হজ্জে তালবিয়া পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ফায়ছাল মাহমূদ 8459 বার পঠিত

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জ। পবিত্র কুরআন ও হাদীছে যার হাকীকত ও ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য সম্পাদন করেনি, সে হজ্জ হ’তে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল’।[1]

হজ্জের কতিপয় রোকন ও সুন্নাত সমূহ রয়েছে। তম্নধ্যে তালবিয়া পাঠ করা অন্যতম সুন্নাত। ইহরাম বাঁধার পর থেকে মসজিদুল হারামে পৌঁছা পর্যন্ত ইহরাম বাঁধার কারণে নিষিদ্ধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং হালাল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তালবিয়াহ পাঠ করতে হয়। এই তালবিয়াহ পুরুষগণ স্বরবে ও মহিলাগণ নিম্নস্বরে পাঠ করবেন। হজ্জের তালবিয়াহ হ’ল নিম্নরূপ :

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ অর্থ: ‘আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’।[2]

হজ্জে তালবিয়াহ পাঠের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُلَبِّى إِلاَّ لَبَّى مَنْ عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ مِنْ حَجَرٍ أَوْ شَجَرٍ أَوْ مَدَرٍ حَتَّى تَنْقَطِعَ الأَرْضُ مِنْ هَا هُنَا وَهَا هُنَا ‘কোন মুসলিম যদি তালবিয়াহ পাঠ করে তখন তার সাথে সাথে ডানে-বামে যা কিছু রয়েছে পাথর, গাছ-পালা কিংবা মাটির ঢেলা তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকে। এমনকি এখান থেকে এদিক ও দিকে (পূর্ব ও পশ্চিমের) ভুখন্ডের শেষসীমা পর্যন্ত’।[3]

উত্তম হজ্জের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে হজ্জের মধ্যে উচ্চস্বরে তালবিয়াহ পাঠ করা হয়। যেমন তা এভাবে হাদীছে এসেছে- عَنْ أَبِى بَكْرٍ الصِّدِّيقِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سُئِلَ أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ الْعَجُّ وَالثَّجُّ আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল কোন প্রকার হজ্জ উত্তম? তিনি বললেন, চিৎকার করা (উচ্চস্বরে তালবিয়াহ পাঠ করা) ও রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানী দেওয়া)।[4]

হজ্জে তালবিয়াহ পঠের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যসমূহ :

১. এক আল্লাহর আহবানে সাড়া দেওয়া :

মুসলিম জাতির কিবলা কাবাঘর বা বায়তুল্লাহ প্রথমে নির্মাণ করেন আল্লাহর আদেশপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ। অতঃপর আদম (আঃ)। তারপর হযরত নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের সময় কাবাঘরের প্রাচীর বিনষ্ট হলেও ভিত্তি পূর্বের মতই ছিল। পরবর্তীকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে ইবরাহীম (আঃ) কাবা পুননির্মাণ করেন। বায়তুল্লাহ নির্মাণ সমাপ্ত হলে আল্লাহ মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ)-কে ফরয হজ্জ ঘোষণা দেওয়ার আদেশ দেন এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করেন। সেই থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ত্বাওয়াফ চলে আসছে। যা আল্লাহর সেই আহবানে সাড়া দেওয়ার নামান্তর, যেখানে আল্লাহ বলেন,وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ- لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ- ‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে’। ‘যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে এবং রিযিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুসমূহ যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলিতে তাদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ ও অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও’ (হজ্জ ২২/২৭-২৮)

ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সূত্র দিয়ে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীমী আহবানের জাওয়াবই বর্তমান হাজীদের লাববায়িক আল্লাহুম্মা লাববায়িক (হাযির হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। আর সেদিন থেকে এযাবৎ পর্যন্ত হজ্জের মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর হতে বনু আদম চলেছে কাবার পথে আলহামদুলিল্লাহ!

২. সকল প্রকার শিরক বিমুখতার ঘোষণা :

জাহান্নামী হওয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর মাধ্যম হ’ল শিরক বা আল্লাহর সাথে কারও সমকক্ষ স্থাপন করা। হজ্জে গমন করে বারংবার তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে আদম সন্তান যাবতীয় শিরক বিমুখতার সেই নযীর স্থাপন করে এবং বলে লাববায়িক লা শারীকা লাকা (হাযির হে প্রভূ! তোমার কোন শরীক নেই)।

কারণ সে শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৫/৭২)

৩. যাবতীয় প্রশংসা এক আল্লাহর দিকে নিবেদন করা :

একজন প্রকৃত সর্বাবস্থায় তার মহান রব আল্লাহর প্রশংসা করে। হজ্জের ময়দানে তালবিয়াহ পাঠ এবং বারংবার একই বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে সে আল্লাহর প্রশংসায় নিমগ্ন থাকে। এধরনের প্রশংসাকারী মুসলিমদের জন্য চিরকাল থাকার জায়গা জান্নাত। যেমন আল্লাহ বলেন, دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ সেখানে তাদের প্রার্থনা হবে, ‘মহা পবিত্র তুমি হে আল্লাহ’ এবং পরস্পরের সম্ভাষণ হবে ‘সালাম’। আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হবে ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বচরাচরের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য’ (ইউনুস ১০/১০)

আর প্রশংসার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ বল, সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহরই জন্য’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১১)

৪. অগণিত নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করা :

বান্দার উপর মহান আল্লাহর নে‘মত অগনিত। এই অজস্র নে‘মতসমূহের শুকরিয়া আদায় করা বান্দার পক্ষে সম্ভব না হ’লেও তাকে আরও বেশী বেশী কল্যাণের অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকাটাই সমীচীন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বেশী বেশী করে দেয়। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (ইবরাহীম ১৪/৭)

আর তাইতো ফরয হজ্জ পালনরত হাজী ছাহেবরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলে, إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ অর্থ ‘নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা ও অনুগ্রহ সবই তোমার’।

৫. পাপ হ’তে মুক্তি :

সৃষ্টিগতভাবেই আদম সন্তান দূর্বল এবং মন্দ কর্মের প্রতি আসক্ত। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দপ্রবণ। কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার প্রতি আমার প্রভু দয়া করেন। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইউসুফ ১২/৫৩)। মানুষ পাপ করবে এটাই বাস্তবতা। কিন্তু সেটার কারণে অনুতপ্ত বান্দাহ উত্তম হিসাবে পরিগণিত। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ بَنِى آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী; আর ভুলকারীদের মধ্যে উত্তম তারা যারা ভুল করার পরে তাওবা করে। (আহমাদ হা/১৩০৪৯; তিরমিযী হা/২৪৯৯)

আর তাই বান্দার জীবনে সংঘটিত বেহিসাবী পাপ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন যরূরী। পাপ মোচনের এই সুবর্ণ সুযোগে বান্দাহ বারবার উচ্চার করে,لَبَّيْكَ (হাযির) لَبَّيْكَ (হাযির) اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ (হে আল্লাহ হাযির)। অর্থাৎ পরম দয়াময় অতি দয়ালু আল্লাহর কাছে বান্দা নিরংকুশভাবে ক্ষমাপ্রার্থী হয়।

অতএব আসুন! আমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ করি তিনি যেন আমাদেরকে পাপ মোচনের অন্যতম ইবাদত হজ্জ পালনের করার তওফীক দান করেন এবং হজ্জে তালবিয়াহ পাঠের তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে অন্তর ও জ্ঞানের প্রসরতা দান করেন-আমীন!

[লেখক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী ]


[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৫০৭।

[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৪১।

[3]. তিরমিযী হা/৮২৮; ইবনু মাজাহ হা/২৯২১; মিশকাত হা/২৫২০।

[4]. তিরমিযী হা/৮২৭; ইবনু মাজাহ হা/২৯২৪।



আরও