যিলহজ্জের প্রথম ৯দিন ছিয়াম পালন করা মুস্তাহাব। সালাফে ছালেহীনরা এই ছিয়ামকে উত্তম মনে করতেন, যদিও রাসূল (ছাঃ) নিজে এই দিনগুলিতে ছিয়াম পালন করেননি মর্মে বর্ণনা করেছেন আয়েশা (রাঃ)। ছিয়াম পালন করা প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় এক দিনও ছিয়াম পালন করে, আল্লাহ তার মুখমন্ডলকে (অর্থাৎ তাকে) জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেন’।[11] 

২. আরাফার মাঠে অবস্থান :

আরাফার মাঠ হাজীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই দিনে আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ وَإِنَّهُ لَيَدْنُو عَزَّ وَجَلَّ ثُمَّ يُبَاهِى بِهِمُ الْمَلاَئِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ ‘মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরাফার দিন জাহান্নাম থেকে যত অধিক সংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন, অন্য কোন দিন এত অধিক বান্দাকে নাজাত দেন না। মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ এ দিন (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করে বলেন, তারা কী চায়?[12]

সুতরাং এই দিনে অধিক পরিমাণে দো‘আ করতে হবে। এই দিনের সর্বোত্তম দো‘আ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ ‘আরাফার দিনের দো‘আই উত্তম দো‘আ’।[13]

৪. আরাফার দিনে ছিয়াম :

আরাফার মাঠে অবস্থানরত হাজী ছাহেবগণ ব্যতীত বাকীরা এই দিনে ছিয়াম পালন করবে। এই দিনের ছিয়াম পালনের ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَهُ ‘আরাফাত দিবসের ছিয়াম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী ১ বছর ও পরবর্তী ১ বছরের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে’।[14]

৫. হজ্জে আকবার এবং কুরবানী :

মজার ব্যাপার হ’ল, আমরা রামাযানের দিনগুলোতে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার সন্তুষ্টির নিমিত্তে না খেয়ে কষ্টের মধ্য দিয়ে ছিয়াম পালন করে থাকি। অথচ কুরবানীর দিনে আমরা খেয়ে থাকি। তারপরও আল্লাহর নিকট এই দিনটি অধিক প্রিয়। এই মহান দিন সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ أَعْظَمَ الأَيَّامِ عِنْدَ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمُ النَّحْرِ ثُمَّ يَوْمُ الْقَرِّ ‘নিশ্চয় দিনগুলোর মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হ’ল, নাহরের (কুরবানীর) দিন। এরপর এর পরবর্তী দিন (কুরবানীর দ্বিতীয় দিন)।[15]

কুরবানীর দিনটি একটি ফযীলতপূর্ণ সময়। এজন্য এর নাম হ’ল (يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ) বা শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিন। হাদীছে এসেছে, ইবন ওমর (ছাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَفَ يَوْمَ النَّحْرِ بَيْنَ الْجَمَرَاتِ فِي الْحَجَّةِ الَّتِي حَجَّ فَقَالَ أَيُّ يَوْمٍ هَذَا قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الْأَكْبَر ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরবানীর দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন? ছাহাবাগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন নাহার বা কুরবানির দিন। রাসূলে করীম (ছাঃ) বললেন, এটা হ’ল ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবার বা শ্রেষ্ঠ হজ্জের দিন’।[16]

৬. হাজীদের রসদপত্র সরবরাহ করা অথবা তাদের পরিবারের দেখভাল করা :

হাজীদের রসদপত্র সরবরাহ করা অথবা তাদের সন্তানদের দেখভাল করার অত্যাধিক ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا أَوْ جَهَّزَ حَاجًّا أَوْ خَلَفَهُ فِي أَهْلِهِ أَوْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أُجُورِهِمْ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْتَقِصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ ‘যে ব্যক্তি কোন জিহাদকারী গাযীকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করল অথবা কোন হাজীর রসদপত্র সরবরাহ করল অথবা তাদের পরিবার-পরিজনকে উত্তমরূপে দেখাশোনা করল অথবা কোন ছিয়ামপালনকারীকে ইফতার করালো, সে তাদের সমপরিমাণ নেকী পাবে। এতে তাদের নেকীর পরিমাণ কম হবে না’।[17]

৭. অন্যায় কাজ ছেড়ে দেওয়া :

কোন ছায়েম যদি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন না করে, তাহ’লে তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্‌‌‌‌‌‌‌প্রয়োজন নেই। অনুরূপ এ মাসেও আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা অন্যায় বা খারাপ কাজ করাকে হারাম করেছেন। কুরআনের ভাষায় বলেন,

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ ‘নিশ্চয় আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাসসমূহের গণনা হ’ল বারোটি। যার মধ্যে চারটি মাস হ’ল ‘হারাম’ (মহাসম্মানিত)। এটিই হ’ল প্রতিষ্ঠিত বিধান। অতএব এ মাসগুলিতে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না’ (তাওবাহ ৯/৩৬)

মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ ‘উপরেরগুলি এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ সমূহকে সম্মান করে, নিশ্চয়ই সেটি হৃদয় নিঃসৃত আল্লাহভীতির প্রকাশ’ (হজ্জ ২২/৩২)। অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ ‘বর্ণিত (হজ্জের) বিধান সমূহ পালন ছাড়াও যে ব্যক্তি আল্লাহকৃত হারাম সমূহকে সম্মান করবে (অর্থাৎ পাপ সমূহ হ’তে বিরত থাকবে), সেটি তার প্রতিপালকের নিকট তার জন্য উত্তম হবে’ (হজ্জ ২২/৩২)

৮. হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ :

হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إنَّ مسحَ الحجرِ الأسودِ، و الركنَ اليمانيِّ، يَحُطَّانِ الخطايا حطّاً ‘নিশ্চয় যে রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে, তার সমস্ত গোনাহ ঝরে পড়বে’।[18] অপর হাদীছে হাজারে আসওয়াদ সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَاللَّهِ لَيَبْعَثَنَّهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، لَهُ عَيْنَانِ يُبْصِرُ بِهِمَا، وَلِسَانٌ يَنْطِقُ بِهِ، يَشْهَدُ عَلَى مَنِ اسْتَلَمَهُ بِحَقٍّ ‘আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন হাজারে আসওয়াদকে উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দু’টি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি যবান থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য দিবে, যে ব্যক্তি খালেছ অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছে’।[19]

৯. ত্বাওয়াফ :  

উমায়র (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনু উমর (রাঃ) চাপাচাপি করে হলেও হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামনী বায়তুল্লাহর এই দুই রুকনে যেতেন। আমি একদিন তাঁকে বললাম, আপনি এ দু’টি রুকনে ভীড়ে চাপাচাপি করে হলেও গিয়ে উপস্থিত হন কিন্তু অন্য কোন ছাহাবী তো এমন চাপাচাপি করে সেখানে যেতে দেখি না। তিনি বললেন, যদি অমি এরূপ চাপাচাপি-ধাক্কাধাক্কি করি তাতে দোষ কি? আমি তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, এ দু’টি রুকন স্পর্শ করলে গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যায় তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, কেউ যদি যথাযথ ভাবে বায়তুল্লাহ সাতবার ত্বাওয়াফ করে একটি ক্রীতদাস আযাদ সমপরিমাণ ছওয়াব হয়। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, ত্বাওয়াফ করতে গিয়ে এমন কোন কদম সে রাখেনা বা তা উঠায়না যদ্বারা তার একটি গুনাহ মাফ না হয় এবং একটি নেকী লেখা না হয়’।[20]

১০. যমযম কূপের পানি :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ مَاءُ زَمْزَمَ فِيهِ طَعَامٌ مِنَ الطُّعْمِ وَشِفَاءٌ مِنَ السُّقْمِ ‘ ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হ’ল যমযমের পানি। এই পানি কোন রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন’।[21] অন্য বর্ণনায় এসেছে। ‘এটি বরকত মন্ডিত’।[22]

১১. হজ্জের ফযীলত :

মাবরূর বা কবুল হজ্জের মর্যাদা অত্যাধিক। যা হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ‘আর জান্নাতই হ’ল হজ্জে মাবরূরের প্রতিদান’।[23]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ্জ হ’তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’।[24]

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّ الْمُتَابَعَةَ بَيْنَهُمَا تَنْفِى الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِى الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ ‘তোমরা ধারাবাহিকভাবে হজ্জ ও ওমরা আদায় করো। কেননা এ দু’টি ধারাবাহিকভাবে আদায় করলে তা দারিদ্র ও গুনাহ দূরীভূত করে, যেমন হাপর লোহার মরিচা দূর করে’।[25]

১২. ওমরার ফযীলত :

ওমরা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا ‘এক ওমরা অপর ওমরা পর্যন্ত সময়ের (ছগীরা গোনাহ সমূহের) কাফফারা স্বরূপ’।[26]

১৩. তালবিয়াহ পাঠের ফযীলত :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُلَبِّى إِلاَّ لَبَّى مَنْ عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ مِنْ حَجَرٍ أَوْ شَجَرٍ أَوْ مَدَرٍ حَتَّى تَنْقَطِعَ الأَرْضُ مِنْ هَا هُنَا وَهَا هُنَا ‘যখন কোন মুসলিম তালবিয়াহ পাঠ করে, তখন তার ডান ও বামে পাথর, বৃক্ষরাজি, মাটি সবকিছুই তার সাথে তালবিয়াহ পাঠ করে। এমনকি পৃথিবীর এ প্রান্ত হ’তে ও প্রান্ত পর্যন্ত (তালবিয়াহ পাঠকারীদের দ্বারা) পূর্ণ হয়ে যায়’।[27]

১৪. জামরায় পাথর নিক্ষেপের ফযীলত :

রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَإِذَا رَمَى الْجِمَارَ؛ لا يَدْرِي أَحَدٌ مَا لَهُ حَتَّى يُوَفَّاهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যখন জামরায় পাথর নিক্ষেপ করা তখন কেউ জানতে পারেনা এর ফযীলত। যা তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রদান করা হবে’।[28] অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, وَأَمَّا رَمْيُكَ الجِمَار؛ فَلَكَ بِكُلِّ حَصَاٍة رَمَيْتَهَا تَكْفِيرُ كَبِيرَةٍ مِنَ الـمُوبِقَاتِ ‘তোমার জামরায় পাথর নিক্ষেপের দ্বারা প্রত্যেক কংকরের বিনিময়ে একটি করে ধ্বংসাত্মক পাপ ক্ষমা করা হবে’।[29] অন্যত্র বলা হয়েছে, إِذَا رَمَيْتَ الجِمَارَ كَانَ لَكَ نُوراً يَوْمَ القِيَامَةِ ‘যখন তুমি জামরায় কংকর নিক্ষেপ করবে ক্বিয়ামতের দিন তা তোমার জন্য নূর বা জ্যোতি হবে’।[30]


[1]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৩।

[2]. ফৎহুল বারী ইবনে রজব ৯/১৫ পৃ.।

[3]. মাজমু‘ ফাতওয়া ২৫/২৮৭; ইবনুল কাইয়িম, বাদায়েউল ফাও‘আয়েদ ৩/১৬২; যাদুল মা‘আদ ১/৫৭; ইবনু কাছীর ৫/৪১৬ পৃ.।

[4]. লাতায়েফুল মা‘আরেফ ২৬৯ পৃ.।

[5]. আবু দাঊদ হা/২৪৩৮; আহমাদ হা/১৯৬৮; ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ হা/২৮৬৫।

[6]. ফৎহুল বারী ইবনে হাজার ২/৪৬০ পৃ.।

[7]. ইবনু কাছীর ৮/৩৯০; ইবনু রজব, লাতাইফুল মা‘আরিফ, পৃ.২৬৮।

[8]. আহমাদ হ/৫৪৪৬।

[9]. মুসলিম হা/২১৩৭; মিশকাত হা/২২৯৪।

[10]. বুখারী হা/৪/১১৩ পৃ.; মাজমু‘ ফাতওয়া ২৪/২২৫।

[11]. বুখারী হা/২৮৪০; মুসলিম হা/১১৫৩; মিশকাত হা/২০৫৩।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/৩০১৪; নাসাঈ হা/৩০০৩; মুসলিম হা/১৩৪৮।

[13]. তিরমিযী হা/৩৫৮৫; মিশকাত হা/২৫৯৮।

[14]. মুসলিম হা/১১৬২; ইবনু মাজাহ হা/১৭২৩; মিশকাত হা/২০৪৪।

[15]. আবু দাঊদ হা/১৭৬৫।

[16]. আবু দাউদ হা/১৯৪৫।

[17]. ইবনু খুযাইমাহ হা/২০৬৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৭৮।

[18]. জামেঊছ ছগীর হা/২৪৩২; ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৭২৯

[19]. তিরমিযী হা/৯৬১; ইবনু মাজাহ হা/২৯৪৪; দারেমী হা/১৮৮১; ছহীহ আত-তারগীব হা/১১৪৪; মিশকাত হা/২৫৭৮।

[20]. তিরমিযী হা/৯৫৯; হাকেম হা/১৭৯৯; মিশকাত হা/২৫৮০।

[21].  দারাকুৎনী, হাকেম, ছহীহ তারগীব হা/১১৬৪।

[22].  আহমাদ, মুসলিম; ছহীহাহ হা/১০৫৬

[23]. বুখারী হা/; ১৭৭৩; মুসলিম হা/১৩৪৯।

[24]. বুখারী হা/১৫২১; মুসলিম হা/৩৫০; মিশকাত হা/২৫০৭

[25]. ইবনু মাজাহ হা/২৮৮৭; তিরমিযী হা/৮১০; নাসাঈ হা/২৬৩০।

[26]. বুখারী হা/১৭৭৩; মুসলিম হা/১৩৪৫; মিশকাত হা/২৫০৮।

[27]. তিরমিযী হা/৮২৮; মিশকাত হা/২৫৫০।

[28]. ইবনু হিববান হা/১৮৮৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১১৫৫; আলবানী হাদীছটি হাসান বলেছেন।

[29]. বাযযার হা/৬১৭৭; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১১১২; আলবানী হাদীছটি হাসান লি গাইরিহী বলেছেন।

[30]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১১৫৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৫১৫; হাদীছটি হাসান ছহীহ।



আরও