নবী ও রাসূলগণের দাওয়াতের মূলনীতি (শেষ কিস্তি)

আবু সাঈদ 1493 বার পঠিত

মূলনীতি-১৩ : পূর্ববতী নবীগণ ও তাঁদের উম্মতগণের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা :

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِي هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ-

‘রাসূলগণের ঐসব বৃত্তান্ত আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি  যদ্বারা আমি আপনার চিত্তকে দৃঢ় করি। এর মাধ্যমে আপনার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য এসেছে উপদেশ ও সাবধান বাণী’ (হূদ ১১/১২০)।

(২) অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَى وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ-

‘তাদের বৃত্তান্তে বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আছে শিক্ষা। ইহা এমন বাণী, যা মিথ্যা প্রবন্ধ নয় কিন্তু মুমিনদের জন্য এটা পূর্ব গ্রন্থে যা আছে উহার সমর্থন এবং সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ, হেদায়াত ও রহমত’ (ইউসুফ ১২/১১১)।

(৩) আল্লাহ বলেন,وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ- ‘আপনি কাহিনী বর্ণনা করে শুনাতে থাকেন হয়তো তারা এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে’ (আ‘রাফ ৬/১৭৫)।

মূলনীতি-১৪ : অবিরাম গতিতে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া এবং সমালোচনাকারীদের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা :

(ক) আল্লাহ বলেন,

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ- الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ

‘অতঃএব আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদের উপক্ষো করুন’। ‘আমিই যথেষ্ট আপনার জন্য, বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে’। ‘যারা আল্লাহর সাথে অপর মা‘বূদ প্রতিষ্ঠা করেছে’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৬)।

(খ) মহান আল্লাহ বলেন,

فَذَرْنِي وَمَنْ يُكَذِّبُ بِهَذَا الْحَدِيثِ سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ- وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ-

‘যারা আমাকে এবং এই বাণীকে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে ছেড়ে দিন আমার হাতে, আমি তাদেরকে এমনভাবে ক্রমেক্রমে ধরব যে, তারা জানতে পারবে না’। ‘আর আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি, আামর কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ট’ (ক্বলম ৬৮/৪৪-৪৫)।

(গ) অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَمَا كُنْتَ تَرْجُو أَنْ يُلْقَى إِلَيْكَ الْكِتَابُ إِلَّا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ ظَهِيرًا لِلْكَافِرِينَ- وَلَا يَصُدُّنَّكَ عَنْ آيَاتِ اللَّهِ بَعْدَ إِذْ أُنْزِلَتْ إِلَيْكَ وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ-

‘আপনি আশা করেননি যে, আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এটাতে শুধু আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। সুতরাং আপনি কখনও কাফেরদের সাহায্যকারী হবেন না’। ‘আপনার প্রতি আল্লাহর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর কেউ যেন আপনাকে কিছুতেই সেগুলো থেকে বিরত না রাখে। অতএব আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান করতে থাকেন এবং কিছুতেই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৬-৮৭)।

(ঘ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ شِئْنَا لَبَعَثْنَا فِي كُلِّ قَرْيَةٍ نَذِيرًا- فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا-

‘আমি ইচ্ছা করলে প্রতিটি জনপদের জন্য একজন সতর্ককারী প্রেরণ করতে পারতাম’। ‘সুতরাং আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং আপনি কুরআনের সাহায্যে তাদের সাথে প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে যান’ (ফুরক্বান ২৫/৫১-৫২)।

মূলনীতি-১৫ : যে দ্বীন গ্রহণ করবে না তার ব্যাপারে দুঃখিত ও চিন্তিত না হওয়া :

(১) মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا- إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا-

‘তারা এই বাণী বিশ্বাস না করলে তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে সম্ভবতঃ তুমি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে’। ‘পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে ওর শোভনীয় করেছি মানুষকে এই পরীক্ষা করার জন্য যে তাদের মধ্যে কর্মে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল করে? (কাহাফ ১৮/৬-৭)।

(২) অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لَا يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُون-

তাদের কথাবার্তায় আপনার যে দুঃখ ও মনঃকষ্ট হয় তা আমি খুব ভাল ভাবেই জানি, তারা শুধুমাত্র আপনাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে না, বরং এই পাপিষ্ঠ যালিমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকেও অস্বীকার ও অমান্য করছে’ (আন‘আম ৬/৩৩)।

(৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَفَمَنْ زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ فَرَآهُ حَسَنًا فَإِنَّ اللَّهَ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِمَا يَصْنَعُونَ-

‘কাউকে যদি তার মন্দ কাজ শোভন করে দেখানো হয় এবং সে ওটাকে উত্তম মনে করে সেই ব্যক্তি কি তার সমান যে সৎ কাজ করে? আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন। অতএব আপনি তাদের জন্য আক্ষেপ করে আপনার প্রাণকে ধ্বংস করবেন না। তারা যা করে আল্লাহ তা জানেন’ (ফাত্বির ৩৫/৮)।

মূলনীতি-১৬ : সুসংবাদ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন :

(এক) আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا- وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا-وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِنَ اللَّهِ فَضْلًا كَبِيرًا

‘হে নবী! আমিতো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে’। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার দিকে আহ্বানকারী রূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে’। ‘আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে মহা অনুগ্রহ’ (আহযাব ৩৩/৪৫-৪৭)।

(দুই) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ فَمَنْ آمَنَ وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ- وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا يَمَسُّهُمُ الْعَذَابُ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ- 

‘আমি রাসূলগণকে শুধু এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে থাকি যে, তারা (সৎ ব্যক্তিদেরকে) সুসংবাদ দিবে এবং  (অসৎ লোকদেরকে) ভয় দেখাবে। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে ও চরিত্র সংশোধন করেছে তাদের জন্য কোন ভয়-ভীতি থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না’। ‘আর যারা আমার আয়াত ও নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে তারা তাদের নিজেদের ফাসেকীর কারণে শাস্তি ভোগ করবে’ (আন‘আম ৬/৪৮-৪৯)।

(তিন) আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا بَعَثَ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِهِ فِى بَعْضِ أَمْرِهِ قَالَ بَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا وَيَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا.

‘নবী করীম (ছাঃ) যখন কোন ছাহাবীকে কোন কাজে প্রেরণ করতেন তিনি বলতেন তোমরা সুসংবাদ দাও ভয় দেখিও না। সহজতা অবলম্বন কর, কঠিনতা নয়’ (মুসলিম হা/৪৬২২)।

মূলনীতি-১৭ : সৎকাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ করা :

(ক) মহান আল্লাহ বলেন,

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.

‘যারা সেই নিরক্ষর রাসূলের অনুসরণ করে চলে যার কথা তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত, ইঞ্জিল কিতাবে লিখিত পায়, যে মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করে আর তাদের জন্য পবিত্র বস্তু সমূহ বৈধ করে এবং অপবিত্র ও খারাপ বস্তুকে তাদের প্রতি অবৈধ করে, আর তাদের উপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদেরকে মুক্ত করে। সুতরাং তার প্রতি যারা ঈমান রাখে, তাকে সম্মান করে ও সহানুভূতি প্রকাশ করে আর সেই আলোকে অনুসরণ করে চলে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে তারাই (ইহকালে ও পরকালে) সাফল্য লাভ করবে’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)।

(খ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ

‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, আর যদি গ্রন্থ প্রাপ্তরা বিশ্বাস স্থাপন করত তাহলে অবশ্যই তাদের জন্য মঙ্গল হত। তাদের মধ্যে কেহ কেহ মুমিন এবং তাদের অধিকাংশই দুষ্কার্যকারী’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।

উপসংহার : মতবাদ বিক্ষুদ্ধ পৃথিবীতে নানা মুনির নানা মতের যাচ্ছেতাই অবস্থা বিরাজমান। মানবতা চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে ইসলামী নবজাগরণের দিকে। একটুখানি শান্তির সুবাতাসে কখন আমাদের প্রাণের বসুন্ধরা শান্তিময় নীড়ে পরিণত হবে। কখন সমস্ত জাহিলিয়াতকে ছেয়ে ইসলামী পতাকা উড্ডীন হবে, আবার কায়েম  হবে উমরী রাজ, নববী পদ্ধতিই হবে যেখানকার হক্ব-বাতিলের একমাত্র মানদ-। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন-আমীন!

[অনুবাদক : ২য় বর্ষ, আল-হাদীছ এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]



বিষয়সমূহ: দাওয়াত
আরও